পুজোর বাকি আর মোটে দিন দশেক। এই কটাদিন, বিশেষ করে শনি রবি ওদের হোমে থাকে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা। ওরা মানে ওই নানান বয়সী বাচ্চারা। তিতলি, রুপাই, পাপিয়া, মুন্নি, বিকলু, দিয়া, গাব্বু সহ আরো জনা কুড়ি ছেলে মেয়ে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এইদিন সব দাদা দিদি কাকা পিসি মাসিরা আসে, তুলে দেয় ওদের হাতে নতুন জামা, রঙ পেনসিল, বই, খাতা। তারপর ঘটা করে চলে ছবি তোলা, যা শুরু হয় ওদের সাথে, তারপর শহুরে মানুষগুলো নিজেরাই ওই নিজেদের ছবি তুলতেই ব্যস্ত হয়ে যায়। এরপর বিকেল হলে ওরা সবাই ফিরে যায় নিজেদের বাড়ি। পড়ে থাকে এই বাচ্চাগুলো। আর থাকে ওদের শেফালি দি, ঝর্ণা দি। হোমের ঘরগুলো তখন সারাদিনের "উৎসবের" পর লণ্ডভণ্ড অবস্থা। সেই সব পরিষ্কার করতে করতে তাদের তখন মেজাজ তিরিক্ষি। একটু ট্যাঁ ফো করলেই তাই বাচ্চাগুলোর জোটে জোর বকুনি।
বিকলুর একদম ভালো লাগেনা এইসব দিনগুলো। কী লাভ? ওই খানিকক্ষণ সং সেজে থাকো। ওই কিছু টুকটাক উপহার। ব্যস। তারপর সারা বছর ওরা বাঁচল কি মরল। কী করলো। কারুর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নেই কোন হেলদোল। ওর এই ছয় বছরের ছোট্ট জীবনেই বুঝে গিয়েছে সার সত্যটা। ওরা তো অনাথ। ওদের জন্য তাই ওই কুড়িয়ে বাড়িয়ে যেটুকু আনন্দ পাওয়া যায়, ওইটুকুই। ওদের না আছে তেমনভাবে পুজো, না আছে ক্রিসমাস। একদিন শুধু লাইন দিয়ে তিন চারটে মণ্ডপে ঘোরা, নতুন জামা পরে। বাকি দিনগুলি হলে টিভিতে বসে ঠাকুর দেখা। আর বড়দিনে স্যান্তা দাদুর ঝুলি থেকে কেক আর খেলনা দুই একটা। এই ওদের উৎসব, এই ওদের উদযাপন।
আজ সকাল থেকেই বড়দির নির্দেশে ওরা স্নান সেরে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তৈরি হচ্ছে। এবারে নাকি বিদেশ থেকে আসছে একটা দল। বিকলুর মন খারাপ। এক রাশ বিরক্তি। বিদেশী মানেই সেই থতকে থতকে জ্যাক অ্যান্ড জিল আর টুইঙ্কল টুইঙ্কল বলতে হবে। আবার সোনিয়া দিদি মম চিত্তে গাইবে, তিতলি দিদি আর পাপিয়া দিদিকে নাচতে হবে। ভালোই লাগেনা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল ও। এমন সময়ে ঝর্ণাদি এলো ওর কাছে, "বিকলু বাবু, এসো তো। বড়দি তোমায় ডাকছেন।" কী ব্যাপার, ওকে আলাদা করে ডাকছে কেন, একটু অবাক হয়েই বিকলু ঝর্ণাদির পিছু পিছু হাঁটা লাগাল। বড়দির ঘরে ঢুকে দেখে একজন কাকু আর একটা কাকী বসে আছে।
কী সুন্দর দেখতে ওদের। ঠিক যেন ফিল্ম স্টার। ওরা ওকে ঢুকতে দেখেই উঠে এলো ওর কাছে। বিকলুকে জড়িয়ে ধরে আদরে ভরিয়ে দিল। প্রাথমিক অবাক ভাব কাটতেই কী ভালো লাগছে বিকলুর। এত আদর তো কখনও পায়নি আগে ও। আর কাকীটার গায়ে কী মিষ্টি গন্ধ। সমস্ত বিরক্তি মুহূর্তের মধ্যেই ভ্যানিশ। বড়দির গলা খাঁকড়িতে কাকীটা ওকে ছাড়ল বটে, কিন্তু নরম হাত দিয়ে বিকলুর একটা হাত আলতো করে ধরেই রইল।
"বিকলু বাবু। গত ক্রিসমাসে তুমি একটা পরিবার চেয়েছিলে স্যান্টাদাদুর কাছে। মনে আছে তো? এই দেখো, তুমি সারা বছর ভালো হয়ে ছিলে। তাই দাদু তোমার শখ পূরণ করেছেন। এঁরা তোমায় নিয়ে যেতে এসেছেন। আজ থেকে এঁরাই তোমার মা বাবা। কী? পছন্দ হয়েছে তো?"
বিকলু ফ্যালফ্যাল করে একবার বড়দি আর একবার ওর "মা বাবা"র দিকে তাকাচ্ছে। এমনটা হবে, ভাবতেই পারেনি তো ও।
ওর "মা" ওকে বুকে জড়িয়ে কপালে গালে চুমু খেয়ে হাসি মুখে বললেন, "সোনামণি, আজ থেকে আমরা একসাথে থাকব তো?" ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বিকলু জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা, তোমার গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে গো। কী সেন্ট মেখেছ?"
সদ্য হওয়া "মা" বললেন, "এটার নাম জানো কী? এটাকেই বলে মা মা গন্ধ।"
No comments:
Post a Comment