১।
"এইবারে সপ্তমী হোল নাইট প্ল্যান অন তো?" বুদ্ধর মেসেজ ঢুকল ওয়াটসঅ্যাপে। অরিজিনে এন এম আরের প্লটগুলো করতে করতে মাথা ধরে গিয়েছে রাহীর। উফ। সোমবার দুপুরে এস আর এফ কনভারশানের প্রেজেন্টেশন রয়েছে। সেই নিয়ে টেনশন, তার সাথে পুজোয় বাড়ি যেতে না পারার মন খারাপ। পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম ও পুজোয় কলকাতা যাচ্ছে না। ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে। আর ওদের পঞ্চ পাণ্ডবের গ্রুপ চ্যাটে একটার পর একটা এই রকম মেসেজ, উহু, নট হেল্পিং অ্যাট অল! ও ছাড়া বাকি চারজনই ফিরছে কলকাতা, ষষ্ঠীর দিনেই। বুদ্ধ আর শুভ ব্যাঙ্গালোর থেকে, রঞ্জা বম্বে আর পুপাই দিল্লী থেকে। সেই লোয়ার কেজি থেকে এক স্কুলে এক সেকশনে পড়েছে ওরা। বাড়িও একে অপরের থেকে হাঁটা পথ। একই পাড়া। সব মিলিয়ে পঞ্চ পাণ্ডবের গ্রুপটা দারুণ পাকাপোক্ত। পুজোর চারদিনের হই হুল্লোড় করতে নিজেরাই যথেষ্ট। প্রতি বছরের মতোই এই বছরেও পঞ্চ পাণ্ডবের প্ল্যানিং চলছে পুরো দমে। সবাই উত্তেজিত, এত মাস পরে দেখা হবে সবার সাথে সবার, এতো বাড়তি পাওনা। শুধু রাহীর মন ভালো নেই। ও পি এইচ ডি করছে আই আই টি ম্যাড্রাসে, কেমিস্ট্রি নিয়ে। কাজের চাপ, সাথে ছুটির কমতি। সব মিলিয়ে এইবারে পুজোর ঠাই তাই চেন্নাইই। ওর বন্ধুরা ওকে বারবার বলছে, কোনভাবে ম্যানেজ করতে। কিন্তু কিছুতেই যে কোন উপায় দেখছে না ও।
২।
"বুদ্ধ, ক্যাব বুক করেছিস?" ফোনের ওপারে শুভর কণ্ঠস্বর। সোমবার দুপুর দেড়টা। নামী আই টি কোম্পানির কিউবিকলে বসে কোড রান হচ্ছে। নীল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সেইসবই দেখছিল বুদ্ধ। মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে বাঁ হাতের কব্জিতে। আর পাঁচ ঘণ্টা, আর চার। আর তিন। এই করেই সকাল থেকে কোনমতে ঠেকিয়ে রেখেছে নিজেকে। রাত্তির আটটার ফ্লাইট। ওর আর শুভর। ইলেক্ট্রনিক সিটিতে কাছাকাছিই অফিস দুজনের। ছোট্টবেলার দুই বন্ধু ফ্ল্যাটমেটও। একই ফ্লাইট ধরে ফিরবে। দুজনেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোবে। একসাথেই এয়ারপোর্ট পৌঁছবে। সেইরকমই প্ল্যান।
"হুম। ওলা প্রি-বুকড। সময়মতো এলে হয়। আর রাস্তায় জ্যামে না ফাঁসি।" বুদ্ধ উত্তর দিল।
"সেই, আধা ব্যাঙ্গালোরই তো মনে হয় এই ফ্লাইটটাই ধরছে। যাকেই জিজ্ঞেস করছি, সব শুনছি ৮ঃ৩৫এর জেট। ই-সিটি থেকে শাটল দিলে পারে।" শুভ একটু হেসেই উত্তর দিল। অন্যান্য দিনে শুভর ফোন মানেই এক গাদা ঘ্যানঘ্যান। এই সম্বর রাইস এতো জঘন্য কেন, বিসি বেলে বাথ না বিষ এটা, টি এল টা হেব্বি বজ্জাত, ইচ্ছে করে কাজ আপ্রুভ করছে না, অটোওলা চোর, এইটুকু আস্তে দেড়শ টাকা নিয়ে নিলো। আর আজ দেখো। নো কমপ্লেন। পুজো পুজো আমেজ। খুব আনন্দ করবে ওরা সবাই মিলে। ইশ, রাহীটা যদি আসতে পারতো।
৩।
"ভাই, আমি সিকিউরিটি লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কী লম্বা লাইন রে বাবা। সব্বাই শুধুই বাংলায় কথা বলছে। গোটা দিল্লী কলকাতায় ফিরছে নাকি?" পুপাইয়ের ভয়েস নোট এলো ওদের গ্রুপে।
"দেখিস, আবার ফ্লাইট মিস করিস না। এত দেরি করে কেউ? ৭ঃ৪০ এর ফ্লাইট, সাড়ে ছটা বেজে গেল। এখনও তুই লাইনে।" রঞ্জা একটু কড়া গলায় মেসেজ পাঠাল।
রঞ্জা বরাবরই একটু দিদিমণি গোছের। আর এখন টিচ ফর ইন্ডিয়া ফেলোশিপ দিয়ে বম্বের স্কুলে চাকরি করতে গিয়ে পুরোপুরি দিদিমণি মোডে চলে গিয়েছে।
"না রে। ডোন্ট ওয়ারি। এয়ার এশিয়ার ঠাকুরদারও সাধ্য নেই আমাদের না নিয়ে প্লেন ওড়ানোর। পুরো পুজো ক্রাউড। একদম মনে হচ্ছে এ যেন ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট না। বরং এ বোধহয় কলেজ স্কোয়ারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, নবমীর সন্ধ্যেয়। উফ। খালি বাংলা আর বাংলা। সবার ওই 'মা, আমি আসছি।' বা 'গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়ো। এই বোর্ডিং দিল বলে' চলছে।"
ব্যাঙ্গালোরের কেম্পে গোউডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পাশাপাশি বসে আছে বুদ্ধ আর শুভ। গ্রুপ চ্যাট পড়ছে। আর হাসছে।
"সত্যি, কত্তদিন পর সবার দেখা হবে, বল? এই প্ল্যানটা ভালো। এয়ারপোর্টেই সবাই মিট করব।" বুদ্ধ বলল।
ফেসবুকে এয়ারপোর্ট চেক-ইন সেলফি আপলোড করতে শুভ এখন ব্যস্ত। মাথা না তুলে শুধু একটা "হুম" বলে ছেড়ে দিল। মোটামুটি আগে পরে ঢুকবে সকলের ফ্লাইট, কাছাকাছি সময়েই। রঞ্জার বম্বের ফ্লাইট একটু দেরিতে। ঘন্টাখানেক মতো। গেট থ্রি বির সামনে সকলের মিট করার কথা। তারপর একসাথে ক্যাব নিয়ে বাড়ি। ঢোকার আগে একবার নিজেদের মণ্ডপে ঢুকে মায়ের মুখ দেখবে। গ্রুপে এই রকমই প্ল্যান হয়ে আছে। আজ তো ষষ্ঠী। বোধন হয়েই গিয়েছে এতক্ষণে। পুজো শুরু। শুধু রাহীর জন্য মন খারাপ লাগছে। বেচারিটা একা একা পড়ে রইল চেন্নাইতে। দুপুরে প্রেজেন্টেশন ভালো হয়েছে জানিয়ে আর মেসেজ করেইনি। সব মেসেজ "সিন" দেখাচ্ছে। উত্তর নেই। নিশ্চয়ই মন খারাপ। বুদ্ধর খারাপ লাগছে। খুব।
৪।
রাত সোয়া এগারোটা। এয়ারপোর্ট গেট থ্রি বির দিকে এগিয়ে চলছে ওরা চারজন। বুদ্ধ, শুভ, পুপাই আর রঞ্জা। "আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল, বল?" রঞ্জা বলল।
"হুম। ব্যাক টু সিটি অফ জয়। এইবারে জয় মা দুর্গা বলে চারদিন হই হই।" পুপাই জবাব দেয়।
"কাল কিন্তু ম্যাডক্স যাবো, যদি এই বছর অন্তত লাক ফেভার করে," বুদ্ধ ফুট কাটল।
"তুই ওই করেই গেলি। ইডিয়ট কোথাকার," শুভ পিছনে লাগে বুদ্ধর।
"সবই ভালো, শুধু রাহীটাকে বড্ড মিস করব।" রঞ্জা বলে।
"আমি ওকে ফ্লাইট থেকে নেমে ফোন করেছিলাম। বলল চেন্নাই বেঙ্গলি গ্রুপের সাথে ঘুরবে। প্ল্যান ট্যান চলছে। শি সাউন্ডেড সো স্যাড রে। আমারই মন খারাপ হয়ে গেল।" পুপাই বলল।
"এই ক্যাব কই রে, সব পনেরো কুড়ি মিনিট ডিস্টেন্সে দেখাচ্ছে। কোন সেডান নেই। যা আছে, ওই এস ইউ ভি।" অ্যাপ থেকে চোখ তুলে শুভ বলল।
"যা পাচ্ছিস, তাই বুক করে দে। ভাই, ষষ্ঠীর রাত। কলকাতা। আর কী এক্সপেক্ট করিস? চল, বাইরে গিয়ে ওয়েট করি।" রঞ্জা পাশ থেকে বলল।
কাঁচের দরজাঠেলে বেরোতেই ওরা থ। ঠিক দেখছে? সামনে ওটা কে? লাল কুর্তা নীল জিন্স, কানে ইয়ারফোন, সাথে বেগুনি ট্রলি ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে, রাহী না?
"সারপ্রাইইইইজ!!!!"
"একী? এটা কখন হলো?"
"কী করে হলো?"
"ফোন করলাম যখন, তুই বললিনা তো?"
"হেঁহেঁ, বল কেমন চমকে দিলাম!"
"এ মেয়ে আমাদের এক কাঠি ওপর দিয়ে যায় দেখছি!"
"আরে, মিটিং ভালো হল। তারপরেও মুখ চুন করে ঘুরছিলাম দেখে গাইড জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে। বললাম সব। উনি বললেন, যাও, দিন দশেক ঘুরে এসো। ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাটলাম। দশ হাজার খসল বস। কিন্তু সে ছ মাস পরে ভুলে যাবো। তোদের মেসেজগুলো সবই পড়ছিলাম। পুরো প্ল্যান জানতাম। আটটা পাঁচে ল্যান্ড করলাম। এই তিন ঘণ্টা ধরে বসে আছি তোদের অপেক্ষায়! তোরা আমার জন্য হা হুতাশ করছিস। আর এদিকে আমি এখানে বসে আছি। কত কষ্টে যে নিজেকে সামলেছি রে...এবার বল, কেমন দিলাম?"
রঞ্জা ওর দিদিমণি স্টাইলে বিধান দিল, "বেশ করেছিস। এইবারে আমাদের এরকম জেনে শুনে গিলটি ফিল করিয়েছিস বলে তোকে যে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!"
"প্রায়শ্চিত্ত? কীরকম?"
"ডিনারে আজ মন্টুদার বিরিয়ানিটা তুই স্পন্সর করবি!"
"বেশ তাই হবে।"
"ওরে, চল রে। ক্যাব এসে গিয়েছে। এবার না উঠলে আর বিরিয়ানি জুটবে না।"
"চল, চল।"
No comments:
Post a Comment