১।
"এই শোনো, একবার আমার কুচিটা ধরে দাও না গো?" ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গত পনেরো মিনিট ধরে পাটভাঙা শাড়িটাকে বাগে অ্যানার চেষ্টা করে অসফল রুমুন। অষ্টমীর সকাল। প্যান্ডেল থেকে বারবার অঞ্জলির জন্য ডেকেই চলেছে। আর মোটে দুই ব্যাচ চলবে। এঁর মধ্যে তৈরি হয়ে পৌঁছতেই হবে। "দাঁড়াও দুই মিনিট, এই শব্দছক্টা শেষ করে আসছি।" জানলার ধারে চেয়ারে বসা অগ্নি একবারের জন্যও কাগজ থেকে মুখ না তুলে উত্তর দিল।"ধুর কখন তোমার শব্দছক শেষ হবে, তারপর নাকি কুচি ধরবে। তাহলে আর এই অষ্টমীতে আমায় অঞ্জলি দিতে হবে না। আমি বরং মীনাদিকে দেখি।"
"মীনাদি? ফিনাইলের গন্ধ হয়ে যাবে শাড়িতে। দেখছ না ঘর মুছছে ও?"
"হাত ধুয়ে আসবে তো। অদ্ভুত!"
"সে যতই ধুক না কেন, গন্ধ থেকেই যাবে। আচ্ছা পতন অভ্যুদয় ড্যাশ পন্থা, লাইনটা জানি কী ছিল?"
"বন্ধুর পন্থা।"
"হ্যাঁ। এই তো। ব্যস। হয়ে গেল। চলো। দেখি কুচিটা ঠিক করি। এও তো আমাদের বছর বছরের অভ্যেস।"
"শোনো, আমি রেডি হচ্ছি, তুমিও তৈরি হয়ে নাও।"
"হ্যাঁ, তোমার তো সময় লাগবে।"
শাড়িটা ঠিক করতে করতে রুমুন দেখল অগ্নি টাওয়েল নিয়ে স্নান করতে ঢুকল বাথরুমে। আলমারি খুলে তাক হাতড়ে হাতড়ে ও গড়িয়াহাট থেকে কেনা কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবিটা বের করে রাখল।
২।
প্রতি বছরের মতো এই বছর রুমুনের পুজোর বাজার আর নিজের মতো করে করাই হয়নি। পুজোর ছুটি পড়ার ঠিক আগেরদিন শেষ হয়েছে স্কুলে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। তারই তোরজোড়ের জন্য মায়ের সাথে টো টো করে হাতিবাগান কলেজ স্ট্রিট চত্বর ঘুরে বেরিয়ে পুজোর মার্কেটিং করার বাৎসরিক রেওয়াজের তাল কেটেছে এই বছর। হাতে নাতে ফলও পেয়েছে। মায়ের সাথে আর সমস্ত বিষয়ে মিল ভালো হলেও জামাকাপড়ের পছন্দের বিশেষ অমিল। ওঁর পছন্দ হালফিলেরও রঙের পোশাক। এদিকে মা এবারে "মাধ্যমিক দিবি এবার, এবারে তো শাড়ি পর," এই অজুহাতে পুজোর পাঁচদিনের জন্যই পাঁচটা সিল্ক আর ঢাকাই শাড়ি বাছাই করে কিনে রেখেছে। অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়ার জন্য মায়ের পছন্দ একটা হাল্কা হলুদের ওপর হলুদ সুতোর কাজের চিকন শাড়ি। হলুদ, রুমুনের সবচেয়ে অপছন্দের রঙ।
৩।
আয়নার ওপরের আলোটা জ্বালিয়ে রুমুন আলতো করে চোখের কোণে কাজলটা লাগাচ্ছিল। এই সময়ে ভীষণভাবে মনোযোগ লাগে ওর। এত বছরের অভ্যেস, তবুও একটু অমনোযোগী হলেই কাজলটা ধেবড়ে যায়। সেটা ওর বিশেষ অপছন্দ। এই নিয়ে তিনবার ঘেঁটে গিয়েছে, সামনে পড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটা তুলোর বল আর ক্লেনজিং মিল্কের খোলা বোতল। বাথরুম থেকে শাওয়ারেরজল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে গুনগুন করে অগ্নির গলায় "শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি"। সত্যিই। ওর গলাটা এত সুন্দর, ভরাট, সুরেলা।
"এই আমার পাজামার দড়িটা পরিয়ে দিয়ো না গো রুমুন। আমার স্নান হয়ে এলো।"
"কেন যে নিজের কাজ নিজে করতে পারো না তুমি। দেখলে আমি রেডি হচ্ছি। তার মধ্যে এই। সারা সকাল সুদোকু আর শব্দছক নিয়ে রইলে। এখন এসে লাস্ট মোমেন্টে..."
"প্লিজ রুমুন। এই শেষ। পরেরবার থেকে আমি নিজেই করব। তুমি দেখো।"
"জানা আছে আমার। প্রত্যেক বছর এই এক কথাই বলো।"
পঁচিশ বছরের সংসার। ঝটপট হাত চলে। মুহূর্তের মধ্যেই পাজামা রেডি। দরজায় হাল্কা টোকা মেরে খবরটা জানিয়ে রুমুন আয়নার সামনে ফিরল। খোঁপা করা বাকি।
৪।
"মা আমার চুলে কিছু একটা স্টাইল করে দাও না প্লিজ।" কিশোরী রুমুন তার মায়ের কাছে আবদার করলো। সুচরিতা নিয়মিত ম্যাগাজিন পড়েন, স্টাইল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। মেয়ের কোমর ছাপানো চুলের ওপর নিত্যনৈমিত্তিক চলে সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা। সুচরিতা আর পাঁচটা সাধারণ মায়ের মতোই রুমুনের চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে "তেল মাখিস না, রুক্ষ চুল" ইত্যাদি বলে শেষ পর্যন্ত একটা বেশ কায়দার খোঁপা করে দিলেন। রুমুনের বাবাও স্ত্রীর নির্দেশমতো জুঁই ফুলের মালা নিয়ে এসেছেন। খোঁপায় মালা লাগিয়ে, মুখে পাউডার বুলিয়ে রুমুন বেরোল পূজামণ্ডপের উদ্দেশ্যে। অষ্টমীর অঞ্জলি। কোনদিনও বাদ যায় না।
"রুমুন তুই গিয়ে অঞ্জলি দে। আমি পরের ব্যাচে দেবো। তোকে তো এরপর প্রসাদ বিতরণের কাউন্টার সামলাতে হবে।" সুচরিতার নির্দেশ।
৫।
বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। সকাল থেকে রান্নাঘরেই অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল রুমুনের। ছেলেমেয়ে দুটো পুজোর ছুটিতে এক সপ্তাহর জন্য বাড়ি আসায় , এখন প্রায় দিনের পুরো সময়টাই কাটছে ওদের পিছনে, ওদের জন্য। নেহাত অগ্নির সাথে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়াটা সেই এতগুলো বছরের অভ্যেস, তাই আজ প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছল মণ্ডপে। শেষ ব্যাচ শুরু হলে বলে। অগ্নিও হন্তদন্ত হয়ে ওর পিছন পিছনই এসে ঢুকল। এত বছর এই পারায় রয়েছে ওরা, প্রায় সকলের সাথেই পরিচিতি তাই রয়েছে। অনেকের সাথেই সেই জন্য সৌজন্যমূলক হাসি ও শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব চলল বেশ খানিকক্ষণ। ইতিমধ্যে মাইকে ঠাকুর মশাইয়ের "শুরু হতে চলেছে লাস্ট ব্যাচ অঞ্জলির। যারা যারা অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে চান, চলে আসুন প্রতিমার সামনে" শোনা আজচ্ছে। বারবার।অগ্নি, রুমুন চলল ঠাকুরের কাছে। ওখানে তাতান আর টিটির আগে থেকেই উপস্থিত। সপরিবারে ওরা অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে।
৬।
ঠাকুরমশাইয়ের বারবার বারণ সত্ত্বেও ঠিক সকলে পুষ্পাঞ্জলির ফুল ঝুড়িতে দেওয়ার অপেক্ষা না করে সামনের দিকেই ছোঁড়ে। প্রতিটি পাড়ায়, প্রতি পুজোয়, প্রতিদিন, প্রতিবার। আর এই পুষ্প নিক্ষেপণের মাধ্যমেই বছর বছর শুরু হয় কত নতুন নতুন সম্পর্ক। গাঁদা ফুলের সাথে দোপাটির পাপড়ি যেমন মিলে মিশে পুষ্পাঞ্জলির রঙিন নৈবেদ্য সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনই রঙিন হয় সম্পর্কগুলি। রুমুনের অনেক বন্ধুরাই ইতিমধ্যে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ। ওর অবশ্য সেই রকম উৎসাহ বা সাহস কোনটাই হয়ে ওঠেনি। আর সুযোগও তেমন মেলেনি।
অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল হলুদ রঙের চিকনের পাঞ্জাবি আর চুড়িদার পরা, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, সুদর্শন ছেলে মাঝে মাঝেই রুমুনের দিকে তাকিয়ে দেখছে। অতি সৌম্য চেহারা, দেখে তো মনে হয় ওদের থেকে বয়সে বড়। এ পাড়ায় আগে দেখেছে বলেও মনে পড়ছেনা। বাবলিকে দেখতে পেয়ে রুমুন জিজ্ঞেস করল, "হ্যাঁ রে, ওই ছেলেটা কে? চিনিস?"
"কে? ওই হলদে পাঞ্জাবি?"
"হুম। কী দারুণ দেখতে।"
"তা যা বলেছিস। ফাটাফাটি দেখতে। এই দেখ দেখ, রুমুন, তোর দিকে কিন্তু মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে।"
"হ্যাঁ। দেখলাম। অনেকক্ষণ ধরেও ব্যাপারটা অবজারভ করেছি।"
"এই চল না। গিয়ে কথা বলবি?"
"পাগল নাকি? কোন কাকিমা জেঠিমা কে দেখে নেবে। তারপর স্ট্রেট মায়ের কানে..."
"জানিস তো রুমুন, আমার মনে হচ্ছে আজ এই হলদে পাঞ্জাবি তোর দিকেই ফুল ছুঁড়বে। কীরকম ম্যাচ করে গিয়েছিস তোরা। দেখিস। আমার মন বলছে। এক্কেবারে রাজযোটক।"
না, সেদিন বাবলির কথা মেলেনি। ওর দিক থেকে একটা ফুলও রুমুনের গায়ে পড়েনি। তবে অঞ্জলি দেওয়ার পর যখন ওরা দুজনে প্রসাদ বিতরণের কাজে ব্যস্ত, তখন ওদের বন্ধু তিতলি এসে আলাপ করিয়েছিল, "হলুদ পাঞ্জাবির" সাথে ওদের। নাম অগ্নি। মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, তিতলির মামার ছেলে। বাড়ি কুচবিহারে। পড়াশোনার জন্য আপাতত হোস্টেলে থাকে কলকাতায়। পুজো উপলক্ষে পিসির বাড়ি এসেছে। ফল ও নাড়ুর প্রসাদটা রুমুন শালপাতার পাত্রে যখন অগ্নিকে দিল, দুজনের মধ্যে বাক্য বিনিময় হলো না বটে। তবে মিষ্টি হাসি হাসল দুজনেই। আর বোধহয় বিধাতা পুরুষও প্রসন্ন হলেন।
কাজ মিটিয়ে রুমুন বাড়ি ফিরছে। বাবলি ওর বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে।
"এক্সকিউজ মি প্লিজ" ডাকে চমকে গেল ও। থমকে দাঁড়ালো, পিছন ঘুরে দেখে "হলুদ পাঞ্জাবি" ওরফে অগ্নি।
"বলো?" একটু নার্ভাস হাসি হেসে উত্তর দেয় রুমুন।
"না। সেরকম কিছু না। শুধু দুটো কথা ছিল।"
"বলো।"
"এক। তোমাকে ষষ্ঠী থেকে রোজ দেখলাম। দুইবেলা। সব রঙের মধ্যে হলুদেই মানায় তোমাকে সবচেয়ে বেশি।"
"ও আছা।" লাজুক হেসে উত্তর দিল রুমুন।
"দ্বিতীয় কথা হল, এরপর থেকে একটু চোখের কোলে কাজল দিয়ো। তোমার ওই চোখদুটোয় খুব মানাবে।"
মাথা নাড়ল রুমুন। অগ্নি ফিরল মণ্ডপে। রুমুন পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। আগামী দিনগুলির পাথেয় সংগ্রহ করে।
৭।
"বাবা তোমার পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি। স্নানটা সেরে ফেলো। অঞ্জলি শুরু হয়ে গিয়েছে।" আলমারি থেকে হাল্কা হলুদ পাঞ্জাবিটা খাটের ওপর রেখে বলল ঝিনুক। ঝিনুক তাতানের স্ত্রী। বিয়ে হয়ে এসেছে এই বাড়িতে পাঁচ বছর হল। গত চার বছর শাশুড়ির সাথে পুজোর বাজার একসাথে করতে গিয়ে জেনেছে শ্বশুর শাশুড়ির বছরের পর বছরের মেনে চলা অষ্টমীর অঞ্জলির ম্যাচিং হলুদ পোশাকের কথা। গত এপ্রিলে হঠাৎ করেই স্ট্রোক হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী রুমুন। অগ্নির নির্দেশেই এবারে তাই পুজোর বাজার করেছে ঝিনুক।
স্নান সেরে হলদে পাঞ্জাবি সাদা পাজামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুলে চিরুনি বোলাচ্ছিল অগ্নি। আর তখনই আয়নার ভিতর দিয়ে দেখতে পেল একটা ঝলমলে হলুদ রঙের ম্যাক্সি পরে জানলার ধারে খাটে বসে রুমুন। অগ্নি ওর দিকে এগিয়ে গেল। মুখে হাল্কা হাসি। রুমুন ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে। জানলার বাইরে শিউলি গাছের ডালখানা মৃদু হাওয়ার জেরে কম্পমান। গ্রিলের ওপর কয়েকটা শিউলি পড়ে আছে। ভোরের শিশির শুকোতে যায়। শক্ত করে নিজের দুই হাতের মধ্যে রুমুনের কম্পমান শীর্ণ হাতটা চেপে ধরল অগ্নি। অনেকটা বিশ্বাস ও ভরসার এই স্পর্শ। "বুঝলে হে গিন্নি, চল্লিশটা অষ্টমী তো এই বাসন্তীসাজে কাটিয়ে দিলাম আমরা। এই বছরই বা বাদজায় কেন? চলো তোমার জন্য উইলচেয়ারের ব্যবস্থা করেছি। আমায় ধরো, আমরা দেবীদর্শন করি একসাথে। ঠিক পারবে। ও দাঁড়াও, আগে তোমার চোখে কাজল পরাই। এতদিনের অভ্যেস তোমার। দেখি আমার অপটু হাতে পারি কি না। মনে আছে সেইবার তোমার বাঁ হাত ভাঙল ঠিক পুজোর আগে, সেইবার কেমন শিখে নিয়েছিলাম তোমার কুচি ধরতে? তারপর থেকে আমিই যেন সব সময় তোমার শাড়ির কুচি ধরব, এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। মনে পড়ে রুমুন?"
শরতের নরম আলো বিছানার ওপর এসে পড়েছে। রুমুনের রুগ্ন শরীরে যেন হঠাৎ প্রাণের ছোঁয়া। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি" গানটা গাইবে প্লিজ অগ্নি? খুব ভালো লাগে তোমার গলায়..."
অগ্নি ওর সুরেলা কণ্ঠে ধরল ওদের শরতের অ্যান্থেমটি।
"মানিক গাঁথা ওই যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
কুঞ্জছায়ায় গুঞ্জরনের সঙ্গীতে
ওড়না ওরায় একই নাচের ভঙ্গিতে,
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি..."
No comments:
Post a Comment