Friday, October 12, 2018

আনন্দমেলা


ভোগের খিচুরি সাঁটিয়ে পূর্ব দিকের ঘরের খাটটার ওপর মালিকানা নিয়ে খালি ঝগড়া হত বাবার সাথে। ভাদুড়িদের দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে শুয়ে শুয়ে ওই চুরি করে পাওয়া এক কণা রোদের আলোয় শারদীয়া আনন্দমেলা পড়ব। এদিকে বাবার তখন চোখে ঘুম। সারা বছরের খাটুনির পর এই তো কষ্টেসৃষ্টে সপ্তমী অষ্টমী সি এল না আর এইচ কীসব নিয়ে টানা চারদিনের ছুটি। একটু জিরিয়ে নেওয়ার মতলব।

পুজো উপলক্ষে তখন চারটে জানলা আর দরজায় মায়ের পছন্দের ছিটের নতুন পর্দা টাঙানো। সাদার ওপর সবুজ লতাপাতার প্রিন্ট। বা অফ ওয়াইটের ওপর ব্রাউন বড় বড় শুকনো পাতা। কী কন্ট্রাস্ট। একটায় তারুণ্যের প্রাচুর্য, অন্যটায় দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার ভার। ঠিক যেন বাবা আর আমি।

বেলা ছোট হয়ে এসেছে। এই ঘরে বেশিক্ষণ রোদ আসবে না আর। একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ, তার মধ্যে এই এক ফালি রোদ যেন বড় আরাম।

তর্ক বিতর্কের পর রফা হত বাবার সাথে। যতক্ষণ না মা রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে ঘরে আসছে, ততক্ষণ পর্দা ফাঁক করে একটু বই পড়া যাবে। তারপর মা এলে সব্বাই ঘুম দেবে। বেশ। ভালো উপায়। জানি মায়ের সমস্ত কাজকর্ম মেটাতে মেটাতে অন্তত একটা ছোট গল্প শেষ হবেই। বা ক্যুইজের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিতে পারবোই। নিদেনপক্ষে সমস্ত রঙিন বিজ্ঞাপনগুলো পড়া হয়ে যাবে।

যথারীতি তারপর শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা ঘরে আসত। আমি ততক্ষণে দুঃসাহস দেখিয়ে অর্জুনের সাথে তিস্তাকে পাশে রেখে চলেছি জঙ্গলের দিকে। "একটুও মনে হয় না না, মা কে সাহায্য করি? শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলা পড়া হচ্ছে। আর তোমাকেও বলিহারি, ছাড়া জামাগুলো একটু ভাঁজ করে রাখতে পারো না? সব আমায় করতে হবে। এতটুকু দয়া হয় না আমার ওপর তোমাদের কারুর। সেই সকাল থেকে খেটেই চলেছি।" মায়ের অভিযোগে ফিরে আসি কলকাতার ঘরে।

"তুমি শোও না। চলো একটু ঘুমিয়ে নিই। আমি বিকেলে উঠে পাট করে দেবো।" আমার অনুনয় কাজে লাগে না। মা নিজে সমস্ত কাজ গুছোতে থাকে। আমি চলি ততক্ষণে আবার উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে, আরো গভীরে। এই বুঝি কোন অজানা বিপদ এলো অর্জুনের দিকে। "বইটা রাখ। শুয়ে পড়। একটু রেস্ট নে কটাদিন। স্কুল খুললেই পরীক্ষা। দশমীর দিন সন্ধ্যে থেকে কিন্তু পড়তে বসতে হবে। তখন একটুও কোন বাহানা শুনবো না। এখন কয়েকদিন একটু ঘুমিয়ে নে।" "প্লিজ মা, আর একটুখানি বাকি। দেখো। দশ পাতা।"
"রেডিওটা বন্ধ কর। কী বকরবকর শুনেই চলেছিস..."
"না না চলুক না। আমি শোওয়ার আগে বন্ধ করে দেবো। একটু রাস্তাঘাটের ভিড়ের কথা শুনি..."

যতক্ষণে তারপর বইটা নামিয়ে রাখতাম পাশে, বাবা নাক ডাকছে। মাও ঘুমের রাজ্যে। কালো রেডিওটাকে বন্ধ করে মায়ের দিকে পাশ ফিরে, মাকে জড়িয়ে আমিও শুয়ে পড়তাম চোখ বুজে। বালিশের বদলে মাথার নিচে তখন শারদীয়া আনন্দমেলাটা। মায়ের গায়ের গন্ধে কী সহজেই ঘুম এসে যেত। ঘুম ভাঙত ঢাকের আওয়াজে বা প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসা মাইকে কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে। মা ততক্ষণে আবার রান্নাঘরে। চায়ের ব্যবস্থা করতে।

যেমন কিছু অভ্যেস বদলায় না, তেমনই কিছু আশ্রয় আজও সমানভাবে জরাগ্রস্থ মনকে দেয় আরাম, ব্যাধির ওষুধ। আজও পুজোর আগের হিমেল সন্ধ্যেয় ঠাণ্ডা লাগিয়ে জ্বর বাধালে, দুপুরবেলা হোস্টেলের ঘরের খাটে যেটুকু রোদ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে, তার কোল ঘেঁষে শুয়ে আনন্দমেলা পড়লে জ্বর জ্বালা কোথায় যেন ফুস করে উড়ে চলে যায়। গ্লানিগুলো পরাজিত হয় সাদা কালো অক্ষরের সঞ্জীবনীতে। সাইকেল চালাতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা শিউলি জানান দেয় শারদীয়ার। ল্যাবের সিঁড়িতে জলের ক্যানের আওয়াজে ঢাকে কাঠি পড়ার শব্দ বেজে ওঠে কানে।

আজ চতুর্থী।

No comments:

Post a Comment