Friday, October 19, 2018

আমার দশমী

বিজয়া দশমী একেক সময় একেক রকমের অনুভূতি নিয়ে আসে আমার কাছে। যখন একদম ছোট ছিলাম, তখন মনে হত এ বাবা, আজকেই তো পুজো শেষ। তার মানে গুরুজনদের বিজয়ার প্রণাম করে ফেললেই চারদিনের লেখাপড়া থেকে ছুটির মেয়াদ শেষ। স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম, হাজার অনুনয় বিনয় করলেও মা শুনবে না। আমার অস্ত্র থাকত তখন, দাঁড়াও, ঠাকুর আগে বিসর্জন হোক। তারপর তো... খালি মনে হত, ঠাকুর, আগে যেন ফেজ ওয়ান না বেরোয়। ফেজ টু যাক, ফোর যাক, দূরদর্শন যাক। আমাদের ফেজ ওয়ান যেন না বেরোয়। নিজেদের ঠাকুর বেরিয়ে গেলেই ব্যস। আর কোন বাহানাই কাজে লাগবে না। কপাল ভালো থাকলে কিছু কিছু বছর ফেজ ওয়ান বেরোত সাতটার পর। ব্যান্ড পার্টি নাচগান ইত্যাদি দেখতে দেখতে আটটা। ফার্স্ট টার্মে খুব ঝোলান ঝোলাইনি, তাই মা একটু সদয় হল। আরো একদিন ভর সন্ধ্যেবেলা পূজাবার্ষিকী পড়ার অনুমতি পেয়ে যেতাম।

আরেকটু বড় হতে "দর্পণে বিসর্জন"এর কনসেপ্টটি জানতে পারলাম। তখন আর কী নিজের সুবিধার্থে সেটি ব্যবহার করছি। ঠাকুর যায়নি বলে পড়তেও বসছি না। এদিকে সবে সবে বাবার মোবাইল আসায় বন্ধুদের এস এম এস পাঠানোর লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কী দ্বন্দ্ব, ভাবা যায়? কে আগে কাকে এস এম এস পাঠাতে পারে... আমার আবার চিরকালই একটু ফরওয়ার্ডেড মেসেজের প্রতি অনীহা। তাই নিজে নিজে ভেবেচিন্তে কিছু কম্পোজ করতে হবে। কত তাড়াতাড়ি ভালো কিছু লেখা যায়, সেই নিয়ে হুলুস্থুল। দুপুর দুপুর হয়ে গেলে রিপ্লাই পাঠাতে থাকো, না হলে কারুর পাঠানো মেসেজ এলে "এখনও ঠাকুর জলে যায় নি" বলে ঠেকিয়ে রাখো।

বাড়ির বাইরে থাকা শুরু হতে বিজয়া দশমী মানে একটু একটু মন খারাপ। ছুটি প্রায় শেষের দিকেই। পুজো পুজো ভাবটাই ভালো। এলেই তো শেষ। আর বিজয়া মানেই এরপর হুড়মুড় হুড়মুড় করে লক্ষ্মী পুজো। আর তার মানেই পরেরদিন ফ্লাইট। আবার কবে ফিরব, কে জানে?

বিজয়ার স্মৃতি বললে একেক বছরের কিছু টুকরো টুকরো ছবি মনে এসে যায়। অনেকটাই ছোট তখন, বছর কুড়ি আগে প্রায়। সোমা পিসি অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে অনেক বছর পর। ভাসান দেখে ওর মধ্যেকার যুবতী সত্ত্বা জেগে উঠেছে। কী উত্তাল নাচ নেচেছিল। বিজয়া মানে তখন আনন্দ। বিজয়া মানে তখন সব আত্মীয় পরিজনদের সাথে দেখা হওয়া। প্রণাম করা।

এখন এই চেন্নাই শহরে বসে সেরকম ভাবে কিছু মনে হয় না। মণ্ডপে না গেলে না শুনতে পাই ঢাকের আওয়াজ। না শুনি শঙ্খধ্বনি। একটা শিউলিও চোখে পড়ে না। ওই মণ্ডপে মণ্ডপে চারদিন ঘুরলাম। সবার সাথে দেখাও হল। ব্যস। বিজয়া দশমী মানে আবার সেই গতানুগতিকে ফেরা। তাই আজকের দিনে যেন আরো বেশি করে মা দুর্গার মুখটা দেখে বারবার কান্না পায়। হঠাৎ মন কেমন করে ওঠে কলকাতায় বসে আছে আমার যে মা দুর্গা, তার কথা ভেবে। ফোন করলে কেঁদে ফেলব, সেই ভয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিই।

অনেকগুলো বছর আগের বিকেলের কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ছোট্ট ম্যাটাডোরে চেপে কোন না কোন বাড়ির পুজোর প্রতিমা বিসর্জনের আওয়াজের বিষাদ  আর বর্তমানে বিজয়ার সন্ধ্যেয় ক্যাম্পাসে সাইকেল চালিয়ে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ ভেসে আসা ছাতিমের পাগলকরা গন্ধ কোথায় যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা চেপে ধরে।

বারবার যেন তখন মন বলে ওঠে, আরেকটা দিন কি থেকে গেলে হত না?



No comments:

Post a Comment