ছোটবেলা থেকে আজকের দিনটা নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহ থাকত। সপ্তাহখানেক আগে থেকে মা আর আমি বসতাম মেনু ঠিক করতে। ভাত হবে না পি-পোলাউ, নিরামিষে ভাজা মুগ ডাল নাকি মাছের মাথা দিয়ে হবে, এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা পর্ব চলত। তবে কিছু আইটেম একেবারে বাঁধাধরা ছিল। ভেটকি মাছের ফিলে দিয়ে ফিস ফ্রাই, মাটন আর জলপাইয়ের চাটনি। দাদাভাই আর মামার আবার মাছের পছন্দ আলাদা। তাই দুই তিন রকমের মাছের ব্যবস্থাও করতে হবে। প্রচুর আলাপ আলোচনার পর মা ফর্দ ধরিয়ে দিত বাবার হাতে। বাবা দুদিন আগে অফিস ফেরতা লেক মার্কেট থেকে মাছ কিনে আনত। আর মা যাদবপুরের একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে পাঁঠার মাংস কিনে আনত।
তখন কত ছোট। মাসে একশো টাকা করে পকেট মানি পাই। সারা বছর ওই জমানো টাকা দিয়ে একে তাকে গিফট কিনে দিই। সেই টাকা দিয়েই দাদাভাইয়ের জন্যও ভাইফোঁটার উপহার নিতে হবে। কী দেওয়া যায়, কী দেওয়া যায়। সেই আবার মা আর আমার ব্রেনস্টরমিং সেশন চলত। তারপর কোন বছর সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি তো কোন বছর অরিফ্লেমের পারফ্যুম। বা কখনও মানি ব্যাগ। যে বছর যেমন সাধয়ে কুলতো। আমার আবার প্রচণ্ড আত্মাভিমান এইসব বিষয়ে। এমনকি ভাইফোঁটার মিষ্টি যেটা দাদাভাইয়ের জন্য কিনব, সেটাও নিজের ট্যাঁক থেকে।
প্রতিপদের দিন বিকেল বিকেল মা আর আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম লর্ডসের মোড়ে কল্পনায়। কী উপচে পড়া ভিড়। তার মধ্যে থেকে বাছাই করে দাদাভাই আর আমআমর জন্য সাত রকমের মিষ্টি আর নোন্তা কিনতাম। তার মধ্যে ভাইফোঁটা লেখা সন্দেশ আর খাজা মাস্ট! এছাড়াও দুপুরের খাবারের পর লাল দই আর রসগোল্লা সকলের জন্য নেওয়া হত।
ভাইফোঁটার দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে নতুন জামা পরে ঠাকুরঘর থেকে চন্দন কাঠ এনে বেটে রেডি রাখতাম। আসন বের করে গুছিয়ে রাখা। বাগান থেকে দুব্বো তোলাটা মা করত, আমার দ্বারা ওইটি হয় না। না খেয়ে ফোঁটা দেবো। এদিকে দাদাভাই এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে ফোঁটা নিয়ে শেষমেশ আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি বারবার ঘর বারান্দা করছি। মোবাইলের যুগে ফোন করে বারবার তাড়া দিচ্ছি। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। প্রতিজ্ঞা করছি, এত কষ্ট পোষায় না। সামনের বছর থেকে প্রতিপদে ফোঁটা দেবো (বরিশালের বাঙ্গাল, আমাদের আসলে প্রতিপদেই ফোঁটা)।
তারপর প্রায় বারোটা নাগাদ মামা মামী ঢুকল, মাসী এসে গিয়েছে আগেই। দাদাভাইও আসছে। শঙ্খধ্বনি, উলু দিয়ে গিফট এক্সচেঞ্জ করে ঝটপট ফোঁটা পর্ব মিটত। ইতিমধ্যে জেঠু আর বাবা পিসির বাড়ি থেকে ফোঁটা নিয়ে গিফট নিয়ে ফিরে এসেছে। বসত একটা জমাটি আড্ডা। দেড়টা দুটোর মধ্যে খেতে বসা। ব্যাচ করে। হাতে হাতে মাকে সাহায্য করা। খাবার শেষে মামা ঠিক বেরিয়ে স্পেশাল মিঠে পান নিয়ে আসত। পান চিবোতে চিবোতে চলত আরেক প্রস্থ গল্প। যাদের যাদের ঘুম পেতো, একেকটা ঘরে বিছানা দখল করে ঘুম। চারটের দিকে স্প্রাইট বা থাম্বস আপ। সাড়ে পাঁচটার দিকে চা আর রসগোল্লা।
শীত আসবো আসবো তখন। সাড়ে পাঁচটায়ই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসত। একে একে মামা মামী, মামণি (মাসী) আর দাদা সবার ফেরার পালা। কোন কোন বছর মামা বাজি নিয়ে আসত। সেই বছরগুলো দাদা আর আমি ওই ফুলঝুরি, তুবড়ি চর্কি জ্বালাতাম। বাড়তি আনন্দ। উপরি পাওনা।
পরেরদিন থেকে স্কুল অফিস সকলের। উৎসব শেষ। মন খারাপের রেশ।
এই বছরেরটা নিয়ে ছয় বছর হল এই ভাইফোঁটায় দাদাভাইকে ফোঁটা দিতে পারলাম না। ওই ওয়াটসআপে শুধু শুকনো মেসেজ করেছি বটে, কিন্তু এই অনুভূতিগুলো আসেই না। সকাল থেকেই তাই ভীষণ মন খারাপ।
No comments:
Post a Comment