- কি গো, রিপোর্টটা পেয়েছ?
- একটা ফোন করবে না পেয়ে?
- জানানোর মত কিছু হলে নিশ্চয়ই জানাতাম।
(খানিকের নীরবতা)
- এবারও নেগেটিভ তাহলে? ডঃ মিত্রর সাথে কবে দেখা করব তাহলে, পারলে কথা বলে এসো।
- বাড়ী গিয়ে কথা বলব। এখন রাখছি।
- ঠিক আছে। কখন ফিরবে?
- জানিনা। দেরী হবে।
রাত এগারোটার পরে আধা মদ্যপ অবস্থায় মুকুলের প্রবেশ বাড়ীতে।
- হাত মুখ ধুয়ে এসো, আমি খাবার বাড়ছি।
- খেয়ে এসেছি। তুমি ঘরে এসো। কথা আছে।
- আমি খাইনি এখনো, চট করে খেয়ে আসছি।
- হুম।
- শোনো সুমি, অনেক তো হল। আর কেন ফালতু লোক হাসাতে বারবার আমায় প্যাথোলজি সেনটারে পাঠাবে বলোতো?
- কি বলছ মুকুল? লোক হাসানো কেন বলছ একে?
- নয়তো কি? তুমি কেন একসেপ্ট করছ না সত্যিটা?
- দেখো এত সহজেই হাল ছাড়লে চলবে নাকি? ডঃ মিত্র তো বলেছেন, সময় লাগবে।
- সেটা উনি তিন বছর আগে বলেছিলেন।
- আশা তো ছাড়েননি।
- বাজে কথা বলো না। ফালতু ফালতু ডাক্তারের পিছনে টাকার শ্রাদ্ধ করে যাচ্ছি। যা হবার না, তা নিয়ে কেন পড়ে আছ?
- তাহলে চল দত্তক নিই? প্লীজ মুকুল, না করো না।
- আবার শুরু হল ওই। মা আর আমি অনেকবার বলেছি তো। কোথাকার কোন পাপীর রক্ত, বেজন্মা আমাদের বংশে আসবে না।
- মুকুল আমারও তো মা হতে ইচ্ছে হয়।
- আমারও বাবা হতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু নিজের সন্তানের। এরকম আস্তাকুড়ের ভাগাড়ের থেকে তুলে আনা না।
- তুমি আমার সাথে একদিন চল অরফানেজে, দেখবে...
- আর একটা কথা হবেনা এই নিয়ে। মা ঠিকই বলে। অনেক আগেই তোমার মত বাঁজা মেয়েকে ডিভোর্স করে আরেকটা বিয়ে করা উচিত ছিল। Good for nothing, তাও যদি অন্যভাবেও সুখে রাখতে আমায়। জীবনটা হেল করে ছাড়লে।
(কিছু মাস পরে, কলকাতা থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে, কুসুম কানন অনাথ আশ্রম।)
- মামণি আমি তোমায় ছেড়ে যাবনা। তুমি সিস্টারকে বলে দাও।
- আরে সোনা, তুই নতুন মাম্মাম পাপা পাবি।
- না আমি তোমাদের, তোমাকে ছেড়ে যাব না কোথাও।
- মামাই জেদ করেনা। ওই নতুন মাম্মাম তোকে কত ভালবাসবে, কতো বড় বাড়িতে থাকবি। টিভিতে ডোরার যেমন বাড়ি দেখিস, সেই রকম সাজানো বাড়ি হবে তোর। কি আনন্দ বল তো।
- না সেখানে তুমি থাকবে না মামনি।
- লক্ষ্মী মা আমার, আমি যাব তো মাঝে মাঝে দেখা করতে। আমরা সবাই যাব। দিয়া দিদির বাড়ি সবাই যাই না বল?
- প্রমিস?
- গড প্রমিস। নে চল, ব্যাগ গুছিয়ে দিই। মাম্মাম পাপা এসে গিয়েছেন।
পাঁচ বছরের রিনিকে তার নতুন বাবা মায়ের কাছে সঁপে দিতে গিয়ে মনে হল যেন নিজের হৃদয়ের একটা টুকরো খসে গেল। তবে এটা ভেবে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা হয় যে অন্তত আরেকটা পরিবার সন্তান পেল, বেঁচে থাকার মানেটা পেল। এই কয়েক মাসেই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলো কতটা আপন হয়ে গিয়েছে সুমির। এখন ওর একটা নয়, দুটো নয়, চল্লিশ জন সন্তান। প্রতিদিন ভোরবেলা ওদের ঘুমন্ত চেহারায় নরম সূর্যের আলোর রশ্মি দেখতে দেখতে সুমি বোঝে, একেই বুঝি বলে স্বর্গ সুখ।
Thursday, June 29, 2017
Wednesday, June 28, 2017
তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে momo
|||তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে momo|||
- হেলো।
- হেলেছি।
- আমি আজ উল্টে পড়ে গেছি একটু আগে।
- ও, তাই বল। আমি ভাবলাম আবার ভূমিকম্প হল না কি।
- হ্যালো?
- (silence)
- আরে হ্যালো।
- কথা বলব না তোর সাথে।
- কেন??
- আমি পড়ে গিয়েছই শুনে এই তোর রিএকশন?
- তা কি করব?
- অন্তত জিজ্ঞেস করবি তো কি হল, চোট পেলাম কিনা। বেঁচে আছি কি মরে গেছি তাতে তো তোর কোন যায় আসেনা।
- এক নম্বরঃ বেঁচে না থাকলে তোর ফোন পেতাম না। অবশ্য তুই ভূত, থুড়ি শাঁকচুন্নি হয়েও আমায় যে জ্বালাবি না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। দুই নম্বরঃ পড়ে গেলে কম বেশী চোট তো পাবিই। তা অত বড় শরীর বানিয়েছিস, ধপাধপ করে পড়বিই। কতবার বলি একটু এক্সারসাইজ কর, তা না। উনি খালি খেয়েই যাবেন।
- তোকে ফোন করাটাই আমার ভুল হল। আর কক্ষনও করবও না। আড়ি।
- কি fickle minded রে তুই? এই বললি আর কথা বলবি না, আর ওমনি ফোন within an hour? একটু ভাও খা, তা না। কিছুই শিখলি না।
- ন্যাকা। By the way, thank you for the momos. কি করে জানলি আমার এখন মোমো খেতে ইচ্ছে করছে?
- Dil ka connection madam
- আর তাও আবার pan fried.. I love you পুচু।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, me too। যা এবার খা। তোর তো pan fried momo ঠাণ্ডা একদমই রোচে না। আর হ্যাঁ, পেনকিলারটা খেতে ভুলিসনা। Fitness level বাড়া! আমি ফেরত আসি সামনের মাসে, দেখ কী দৌড় করাব।
- কচু পোড়া। দৌড়ে দৌড়ে ওই ফুচকাওয়ালা অবধি ঠিক আছে। হুহ।
- হেলো।
- হেলেছি।
- আমি আজ উল্টে পড়ে গেছি একটু আগে।
- ও, তাই বল। আমি ভাবলাম আবার ভূমিকম্প হল না কি।
- হ্যালো?
- (silence)
- আরে হ্যালো।
- কথা বলব না তোর সাথে।
- কেন??
- আমি পড়ে গিয়েছই শুনে এই তোর রিএকশন?
- তা কি করব?
- অন্তত জিজ্ঞেস করবি তো কি হল, চোট পেলাম কিনা। বেঁচে আছি কি মরে গেছি তাতে তো তোর কোন যায় আসেনা।
- এক নম্বরঃ বেঁচে না থাকলে তোর ফোন পেতাম না। অবশ্য তুই ভূত, থুড়ি শাঁকচুন্নি হয়েও আমায় যে জ্বালাবি না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। দুই নম্বরঃ পড়ে গেলে কম বেশী চোট তো পাবিই। তা অত বড় শরীর বানিয়েছিস, ধপাধপ করে পড়বিই। কতবার বলি একটু এক্সারসাইজ কর, তা না। উনি খালি খেয়েই যাবেন।
- তোকে ফোন করাটাই আমার ভুল হল। আর কক্ষনও করবও না। আড়ি।
- কি fickle minded রে তুই? এই বললি আর কথা বলবি না, আর ওমনি ফোন within an hour? একটু ভাও খা, তা না। কিছুই শিখলি না।
- ন্যাকা। By the way, thank you for the momos. কি করে জানলি আমার এখন মোমো খেতে ইচ্ছে করছে?
- Dil ka connection madam
- আর তাও আবার pan fried.. I love you পুচু।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, me too। যা এবার খা। তোর তো pan fried momo ঠাণ্ডা একদমই রোচে না। আর হ্যাঁ, পেনকিলারটা খেতে ভুলিসনা। Fitness level বাড়া! আমি ফেরত আসি সামনের মাসে, দেখ কী দৌড় করাব।
- কচু পোড়া। দৌড়ে দৌড়ে ওই ফুচকাওয়ালা অবধি ঠিক আছে। হুহ।
Tuesday, June 27, 2017
এসো বসো আহারে
।।এসো বসো আহারে।।
স্থানঃ কোন এক বাঙালি রেস্টুরেন্ট
সময়ঃ রবিবার দুপুর
অর্কঃ নে কি খাবি বলে দে, শিগগিরি অর্ডার দিয়ে দে। ভিড় শুরু হলে পাবিনা।
পায়েলঃ আমি কিন্তু বিরিয়ানি খাবই। তার সাথে দেখি কি খাই। এখানে এসছি আর মাছ খাব না, হওয়াটা মুশকিল।
অর্কঃ মাছ কি বিরিয়ানি দিয়ে খাবি নাকি?
পায়েলঃ কেন? ভাত দিয়ে খাব!
অর্কঃ ওই তো ওইটুকু পাখির আহার করিস, সে আবার নাকি বিরিয়ানি-ভাত দুইই নেবে! যতসব।
পায়েলঃ বাজে বকিসনা তো। আমি কি বিরিয়ানি ভাত সব একা খাব নাকি? শেয়ার করবি আমার সাথে।
অর্কঃ উহু! ওই জিনিসটি হচ্ছেনি হে। এই শর্মা খাবার শেয়ার করেনা!!!
পায়েলঃ মর গে যা। যা ইচ্ছে অর্ডার কর নিজের। আমার একটা মাটন বিরিয়ানি আর হাফ ভাত, সাথে লাউ চিংড়ি।
অর্কঃ বেশ। দাদা তাহলে অর্ডার নিয়ে নিন। দেড়টা ভাত, একটা মাটন বিরিয়ানি, একটা লাউ চিংড়ি, একটা শুক্তো, একটা ধোকার ডালনা, একটা ভাপা চিংড়ি আর একটা দই মাছ। ও হ্যাঁ, শেষে চাটনি দেবেন দুটো।
প্লেটে সাজিয়ে সব খাবার এসে পড়ল কিছুক্ষণেই। খাওয়া শুরু করল।
অর্কঃ আহা, কি অপূর্ব! খাঁটি বাঙালি মেনু। আমার বিয়েতে এরকম মেনু রাখব।
পায়েলঃ রাত্তিরে শুক্তো???
অর্কঃ আরে হাঁদা, সকালে। মানে বিয়েবাড়ির দুপুরে এই খাবার হবে। সোনামুগ ডালের সাথে তার দোসর ঝিরিঝিরি আলু ভাজা, শুক্তো, এঁচোড় হবে চিংড়ি দিয়ে, সাথে পাবদার পাতলা বড়ি দেওয়া ঝোল আর পাকা কাতলা মাছের পেটি দিয়ে দই মাছ। শেষ পাতে লাল দই আর আমের চাটনি।
পায়েলঃ বিয়ের দুপুরে খাওয়া তো তোর বারণ! নিজের পছন্দের মেনু দিয়ে তোর কি লাভ?
অর্কঃ সবসময় নিজের লাভ দেখতে নেই মা! তাছাড়া আমি মোটেই বিয়েতে উপোস করব না। দেখিসনা বলির পাঁঠাকে কিরকম খাইয়ে দাইয়ে তাগড়াই করে? আমিও তো বলিই হব!
পায়েলঃ হ্যাঁ সেই। বটে।
অর্কঃ আর তোর কি পছন্দের মেনু হবে বিয়েতে?
পায়েলঃ দুপুরটা নিয়ে লীস্ট বদারড। রাত্রে অবশ্যই মিষ্টি পোলাউ, চিকেন কোর্মা, তন্দুরী ভেটকি থাকতেই হবে। মিষ্টিতে গরম মালপোয়া আর বেকড রসগোল্লা থাকতেই হবে। আর যা ইচ্ছে হোক, না হলেও হবে।
অর্কঃ আহ, শুনেই কিরকম জিভে জল এসে গেল। নাহ, মানতেই হচ্ছে, তোর টেস্ট আছে।
পায়েলঃ হে হে, সে আর বলতে। আর তোর কি মেনু হবে?
অর্কঃ তুই কোন দেশী পাগল রে? এক্ষুণি তো এত্ত লম্বা মেনু বললি। একই বিয়েতে কত মেনু হবে?? আমার পছন্দেরটা বউভাতের দিন হবে।
খানিকক্ষণ একটু অর্কর দিকে তাকিয়ে রইল পায়েল। ব্যাপারটা বুঝে শুনে
পায়েলঃ ছাগল শেষমেশ এইভাবে প্রপোজ করলি??? ওয়েল, ইন দ্যাট কেস, আমিও কিন্তু উপোস করছিনা তাহলে সারাদিন! হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। তবে এঁচোড়, আম...মানে সেই গরম কালে বিয়ে। উফফ।
*****************************************************************************
আজ খুব জমিয়ে মাটন বিরিয়ানি কাবাব দিয়ে রাতের খাওয়াটা সেরেছি, তাই ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ।
Monday, June 26, 2017
তুমি অন্য কারুর সঙ্গে বেঁধো ঘর
- ডাক্তারবাবু কি বললেন দিদি?
- বড় ডাক্তার এখনো আসেননি। এখন জুনিয়ার ডাক্তার আপাতত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করেছেন। আপনার মায়ের মাথার চোট তো বেশ গভীর।
- বড় ডাক্তার মানে ডাক্তার সান্যাল তো?
- হ্যাঁ, উনি রাউন্ডে বেরিয়েছেন, পরপর দেখে আপনার মায়ের কাছেও আসবেন। রাউন্ড শেষ হলে চেম্বারে ডেকে নেবেন। অপেক্ষা করুন।
ডাক্তার শুভঙ্কর সান্যাল। বয়স আনুমানিক ৬৫। এক মাথা শুভ্রকেশ, সৌম্য চেহারা। দেখলেই একরকম ভক্তি ভাব জাগে মনে। লন্ডন থেকে নিউরোসার্জারিতে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় তিরিশ বছর আগে। সেই থেকে সপ্তাহে চারদিন বিকেলে কলকাতায় ও বাকি সমস্ত সময় এই বেলাপুর টাউন হাসপাতালে কাটান। বিপত্নীক, নিঃসন্তান। কোনরকম পিছুটান নেই। এই হাসপাতাল, রুগী, হাসপাতালের কর্মী- এসব নিয়েই ওনার জীবন। বা বলা চলে এঁরাই ওনার জীবন। এঁরা আছে বলেই তিনি ২৮ বছর আগের ঘটনাটিকে কিছুটা হলেও মাঝে মাঝে ভুলে থাকতে পারেন। সেই দুর্ঘটনা ওনাকে সাংঘাতিক ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনো এত বছর পরেও রাত্রে শুতে গেলে চোখের সামনে ভেসে আসে সেই ভয়াবহ দৃশ্য। এক জোড়া হেডলাইট উল্টো দিক থেকে আসছে, একদম শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং উইলটা বাঁদিকে কাটাতে সোজা ধাক্কা ল্যাম্প পোস্টে। পাশে বসে থাকা রাকা ও দীপের সেই চীৎকার এখনো কানে বাজে। নিজেও আহত হন, তাও ওই অবস্থাতেই হাইওয়েতে গাড়ী থামিয়ে যতক্ষণে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, ততক্ষণে স্ত্রী পুত্র দুজনকেই চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেদিনের মত অসহায়তা আজ অবধি আর কখনো বোধ করেননি শুভঙ্কর। তবে ওনার একটি বিরাট গুণ, কর্মক্ষেত্রে কোনদিনও এর প্রভাব পড়েনি। আজ অবধি যত সার্জারি করেছেন, একটাও বিফলে যায়নি। অপারেশন টেবিল থেকে প্রতিটি রুগী সুস্থ হয়ে ফিরেছে। আর তাই পেশেন্টরা ডঃ সান্যালকে অনেক সময়েই দেবতার আসনে উন্নীত করতে দ্বিধা করেননা।
রেসিডেন্ট ডাক্তার বলে রেখেছিল আজকের নতুন কেসের কথা। পেশেন্ট একজন ভদ্রমহিলা। বয়স আনুমানিক ৬০-৬২। বাড়িতে গতকাল হঠাৎ ব্ল্যাকাউট হয়। পড়েও যান, সেই সময়ে খাটের কোণায় কপাল ঠুকে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। বাড়ির লোকজন তড়িঘড়ি নিয়ে আসেন হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে, কিন্তু পেশেন্টের সমানে জ্ঞান আসছে যাচ্ছে, তাই ওনাকে দেখতে যাওয়ার তলব পড়েছে। ওয়ার্ডের বাকি পেশেন্টদের দেখে অবশেষে এলেন বেড নং ৪৮এ।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন সুলতা মাসি। সেই অবিকল পানপাতার মত মুখ, নাকের ডগায় ছোট্ট খয়েরী তিল, সাদাকালো কোঁকড়া চুল, টিকলো নাক - এক লহমায় ৫০-৫৫ বছর আগে চলে গেলেন। তখন তিনি শুভঙ্কর, সক্কলের প্রিয় শুভ। সান্যাল বাড়ীর একরত্তি ছেলে, সবার নয়নের মণি। ছোটবেলায় মাকে হারানোর ফলে কাকী-পিসি-মাসি-ঠাকুমার কাছে মানুষ। সবচেয়ে বেশী সময় কাটত পাশের বাড়িতে, সুলতা মাসির কাছে। ওই বাড়িটা হর মামার বাড়ি। মামা মামির সাথে থাকত বিধবা সুলতা মাসী ও তার মেয়ে গৌরী। গৌরী আর শুভঙ্করের বয়সের ফারাক ওই বছর তিন চারেকের। একসাথেই ওদের বেড়ে ওঠা। মামা-মামী নিঃসন্তান ছিলেন, গৌরী ওদের আদরেই বড় হচ্ছিল। ওর লেখাপড়া, সাধারণ জীবনযাপন, সখ আহ্লাদ মেটানো কোন কিছুতেই কোন খামতি ছিলনা। শুভঙ্করদের মত অত ধনী না হলেও গৌরীর মামাও নিতান্ত ফেলনা ছিলেন না। সরকারী দপ্তরে বড় বাবু ছিলেন। দুই বাড়ির মধ্যে যোগাযোগ বরাবরই খুব ভালো ছিল। ওরা দুজনে পড়ত পাশাপাশি দুটো স্কুলে - সরকারী বয়েজ ও গার্লস স্কুলে। স্কুলে যাওয়া আসা একসাথে হত। সক্কাল হতে না হতে কোনমতে দুধ কলা মুড়ি খেয়ে সাইকেল বের করত শুভ। গৌরীদের বাড়ির সামনে সাইকেলটা যতক্ষণে নিয়ে যেত, ইতিমধ্যে হাঁকডাক পেড়ে ওকে বাড়ি থেকে বের করিয়ে আনত। তারপরে দুজনে একসাথে যেতো স্কুল।
গ্রীষ্মের চাঁদিফাটা রোদে, বর্ষায় ক্ষেতের আল বরাবর, শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় গুড়ের গন্ধে যখন চারিদিক মেতে থাকত, ওরা একসাথে সাইকেলে স্কুল যেত। দুপুরে আজ এই বাড়ী কাল ওই বাড়ি করে একসাথে খাওয়া হত। সুলতা মাসী গৌরী আর শুভর পছন্দের রান্না রেঁধে যত্ন করে দুজনকে একসাথে বেড়ে খাওয়াতেন। শুভর ঠাকুমার থালা থেকেও দুজনের সিদ্ধ ভাত ঘি দিয়ে মেখে খাওয়াটা প্রায় নিয়মের মধ্যে পড়ত। দুর্গা পুজো, রথের মেলা, শীতকালের যাত্রাপালা সর্বত্র একসাথে ওরা গিয়ে কত আনন্দও করত। দেখতে দেখতে শুভর স্কুলের পাঠ মিটল। ভীষণ ভালো নম্বর পেয়ে ও কলকাতায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেল। গৌরীর তখনও তিন বছর বাকি।
পেশেন্টের বেডের পাশে রাখা কাগজপত্রে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলেন নাম। সেদিনের কুমারী গৌরী বসু আজ শ্রীমতী গৌরী মিত্র। রিপোর্টগুলিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। এখন গৌরী ঘুমোচ্ছে, কড়া সেডেটিভের কল্যাণে। চ্যানেল করে বাঁ হাতের শিরা দিয়ে শরীরে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও ওষুধ। সস্নেহে, অতি যত্নে ডঃ সান্যাল গৌরীর ডান হাতটি নিজের হাতে তুলে নিলেন পালস মাপতে। সেই স্পর্শ। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরেও যে স্পর্শ তিনি ভুলতে পারেননি।
শুভর যেদিন কলকাতায় চলে আসার কথা, তার আগেরদিন বিকেলে ওরা দেখা করতে গেল পুরনো শিবমন্দিরের কাছে। যতক্ষণে গৌরী এসে পৌঁছেছে, শুভর একটা সিগারেট খাওয়া প্রায় শেষ।
- তুমি আবার ওই ছাইপাঁশ খাচ্ছ শুভদা?
- তুই জানিসনা গৌরী, এতে টান দিয়ে কত সুখ।
- চুপ করো। কলকাতায় গেলে না, তার আগেই এইরকম করছ। এরপরে কলকাতায় হোস্টেলে থাকা শুরু করলে তো তুমি গোল্লায় যাবে।
- হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। ওখানে কে আমায় এমন করে শাসন করবে বল গৌরী?
- কলকাতায় গিয়ে তোমার কত নতুন নতুন বন্ধু হবে। বান্ধবী হবে। তারা দেখবে। তখন গৌরীর কথা মনেও পড়বেনা তোমার।
- ওই শুরু হল মেয়ের। ঠোঁট ফুলিয়ে এবারে কাঁদ। একেই নাকের ডগায় দেখছি টুকটুকে লাল রঙ।
- বলো তুমি কলকাতায় গেলে আমায় ভুলবে না?
- আরে পাগলী। তুই হলি আমার ছোটবেলার গৌরী, তোকে কখনো ভুলতে পারি?
- তবে যে মাধুরী বলছিল, শিশির দা কলকাতায় যাওয়ার পর আর পায়েলদির সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি?
- শিশিরের সাথে তুই আমার তুলনা করলি গৌরী?
- আমার খুব ভয় করে যে শুভদা। যবে থেকে তোমার admissionএর খবর দিয়েছ, আমার মন অস্থির হয়ে গিয়েছে। খালি মনে হচ্ছে আর বোধহয় সবকিছু আগের মত থাকবেনা।
শুভ আস্তে করে নিজের দুই হাতের মধ্যে গৌরীর দুই হাতজোড়া চেপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- গৌরী যে কোন ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন, আমরা একে ওপরের সাথেই থাকব। আমি নিজের দিব্যি দিয়ে বললাম আজ। আমার ওপর ভরসা রাখ।
অনন্তকাল দুজনে এইভাবে বসেছিল। কোন কথা না বলেও যে কত কথা বলা যায়, তার আরো একটা নিদর্শন যেন রয়ে গেল সেদিনের ওই বিকেলে। কনে দেখা আলোয় লক্ষ্মী প্রতিমার মত গৌরী আর শুভঙ্করের ওই শেষ দেখা।
পালস রেট এখন একটু stable। তিনি মেডিকেল চার্টে প্রয়োজন মত নির্দেশিকা লিখে নার্সকে বলে গেলেন কোনরকম কিছু অবস্থার পরিবর্তন হলেই ওনাকে জানাতে। চেম্বারে এরপর এক এক করে সমস্ত পেশেন্ট পার্টি আসা শুরু হল। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে তিনি সকলকে তাদের প্রিয়জনের সংবাদ দিলেন। শেষে এলো বছর ৪০ এর এক ভদ্রলোক। নিজেকে গৌরীর ছেলে অনিমেষ মিত্র বলে পরিচয় দিলেন। ডঃ সান্যালের মনে হল আজ ওনার ছেলে দীপ বেঁচে থাকলে হয়তো এই রকমই হত। কে জানে, হয়তো অনিমেষের বন্ধুও হতে পারত।
- ডাক্তারবাবু মা কে কেমন দেখলেন?
- condition stable আপাতত, কাল সকালে একবার স্ক্যান করাতে হবে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে। Internal hemorrhage আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
পরের দিন সকালে হাসপাতালের ambulance করে গৌরীকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে স্ক্যান করিয়ে আনা হল। স্ক্যান রিপোর্ট দেখে ডঃ সান্যাল অনিমেষকে জানালেন যে খুব শিগগিরি সার্জারি করতে হবে। পারলে কালকেই। বাড়ির লোকজন এক বাক্যে ডাক্তারবাবুর কথা বেদ বাক্য মনে করে সম্মতি জানিয়ে দিলেন। অনেক রাত্রে একবার শুভঙ্কর গৌরীর বেডের কাছে গেলেন। রাতের নার্সকে বেরিয়ে যেতে বলে বসলেন গৌরীর সামনে।
- গৌরী
নিদ্রাচ্ছন্ন গৌরী দুইবার নিজের নাম শুনে তাকালেন চোখ মেলে।
- আমায় চিনতে পারছিস?
- আপনি?
-আমি যে তোর শুভদা।
- শুভ দা? কত বছর পরে, মনে হচ্ছে যেন এক জীবন পরে দেখছি তোমায়।
- কেমন আছিস?
- খুব মাথায় যন্ত্রণা করছে।
- কোন চিন্তা করিসনা, কাল তোর অপারেশন করব, দেখবি তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
- সত্যি বলছ?
- আমার ওপর ভরসা রাখ।
শিবমন্দিরের কাছে বসেও তো সেদিন তিনি গৌরীকে ভরসা রাখতে বলেছিলেন। তারপরে কী হল? রাখতে পেরেছিলেন কথা? যখন সেকন্ড ইয়ারে পড়াকালীন গৌরী আকুলি বিকুলি করে জানাল যে মামা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, শুভ যেন এসে ওকে বাঁচায়, শুভকে ছাড়া ও থাকতে পারবেনা, শুভঙ্কর তো কিছুই করতে পারেননি। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে কায়স্থ বাড়ির মেয়েকে বৌ হিসেবে আনতে কিছুতেই রাজী হয়নি। শুভর ঠাকুমা তো তখন এক রকম জোর করেই রাকার সাথে আশীর্বাদ করিয়ে দেন। নইলে আশি বছরের ঠাকুমা জল স্পর্শ করবেন না বলেছিলেন। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে গৌরীর পাশে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট বহুকাল ওঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ডাক্তারি পাস করে রাকার সাথে বিয়েটাও হয়ে যায়। এরপর লন্ডন, তারপরে আর বহু বছর বাদে কলকাতায় ফেরা। জীবনে নীল এলো। ইতিমধ্যে গৌরীর সাথে আর দেখাই হয়নি, কিন্তু ওর কথা ভুলতে পারেননি শুভঙ্কর।
- গৌরী তুই আমার সাথে থাকবি? আমি জানি তখন আমার একটা স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত ছিল। আমি ভুল করেছিলাম। তুই দয়া করে আমায় ক্ষমা করে দে। চল আমরা আমাদের বাকি জীবনটা একসাথে কাটাই।
- এসব হয় না শুভদা। তোমার এ কথা সিনেমা বইতে চলতে পারে, বাস্তবে এটা কিছুতেই হতে পারেনা। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
- তোর যা ইচ্ছে। ভালো থাকিস গৌরী। কাল তোর অপারেশন হয়ে গেলে আমার তবে ছুটি।
সাধারণত পরের দিন সার্জারি থাকলে ডঃ সান্যাল চেষ্টা করেন একটানা আট ঘণ্টা ঘুমনোর। কিন্তু আজ কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার চোখের সামনে নানান ছবি ভেসে আসছিল। ছোট্টবেলাকার সমস্ত স্মৃতি, গৌরী, শুভ, সুলতা মাসী, বাবা, ঠাকুমা...মেডিকেল কলেজ। রাকা আর দীপের কথা ভাবতে গিয়ে দুই গাল বেয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল। অনেক রাত্রে হাল্কা ঘুম এলো।
পরেরদিন সকালে হাসপাতালে পৌঁছে যথাসময়ে ও টি তে ঢুকলেন। মনের ভিতরের ঝড় প্রভাব ফেলল ওনার সার্জারিতে। ক্রমাগত ভুল করতে লাগলেন। সহকারী ডাক্তার নার্স একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ক্রমশ গৌরীর প্রেশার ফল করতে লাগল, পালস কমতে লাগল। গৌরী মৃত্যুর কোলে ঢলে যেতে লাগলেন। এই প্রথম ডঃ সান্যাল কোন কেসে ব্যর্থ হলেন।
বিদ্ধ্বস্ত ডাক্তার নিজের বাড়ি ফিরে এলেন দুপুর দুপুরই। আরামকেদারায় গা এলিয়ে বসলেন, হাতে পুরনো album। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সি ডি প্লেয়ারে বাজছে "বনমালী তুমি পরজন্মে হইয়ো রাধা।"
- বড় ডাক্তার এখনো আসেননি। এখন জুনিয়ার ডাক্তার আপাতত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করেছেন। আপনার মায়ের মাথার চোট তো বেশ গভীর।
- বড় ডাক্তার মানে ডাক্তার সান্যাল তো?
- হ্যাঁ, উনি রাউন্ডে বেরিয়েছেন, পরপর দেখে আপনার মায়ের কাছেও আসবেন। রাউন্ড শেষ হলে চেম্বারে ডেকে নেবেন। অপেক্ষা করুন।
ডাক্তার শুভঙ্কর সান্যাল। বয়স আনুমানিক ৬৫। এক মাথা শুভ্রকেশ, সৌম্য চেহারা। দেখলেই একরকম ভক্তি ভাব জাগে মনে। লন্ডন থেকে নিউরোসার্জারিতে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় তিরিশ বছর আগে। সেই থেকে সপ্তাহে চারদিন বিকেলে কলকাতায় ও বাকি সমস্ত সময় এই বেলাপুর টাউন হাসপাতালে কাটান। বিপত্নীক, নিঃসন্তান। কোনরকম পিছুটান নেই। এই হাসপাতাল, রুগী, হাসপাতালের কর্মী- এসব নিয়েই ওনার জীবন। বা বলা চলে এঁরাই ওনার জীবন। এঁরা আছে বলেই তিনি ২৮ বছর আগের ঘটনাটিকে কিছুটা হলেও মাঝে মাঝে ভুলে থাকতে পারেন। সেই দুর্ঘটনা ওনাকে সাংঘাতিক ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনো এত বছর পরেও রাত্রে শুতে গেলে চোখের সামনে ভেসে আসে সেই ভয়াবহ দৃশ্য। এক জোড়া হেডলাইট উল্টো দিক থেকে আসছে, একদম শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং উইলটা বাঁদিকে কাটাতে সোজা ধাক্কা ল্যাম্প পোস্টে। পাশে বসে থাকা রাকা ও দীপের সেই চীৎকার এখনো কানে বাজে। নিজেও আহত হন, তাও ওই অবস্থাতেই হাইওয়েতে গাড়ী থামিয়ে যতক্ষণে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, ততক্ষণে স্ত্রী পুত্র দুজনকেই চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেদিনের মত অসহায়তা আজ অবধি আর কখনো বোধ করেননি শুভঙ্কর। তবে ওনার একটি বিরাট গুণ, কর্মক্ষেত্রে কোনদিনও এর প্রভাব পড়েনি। আজ অবধি যত সার্জারি করেছেন, একটাও বিফলে যায়নি। অপারেশন টেবিল থেকে প্রতিটি রুগী সুস্থ হয়ে ফিরেছে। আর তাই পেশেন্টরা ডঃ সান্যালকে অনেক সময়েই দেবতার আসনে উন্নীত করতে দ্বিধা করেননা।
রেসিডেন্ট ডাক্তার বলে রেখেছিল আজকের নতুন কেসের কথা। পেশেন্ট একজন ভদ্রমহিলা। বয়স আনুমানিক ৬০-৬২। বাড়িতে গতকাল হঠাৎ ব্ল্যাকাউট হয়। পড়েও যান, সেই সময়ে খাটের কোণায় কপাল ঠুকে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। বাড়ির লোকজন তড়িঘড়ি নিয়ে আসেন হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে, কিন্তু পেশেন্টের সমানে জ্ঞান আসছে যাচ্ছে, তাই ওনাকে দেখতে যাওয়ার তলব পড়েছে। ওয়ার্ডের বাকি পেশেন্টদের দেখে অবশেষে এলেন বেড নং ৪৮এ।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন সুলতা মাসি। সেই অবিকল পানপাতার মত মুখ, নাকের ডগায় ছোট্ট খয়েরী তিল, সাদাকালো কোঁকড়া চুল, টিকলো নাক - এক লহমায় ৫০-৫৫ বছর আগে চলে গেলেন। তখন তিনি শুভঙ্কর, সক্কলের প্রিয় শুভ। সান্যাল বাড়ীর একরত্তি ছেলে, সবার নয়নের মণি। ছোটবেলায় মাকে হারানোর ফলে কাকী-পিসি-মাসি-ঠাকুমার কাছে মানুষ। সবচেয়ে বেশী সময় কাটত পাশের বাড়িতে, সুলতা মাসির কাছে। ওই বাড়িটা হর মামার বাড়ি। মামা মামির সাথে থাকত বিধবা সুলতা মাসী ও তার মেয়ে গৌরী। গৌরী আর শুভঙ্করের বয়সের ফারাক ওই বছর তিন চারেকের। একসাথেই ওদের বেড়ে ওঠা। মামা-মামী নিঃসন্তান ছিলেন, গৌরী ওদের আদরেই বড় হচ্ছিল। ওর লেখাপড়া, সাধারণ জীবনযাপন, সখ আহ্লাদ মেটানো কোন কিছুতেই কোন খামতি ছিলনা। শুভঙ্করদের মত অত ধনী না হলেও গৌরীর মামাও নিতান্ত ফেলনা ছিলেন না। সরকারী দপ্তরে বড় বাবু ছিলেন। দুই বাড়ির মধ্যে যোগাযোগ বরাবরই খুব ভালো ছিল। ওরা দুজনে পড়ত পাশাপাশি দুটো স্কুলে - সরকারী বয়েজ ও গার্লস স্কুলে। স্কুলে যাওয়া আসা একসাথে হত। সক্কাল হতে না হতে কোনমতে দুধ কলা মুড়ি খেয়ে সাইকেল বের করত শুভ। গৌরীদের বাড়ির সামনে সাইকেলটা যতক্ষণে নিয়ে যেত, ইতিমধ্যে হাঁকডাক পেড়ে ওকে বাড়ি থেকে বের করিয়ে আনত। তারপরে দুজনে একসাথে যেতো স্কুল।
গ্রীষ্মের চাঁদিফাটা রোদে, বর্ষায় ক্ষেতের আল বরাবর, শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় গুড়ের গন্ধে যখন চারিদিক মেতে থাকত, ওরা একসাথে সাইকেলে স্কুল যেত। দুপুরে আজ এই বাড়ী কাল ওই বাড়ি করে একসাথে খাওয়া হত। সুলতা মাসী গৌরী আর শুভর পছন্দের রান্না রেঁধে যত্ন করে দুজনকে একসাথে বেড়ে খাওয়াতেন। শুভর ঠাকুমার থালা থেকেও দুজনের সিদ্ধ ভাত ঘি দিয়ে মেখে খাওয়াটা প্রায় নিয়মের মধ্যে পড়ত। দুর্গা পুজো, রথের মেলা, শীতকালের যাত্রাপালা সর্বত্র একসাথে ওরা গিয়ে কত আনন্দও করত। দেখতে দেখতে শুভর স্কুলের পাঠ মিটল। ভীষণ ভালো নম্বর পেয়ে ও কলকাতায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেল। গৌরীর তখনও তিন বছর বাকি।
পেশেন্টের বেডের পাশে রাখা কাগজপত্রে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলেন নাম। সেদিনের কুমারী গৌরী বসু আজ শ্রীমতী গৌরী মিত্র। রিপোর্টগুলিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। এখন গৌরী ঘুমোচ্ছে, কড়া সেডেটিভের কল্যাণে। চ্যানেল করে বাঁ হাতের শিরা দিয়ে শরীরে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও ওষুধ। সস্নেহে, অতি যত্নে ডঃ সান্যাল গৌরীর ডান হাতটি নিজের হাতে তুলে নিলেন পালস মাপতে। সেই স্পর্শ। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরেও যে স্পর্শ তিনি ভুলতে পারেননি।
শুভর যেদিন কলকাতায় চলে আসার কথা, তার আগেরদিন বিকেলে ওরা দেখা করতে গেল পুরনো শিবমন্দিরের কাছে। যতক্ষণে গৌরী এসে পৌঁছেছে, শুভর একটা সিগারেট খাওয়া প্রায় শেষ।
- তুমি আবার ওই ছাইপাঁশ খাচ্ছ শুভদা?
- তুই জানিসনা গৌরী, এতে টান দিয়ে কত সুখ।
- চুপ করো। কলকাতায় গেলে না, তার আগেই এইরকম করছ। এরপরে কলকাতায় হোস্টেলে থাকা শুরু করলে তো তুমি গোল্লায় যাবে।
- হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। ওখানে কে আমায় এমন করে শাসন করবে বল গৌরী?
- কলকাতায় গিয়ে তোমার কত নতুন নতুন বন্ধু হবে। বান্ধবী হবে। তারা দেখবে। তখন গৌরীর কথা মনেও পড়বেনা তোমার।
- ওই শুরু হল মেয়ের। ঠোঁট ফুলিয়ে এবারে কাঁদ। একেই নাকের ডগায় দেখছি টুকটুকে লাল রঙ।
- বলো তুমি কলকাতায় গেলে আমায় ভুলবে না?
- আরে পাগলী। তুই হলি আমার ছোটবেলার গৌরী, তোকে কখনো ভুলতে পারি?
- তবে যে মাধুরী বলছিল, শিশির দা কলকাতায় যাওয়ার পর আর পায়েলদির সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি?
- শিশিরের সাথে তুই আমার তুলনা করলি গৌরী?
- আমার খুব ভয় করে যে শুভদা। যবে থেকে তোমার admissionএর খবর দিয়েছ, আমার মন অস্থির হয়ে গিয়েছে। খালি মনে হচ্ছে আর বোধহয় সবকিছু আগের মত থাকবেনা।
শুভ আস্তে করে নিজের দুই হাতের মধ্যে গৌরীর দুই হাতজোড়া চেপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- গৌরী যে কোন ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন, আমরা একে ওপরের সাথেই থাকব। আমি নিজের দিব্যি দিয়ে বললাম আজ। আমার ওপর ভরসা রাখ।
অনন্তকাল দুজনে এইভাবে বসেছিল। কোন কথা না বলেও যে কত কথা বলা যায়, তার আরো একটা নিদর্শন যেন রয়ে গেল সেদিনের ওই বিকেলে। কনে দেখা আলোয় লক্ষ্মী প্রতিমার মত গৌরী আর শুভঙ্করের ওই শেষ দেখা।
পালস রেট এখন একটু stable। তিনি মেডিকেল চার্টে প্রয়োজন মত নির্দেশিকা লিখে নার্সকে বলে গেলেন কোনরকম কিছু অবস্থার পরিবর্তন হলেই ওনাকে জানাতে। চেম্বারে এরপর এক এক করে সমস্ত পেশেন্ট পার্টি আসা শুরু হল। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে তিনি সকলকে তাদের প্রিয়জনের সংবাদ দিলেন। শেষে এলো বছর ৪০ এর এক ভদ্রলোক। নিজেকে গৌরীর ছেলে অনিমেষ মিত্র বলে পরিচয় দিলেন। ডঃ সান্যালের মনে হল আজ ওনার ছেলে দীপ বেঁচে থাকলে হয়তো এই রকমই হত। কে জানে, হয়তো অনিমেষের বন্ধুও হতে পারত।
- ডাক্তারবাবু মা কে কেমন দেখলেন?
- condition stable আপাতত, কাল সকালে একবার স্ক্যান করাতে হবে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে। Internal hemorrhage আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
পরের দিন সকালে হাসপাতালের ambulance করে গৌরীকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে স্ক্যান করিয়ে আনা হল। স্ক্যান রিপোর্ট দেখে ডঃ সান্যাল অনিমেষকে জানালেন যে খুব শিগগিরি সার্জারি করতে হবে। পারলে কালকেই। বাড়ির লোকজন এক বাক্যে ডাক্তারবাবুর কথা বেদ বাক্য মনে করে সম্মতি জানিয়ে দিলেন। অনেক রাত্রে একবার শুভঙ্কর গৌরীর বেডের কাছে গেলেন। রাতের নার্সকে বেরিয়ে যেতে বলে বসলেন গৌরীর সামনে।
- গৌরী
নিদ্রাচ্ছন্ন গৌরী দুইবার নিজের নাম শুনে তাকালেন চোখ মেলে।
- আমায় চিনতে পারছিস?
- আপনি?
-আমি যে তোর শুভদা।
- শুভ দা? কত বছর পরে, মনে হচ্ছে যেন এক জীবন পরে দেখছি তোমায়।
- কেমন আছিস?
- খুব মাথায় যন্ত্রণা করছে।
- কোন চিন্তা করিসনা, কাল তোর অপারেশন করব, দেখবি তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
- সত্যি বলছ?
- আমার ওপর ভরসা রাখ।
শিবমন্দিরের কাছে বসেও তো সেদিন তিনি গৌরীকে ভরসা রাখতে বলেছিলেন। তারপরে কী হল? রাখতে পেরেছিলেন কথা? যখন সেকন্ড ইয়ারে পড়াকালীন গৌরী আকুলি বিকুলি করে জানাল যে মামা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, শুভ যেন এসে ওকে বাঁচায়, শুভকে ছাড়া ও থাকতে পারবেনা, শুভঙ্কর তো কিছুই করতে পারেননি। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে কায়স্থ বাড়ির মেয়েকে বৌ হিসেবে আনতে কিছুতেই রাজী হয়নি। শুভর ঠাকুমা তো তখন এক রকম জোর করেই রাকার সাথে আশীর্বাদ করিয়ে দেন। নইলে আশি বছরের ঠাকুমা জল স্পর্শ করবেন না বলেছিলেন। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে গৌরীর পাশে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট বহুকাল ওঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ডাক্তারি পাস করে রাকার সাথে বিয়েটাও হয়ে যায়। এরপর লন্ডন, তারপরে আর বহু বছর বাদে কলকাতায় ফেরা। জীবনে নীল এলো। ইতিমধ্যে গৌরীর সাথে আর দেখাই হয়নি, কিন্তু ওর কথা ভুলতে পারেননি শুভঙ্কর।
- গৌরী তুই আমার সাথে থাকবি? আমি জানি তখন আমার একটা স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত ছিল। আমি ভুল করেছিলাম। তুই দয়া করে আমায় ক্ষমা করে দে। চল আমরা আমাদের বাকি জীবনটা একসাথে কাটাই।
- এসব হয় না শুভদা। তোমার এ কথা সিনেমা বইতে চলতে পারে, বাস্তবে এটা কিছুতেই হতে পারেনা। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
- তোর যা ইচ্ছে। ভালো থাকিস গৌরী। কাল তোর অপারেশন হয়ে গেলে আমার তবে ছুটি।
সাধারণত পরের দিন সার্জারি থাকলে ডঃ সান্যাল চেষ্টা করেন একটানা আট ঘণ্টা ঘুমনোর। কিন্তু আজ কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার চোখের সামনে নানান ছবি ভেসে আসছিল। ছোট্টবেলাকার সমস্ত স্মৃতি, গৌরী, শুভ, সুলতা মাসী, বাবা, ঠাকুমা...মেডিকেল কলেজ। রাকা আর দীপের কথা ভাবতে গিয়ে দুই গাল বেয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল। অনেক রাত্রে হাল্কা ঘুম এলো।
পরেরদিন সকালে হাসপাতালে পৌঁছে যথাসময়ে ও টি তে ঢুকলেন। মনের ভিতরের ঝড় প্রভাব ফেলল ওনার সার্জারিতে। ক্রমাগত ভুল করতে লাগলেন। সহকারী ডাক্তার নার্স একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ক্রমশ গৌরীর প্রেশার ফল করতে লাগল, পালস কমতে লাগল। গৌরী মৃত্যুর কোলে ঢলে যেতে লাগলেন। এই প্রথম ডঃ সান্যাল কোন কেসে ব্যর্থ হলেন।
বিদ্ধ্বস্ত ডাক্তার নিজের বাড়ি ফিরে এলেন দুপুর দুপুরই। আরামকেদারায় গা এলিয়ে বসলেন, হাতে পুরনো album। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সি ডি প্লেয়ারে বাজছে "বনমালী তুমি পরজন্মে হইয়ো রাধা।"
Sunday, June 25, 2017
শুভ রথযাত্রা
অনুরোধ করব লেখাটা পড়ার সময় সাথে দেওয়া লিঙ্কটি ইয়ারফোন বা স্পিকারে চালিয়ে শুনতে। মনে হয় ভালো লাগবে।
https://www.youtube.com/watch?v=EmkMEB-exl4
উফ, বাবা যে কেন আসছে না এখনো, এই করতে করতে মা কে ব্যাতিব্যস্ত করে তুলতে লাগল বুবাই। মা ততক্ষণে মিনতি মাসীর সাথে মিলে জিলিপি ভাজা শুরু করে দিয়েছে। রথ টানার পরেই যে মনটা ঘুগনি জিলিপি জিলিপি করে!
ঠিক সাড়ে চারটে বাজতেই গেটে আওয়াজ পেল বুবাই।
মা! বাবা এসে গেছে!!!
হ্যাঁ, দাঁড়া, লোকটা ক্লান্ত হয়ে এসছে বাস ট্রামে। একটু দুটো মিনিট জিরোতে দে।
বাবা বাবা বাবা। রথ!!!!
বুবাই, কি সুন্দর সাজিয়েছিস তুই?
মা আর আমি করেছি। ছবি তুলে দাও। দিদুনকে পাঠাব।
আচ্ছা আচ্ছা দেবো। এবার চল দেখি রথ টানি!
বাবা রথের দড়ি ধরে টানা শুরু করল। পিছন পিছন মা ছেলের wheelchairটা ঠেলতে ঠেলতে উঠোনে আনল। হাতে রথের রসি ধরে ছোট্ট বুবাই আনন্দে দুই হাতে তালি দিতে লাগল।
হাল্কা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল আকাশ ভেঙ্গে।
Saturday, June 24, 2017
গ্রুম শপিং
রোহিণীর বয়স ২৭। চাকরী করে চেন্নাইতে এক আইটি কোম্পানিতে। কেরিয়ারে মোটামুটি থিতু হয়েছে গত বছর এমবিএ পাস করার পর। মধ্যবিত্ত বাঙালি মা বাবার এখন তাই একটাই চিন্তা, মেয়ের বিয়ে দিয়ে তথাকথিত "সেটল" করানো। আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে থেকে কোন মনোমত সম্বন্ধ না আসায় শেষমেশ মা বাবা দ্বারস্থ হল বিভিন্ন ডট কমের। সবই ভালো, "গ্রুম শপিং" এর নামে "উইন্ডো শপিং"ই বেশী চলছিল। রোহিণী এবং ওর মা বাবা সকলেই প্রায় তিতিবিরক্ত, দেশে কী সুপাত্রের অভাব পড়ল?
অবশ্য আমাদের রোহিণীর কিন্তু নানান বাতিক। ছেলের প্রোফাইলে যদি সেলফি থাকে, তাঁকে তৎক্ষণাৎ বাতিল। কারণ? হাসবেন না, তার মানে নাকি ছেলে খুবই অমিশুকে, কোন বন্ধু নেই তার একটা ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। ভাবুন তো, এটা কোন কথা হল? আচ্ছা, আরেকটা বলি। রোহিণী ইংরিজিতে বেশ ভালো, ছোট থেকে কনভেন্ট স্কুলে পড়াশোনা করেছে। ভালো ইংরেজি বলতে হবে, লিখতে হবে, এটা ওর একটা দাবী। একটি আইটি কোম্পানির অতি উচ্চপদস্থ ছেলের বাড়ী থেকে সম্বন্ধও এলো। ও তার প্রোফাইল পড়ে সিধা নাকচ করে দিল। কারণটা কি? ছেলে নাকি "carrier oriented"।
লেটেস্টটা বলি। ছেলে জাপানে পোস্ট ডক্টরেট করছে ইঞ্জিনিয়ারিঙে। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। গায়ের রঙ একটু চাপা, সে না হয় ঠিক আছে, রোহিণীর তাতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ওর ঠিক ইয়ে হল না ওর ছবি দেখে। বাবা মায়ের খুব পছন্দ এই ছেলেটিকে। অথচ ও কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা নাকচ করার। তবে বিধাতা পুরুষ আছেন ওর সাথে। ছেলেটির প্রোফাইলে দেখল, জন্ম সময় সকাল ৪ঃ২০। ব্যাস। কারণ দিয়ে দিল। একটা নয়, দু-দুটো। ১। যে ছেলে ওই ভোর রাত্তিরে মা কে জ্বালিয়েছে, সে মোটেই সুবিধের নয়। বউকেও জ্বালাবে। ২। এর তো জন্মলগ্নেই ৪২০!!!
আপনারাই বলুন। রোহিণীর কি আদৌ বিয়ে হবে?
Tuesday, June 20, 2017
মধু
অবশেষে সেই দিন চলে এলো। ১৩ই জানুয়ারি। আজ দুপুরের ট্রেনে উঠছি, গন্তব্য পুণা। যাচ্ছি একটি কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপে। এই প্রথম পশ্চিম ভারতে যাওয়া, তার ওপর অনেকদিন বাদে ট্রেনে যাব, একা; অল্প হলেও উত্তেজনা হচ্ছিল। সাম্প্রতিক কালে সাইকেল থেক উল্টে গিয়ে ডান হাতে বেদম চোট পাওয়ার ফলে খুবই সামান্য লাগেজ নিয়ে বেরোলাম। চেন্নাই সেন্ট্রালে পৌছতে পৌছতে একটু দেরী হয়ে গেল বটে, দেখলাম প্ল্যাটফর্মে মুম্বাই মেল দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে সুস্থে এ-১ এর সামনে গেলাম, মোটামুটি ফাঁকা। অভ্যেসবশতই এরপরে চার্টে নিজের নাম দেখলাম। হাতে কনফার্মড টিকিট থাকলেও চার্ট দেখাটা কখনো বাদ যায়না। আসলে আশেপাশের যাত্রীরা কে বা কারা, অন্তত নাম বয়েস এসব দেখে একটু কল্পনা করে নিতে ভালো লাগে। দেখলাম আমি যে চারজনের ব্লকটিতে লোয়ার বার্থে আছি, সেখানে আর কেউ নেই। এমনকি সাইড লোয়ার আপারেও কেউ নেই। ভালোই হল, ট্রেন কমবেশী ফাঁকাই যাচ্ছে। নিশ্চিন্তে যাওয়া যাবে, হুঠহাঠ মাঝরাত্রে ছোট বাচ্চার কান্নায় ঘুম ভাঙবার সম্ভবনা কম, বা অনেক রাত্তির অবধি এক দঙ্গল স্কুল পড়ুয়াদের গানের লড়াই বা তাস লুডোর উল্লাসে ঘুম না আসার সমস্যাও হবেনা। অতি প্রসন্ন হয়ে নিজের বার্থে বসলাম। সুটকেসটিকে সীটের নীচে এবং পোস্টারটিকে আপাতত সীটের ওপরে রেখে বেশ পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম। যথারীতি ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়েনি। প্রায় মিনিট দশেক পরে যখন গুটিগুটি পায়ে সেন্ট্রাল ছাড়ল মুম্বাই মেল, বাড়িতে মা বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যেই টিকিট চেকার এসে আমার টিকিট দেখে গেল। আমারও একটু ঝিমুনি আসছিল, ইয়ারফোন কানে গুঁজে জানলার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে বসলাম। কতক্ষণ যে এরকমভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। এক সময়ে খুব ঠাণ্ডা লাগছিল বলে ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখলাম দুটো বাজে। রেনিগুন্টা আসতে আরো আধ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট। খিদে পাচ্ছে, তখন কিছু কিনে খাওয়া যাবে ভাবতে ভাবতে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে শরদিন্দু অমনিবাসটা বের করলাম। পুণা যাচ্ছি বলে যেন আরো ইচ্ছে করে ওনার বই নিয়ে যাচ্ছিলাম। পেজ মার্ক দেওয়া পাতাটা খুলে আরম্ভ করলাম পড়া। মধু-মালতী। সেই পুণার রাস্তায় সাইকেল চালাত জীবদ্দশায় এবং পরে অলৌকিক সত্ত্বা নিয়েও তাদের বামন রাওয়ের দোকান থেকে প্রতি রাতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেরানোর গল্প।
রেনিগুন্টায় ট্রেন থামল মিনিট পাঁচেক। ইতিমধ্যে হকারের থেকে ইডলি-বড়া আর কফি কিনলাম। ট্রেন সবে ছাড়ব ছাড়ব করছে, তখন দেখি এক ভদ্রলোক (নাকি ছোকরা, কী বলব, বয়েস আনুমানিক ২৮-২৯ বেশ হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার উল্টোদিকের সীটে ব্যাকপ্যাক রেখে বসল। অল্পক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে একটা প্রিন্ট-আউট (সম্ভবত টিকিটের) হাতে করে দেখলাম দরজার দিকে গেল। বোধহয় টিটির কাছে। কিছুক্ষণ বাদে ফিরল বেডরোল নিয়ে। বুঝলাম ইনি তার মানে আমার সহযাত্রী। অর্থাৎ, গোটা জার্নিটা তাহলে একা একা ভূতের মতো কাটাতে হবেনা। বকবক করতে আমার খুব ভালো লাগে, আর সহ যাত্রী প্রায় সমবয়সী হওয়ায় মনে হল যে যাক, তাহলে হয়ত গল্প করে কিছুটা সময় কাটানো যাবে। অবশ্য উনি আদৌ কথাবার্তা ভালোবাসেন কিনা, জানিনা। মনে মনে ভাবলাম একটু খানিকক্ষণ দেখি, তারপরে নাহয় নিজে যেচে আলাপ করব মনে হলে। আর উনি যদি পুণার বাসিন্দা হন, একটু রাস্তাঘাট সম্বন্ধে জেনেও নেওয়া যাবে।
ট্রেন ছুটে চলেছে অন্ধ্র প্রদেশের মধ্যে দিয়ে। ধীরে ধীরে দেখলাম কখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেল। প্যান্ট্রি কারের থেকে চা কফি ওয়ালা এক চক্কর দিয়ে গেল। বাইরের দৃশ্য আর দেখা যাচ্ছেনা, বইয়ে আবার মনোযোগ দেবো বলে সেটি হাতে নিতেই ওদিক থেকে কথা শুরু হল।
-আপনি বাঙালি দেখছি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছেন। নমস্কার। আমার নাম মধুসূদন দেশপাণ্ডে।
-দেশপাণ্ডে? মারাঠি?
-হ্যাঁ, ভাবছেন তো কি করে এত পরিষ্কার বাংলা বলছি?
-হ্যাঁ মানে...
-আসলে আমার জন্ম থেকে বারো বছর বয়স অবধি আমি খড়গপুরে থেকেছি। আমার বাবা রেলে চাকরী করেন। সেই সূত্রে ওখানে স্কুলে বাংলা শিখেছি।
-ও আচ্ছা। কোথায় চললেন, পুণা নাকি বম্বে?
-আমি পুণার আগের ষ্টেশন, দউন্ড জংশনে নামব।
-আমি পুণা যাচ্ছি।
-কাজে না ভ্রমণে?
-বাবা! ভ্রমণ! কী সাধু ভাষা ব্যবহার করেন আপনি!!
-আসলে বাংলার চর্চা এখনো ওই একটু আধটু বই পড়ে, তাই ওই ভাষাটাই যা রপ্ত হয়ে আছে।
-আমি যাচ্ছি একটা কনফারেন্সে। পুণে ইউনিভার্সিটিতে।
-ও। আমি একটা সময়ে ওইসব জায়গায় খুব ঘুরে বেড়াতাম। ফারগুসন কলেজের ছাত্র ছিলাম। এস পি, মানে আপনার সাবিত্রীবাই ফুলে পুণে ইউনিভার্সিটিতে অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। সবাই সাইকেলে চড়ে অনেক দূরে দূরে চলে যেতাম।
-পুণায় আমার এই প্রথমবার যাওয়া। জিওগ্রাফি বইতে, হিস্ট্রি বইতে অনেক পড়েছি এই শহরটাকে নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশী করে যেন চিনেছি শরদিন্দু বাবুর লেখা থেকে। আমার খুব কৌতূহল তাই শহরটার বিষয়ে।
-থাকছেন কোথায়?
-আমি আইসারের হোস্টেলে থাকছি।
-আচ্ছা, মানে বানের অঞ্চল। খুবই সুন্দর ওই জায়গাটা।
-ওখানে বেড়ানোর মত কিছু আছে আশেপাশে?
- ওই অঞ্চলে ঠিক তেমন কিছু নেই। পাষাণ লেকে যেতে পারেন, একদম ভোরবেলা বা সন্ধ্যের মুখে মুখে। অনেক পাখী দেখতে পাবেন। এমনিতে পুণার রাস্তাঘাটে হেঁটে চলে দেখবেন, ভালো লাগবে। হাতে সময় থাকলে গাড়ী ভাড়া করে শনিবারয়াডা, পার্বতী, সিঙ্ঘগঢ় এসবে যেতে পারেন। তবে চেষ্টা করবেন একা না যাওয়ার, লোকজন নিয়ে যাবেন, বড্ড নিরিবিলি।
-থ্যাঙ্ক ইউ। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব এগুলোয় যাওয়ার।
-কোন গল্প চলছে এখন?
-আপাতত মধু-মালতী। পড়েছেন?
-আলবত। আমায় বন্ধুরা মধু বলে ডাকে, তাই আমি ছোটবেলায় ভাবতাম যে এ গল্প বুঝি আমায় নিয়ে লেখা। তারপর যখন কলেজে উঠে আমার এক বান্ধবী হল, কাকতালীয় ভাবে তারও নাম মালতী, ভাবতে পারবেন না কতটা আনন্দ হয়েছিল। শুনতে খুব বোকাবোকা লাগলেও, ওই ১৮-১৯ বছর বয়েসেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমাদেরও একদিন একটা প্রেম কাহিনী হবে, মধু-মালতীর মত।
-সেকি? জেনেশুনে কেউ ওরকম পরিণতি চায় নাকি?
-দেখুন, মধু-মালতী কেন ইম্মরটাল হয়ে আছে শরদিন্দু বাবুর লেখায়? ওরা বেঁচে থাকলে কী ভদ্রলোক লিখতেন ওদের নিয়ে? ভাবুন!
-সেটা ঠিক, কিন্তু তা বলে কেউ জেনেশুনে এরকম কামনা করে নাকি নিজের জীবনের?
-আমরা করতাম। তা কিছুটা পূরণ হয়েছিল।
-মানে?
-এসে বলছি।
গল্প করতে করতে কখন আটটা বেজে গিয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই খেয়াল করিনি। গুন্টাকাল জংশনে ট্রেন থেমেছে তখন। পঁচিশ মিনিট থামার কথা এখানে। ডিনার এখানেই কিনে নেব ঠিক ছিল। মধুসূদন প্ল্যাটফর্মে নামল চা-নাস্তার আশায়। আমি রেলের ক্যাটারারের থেকে একটা নন ভেজ মীল নিলাম। বাড়িতে কথাও বলে নিলাম ফোনে সিগনাল আছে দেখে। ট্রেন যদি এরকমভাবে চালাতে পারে, তাহলে কাল রাইট টাইমেই পুণা ঢুকে যাব বুঝলাম। নিশ্চিন্তও হলাম। অজানা অচেনা শহরে যত সকাল সকাল যাওয়া যায়, ততই ভালো। কালকের দিনটা পুরো হাত খালি। পরশু থেকে কনফারেন্স শুরু হয়ে গেলে তো আর তেমনভাবে ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ পাবোনা। যদি কোথাও যাওয়া যায়, অন্তত পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক যাওয়াটা কালকেই সেরে ফেললে হয়। মধুর থেকে জেনে নিতে হবে অটো ট্যাক্সির ভাড়ার কথা।
হঠাৎ খেয়াল হল। একি, ছেলেটা গেল কোথায়। ট্রেনের গ্রীন সিগনাল দিয়ে দিয়েছে, ট্রেন মৃদু গতিতে চলা শুরু করেও দিল। কিন্তু মধু কই? তাহলে হয়ত অন্যও কোন কামরায় উঠে পড়েছে। পরের ষ্টেশনের আগে তো এখানে আসতেও পারবেনা। প্যান্ট্রিটা আমাদের ঠিক পাশেই বলে ভেস্টিবিউল একদিকে বন্ধ। আমি ডিনার সেরে হাত মুখ ধুয়ে নিজের জায়গায় ফেরত চলে এলাম। আশেপাশের কম্পারটমেন্টে লোকে একে একে বিছানা পেতে শোওয়ার আয়োজন করছে। ট্রেন জার্নিতে বেশীরভাগ লোকই রাত্রে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, আসলে তেমন কিছু করার থাকেনা বলে বোধহয়। আমিও বিছানা পেতে বই হাতে করে শুলাম। আডোনি, মন্ত্রালায়াম রোড, কৃষ্ণা সমস্ত ষ্টেশন গেল। এক মিনিট করে থামল। কিন্তু কই, মধুর তো দেখা নেই। ও কি তাহলে ট্রেনে উঠতে পারেনি? নাকি অল্প সময় থামছে বলে নামতে সাহস পাচ্ছেনা ট্রেন থেকে? হয়ত মাঝ্রাত্রে বড় স্টপে থামলে আসবে। ওর সীটে বিছানার চাদর কম্বল পরিপাটি করে ভাজ করে রাখা, ও আসলে হাতই দেয়নি ওতে। পিঠের ব্যাগটাও নিয়ে নীচে নেমেছিল, যাক অন্তত কিছু দরকার পড়লে সাথে থাকবে সব। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল, টেরই পাইনি। ঘুম ভাঙল যখন, দেখি সাতটা বাজে। ভাগ্যিস রোজের অ্যালার্মটা কাটিনি। এত আরামের ঘুম অনেকদিন পরে ঘুমিয়েছি। উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখলাম, তখনো মধু নেই। আহা রে, তাহলে হয়ত ট্রেন মিস করেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাগ গুছিয়ে বসলাম। আটটায় দউন্ড ষ্টেশন এলো। আমি উৎসুক হয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে রইলাম মধু কে দেখতে পাই কিনা ভেবে। ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোচ্ছে, দেখলাম অনেক দূরে, বেঞ্চিতে বসে মধু। আমায় হাত নেড়ে যাচ্ছে। বুঝলাম সারা রাত তার মানে অন্যও কোন কামরায় খালি সীটে কাটিয়েছে। একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল, ওর গল্পের পুরোটা শোনা হলনা।
সাড়ে আটটায় কোচ আটেন্ডেন্ট এলো বেড রোল ফেরত নিতে। আমার গুলো নিয়ে চলে যাচ্ছিল, আমি ডেকে বললাম,
- ভাইয়া উস সীটকা ভি লেলো। প্যাসেঞ্জার উতার গয়া।
-ক্যা ম্যাডাম? ক্যা লু উস সীট সে?
-ও বেড রোল।
-কহা হে? কুছ নহি হে ওয়াহা।
-ক্যা কুছ নহি? হে না ও।
-আরে ম্যাডাম ও পুরানা আখবার হে। প্যাসেঞ্জার নেহি হে তো বেড রোল কৈসে?
আমি উঠে গিয়ে দেখলাম যে সত্যি, ওখানে তো ১২ তারিখের টাইমস অফ ইন্ডিয়া রাখা। বম্বে এডিশন। বুঝলাম কোথাও একটা খুব বড় গণ্ডগোল হয়েছে। পুণায় নেমে চার্টে চোখ বোলালাম দরজায়। দেখলাম এ-১ এ আমার আশেপাশে কোথাও কারুর নাম নেই। মাথাটা কিরকম একটা ঘুরে গেল। কোনমতে অটো স্ট্যান্ডে গিয়ে বানের রোড বলে লাগেজ উঠিয়ে বসলাম। তিনদিন ছিলাম পুণাতে। রাস্তায় রাস্তায় অনেক হেঁটেছি, ফারগুসন কলেজ, এস পি ইউনিভারসিটি চত্বরে প্রচুর ঘুরলাম। ১৮ তারিখ ভোরবেলা বম্বের ট্রেনটা যখন ষ্টেশন ছাড়ছে, দূরে চায়ের স্টলে দেখলাম মধু দাঁড়িয়ে, হাতে চায়ের কাপ। হাসিমুখে আমায় হাত নাড়ছে।
Saturday, June 17, 2017
একটি অতি প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের parody মাথায় এলো সাইকেল চালাতে চালাতে।
তবু মনে রেখো যদি পড়ি মহা ঋণে,
তবু মনে রেখো।
যদি দুহাজারি নোট বদলাতে না পারি ছোট নোট দিয়ে,
যদি থাকি কাছাকাছি, খুচরো দিয়ো বঁধুর মতো মাঝে মাঝে-
তবু মনে রেখো।
যদি টাকা ফুরায় পেটিএমে,
একদিন যদি ওলা মানি দাও মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
একদিন যদি পাসওয়ার্ড যাই ভুলে ক্রেডিট কার্ডের,
তবু মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
আগের পাওনা টাকা নাই দেখা দেয়
তোমার একাউন্টে,
তবু মনে রেখো।
Monday, June 12, 2017
সিকিউরিটি চেক-ইন এর পরে গেটের সামনেই চলে এলাম। হাতে এখনো ঘণ্টা খানেকের ওপর বাকি বোর্ডিঙের। জানলার ধারে খালি জায়গাটা দেখে তো লাফিয়ে লাফিয়ে এসে বসা গেল, কিন্তু এতক্ষণ কি করণীয়? সঙ্গে পাওয়ার ব্যাঙ্কটিও নেই যে একটু মোবাইলে গান শুনবে; এত ঝটপট আজকাল চার্জ শেষ হয়ে যায়। অগত্যা, লোক দেখা যাক! লোকজন দেখতে মন্দ লাগেনা আমার। বেশ একটা চেহারা দেখে বা আশে পাশের লোকেদের কথাবার্তার টুকরো যেইটুকু কানে ভেসে আসে, তার থেকে তাদের বিষয়ে নিজের মত করে গল্প বানিয়ে ফেলতে খুব মজা লাগে।
এই করতে করতে দিব্যি কাটছিল সময়। মাঝে মাঝে ডিসপ্লেবোর্ডটির দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। বোর্ডিং আরম্ভ হল কিনা দেখতে। এই ফাঁকে কখন দেখি আমার পাশের সীটটি তে এক অতি সুপুরুষ ব্যাক্তি এসে বসেছেন। সামনে তার ল্যাপটপে টার্মিনাল খোলা। নিজে লিনাক্স ব্যাবহার করি বলে উবুন্টুর চেনা ইন্টারফেস দেখে কীরকম একটা এক্সট্রা ভালোলাগা তৈরী হয়ে গেল। পরনে হাল্কা নীলের ওপর ভীষণ সরু সাদা স্ট্রাইপ ফুল হাটা শার্ট, চোখে রিমলেস চশমা। ফর্সা গালে একদিনের হাল্কা একটু সব্জেটে দাড়ির আভা। আমি তো পুরো ফ্ল্যাট! সমানে চান্স খুঁজছি দেখার যে উনি কোন ফ্লাইটে। আসলে ওই একই টাইমে (মিনিট কুড়ির ব্যাবধানে) পাশাপাশি গেট থেকে একটা চেন্নাই আর একটা বেঙ্গালুরুর প্লেন ছিল। আমার হাতে ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার চেন্নাই যাওয়ার বিমানের বোর্ডিং পাস। কপাল খুলল মিনিট দশেক পরে। দেখলাম ভাগ্যদেবী প্রসন্ন তখনো আমার ওপরে। ভদ্রলোকেরও একই বিমান, এমনকি কপাল ভাবুন আমার, আমার পাশেরই সীট।
যাক! দুই ঘণ্টার জার্নি আর যাই হোক, অন্তত ঝারি মেরে কাটানো যাবে। বাড়ি ছেড়ে আসার দুঃখও মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল। বেশ একটা ফুরফুরে মন নিয়ে প্লেনে তো গিয়ে উঠলাম। "তিনি" আসতেই আমার আইল সীট থেকে বেরিয়ে তাঁকে ভিতরে বসতে দিলাম। সৌজন্যমূলক একটু হাসিও হাসলাম দুজনেই। ততক্ষণে তো বোধহয় মনে মনে প্রায় হানিমুনে কোথায় যাব দূরে থাক, fifth anniversaryটা সুইজারল্যান্ড না কাশ্মীর (আমার আসলে পাহাড় খুব প্রিয় কিনা!) কোথায় কাটাবো (ডিপেন্ড করছে ততদিনে আমি PhDটা সেরে কি করছি, তার ওপর) ভাবছি, এদিকে ওনার সামনে এক্কেবারে নির্লিপ্ত থাকার ভেক ধরে বসে আছি। পূর্ব experience থেকে বলতে পারি, ছেলেদের chase করে আজ অবধি successful হইনি, কাজেই একদম চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম। তা টেক-অফ ও বেশ ঘটনাবিহীন ভাবেই হল। খাবারের ট্রের থেকে দই বড়াতে চামচ বসাতে যাব কি পাশ থেকে তার গলার আওয়াজ।
- কী যে ছাইপাঁশ খেতে দেয় এরা, সরকারী বিমান বলেই এরকম যা ইচ্ছে তাই।
ব্যাস! গেল আমার মাথাটি গরম হয়ে। দই বড়াকে খারাপ বলা আর তার ওপর সরকারী বিমান বলে খোঁটা দেওয়া... এ তো মেনে নেওয়া যায় না। সরকারী চাকুরে মা বাবার মেয়ে হয়ে এ হেন বদনাম নেব না। দিলাম চারটি কথা শুনিয়ে।
- কেন? এটা খারাপ কী? অন্তত পেট ভরার মত খাবার দেয়। কয়েক মাস আগে বম্বে গেলাম, এমনি অল্প ব্রেকফাস্ট দিল জেটে, পেটই ভরেনি আমার! আর সরকারী কিছু হলেই খারাপ? জানেন এয়ার ইন্ডিয়া আছে বলেই দেশের কত remote locations এখন connected by air?
তিনিও দমবার পাত্র নন।
- সে তো BSNLও claim করে নাকি কীসব "Connecting India" , তা চাইলেও ফোনর সিগনাল পান সবসময়, বলুন? নাকি আপনি ভরসা করে ওটির কানেকশন রাখেন?
ব্যাস। হল final nail in the coffin।
- শুনুন মশাই, এই BSNLএর connectionটি ছিল বলেই আমি ঘরে বসে web check-in করেছি। আপনার তো দেখছি kiosk checkin। প্রাইভেট কোম্পানির internet বুঝি service দেয়নি? আপনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। বেচারা। কত কষ্ট করে টাকা খরচা করে আপনি আপনার অপছন্দের airlines এর টিকিট কেটে চললেন। যাই হোক।
বাকি সময়টুকু Kindleএ মন দিয়েই কাটালাম।
ঠিক এইভাবেই আমি আরেকটিও হতেও পারত প্রেমকাহিনীকে কেঁচিয়ে দিলাম।
এই করতে করতে দিব্যি কাটছিল সময়। মাঝে মাঝে ডিসপ্লেবোর্ডটির দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। বোর্ডিং আরম্ভ হল কিনা দেখতে। এই ফাঁকে কখন দেখি আমার পাশের সীটটি তে এক অতি সুপুরুষ ব্যাক্তি এসে বসেছেন। সামনে তার ল্যাপটপে টার্মিনাল খোলা। নিজে লিনাক্স ব্যাবহার করি বলে উবুন্টুর চেনা ইন্টারফেস দেখে কীরকম একটা এক্সট্রা ভালোলাগা তৈরী হয়ে গেল। পরনে হাল্কা নীলের ওপর ভীষণ সরু সাদা স্ট্রাইপ ফুল হাটা শার্ট, চোখে রিমলেস চশমা। ফর্সা গালে একদিনের হাল্কা একটু সব্জেটে দাড়ির আভা। আমি তো পুরো ফ্ল্যাট! সমানে চান্স খুঁজছি দেখার যে উনি কোন ফ্লাইটে। আসলে ওই একই টাইমে (মিনিট কুড়ির ব্যাবধানে) পাশাপাশি গেট থেকে একটা চেন্নাই আর একটা বেঙ্গালুরুর প্লেন ছিল। আমার হাতে ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার চেন্নাই যাওয়ার বিমানের বোর্ডিং পাস। কপাল খুলল মিনিট দশেক পরে। দেখলাম ভাগ্যদেবী প্রসন্ন তখনো আমার ওপরে। ভদ্রলোকেরও একই বিমান, এমনকি কপাল ভাবুন আমার, আমার পাশেরই সীট।
যাক! দুই ঘণ্টার জার্নি আর যাই হোক, অন্তত ঝারি মেরে কাটানো যাবে। বাড়ি ছেড়ে আসার দুঃখও মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল। বেশ একটা ফুরফুরে মন নিয়ে প্লেনে তো গিয়ে উঠলাম। "তিনি" আসতেই আমার আইল সীট থেকে বেরিয়ে তাঁকে ভিতরে বসতে দিলাম। সৌজন্যমূলক একটু হাসিও হাসলাম দুজনেই। ততক্ষণে তো বোধহয় মনে মনে প্রায় হানিমুনে কোথায় যাব দূরে থাক, fifth anniversaryটা সুইজারল্যান্ড না কাশ্মীর (আমার আসলে পাহাড় খুব প্রিয় কিনা!) কোথায় কাটাবো (ডিপেন্ড করছে ততদিনে আমি PhDটা সেরে কি করছি, তার ওপর) ভাবছি, এদিকে ওনার সামনে এক্কেবারে নির্লিপ্ত থাকার ভেক ধরে বসে আছি। পূর্ব experience থেকে বলতে পারি, ছেলেদের chase করে আজ অবধি successful হইনি, কাজেই একদম চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম। তা টেক-অফ ও বেশ ঘটনাবিহীন ভাবেই হল। খাবারের ট্রের থেকে দই বড়াতে চামচ বসাতে যাব কি পাশ থেকে তার গলার আওয়াজ।
- কী যে ছাইপাঁশ খেতে দেয় এরা, সরকারী বিমান বলেই এরকম যা ইচ্ছে তাই।
ব্যাস! গেল আমার মাথাটি গরম হয়ে। দই বড়াকে খারাপ বলা আর তার ওপর সরকারী বিমান বলে খোঁটা দেওয়া... এ তো মেনে নেওয়া যায় না। সরকারী চাকুরে মা বাবার মেয়ে হয়ে এ হেন বদনাম নেব না। দিলাম চারটি কথা শুনিয়ে।
- কেন? এটা খারাপ কী? অন্তত পেট ভরার মত খাবার দেয়। কয়েক মাস আগে বম্বে গেলাম, এমনি অল্প ব্রেকফাস্ট দিল জেটে, পেটই ভরেনি আমার! আর সরকারী কিছু হলেই খারাপ? জানেন এয়ার ইন্ডিয়া আছে বলেই দেশের কত remote locations এখন connected by air?
তিনিও দমবার পাত্র নন।
- সে তো BSNLও claim করে নাকি কীসব "Connecting India" , তা চাইলেও ফোনর সিগনাল পান সবসময়, বলুন? নাকি আপনি ভরসা করে ওটির কানেকশন রাখেন?
ব্যাস। হল final nail in the coffin।
- শুনুন মশাই, এই BSNLএর connectionটি ছিল বলেই আমি ঘরে বসে web check-in করেছি। আপনার তো দেখছি kiosk checkin। প্রাইভেট কোম্পানির internet বুঝি service দেয়নি? আপনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। বেচারা। কত কষ্ট করে টাকা খরচা করে আপনি আপনার অপছন্দের airlines এর টিকিট কেটে চললেন। যাই হোক।
বাকি সময়টুকু Kindleএ মন দিয়েই কাটালাম।
ঠিক এইভাবেই আমি আরেকটিও হতেও পারত প্রেমকাহিনীকে কেঁচিয়ে দিলাম।
Subscribe to:
Posts (Atom)