Monday, June 26, 2017

তুমি অন্য কারুর সঙ্গে বেঁধো ঘর

- ডাক্তারবাবু কি বললেন দিদি?
- বড় ডাক্তার এখনো আসেননি। এখন জুনিয়ার ডাক্তার আপাতত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করেছেন। আপনার মায়ের মাথার চোট তো বেশ গভীর।
- বড় ডাক্তার মানে ডাক্তার সান্যাল তো?
- হ্যাঁ, উনি রাউন্ডে বেরিয়েছেন, পরপর দেখে আপনার মায়ের কাছেও আসবেন। রাউন্ড শেষ হলে চেম্বারে ডেকে নেবেন। অপেক্ষা করুন।


ডাক্তার  শুভঙ্কর সান্যাল। বয়স আনুমানিক ৬৫। এক মাথা শুভ্রকেশ, সৌম্য চেহারা। দেখলেই একরকম ভক্তি ভাব জাগে মনে। লন্ডন থেকে নিউরোসার্জারিতে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় তিরিশ বছর আগে। সেই থেকে সপ্তাহে চারদিন বিকেলে কলকাতায় ও বাকি সমস্ত সময় এই বেলাপুর টাউন হাসপাতালে কাটান। বিপত্নীক, নিঃসন্তান। কোনরকম পিছুটান নেই। এই হাসপাতাল, রুগী, হাসপাতালের কর্মী- এসব নিয়েই ওনার জীবন। বা বলা চলে এঁরাই ওনার জীবন। এঁরা আছে বলেই তিনি ২৮ বছর আগের ঘটনাটিকে কিছুটা হলেও মাঝে মাঝে ভুলে থাকতে পারেন। সেই দুর্ঘটনা ওনাকে সাংঘাতিক ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনো এত বছর পরেও রাত্রে শুতে গেলে চোখের সামনে ভেসে আসে সেই ভয়াবহ দৃশ্য। এক জোড়া হেডলাইট উল্টো দিক থেকে আসছে, একদম শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং উইলটা বাঁদিকে কাটাতে সোজা ধাক্কা ল্যাম্প পোস্টে। পাশে বসে থাকা রাকা ও দীপের সেই চীৎকার এখনো কানে বাজে। নিজেও আহত হন, তাও ওই অবস্থাতেই হাইওয়েতে গাড়ী থামিয়ে যতক্ষণে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, ততক্ষণে স্ত্রী পুত্র দুজনকেই চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেদিনের মত অসহায়তা আজ অবধি আর কখনো বোধ করেননি শুভঙ্কর। তবে ওনার একটি বিরাট গুণ, কর্মক্ষেত্রে কোনদিনও এর প্রভাব পড়েনি। আজ অবধি যত সার্জারি করেছেন, একটাও বিফলে যায়নি। অপারেশন টেবিল থেকে প্রতিটি রুগী সুস্থ হয়ে ফিরেছে। আর তাই পেশেন্টরা ডঃ সান্যালকে অনেক সময়েই দেবতার আসনে উন্নীত করতে দ্বিধা করেননা।
রেসিডেন্ট ডাক্তার বলে রেখেছিল আজকের নতুন কেসের কথা। পেশেন্ট একজন ভদ্রমহিলা। বয়স আনুমানিক ৬০-৬২। বাড়িতে গতকাল হঠাৎ ব্ল্যাকাউট হয়। পড়েও যান, সেই সময়ে খাটের কোণায় কপাল ঠুকে গিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। বাড়ির লোকজন তড়িঘড়ি নিয়ে আসেন হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে, কিন্তু পেশেন্টের সমানে জ্ঞান আসছে যাচ্ছে, তাই ওনাকে দেখতে যাওয়ার তলব পড়েছে। ওয়ার্ডের বাকি পেশেন্টদের দেখে অবশেষে এলেন বেড নং ৪৮এ।

হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন সুলতা মাসি। সেই অবিকল পানপাতার মত মুখ, নাকের ডগায় ছোট্ট খয়েরী তিল, সাদাকালো কোঁকড়া চুল, টিকলো নাক - এক লহমায় ৫০-৫৫ বছর আগে চলে গেলেন। তখন তিনি শুভঙ্কর, সক্কলের প্রিয় শুভ। সান্যাল বাড়ীর একরত্তি ছেলে, সবার নয়নের মণি। ছোটবেলায় মাকে হারানোর ফলে কাকী-পিসি-মাসি-ঠাকুমার কাছে মানুষ। সবচেয়ে বেশী সময় কাটত পাশের বাড়িতে, সুলতা মাসির কাছে। ওই বাড়িটা হর মামার বাড়ি। মামা মামির সাথে থাকত বিধবা সুলতা মাসী ও তার মেয়ে গৌরী। গৌরী আর শুভঙ্করের বয়সের ফারাক ওই বছর তিন চারেকের। একসাথেই ওদের বেড়ে ওঠা। মামা-মামী নিঃসন্তান ছিলেন, গৌরী ওদের আদরেই বড় হচ্ছিল। ওর লেখাপড়া, সাধারণ জীবনযাপন, সখ আহ্লাদ মেটানো কোন কিছুতেই কোন খামতি ছিলনা। শুভঙ্করদের মত অত ধনী না হলেও গৌরীর মামাও নিতান্ত ফেলনা ছিলেন না। সরকারী দপ্তরে বড় বাবু ছিলেন। দুই বাড়ির মধ্যে যোগাযোগ বরাবরই খুব ভালো ছিল। ওরা দুজনে পড়ত পাশাপাশি দুটো স্কুলে - সরকারী বয়েজ ও গার্লস স্কুলে। স্কুলে যাওয়া আসা একসাথে হত। সক্কাল হতে না হতে কোনমতে দুধ কলা মুড়ি খেয়ে সাইকেল বের করত শুভ। গৌরীদের বাড়ির সামনে সাইকেলটা যতক্ষণে নিয়ে যেত, ইতিমধ্যে হাঁকডাক পেড়ে ওকে বাড়ি থেকে বের করিয়ে আনত। তারপরে দুজনে একসাথে যেতো স্কুল।
গ্রীষ্মের চাঁদিফাটা রোদে, বর্ষায় ক্ষেতের আল বরাবর, শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় গুড়ের গন্ধে যখন চারিদিক মেতে থাকত, ওরা একসাথে সাইকেলে স্কুল যেত। দুপুরে আজ এই বাড়ী কাল ওই বাড়ি করে একসাথে খাওয়া হত। সুলতা মাসী গৌরী আর শুভর পছন্দের রান্না রেঁধে যত্ন করে দুজনকে একসাথে বেড়ে খাওয়াতেন। শুভর ঠাকুমার থালা থেকেও দুজনের সিদ্ধ ভাত ঘি দিয়ে মেখে খাওয়াটা প্রায় নিয়মের মধ্যে পড়ত। দুর্গা পুজো, রথের মেলা, শীতকালের যাত্রাপালা সর্বত্র একসাথে ওরা গিয়ে কত আনন্দও করত। দেখতে দেখতে শুভর স্কুলের পাঠ মিটল। ভীষণ ভালো নম্বর পেয়ে ও কলকাতায় মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেল। গৌরীর তখনও তিন বছর বাকি।



পেশেন্টের বেডের পাশে রাখা কাগজপত্রে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলেন নাম। সেদিনের কুমারী গৌরী বসু আজ শ্রীমতী গৌরী মিত্র। রিপোর্টগুলিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। এখন গৌরী ঘুমোচ্ছে, কড়া সেডেটিভের কল্যাণে। চ্যানেল করে বাঁ হাতের শিরা দিয়ে শরীরে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও ওষুধ। সস্নেহে, অতি যত্নে ডঃ সান্যাল গৌরীর ডান হাতটি নিজের হাতে তুলে নিলেন পালস মাপতে। সেই স্পর্শ। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরেও যে স্পর্শ তিনি ভুলতে পারেননি।



শুভর যেদিন কলকাতায় চলে আসার কথা, তার আগেরদিন বিকেলে ওরা দেখা করতে গেল পুরনো শিবমন্দিরের কাছে। যতক্ষণে গৌরী এসে পৌঁছেছে, শুভর একটা সিগারেট খাওয়া প্রায় শেষ।
- তুমি আবার ওই ছাইপাঁশ খাচ্ছ শুভদা?
- তুই জানিসনা গৌরী, এতে টান দিয়ে কত সুখ।
- চুপ করো। কলকাতায় গেলে না, তার আগেই এইরকম করছ। এরপরে কলকাতায় হোস্টেলে থাকা শুরু করলে তো তুমি গোল্লায় যাবে।
- হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। ওখানে কে আমায় এমন করে শাসন করবে বল গৌরী?
- কলকাতায় গিয়ে তোমার কত নতুন নতুন বন্ধু হবে। বান্ধবী হবে। তারা দেখবে। তখন গৌরীর কথা মনেও পড়বেনা তোমার।
- ওই শুরু হল মেয়ের। ঠোঁট ফুলিয়ে এবারে কাঁদ। একেই নাকের ডগায় দেখছি টুকটুকে লাল রঙ।
- বলো তুমি কলকাতায় গেলে আমায় ভুলবে না?
- আরে পাগলী। তুই হলি আমার ছোটবেলার গৌরী, তোকে কখনো ভুলতে পারি?
- তবে যে মাধুরী বলছিল, শিশির দা কলকাতায় যাওয়ার পর আর পায়েলদির সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি?
- শিশিরের সাথে তুই আমার তুলনা করলি গৌরী?
- আমার খুব ভয় করে যে শুভদা। যবে থেকে তোমার admissionএর খবর দিয়েছ, আমার মন অস্থির হয়ে গিয়েছে। খালি মনে হচ্ছে আর বোধহয় সবকিছু আগের মত থাকবেনা।
শুভ আস্তে  করে নিজের দুই হাতের মধ্যে গৌরীর দুই হাতজোড়া চেপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- গৌরী যে কোন ঝড় ঝাপটা আসুক না কেন, আমরা একে ওপরের সাথেই থাকব। আমি নিজের দিব্যি দিয়ে বললাম আজ। আমার ওপর ভরসা রাখ।
 অনন্তকাল দুজনে এইভাবে বসেছিল। কোন কথা না বলেও যে কত কথা বলা যায়, তার আরো একটা নিদর্শন যেন রয়ে গেল সেদিনের ওই বিকেলে। কনে দেখা আলোয় লক্ষ্মী প্রতিমার মত গৌরী আর শুভঙ্করের ওই শেষ দেখা।



পালস রেট এখন একটু stable। তিনি মেডিকেল চার্টে প্রয়োজন মত নির্দেশিকা লিখে নার্সকে বলে গেলেন কোনরকম কিছু অবস্থার পরিবর্তন হলেই ওনাকে জানাতে। চেম্বারে এরপর এক এক করে সমস্ত পেশেন্ট পার্টি আসা শুরু হল। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে তিনি সকলকে তাদের প্রিয়জনের সংবাদ দিলেন। শেষে এলো বছর ৪০ এর এক ভদ্রলোক। নিজেকে গৌরীর ছেলে অনিমেষ মিত্র বলে পরিচয় দিলেন। ডঃ সান্যালের মনে হল আজ ওনার ছেলে দীপ বেঁচে থাকলে হয়তো এই রকমই হত। কে জানে, হয়তো অনিমেষের বন্ধুও হতে পারত।
- ডাক্তারবাবু মা কে কেমন দেখলেন?
- condition stable আপাতত, কাল সকালে একবার স্ক্যান করাতে হবে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে। Internal hemorrhage আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
পরের দিন সকালে হাসপাতালের ambulance করে গৌরীকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে স্ক্যান করিয়ে আনা হল। স্ক্যান রিপোর্ট দেখে ডঃ সান্যাল অনিমেষকে জানালেন যে খুব শিগগিরি সার্জারি করতে হবে। পারলে কালকেই। বাড়ির লোকজন এক বাক্যে ডাক্তারবাবুর কথা বেদ বাক্য মনে করে সম্মতি জানিয়ে দিলেন। অনেক রাত্রে একবার শুভঙ্কর গৌরীর বেডের কাছে গেলেন। রাতের নার্সকে বেরিয়ে যেতে বলে বসলেন গৌরীর সামনে।

- গৌরী
নিদ্রাচ্ছন্ন গৌরী দুইবার নিজের নাম শুনে তাকালেন চোখ মেলে।
- আমায় চিনতে পারছিস?
- আপনি?
-আমি যে তোর শুভদা।
- শুভ দা? কত বছর পরে, মনে হচ্ছে যেন এক জীবন পরে দেখছি তোমায়।
- কেমন আছিস?
- খুব মাথায় যন্ত্রণা করছে।
- কোন চিন্তা করিসনা, কাল তোর অপারেশন করব, দেখবি তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
- সত্যি বলছ?
- আমার ওপর ভরসা রাখ।



শিবমন্দিরের কাছে বসেও তো সেদিন তিনি গৌরীকে ভরসা রাখতে বলেছিলেন। তারপরে কী হল? রাখতে পেরেছিলেন কথা? যখন সেকন্ড ইয়ারে পড়াকালীন গৌরী আকুলি বিকুলি করে জানাল যে মামা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, শুভ যেন এসে ওকে বাঁচায়, শুভকে ছাড়া ও থাকতে পারবেনা, শুভঙ্কর তো কিছুই করতে পারেননি। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে কায়স্থ বাড়ির মেয়েকে বৌ হিসেবে আনতে কিছুতেই রাজী হয়নি। শুভর ঠাকুমা তো তখন  এক রকম জোর করেই রাকার সাথে আশীর্বাদ করিয়ে দেন। নইলে আশি বছরের ঠাকুমা জল স্পর্শ করবেন না বলেছিলেন। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে গৌরীর পাশে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট বহুকাল ওঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ডাক্তারি পাস করে রাকার সাথে বিয়েটাও হয়ে যায়। এরপর লন্ডন, তারপরে আর বহু বছর বাদে কলকাতায় ফেরা। জীবনে নীল এলো। ইতিমধ্যে গৌরীর সাথে আর দেখাই হয়নি, কিন্তু ওর কথা ভুলতে পারেননি শুভঙ্কর।



- গৌরী তুই আমার সাথে থাকবি? আমি জানি তখন আমার একটা স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত ছিল। আমি ভুল করেছিলাম। তুই দয়া করে আমায় ক্ষমা করে দে। চল আমরা আমাদের বাকি জীবনটা একসাথে কাটাই।
- এসব হয় না শুভদা। তোমার এ কথা সিনেমা বইতে চলতে পারে, বাস্তবে এটা কিছুতেই হতে পারেনা। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
- তোর যা ইচ্ছে। ভালো থাকিস গৌরী। কাল তোর অপারেশন হয়ে গেলে আমার তবে ছুটি।


সাধারণত পরের দিন সার্জারি থাকলে ডঃ সান্যাল চেষ্টা করেন একটানা আট ঘণ্টা ঘুমনোর। কিন্তু আজ কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার চোখের সামনে নানান ছবি ভেসে আসছিল। ছোট্টবেলাকার সমস্ত স্মৃতি, গৌরী, শুভ, সুলতা মাসী, বাবা, ঠাকুমা...মেডিকেল কলেজ। রাকা আর দীপের কথা ভাবতে গিয়ে দুই গাল বেয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল। অনেক রাত্রে হাল্কা ঘুম এলো।
পরেরদিন সকালে হাসপাতালে পৌঁছে যথাসময়ে ও টি তে ঢুকলেন। মনের ভিতরের ঝড় প্রভাব ফেলল ওনার সার্জারিতে। ক্রমাগত ভুল করতে লাগলেন। সহকারী ডাক্তার নার্স একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। ক্রমশ গৌরীর প্রেশার ফল করতে লাগল, পালস কমতে লাগল। গৌরী মৃত্যুর কোলে ঢলে যেতে লাগলেন। এই প্রথম ডঃ সান্যাল কোন কেসে ব্যর্থ হলেন।

বিদ্ধ্বস্ত ডাক্তার নিজের বাড়ি ফিরে এলেন দুপুর দুপুরই। আরামকেদারায় গা এলিয়ে বসলেন, হাতে পুরনো album। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সি ডি প্লেয়ারে বাজছে "বনমালী তুমি পরজন্মে হইয়ো রাধা।"

No comments:

Post a Comment