অবশেষে সেই দিন চলে এলো। ১৩ই জানুয়ারি। আজ দুপুরের ট্রেনে উঠছি, গন্তব্য পুণা। যাচ্ছি একটি কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপে। এই প্রথম পশ্চিম ভারতে যাওয়া, তার ওপর অনেকদিন বাদে ট্রেনে যাব, একা; অল্প হলেও উত্তেজনা হচ্ছিল। সাম্প্রতিক কালে সাইকেল থেক উল্টে গিয়ে ডান হাতে বেদম চোট পাওয়ার ফলে খুবই সামান্য লাগেজ নিয়ে বেরোলাম। চেন্নাই সেন্ট্রালে পৌছতে পৌছতে একটু দেরী হয়ে গেল বটে, দেখলাম প্ল্যাটফর্মে মুম্বাই মেল দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে সুস্থে এ-১ এর সামনে গেলাম, মোটামুটি ফাঁকা। অভ্যেসবশতই এরপরে চার্টে নিজের নাম দেখলাম। হাতে কনফার্মড টিকিট থাকলেও চার্ট দেখাটা কখনো বাদ যায়না। আসলে আশেপাশের যাত্রীরা কে বা কারা, অন্তত নাম বয়েস এসব দেখে একটু কল্পনা করে নিতে ভালো লাগে। দেখলাম আমি যে চারজনের ব্লকটিতে লোয়ার বার্থে আছি, সেখানে আর কেউ নেই। এমনকি সাইড লোয়ার আপারেও কেউ নেই। ভালোই হল, ট্রেন কমবেশী ফাঁকাই যাচ্ছে। নিশ্চিন্তে যাওয়া যাবে, হুঠহাঠ মাঝরাত্রে ছোট বাচ্চার কান্নায় ঘুম ভাঙবার সম্ভবনা কম, বা অনেক রাত্তির অবধি এক দঙ্গল স্কুল পড়ুয়াদের গানের লড়াই বা তাস লুডোর উল্লাসে ঘুম না আসার সমস্যাও হবেনা। অতি প্রসন্ন হয়ে নিজের বার্থে বসলাম। সুটকেসটিকে সীটের নীচে এবং পোস্টারটিকে আপাতত সীটের ওপরে রেখে বেশ পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলাম। যথারীতি ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়েনি। প্রায় মিনিট দশেক পরে যখন গুটিগুটি পায়ে সেন্ট্রাল ছাড়ল মুম্বাই মেল, বাড়িতে মা বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যেই টিকিট চেকার এসে আমার টিকিট দেখে গেল। আমারও একটু ঝিমুনি আসছিল, ইয়ারফোন কানে গুঁজে জানলার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে বসলাম। কতক্ষণ যে এরকমভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। এক সময়ে খুব ঠাণ্ডা লাগছিল বলে ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখলাম দুটো বাজে। রেনিগুন্টা আসতে আরো আধ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট। খিদে পাচ্ছে, তখন কিছু কিনে খাওয়া যাবে ভাবতে ভাবতে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে শরদিন্দু অমনিবাসটা বের করলাম। পুণা যাচ্ছি বলে যেন আরো ইচ্ছে করে ওনার বই নিয়ে যাচ্ছিলাম। পেজ মার্ক দেওয়া পাতাটা খুলে আরম্ভ করলাম পড়া। মধু-মালতী। সেই পুণার রাস্তায় সাইকেল চালাত জীবদ্দশায় এবং পরে অলৌকিক সত্ত্বা নিয়েও তাদের বামন রাওয়ের দোকান থেকে প্রতি রাতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেরানোর গল্প।
রেনিগুন্টায় ট্রেন থামল মিনিট পাঁচেক। ইতিমধ্যে হকারের থেকে ইডলি-বড়া আর কফি কিনলাম। ট্রেন সবে ছাড়ব ছাড়ব করছে, তখন দেখি এক ভদ্রলোক (নাকি ছোকরা, কী বলব, বয়েস আনুমানিক ২৮-২৯ বেশ হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার উল্টোদিকের সীটে ব্যাকপ্যাক রেখে বসল। অল্পক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে একটা প্রিন্ট-আউট (সম্ভবত টিকিটের) হাতে করে দেখলাম দরজার দিকে গেল। বোধহয় টিটির কাছে। কিছুক্ষণ বাদে ফিরল বেডরোল নিয়ে। বুঝলাম ইনি তার মানে আমার সহযাত্রী। অর্থাৎ, গোটা জার্নিটা তাহলে একা একা ভূতের মতো কাটাতে হবেনা। বকবক করতে আমার খুব ভালো লাগে, আর সহ যাত্রী প্রায় সমবয়সী হওয়ায় মনে হল যে যাক, তাহলে হয়ত গল্প করে কিছুটা সময় কাটানো যাবে। অবশ্য উনি আদৌ কথাবার্তা ভালোবাসেন কিনা, জানিনা। মনে মনে ভাবলাম একটু খানিকক্ষণ দেখি, তারপরে নাহয় নিজে যেচে আলাপ করব মনে হলে। আর উনি যদি পুণার বাসিন্দা হন, একটু রাস্তাঘাট সম্বন্ধে জেনেও নেওয়া যাবে।
ট্রেন ছুটে চলেছে অন্ধ্র প্রদেশের মধ্যে দিয়ে। ধীরে ধীরে দেখলাম কখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেল। প্যান্ট্রি কারের থেকে চা কফি ওয়ালা এক চক্কর দিয়ে গেল। বাইরের দৃশ্য আর দেখা যাচ্ছেনা, বইয়ে আবার মনোযোগ দেবো বলে সেটি হাতে নিতেই ওদিক থেকে কথা শুরু হল।
-আপনি বাঙালি দেখছি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছেন। নমস্কার। আমার নাম মধুসূদন দেশপাণ্ডে।
-দেশপাণ্ডে? মারাঠি?
-হ্যাঁ, ভাবছেন তো কি করে এত পরিষ্কার বাংলা বলছি?
-হ্যাঁ মানে...
-আসলে আমার জন্ম থেকে বারো বছর বয়স অবধি আমি খড়গপুরে থেকেছি। আমার বাবা রেলে চাকরী করেন। সেই সূত্রে ওখানে স্কুলে বাংলা শিখেছি।
-ও আচ্ছা। কোথায় চললেন, পুণা নাকি বম্বে?
-আমি পুণার আগের ষ্টেশন, দউন্ড জংশনে নামব।
-আমি পুণা যাচ্ছি।
-কাজে না ভ্রমণে?
-বাবা! ভ্রমণ! কী সাধু ভাষা ব্যবহার করেন আপনি!!
-আসলে বাংলার চর্চা এখনো ওই একটু আধটু বই পড়ে, তাই ওই ভাষাটাই যা রপ্ত হয়ে আছে।
-আমি যাচ্ছি একটা কনফারেন্সে। পুণে ইউনিভার্সিটিতে।
-ও। আমি একটা সময়ে ওইসব জায়গায় খুব ঘুরে বেড়াতাম। ফারগুসন কলেজের ছাত্র ছিলাম। এস পি, মানে আপনার সাবিত্রীবাই ফুলে পুণে ইউনিভার্সিটিতে অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। সবাই সাইকেলে চড়ে অনেক দূরে দূরে চলে যেতাম।
-পুণায় আমার এই প্রথমবার যাওয়া। জিওগ্রাফি বইতে, হিস্ট্রি বইতে অনেক পড়েছি এই শহরটাকে নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশী করে যেন চিনেছি শরদিন্দু বাবুর লেখা থেকে। আমার খুব কৌতূহল তাই শহরটার বিষয়ে।
-থাকছেন কোথায়?
-আমি আইসারের হোস্টেলে থাকছি।
-আচ্ছা, মানে বানের অঞ্চল। খুবই সুন্দর ওই জায়গাটা।
-ওখানে বেড়ানোর মত কিছু আছে আশেপাশে?
- ওই অঞ্চলে ঠিক তেমন কিছু নেই। পাষাণ লেকে যেতে পারেন, একদম ভোরবেলা বা সন্ধ্যের মুখে মুখে। অনেক পাখী দেখতে পাবেন। এমনিতে পুণার রাস্তাঘাটে হেঁটে চলে দেখবেন, ভালো লাগবে। হাতে সময় থাকলে গাড়ী ভাড়া করে শনিবারয়াডা, পার্বতী, সিঙ্ঘগঢ় এসবে যেতে পারেন। তবে চেষ্টা করবেন একা না যাওয়ার, লোকজন নিয়ে যাবেন, বড্ড নিরিবিলি।
-থ্যাঙ্ক ইউ। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব এগুলোয় যাওয়ার।
-কোন গল্প চলছে এখন?
-আপাতত মধু-মালতী। পড়েছেন?
-আলবত। আমায় বন্ধুরা মধু বলে ডাকে, তাই আমি ছোটবেলায় ভাবতাম যে এ গল্প বুঝি আমায় নিয়ে লেখা। তারপর যখন কলেজে উঠে আমার এক বান্ধবী হল, কাকতালীয় ভাবে তারও নাম মালতী, ভাবতে পারবেন না কতটা আনন্দ হয়েছিল। শুনতে খুব বোকাবোকা লাগলেও, ওই ১৮-১৯ বছর বয়েসেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমাদেরও একদিন একটা প্রেম কাহিনী হবে, মধু-মালতীর মত।
-সেকি? জেনেশুনে কেউ ওরকম পরিণতি চায় নাকি?
-দেখুন, মধু-মালতী কেন ইম্মরটাল হয়ে আছে শরদিন্দু বাবুর লেখায়? ওরা বেঁচে থাকলে কী ভদ্রলোক লিখতেন ওদের নিয়ে? ভাবুন!
-সেটা ঠিক, কিন্তু তা বলে কেউ জেনেশুনে এরকম কামনা করে নাকি নিজের জীবনের?
-আমরা করতাম। তা কিছুটা পূরণ হয়েছিল।
-মানে?
-এসে বলছি।
গল্প করতে করতে কখন আটটা বেজে গিয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই খেয়াল করিনি। গুন্টাকাল জংশনে ট্রেন থেমেছে তখন। পঁচিশ মিনিট থামার কথা এখানে। ডিনার এখানেই কিনে নেব ঠিক ছিল। মধুসূদন প্ল্যাটফর্মে নামল চা-নাস্তার আশায়। আমি রেলের ক্যাটারারের থেকে একটা নন ভেজ মীল নিলাম। বাড়িতে কথাও বলে নিলাম ফোনে সিগনাল আছে দেখে। ট্রেন যদি এরকমভাবে চালাতে পারে, তাহলে কাল রাইট টাইমেই পুণা ঢুকে যাব বুঝলাম। নিশ্চিন্তও হলাম। অজানা অচেনা শহরে যত সকাল সকাল যাওয়া যায়, ততই ভালো। কালকের দিনটা পুরো হাত খালি। পরশু থেকে কনফারেন্স শুরু হয়ে গেলে তো আর তেমনভাবে ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ পাবোনা। যদি কোথাও যাওয়া যায়, অন্তত পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক যাওয়াটা কালকেই সেরে ফেললে হয়। মধুর থেকে জেনে নিতে হবে অটো ট্যাক্সির ভাড়ার কথা।
হঠাৎ খেয়াল হল। একি, ছেলেটা গেল কোথায়। ট্রেনের গ্রীন সিগনাল দিয়ে দিয়েছে, ট্রেন মৃদু গতিতে চলা শুরু করেও দিল। কিন্তু মধু কই? তাহলে হয়ত অন্যও কোন কামরায় উঠে পড়েছে। পরের ষ্টেশনের আগে তো এখানে আসতেও পারবেনা। প্যান্ট্রিটা আমাদের ঠিক পাশেই বলে ভেস্টিবিউল একদিকে বন্ধ। আমি ডিনার সেরে হাত মুখ ধুয়ে নিজের জায়গায় ফেরত চলে এলাম। আশেপাশের কম্পারটমেন্টে লোকে একে একে বিছানা পেতে শোওয়ার আয়োজন করছে। ট্রেন জার্নিতে বেশীরভাগ লোকই রাত্রে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, আসলে তেমন কিছু করার থাকেনা বলে বোধহয়। আমিও বিছানা পেতে বই হাতে করে শুলাম। আডোনি, মন্ত্রালায়াম রোড, কৃষ্ণা সমস্ত ষ্টেশন গেল। এক মিনিট করে থামল। কিন্তু কই, মধুর তো দেখা নেই। ও কি তাহলে ট্রেনে উঠতে পারেনি? নাকি অল্প সময় থামছে বলে নামতে সাহস পাচ্ছেনা ট্রেন থেকে? হয়ত মাঝ্রাত্রে বড় স্টপে থামলে আসবে। ওর সীটে বিছানার চাদর কম্বল পরিপাটি করে ভাজ করে রাখা, ও আসলে হাতই দেয়নি ওতে। পিঠের ব্যাগটাও নিয়ে নীচে নেমেছিল, যাক অন্তত কিছু দরকার পড়লে সাথে থাকবে সব। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল, টেরই পাইনি। ঘুম ভাঙল যখন, দেখি সাতটা বাজে। ভাগ্যিস রোজের অ্যালার্মটা কাটিনি। এত আরামের ঘুম অনেকদিন পরে ঘুমিয়েছি। উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখলাম, তখনো মধু নেই। আহা রে, তাহলে হয়ত ট্রেন মিস করেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাগ গুছিয়ে বসলাম। আটটায় দউন্ড ষ্টেশন এলো। আমি উৎসুক হয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে রইলাম মধু কে দেখতে পাই কিনা ভেবে। ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোচ্ছে, দেখলাম অনেক দূরে, বেঞ্চিতে বসে মধু। আমায় হাত নেড়ে যাচ্ছে। বুঝলাম সারা রাত তার মানে অন্যও কোন কামরায় খালি সীটে কাটিয়েছে। একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল, ওর গল্পের পুরোটা শোনা হলনা।
সাড়ে আটটায় কোচ আটেন্ডেন্ট এলো বেড রোল ফেরত নিতে। আমার গুলো নিয়ে চলে যাচ্ছিল, আমি ডেকে বললাম,
- ভাইয়া উস সীটকা ভি লেলো। প্যাসেঞ্জার উতার গয়া।
-ক্যা ম্যাডাম? ক্যা লু উস সীট সে?
-ও বেড রোল।
-কহা হে? কুছ নহি হে ওয়াহা।
-ক্যা কুছ নহি? হে না ও।
-আরে ম্যাডাম ও পুরানা আখবার হে। প্যাসেঞ্জার নেহি হে তো বেড রোল কৈসে?
আমি উঠে গিয়ে দেখলাম যে সত্যি, ওখানে তো ১২ তারিখের টাইমস অফ ইন্ডিয়া রাখা। বম্বে এডিশন। বুঝলাম কোথাও একটা খুব বড় গণ্ডগোল হয়েছে। পুণায় নেমে চার্টে চোখ বোলালাম দরজায়। দেখলাম এ-১ এ আমার আশেপাশে কোথাও কারুর নাম নেই। মাথাটা কিরকম একটা ঘুরে গেল। কোনমতে অটো স্ট্যান্ডে গিয়ে বানের রোড বলে লাগেজ উঠিয়ে বসলাম। তিনদিন ছিলাম পুণাতে। রাস্তায় রাস্তায় অনেক হেঁটেছি, ফারগুসন কলেজ, এস পি ইউনিভারসিটি চত্বরে প্রচুর ঘুরলাম। ১৮ তারিখ ভোরবেলা বম্বের ট্রেনটা যখন ষ্টেশন ছাড়ছে, দূরে চায়ের স্টলে দেখলাম মধু দাঁড়িয়ে, হাতে চায়ের কাপ। হাসিমুখে আমায় হাত নাড়ছে।
No comments:
Post a Comment