Tuesday, September 26, 2017

বোধন

রথযাত্রার দিন থেকেই মজুমদার বাড়িতে একটা খুশীর হাওয়া বইতে থাকে। কাঠামো তৈরি হয় যে ওদিন থেকেই। শতাব্দী প্রাচীন এই মজুমদার বাড়ীর পুজো। এক কালে প্রায় একশো সদস্যর পরিবারের এখন বেশীরভাগই চাকরি, লেখাপড়া সূত্রে দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আশ্বিন মাস পড়লেই সবাই যে যার জায়গা থেকে ফিরে আসে এই বাড়ীতে, একসাথে পুজো করবে বলে। প্রাচীন এই পুজোয় নিয়ম কানুন মেনে চলা হয় প্রায় একদম প্রথম বছরের পুজোর মত করেই। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য সদস্যারা খেয়াল রাখেন যাতে ঐতিহ্যবাহী পুজোর নিয়মাবলী থেকে এক চুলও এদিক ওদিক না নড়ে। এই বছর এই দায়িত্বে রয়েছেন অশীতিপর সুরমা দেবী। বয়সেও যেমন প্রাচীন, তেমনি চিন্তাধারাতেও।  কাঠামো তৈরির দিন পুজোয় যেমন বাড়ির কাজের মেয়ে মলয়াকে ছুটি দিলেন, প্রথমে শুনে কেউ ভাবতেই পারেন যে হয়তো পূজা পার্বণ বলে ছুটি দিলেন, তা তো খুবই ভালো কথা। আসলে মলয়া সন্তানহীনা, আর তাই সুরমা দেবীর মতে, "অপয়া"। পুজোর কাজে কর্মে তাই তার আসা একদম বারণ। মিঠি, সুরমা দেবীর ছোট নাতনী, একবার বলার চেষ্টা করেছিল ঠাকুমাকে। ও ক্লাস এইটে পড়ে, ছোটবেলা থেকেই ঠাকুমার ন্যাওটা। পুজোর সমস্ত কাজে মা জেঠিমা ঠাকুমা পিসিদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে। তাই রথের দিন স্কুলে যায়নি, পুজোর কাজে সাহায্য করবে ভেবে। মলয়া মাসি ওর খুব প্রিয়, কিন্তু সেইদিন ওকে ছুটি দেওয়ায় ঠাকুমার কাছে কারণ জানতে পেয়ে খুব দুঃখ পেয়েছিল। " আচ্ছা ঠাম্মি, মলয়া মাসীর সন্তান হয়নি, তাহলে তো দেখো ওর কত দুঃখ। তার ওপর তুমি ওকে পুজোয় আসতে দিলে না কেন? আরো কষ্ট পেল তো মাসি।"
" শোন মিঠি, এই বাড়ির কিছু নিয়ম কানুন আছে। যা বুঝিস না, তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমাকে নিয়ম মানতে দে। "
" কিন্তু ঠাম্মি..."
" যা গিয়ে চন্দন কাঠটা ওপর থেকে নিয়ে আয়। তোর মাকে কখন থেকে বলেছি। স্কুলে গিয়ে যত ছাই পাঁশ শিখে আসে আর তারপর পটর পটর করা। আর হ্যাঁ, হাত পা ধুয়ে আমার পুজোর ঘরে ঢুকবি। যত অনাসৃষ্টি। "
মিঠি একদম একা, ওর দাদা দিদিরা কেউ আসেনি এখনো। সব্বাই বাইরে, হয় কলেজে নয় চাকরি করছে। ওর কথায় সায় দেওয়ার জন্য কেউ নেই। বাবা কে বললে বাবা বলবে, " নিয়ম যা, তা তো মানতেই হবে মা?" আর মা কে বললে সেই একই উত্তর, " মিঠি, গুরুজনদের কথা সব সময় মেনে চলতে হয়।" আচ্ছা, নিয়ম মানা, গুরুজনদের কথা শুনে চলা তো ভালো। কিন্তু নিয়মের তো কোন কারণ থাকা দরকার, তাই না? কে বোঝাবে।

মিঠি স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজ ঠাকুর দালান হয়ে আসে। পরাণ দাদু ঠাকুর বানায় আর ও বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে পরাণ দাদুকেই দেখে চলেছে, কি নিখুঁত করে প্রতিমা গড়ে। প্রথমে খড়ের ওপর কাদামাটি লেপে, তারপরে আসতে আসতে সেই মাটি শুকিয়ে গেলে রঙ। কাঠামো সঠিক না হলে রঙও ভালো বসবে না। ঠিক যেন মানুষের মন, সঠিক ভাবে তাকে লালন পালন করলে তবেই তো বিকশিত হবে। এখন তো ছোট বলে কেউ ওর কথা শোনেনা, কিন্তু ওকে বোঝাতেই হবে সকলকে।
দিন যায়, এসে পড়ে মহালয়া। পুজোর তোড়জোড় ভালো করেই চলছে মজুমদার বাড়িতে। ফুল কাকারা কাল আসবে দিল্লী থেকে। বনি পিসিরা আসছে পরশু, লন্ডন থেকে। সুমি দিদি এবারে একা আসছে, জামাইবাবু ছুটি পায়নি। লাল্টুদা, ঊর্মিদিরা আজ বিকেলেই। ভাবতেই কী আনন্দ হচ্ছে মিঠির। পঞ্চমী অবধি স্কুল আছে বটে ওর, কিন্তু এই কটাদিন স্কুলে তেমনভাবে কারুরই মন বসে না। কবে কোন জামা পরবে, কোথায় কোথায় ঘুরবে, কী খাবে, এই নিয়ে চলছে প্ল্যানিং। কিন্তু এইসবের মধ্যেই আরেকটা টেনশন এবারে মিঠিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। গত মাসের মত চললে, এবারে ঠিক ষষ্ঠীর দিনে ওর পিরিয়ডের ডেট। সারাটা বছর এত মুখিয়ে থাকে পুজোর এই পাঁচদিনের জন্য, পুজোর কাজ করতে এত ভালো লাগে। কিন্তু এইবার ডেটে ডেটে ওর পিরিয়ডটা এলে ঠাম্মি কিছুতেই ওকে ঠাকুর দালানেই আসতে দেবেনা। মা কে বলেও লাভ হবে না। মা তো সেই ঠাম্মির ভয়েই কাটিয়ে দিল জীবনটা।

বলে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। হলও ঠিক তাই। পঞ্চমীর দিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরেই টের পেল, শরীর ওকে জানিয়ে দিল আরো একবার, মেয়ে হওয়ার "জ্বালা"। মায়েরা সবাই মিলে বসে আনন্দনাড়ু গড়ছিল, কানে কানে মায়ের কাছে জানালো। আর ঠিক যেমন ভেবেছিল, মাও ওকে তক্ষুনি "কী সর্বনাশ, কেন এই অবস্থায় এই ঘরে ঢুকলি, এক্ষুণি এখান থেকে চলে যা। এই ঘরে আর আসবি না"  বলে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল। মুখ চুন করে মিঠি দোতলায় ওর নিজের ঘরে চলে গেল। জানলার ধারে বসে হাঁ করে নীচে ঠাকুর দালানে চোখ গেল ওর। দেখল, মা এক কড়াই নাড়ুর কাঁথ ফেলতে গেল রান্নাঘরের দিকে। দশমী অবধি ও থাকবে "অশুদ্ধ", আর পুজোর কোন কাজে তো থাকতে পারবেই না, তার ওপর আবার অষ্টমীর অঞ্জলিও দিতে পারবে না। ঠাম্মির এই বিধান। পুজোটা গেল ভেস্তে এইবারের মত।  মিঠি বুঝতে পারে না, এই যুগে এসেও কী করে পিরিয়ডের মতো অতি সাধারণ শারীরিক অবস্থাকে এমন বিচ্ছিরি নজরে দেখা হয়।

"কী মিঠি রানী? মুখ চুন করে বসে কেন? চল নীচে যাবি না? নাড়ু বানাচ্ছে তো সবাই।"
" সুমি দিদি? কখন এলে?"
" এই একটু আগে, একবার ভবানীপুরে গিয়েছিলাম। আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। ও কাল ইউ কে চলে যাবে,আর দেখা হত না পুজোয়, তাই। কিন্তু তুই নাড়ুর ওখানে না গিয়ে এখানে কেন?"
" আমার পুজোটা পুরো গেল সুমি দিদি। পিরিয়ড স্টার্ট হয়েছে আজকেই। "
" উফ, নিশ্চয়ই দিদান তার প্রাগৈতিহাসিক বিধান দিয়েছে?"
" হুম। কি করব বল।"
" আমি বুঝিনা, বাড়ির বাকি সকলে কেন এখনো এগুলো এলাউ করে। প্রত্যেকে শিক্ষিত, ঘরে বাইরে সমানভাবে পারদর্শী। তা সত্ত্বেও এই বস্তাপচা মনোভাব, শতাব্দী প্রাচীন নিয়ম মানে কেন?"
" গুরুজনদের অসম্মান হবে না মানলে দিদি। মা সারাক্ষণ এই বলে আমায়।"
" মামা মামীদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমার মাও কিছুই বলবে না। সব ওই সুরমা মজুমদারের চোখ রাঙানিতে কাত।"
" হ্যাঁ। নইলে ঠাম্মি এমন শুরু করবে। কে জানে হয়তো নির্জলা উপোস শুরু করে দিতে পারে। কিছুই বলা যায় না তাকে।"
"  তুই চিন্তা করিস না বাবু। আমি দেখছি কী করা যায়।"

খানিক বাদে ওদের সিংহবাহিনী দলের গভীর আলোচনা বসল মিঠির ঘরে। সিংহবাহিনী মানে ওরা সব খুড়তুতো পিসতুতো ভাই বোনেরা। মিঠির প্রতি এই অন্যায়ের কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। এবং ঠিক হল, ঠাম্মির পন্থাই অবলম্বন করা হবে। দল বেঁধে ওরা গেল ঠাকুরদালানে। সেখানে তখন সুরমা দেবীর নির্দেশে পুজোর ফাইনাল জোগাড়যন্ত্র করতে ব্যস্ত বাড়ির ছেলে বৌরা।

" কী হয়েছে দিদিভাই? সবাই হঠাৎ দল বেঁধে এখানে? আর এই মিঠি, তোকে বললাম না এইদিকে আসবি না। যা যা সরে দাঁড়া। সিঁড়িতে উঠিসনা। এক্ষুণি মোছা হয়েছে। চোদ্দবার মুছবার সময় নেই কারুর। "
" দিদান, আমরা একটা কথা জানাতে এসেছি তোমাদের। তোমার কথা অনুযায়ী, মিঠি যখন এইবারে পুজোর কোন কাজে থাকতে পারবেনা, পুজোয় কোনভাবেই অংশ নিতে পারবেনা, ওর বড় বড় দাদা দিদিরা হয়ে, আমরাও ওর সাথে থাকব। আমরাও কেউ কোনভাবেই পুজোয় থাকব না এইবারে। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।"
" এই এসব কী বলছিস সুমি?"
" মা, তুমি থামো। আমি দিদানের সাথে কথা বলছি। তুমি মাঝখান থেকে এসো না প্লীজ।"
" দেখলি বিনু? তোর মেয়ের কথার ছিরি? হ্যাঁ রে সুমি, তুই কি জানিস না কেন মিঠিকে আমি বারণ করেছি?"
" জানি, কিন্তু তোমার কারণ কোন কারণই না। তাই জন্যই ও যদি বিনা কারণে বাদ পড়ে পুজো থেকে, তাহলে আমরাও বাদ।"
" বিনা কারণে মানে? ও তো এখন অশুচি।"
" অশুচি আবার কি দিদান? পিরিয়ড হওয়া অশুচি?"
" অবশ্যই।"
" মোটেই না। পিরিয়ড একটি অতি সাধারণ শারীরিক অবস্থা। যেমন হাঁচি কাশি হয়, তেমনি। না, ভুল বললাম। হাঁচি কাশি তো অসুখ। যেমন হার্ট বিট করে প্রতি মুহূর্তে, যেমন শ্বাস প্রশ্বাস নিই মারা, ঠিক তেমনি মাসে একবার করে আমাদের মেয়েদের পিরিয়ড হয়। এতে অশুচির কি দেখলে?"
" না। শাস্ত্রে লেখা আছে। "
" কোথায় দেখাও? আর থাকলেও, সেই শাস্ত্রও গুলি মারো। আর হ্যাঁ শোন, অম্বুবাচীর সময়ে যে তোমার ঠাকুরেরও পিরিয়ড হয়? সেই বেলা? ঠাকুর তখন অশুচি? বলো?"

সুরমা দেবী কিচ্ছু বলেন না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন নিজের নাটি নাতনিগুলোর দিকে। সেদিন রাত্রে কোনোমতে সবাই খেয়ে ঘুমোল। পরের দিন সকাল সকাল সবাই উঠে স্নান সেরে ফেলল। বাড়ির বড়রা পুজোর দালানে বসে। কিন্তু সুরমা দেবীর তখনো দেখা নেই। ঠাকুরমশাই চণ্ডীপাঠ শুরুর জন্য তৈরি, সুরমা দেবী আসলেই হয়।

" কী রে দাদা? মা তো এখনো এলো না? কোথায় গেল?"
" হ্যাঁ রে বনি। আমিও তো তাই ভাবছি। মা তো লেট করেনা কখনো। হল কি?"
" বৌদি মা কে দেখেছো সকাল থেকে? "
" হ্যাঁ বনি। মা কে তো সকাল সকাল দেখলাম বাগানের দিকে যাচ্ছিল, ফুলের সাজি হাতে নিয়ে। হয়তো ঠাকুর ঘরে দেরী হয়ে গিয়েছে। দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি। "
" হ্যাঁ। বাচ্চাগুলোও কিরকম মিছিমিছি গোঁয়ারপনা করছে দেখো তো। আদ্যিকালের নিয়ম, যেমন চলে আছে, মেনে নে না বাবা। কি ফালতু ফালতু পুজো আচ্চার মধ্যে ব্যতিক্রমী হওয়ার চেষ্টা।"

" কিচ্ছু গোঁয়ারপনা না। আমার নাটি নাতনিরা যা করেছে, একদম ঠিক।"
ঠাকুর দালানে উপস্থিত সক্কলে তাকিয়ে দেখল, সুরমা দেবী, সাথে তার সিংহবাহিনী। সুরমা দেবী ডান হাত দিয়ে মিঠির হাত ধরে উঠলেন ঠাকুর দালানে।
" শোন, যে নিয়ম, আচার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, তা যে এখনো মানতে হবে, তা মোটেই না। এইসব নিয়মের না কোন মানেই নেই। কাল আমার নাতি নাতনিগুলোর কথা অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম। আর তখনই বুঝলাম, যে যা করছি, একদম ভুল। সব্বাই মিলে সব রকম ভেদাভেদ ভুলে আমরা এই কতাদিন আনন্দ করব, মায়ের পুজো করব। দুর্গা তো আমাদের মেয়ে, এক মেয়ের আদরে আরেক মেয়ে সুযোগ পাবে না কেন? আমাদের কি বুকে এতটুকু ভালোবাসা নেই? আর হ্যাঁ, মলয়ার প্রতিও আমি অন্যায় করেছি। আমি নিজে ওর কাছে ক্ষমা চাইব। ওকে ডেকে পাঠিয়েছি। ও আসুক। তারপর সবাই মিলে একসাথে পুজো শুরু করা হবে। "

ঠাকুর দালানে তখন দেবী দুর্গার সাথে সাথে মর্ত্যবাসীদেরও শুভ বুদ্ধির বোধন হল।







Saturday, September 23, 2017

গন্ধ


" হ্যাঁ দিদি, আমি এই মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ছি। চিন্তা করো না। সব রেডি। আজকের ইন্টার্ভিউটা দারুণ হবে। " ফোন নামিয়ে রেখে একবার আয়নায় নিজেকে জরিপ করল কস্তুরী, কস্তুরী সেন , ট্রেনী জার্নালিস্ট, তিতলি পত্রিকার। তিতলি একটি মহিলা কেন্দ্রিক পাক্ষিক পত্রিকা, মোটামুটি এই সেগমেন্টের প্রথম পাঁচের মধ্যে পড়ে। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, ভ্রমণ, রন্ধনশিল্প, সাহিত্যকলা ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে তিতলি হাজির হয় পাঠকদের কাছে। কস্তুরী এতদিন সিনিয়র দিদিদের সাথে ইন্টার্ভিউগুলিতে যেত, শুনত, শিখত। আজও তাই যাওয়ার কথা ছিল। বিখ্যাত অন্ট্রেপ্রেনিউর, শ্রী সৌরভ বণিক অনেক টালবাহানা করে অবশেষে আজ দুপুর বারোটার সময় ওদের ম্যাগাজিন থেকে আসতে বলেছিলেন। শ্রুতিদির কথা ছিল এটা কাভার করার, সাথে থাকত কস্তুরী, কিন্তু গত সপ্তাহে একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটিয়ে শ্রুতিদি আপাতত শয্যাশায়ী। আর তার ফলে ইন্টার্ভিউয়ের দায়িত্ব এই প্রথম বার, পুরোটাই পড়েছে কস্তুরীর ঘাড়ে।

অনেকদিন ধরেই কস্তুরীর মনের কোণে একটা আশা ছিল, একদিন ও একা গিয়ে কোন বড় মাপের মানুষের ইন্টার্ভিউ নেবে, সেই ইন্টার্ভিউ ছাপার পর দিকে দিকে ওর নাম সবাই জেনে যাবে। তাই সৌরভ বণিকের ইন্টার্ভিউটা ওকে আজ যেমন করেই হোক, ভালো করতেই হবে। নিজের প্রিয় সুগন্ধী হাল্কা করে গায়ে লাগিয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কস্তুরী অফিসের পাঠানো ক্যাবে গিয়ে বসল। ভদ্রলোকের বাড়ি মালঞ্চগ্রাম নামে এক জায়গায়, কলকাতা থেকে প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ। গাড়িতে বসে অসে তাই কস্তুরী ওনার বিষয়ে জোগাড় করা সমস্ত তথ্যে আরেকবার চোখ বোলাতে লাগল। শ্রুতিদি যখন কোন কাজ করে, এত নিখুঁত ভাবে করে, এই ফাইলটা দেখে নতুন করে শ্রুতিদির প্রতি কস্তুরীর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

সৌরভ বণিকের পরিবারের ব্যবসা কেমিক্যালসের ও রঙের, প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি। অবশ্য সেই ব্যবসার হাল তেমন আহামরি কিছু নয়। সৌরভ  নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, বিদেশের নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে গবেষণা করে দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন এবং এক লাফে পাঁচ বছরের মধ্যেই বণিক কেমিক্যালসের নাম সারা দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। ব্র্যান্ডের নামী সুগন্ধীগুলোর মতই কোম্পানীর নাম যশ দিকে দিকে। বহু পুরস্কার এসেছে ঝুলিতে। আজকের এই ইন্টারভিউটির মাধ্যমে তিতলি থেকে এই নবীন ব্যবসায়ীর উত্তরণের কাহিনী জনগণের কাছে আসতে চলেছে।

সৌরভ বণিক তেমন বেশী প্রচারে থাকেন না। উনি তেমনই ব্যক্তি যিনি কাজ দিয়েই নিজেকে চেনাতে চান সকলের কাছে। তাই এই সাক্ষাৎকারটি দিতে তিনি সহজে রাজী হন নি। শ্রুতিদির পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা করার পরে আজ বেলা বারোটার সময় দিয়েছেন উনি তিতলিকে। তিতলির হয়ে কস্তুরীকে তাই আজ নিজের সেরাটুকু দিতেই হবে, বারবার করে পাখি পড়ার মত শ্রুতিদি বলেছিল। পৌনে বারোটা নাগাদ ওরা পৌঁছল মালঞ্চগ্রামে, বণিক বাড়ী। বিশাল তিনতলা বাড়ী, প্রায় অট্টালিকা বলা চলে। সামনে সুসজ্জিত বাগান। গাড়িটা উল্টোদিকের রাস্তায় গাছের তলায় রাখতে বলে কস্তুরী ধীর পায়ে এল সদর দরজায়। অদ্ভুত লাগল, এত বড় বাড়ি, অথচ কোন দারোয়ান নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খানিক অপেক্ষা করে, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজতে ও কলিং বেল বাজালো। একটা মিষ্টি পাখির ডাক, বেশ খানিকক্ষণ বাজল। দুই তিন মিনিট হয়ে গেল, অথচ কোন সাড়াশব্দ নেই কারুর। আরেকবার বেল বাজালো কস্তুরী। কিন্তু তারপরেও কোন শব্দ নেই প্রায় পাঁচ মিনিট। কি করবে, ফেরত যাবে, নাকি ভদ্রলোককে ফোন করবে, ভাবতে ভাবতে এমন সময় দরজা খুলে গেল। অপর প্রান্তে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, উনিই সৌরভ বণিক। গত তিন চারদিন ধরে ওনার বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে কতবার যে এই চেহারাটাকে দেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এক মাথা কুচকুচে কালো চুল, ফর্সা গোল মুখ, কুতকুতে দুটো চোখ। আর সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেটা, ঠোঁটের ওপরে একটা কালো আঁচিল।

"নমস্কার। আমি কস্তুরী সেন, তিতলি পত্রিকা থেকে আসছি।"

"আর শ্রুতি মুখোপাধ্যায়? উনি কই?"

"শ্রুতিদির একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, শয্যাশায়ী। তাই আসতে পারেননি, আপনার সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিয়েছিল গত কাল।"

"ও আচ্ছা। দিলীপ গত তিনদিন ধরে আসছেনা। তাই আমি জানতাম না। আসুন। বসুন।"

ঘরে ঢুকে কস্তুরীর দু চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এত সুন্দর আরটিস্টিক ভাবে সাজানো গোছানো ঘর, দেওয়াল জুড়ে দুর্দান্ত কিছু অয়েল পেন্টিং, ক্যাবিনেট জুড়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের থেকে জড়ো করা স্যুভেনির। বইয়ের তাকে ভর্তি ভর্তি রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, কোলরিজ, হেমিংওয়ে।

" বসুন। চা খাবেন তো? দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।"

" না না ঠিক আছে, লাগবে না। আপনি আবার কষ্ট করতে যাবেন কেন?"

" আরে কিছু হবে না। আমার কাজের লোকগুলো রবিবার করে ছুটি নেয়, আমার অভ্যেস আছে চা করার। পাঁচ মিনিট সময় দিন, আসছি।"

মিনিট দশেক পরে সৌরভ বণিক ঘরে ঢুকলেন, হাতে চায়ের ট্রে আর কিছু কুকিজ নিয়ে। সুগন্ধীর ব্যবসা বলে বোধহয়, বাড়িতে ঢোকা ইস্তক কস্তুরী একটা মিষ্টি সুবাস পাচ্ছে। চায়র কাপ হাতে নিয়ে সেখান থেকেও পেল জ্যাস্মিনের সুগন্ধ।

" দার্জিলিং থেকে আনানো, স্পেশাল জ্যাসমিন টি। খান। ভালো লাগবে। অপূর্ব গন্ধ। স্বাদও অতুলনীয়।"

" হ্যাঁ নিচ্ছি। ধন্যবাদ।"

"রিলাক্স করে বসুন। এত আড়ষ্ট হয়ে আছেন কেন? আরাম করে বসুন। হাতে অনেক সময় আছে। চা টা খান, তারপরে সাক্ষাৎকার শুরু হবে। "

" হ্যাঁ ঠিক আছে। আমি এমনিও গরমে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা, বরং আপনার ইন্টার্ভিউ শুরু করি? কিছু যদি মনে না করেন। আসলে সময় তো বেশী নেই, এক ঘণ্টার মোটে শিডিউল।"

" বেশ। তাহলে শুরু করুন প্রশ্ন। তবে একটা কথা। আমি কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারি, আর আগে পরেও দিতে পারি। ঠিক আছে?"

"বেশ, তাই হবে। তাহলে শুরু করি? আমি কিন্তু রেকর্ড করব উত্তর।"

" আপত্তি নেই।"

" আচ্ছা সৌরভ বাবু, প্রথম প্রশ্ন। আপনি ছোট থেকে কি ভেবেছিলেন পারিবারিক ব্যবসায় আসবেন?"

"অবশ্যই। বাবা দাদুকে ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করতে দেখে আমিও তখন থেকে ভাবতাম যে একদিন এই ব্যবসায় যোগদান করব। তবে, আমার কিন্তু সেকেলে নিয়ম কানুন, ব্যবসার নীতি ভালো লাগত না। আর তাই বিদেশ থেকে আমি পড়াশোনা করে আসি। এসে ব্যবসার হাল ধরে আজ একটা অনেক diversify করেছি। "

" ঠিকই। আপানদের তো আগে বোধহয় কেমিক্যালস আর রঙের ব্যবসা ছিল শুধু? এখন তো এ ছাড়াও অনেক অন্যান্য প্রোডাক্ট আছে। একটু সেই বিষয়ে বলুন।"

" দেখুন বিদেশে থাকাকালীন যেটা আমি রিয়েলাইজ করি, সেটা হল, দেশে ফিরলে পরে বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা যেই গিফট পেলে সবচেয়ে খুশী হয়, তা হল সুগন্ধী। তখনই এর কারণ ভাবতে গিয়ে বুঝলাম যে কস্তুরীমৃগের দেশ এখানে হলেও, আমাদের দেশে সুগন্ধীর প্রোডাকশন কোয়ালিটি মন্দ। তাই ডিমান্ড থাকলেও দেশীয় জিনিসের সাপ্লাই নেই, তাই এই সুগন্ধীর মার্কেটটা ট্যাপ করার খুব ইচ্ছে হল আমার। সেই ইচ্ছে থেকেই এরপর শুরু হল আমাদের কোম্পানির নতুন ডিভিশন যেখানে  আমরা মূলত এরোমাথেরাপি ও সুগন্ধী নিয়ে কারবার করি।"

" আচ্ছা। সৌরভ বাবু, এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আপনার সবচেয়ে প্রিয় ফ্রেগ্রেন্স কি?"

" বলব, রাদার, শোঁকাব। একটু সময় দিন। জিনিসটা আমার কাছে খুব স্পেশাল, তাই তাড়াহুড়ো করতে চাইনা। সময় লাগবে, কিন্তু আমি আপনাকে ডেমো দেব। অন্য কোন প্রশ্ন থাকলে করুন।"

 এরপর আরো খানিকক্ষণ চলতে লাগল কস্তুরীর প্রশ্নপর্ব। সৌরভ বণিকও হাসি মুখেই উত্তর দিলেন। ইতিমধ্যে চা শেষ হয়ে যাওয়ায় ভদ্রলোক বললেন, " চলুন তাহলে। আপনাকে আমার ল্যাবরেটরিটা দেখিয়ে আনি। ওখানেই আমার প্রিয় কিছু গন্ধ রাখা আছে। আপনি দেখতে পাবেন।"

যে আঁতুড়ঘরে সৃষ্টি হয়েছে কিছু বাজার কাঁপানো গন্ধ, যেখানে জন্ম নিয়েছে কিছু যুগান্তকারী বিউটি প্রোডাক্ট, সেইখানে যে সৌরভ বণিক কস্তুরীকে নিয়ে যাবেন, ও ভাবতেই পারেনি। তাই প্রস্তাবটা শুনে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

" কি হল? চলুন? দেখবেন না আমার ল্যাব?"

" হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আসলে আমি ভাবছিলাম যে এরকম একটা সুযোগ পেলাম। কিন্তু সাথে ক্যামেরাম্যানকে আনিনি। ছবি মিস হয়ে যাবে।"

" না না। ছবি তুলতে এমনিও দিতাম না। আপনাকে আলাদা করে দেখাচ্ছি। জনগণকে আমার ল্যাব, আমার কর্মকাণ্ড দেখাতে চাইছিনা এক্ষুনি। হ্যাঁ, আপনি বরং আপনার মোবাইলটাও এখানেই রেখে যান। ভিতরে গিয়ে সিগন্যাল পাবেন না। ভুল করে যদি ছবি তুলে ফেলেন, তখন মুশকিল হয়ে যাবে।"

" আমি ছবি তুলবনা আপনি বারণ করলে।"

" হ্যাঁ। সে ঠিক আছে। কিন্তু ফোনটা রেখে যান। চিন্তা করবেন না। আমার বাড়িতে এখন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। মেন গেটও লক করা আছে। ফোন চুরি যাবে না। আপনি আসুন।"

অগত্যা কস্তুরী বাধ্য হয়েই নিজের ফোনটা সেন্টার টেবিলে রেখে সৌরভ বাবুর পিছন পিছন হাঁটা শুরু করল বাড়ির ভিতর। একটা লম্বা করিডর, আর তার দুইদিকে সার দিয়ে কিছু ঘর। প্রত্যেকটা ঘরেই তালা বন্ধ। এক তলা বলে করিডরে তেমন আলো ঢুকছেনা। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা ফেলে চলতে চলতে অবাক হয়েই চারিদিক দেখছিল কস্তুরী। ঘরগুলির পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটা অদ্ভুত ধরণের ভয় করছিল ওর। সম্বিৎ ফিরল সৌরভের কোথায়, " এই সমস্ত ঘরবাড়ি এক কালে লোকে ভর্তি থাকত। আমাদের যৌথ পরিবার এখন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সবাই এদিক সেদিকে ছড়িয়ে আছে। আমার বাবা মা বেনারসে গিয়েছেন। কালি পুজোর পরে ফিরবেন। এটাই ওনাদের প্রতি বছরের নিয়ম। তাই আর কি বাড়ি এত খালি দেখছেন। আমি একা থাকব, কাজের লোকদেরও তাই ছুটি দিয়েছি। একজন মাসি এসে সপ্তাহে তিনদিন ঘরদোর ঝাঁট মোছ করে যায়। আমার রান্নাবান্না আমি নিজেই করে নিই। রান্না আমার আরেকটা প্যাশন।"

" ও! তাই? বেশ, ইন্টারেস্টিং, যে রাঁধে সে গন্ধও বেচে।"

" ওই রকমই। চলুন। আমরা এসে পড়েছি, এই এইটা আমার ল্যাব। আপনি বসুন। আমি আরেকটা চেয়ার নিয়ে আসছি। "

এই বলে সৌরভ ল্যাবের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। সেখান থেকে তারপরে বেরোলেন একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা কাঠের বাক্স নিয়ে। কস্তুরীর সামনে বসে বাক্সটার লোক খুলতে খুলতে বললেন, " এই বাক্সের মধ্যেই রয়েছে আমার কিছু পছন্দের গন্ধ। আপনার চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখছেন তো কত শিশি ভর্তি তাক? সেইরকমই কিছু ভায়াল আমার এই বাক্সে আছে। "

কস্তুরী তাকিয়ে দেখল, ঘরের আলো কম হওয়ায়, এতক্ষণ নজরে আসেনি। ঘরময় বেশ কিছু শেল্ফ, আর প্রতিটি শেল্ফে রাখা সারি দিয়ে কাঁচের শিশি।

" এইটা দেখুন, শুরু করছি এইটা দিয়ে। এতে রয়েছে এক ধরণের জংলা ফুলের এসেন্স। আমি কিছু বছর আগে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, তখন হঠাৎ করেই হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এই ফুলগুলির সন্ধান পাই। শুকে দেখুন। "

কস্তুরীর নাকের ডগায় কমলা রঙের তরলযুক্ত ভায়ালটা ধরলেন সৌরভ। একটা অদ্ভুত রকমের মাদকতা মিশ্রিত সুগন্ধ ওর শরীরে হিল্লোল তুলল।

" অপূর্ব। এটি আপনার কোন প্রোডাক্টে ব্যবহার করেছেন বলবেন? আমি কিনতে চাই। "

" নিজের সবচেয়ে প্রিয় গন্ধগুলো সম্পূর্ণ আমার কস্তুরী। আমি ওইগুলো বিক্রি করে কারুর সাথে ভাগ করে নিতে চাই না। দাঁড়ান, এর পরেরটা দেখুন। শান্ত হয়ে বসুন। "

একটা হাল্কা বেগুনি রঙের তরল ভর্তি ভায়াল এরপর ওর নাকের সামনে এনে ধরল সৌরভ।

" এটি আমি চায়নাতে পাই। যখন গ্রেট ওয়ালের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম, আবারও পথের ধারের কিছু জংলা ফুল কুড়িয়ে পাই। তবে আশ্চর্যভাবে ফুলের চেয়েও পাতার গন্ধ আমায় বেশী টানে। এটি সেই গন্ধ। "

প্রায় মিনিট দুই তিনেক সৌরভ ওর সামনে ওই ভায়ালের ঢাকনা খুলে কস্তুরীকে শুঁকতে দিল ওই গন্ধ।

" কি দুর্দান্ত! আপনি যে কেন এই গন্ধ বিক্রি করেন না। আমার তো মন চাইছে খালি এটাই শুঁকে যাই। মাথাটা কি সুন্দর হাল্কা লাগছে। "

" বেশ তো, খানিকক্ষণ শুঁকুন। আমি তো ধাপে ধাপে আমার প্রিয় গন্ধগুলি আপনাকে দেখাচ্ছি। এরপরের কয়েকটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওগুলোর লাইভ ডেমো দেব। আগে এইটা শেষ হোক। "

এরপরে হলুদ, খয়েরী, নীল বিভিন্ন রঙের ভায়ালের থেকে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কস্তুরীর দু চোখের পাতা কখন এক হয়ে গিয়েছিল, ও টেরই পায়নি। চোখ মেলে দেখল ওর সামনে সৌরভ বণিক বসে। নিজেকে একটু ধাতস্থ করতে গিয়ে টের পেল, হাত দুটো বাঁধা।

" এ কি? আমার হাত বাঁধা কেন?"

" আসলে এবারে আমার সবচেয়ে পছন্দের গন্ধ প্রস্তুত করব। তখন সেই গন্ধ তৈরির সময়ে আপনি পাগল হয়ে ছটফট করতে পারেন। আর তাতে আমার কিঞ্চিৎ অসুবিধে হবে। সেই জন্যই এই প্রিকশন। "

" সে আবার কি? ছটফট করব কেন? "

" আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা তাই বলছে। সুগন্ধীর সাবজেক্টরা ছটফট করে বইকি। তারপরে মিইয়ে যায়। বারবার বলা সত্ত্বেও শোনেনা। তাই এই পন্থাটি নিতে হল। দুঃখিত।  "

" সাবজেক্ট? তার সাথে আমার কি সম্পর্ক? কিছু বুঝছি না। "

" সব বুঝে যাবেন। একটু ধৈর্য রাখুন। "

" এ কি? আপনি ছুরি নিয়ে আসছেন কেন এদিকে? "

" চুপ। বললাম না। "

" আলো নেভাচ্ছেন কেন? "

" মোমবাতিটা জ্বালাবো, আর আলো লাগবে না। আপনি শান্ত হোন কস্তুরী। আমার সুগন্ধী তৈরির সময়ে এত কথা আমি একদম পছন্দ করিনা। আপনি কথা বললে কিন্তু মুখে কাপড় দিতে বাধ্য হব। প্লীজ আমায় দিয়ে অপ্রিয় কাজ করাবেন না। "

" আপনি ছুরিটা দূরে রাখুন। লেগে যাবে আমার। "

" দূরে রাখলে তো ম্যাডাম আমি সুগন্ধী পাব না। "

" প্লীজ সৌরভ বাবু, পাগলামি করছেন কেন? আমি চাই না আপনার প্রিয় সুগন্ধের হদিশ। আমার বাঁধন খুলুন। "

" তা বললে কি আর হবে ম্যাডাম? সিকুয়েন্স অনুযায়ী চলছি। মাঝপথে বেরোনো যাবে না। এখন আপনি চুপটি করে বসুন, নইলে বেশী ব্যথা লাগবে। ও মা আপনি এত তাড়াতাড়ি ঘামতে শুরু করে দিলেন? বাহ। অন্যান্যবার তো আমায় ফ্যান বন্ধ করতে হয়। আপনি ভারী লক্ষ্মী মেয়ে তো। ঘাম এসে গিয়েছে। এবারে একটু রক্ত আসুক। দুটো মিশুক।"

" সৌরভ বাবু, প্লীজ।"

" তখন থেকে কি প্লীজ প্লীজ করে চলেছেন বলুন তো?  আপনাকে কথা দিচ্ছি, খুব বেশী লাগবে না। ব্যস, একটা মোটে কাটব। পরে আপনাকে পেন কিলারও দিয়ে দেব। আপনি জানেন না, কাঁচা রক্ত আর তার সাথে মেশা ভয়ার্ত মানুষের শরীরের ঘাম...অনবদ্য এক পাগলকরা গন্ধ সৃষ্টি করে। আমি আগে বহুবার এটা অনুভব করেছি। ভারী ভালো লাগবে। একটু স্থির হয়ে বসুন, আপনাকেও শোঁকাব।"

" বাঁচাও। কে আছো? প্লীজ হেল্প!"

" চীৎকার করে লাভ নেই কস্তুরী। বাড়িতে আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বললাম না কাজের লোকেদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি?"

" প্লীজ, এরকম করবেন না। আমার লাগছে।"

" ছুরিটা ঠিক করে বসল না আর এর মধ্যেই লাগছে?"

" হেল্প! হেল্প! "

" আপনি চীৎকার করুন। নিজেরই ক্ষতি, ঠিক যেই গন্ধটা আমি চাই, সেটা আসতে আরো দেরী হবে। ভালো। আমার কি? দিনের শেষে আমার গন্ধ পেলেই হল!"

" আহা, লাফঝাঁপের চেষ্টা করবেন না প্লীজ। লেগে যাবে। আমি কিন্তু ছোট্ট একটা কাট করছি, আপনি এত নাড়ালে কিন্তু উন্ডটা বড় হয়ে যাবে। ঠিকঠাক গন্ধ পাব না। তখন আমায় আবার আপনার ডান হাতে এটেম্পট নিতে হবে। "

টুপ টাপ টুপ টাপ। কস্তুরীর রক্তের ফোঁটা, ভয়ের ঘাম মিলে মিশে একাকার। নতুন কাঁচের ভায়ালে বন্দী হতে থাকে আদিম সুগন্ধী। প্রিয় গন্ধ সঞ্চয় হতে দেখে সৌরভ বণিকের মুখে ফুটে ওঠে এক পৈশাচিক হাসি, মোমবাতির আলোয় যা মনে করিয়ে দেয় যে কোন হিংস্র পশুকে। চেয়ারে নেতিয়ে পড়ে থাকে সাবজেক্ট, কস্তুরী।

           *********************************************

( গল্পটা পড়ে হয়তো পারফ্যুম সিনেমাটির কথা মনে হতে পারে। আমার অবশ্য সিনেমাটির বিষয়ে কোন ধারণা ছিল না। আদ্ধেক লেখার পরে প্লটটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে জেনেছি। )

Thursday, September 21, 2017

জিয়া নস্টাল

ধুর, অফিসের ছুটিটা স্যাঙ্কশন হল না। অনেক করে শুভ বলল ম্যানেজারকে, কিন্তু তিনি আর কি বুঝবেন দুর্গা পুজোর সেন্টিমেন্ট। সমানে বলে গেল, projectএর এখন যা অবস্থা, কিছুতেই ছুটি দেওয়া সম্ভব না। এত বড় উজবুক, আবার বলে কিনা "তুমি না হয় দীপাবলিতে যাও।" আরে বাবা, না হয় কালি পুজোয় বাজি ফাটানো, আলো দিয়ে বাড়ি সাজানোতে আনন্দ আছে, কিন্তু কোনভাবেই কি তা দুর্গা পুজোর সাথে তুলনা করা যায়? কে বোঝাবে। খুবই বিরক্তি সহকারে নিজের কিউবিকলে এসে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ের মেসেজ। " বাবু, ছুটি পেলি?" মেসেজটা দেখে হঠাৎ রাগ চলে গিয়ে শুভর প্রচণ্ড কান্না এলো। এই প্রথম ওর সারা জীবনে পুজোয় বাড়ির থেকে এত দূরে থাকবে। একটা দুঃখ দুঃখ স্মাইলি পাঠিয়ে মা কে উত্তর পাঠালো শুভ। কি আর করবে, দাঁতে দাঁত চিপে, বুকে পাথর রেখে মেনে নিয়েই চলতে হবে। এইটাই বোধহয় বড় হওয়ার সাইড এফেক্ট। কোচিতে পুজো হয় ঠিকই, কিন্তু ও যেখানে থাকে, তার চেয়ে অনেকটা দূরে। অফিসে ছুটি না পেলে সন্ধ্যেবেলা টায়ার্ড হয়ে আদৌ যাওয়া হবে কি না সন্দেহ। তেমন বিশেষ চেনাজানা কেউ নেই যে একসাথে যাবে। একা একা কি আর ভালো লাগে না কি।

মনে পড়ে গেল, ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সাত্যকিরা পুজোয় সিমলা কুলু মানালি বেড়াতে যাচ্ছে শুনে ওরও কি বায়না বাড়িতে। কি? না ওকেও পুজোয় বেড়াতে যেতে হবে। সেইবারে মা বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, পুজোর পাঁচটা দিন, কোনভাবেই পাড়ার পুজোটা ছেড়ে কোত্থাও যাবে না ওরা। খুব মন খারাপ হয়েছিল শুনে, তখন নিজেদের ওই ছোট্ট পুজোটাকেই ভিলেন মনে হত। সব বন্ধুরা কি সুন্দর হয় হোল নাইটের প্ল্যান করছে, নয়তো কেউ কাশ্মীর যাচ্ছে। অথচ বাবা মা পাড়ার প্যান্ডেল ছেড়ে কোথাও যাবেই না। শুভর জন্য পুজো মানেই তাই শুধুমাত্রই গলির মোড়ের প্যান্ডেল। পঞ্চমীর দিন দুপুর থেকেই মায়ের ব্যস্ততা শুরু, সন্ধ্যেবেলা আনন্দমেলার জন্য ঘুগনি আর মোচার চপ বানানোর তোড়জোড়। তারপর ষষ্ঠীতে বিকেলে বোধনের পুজো, সপ্তমীর সক্কাল সক্কাল কলাবউ স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া, ফিরে এসে আবার পুজো, অষ্টমীর ভোগ রাধা, অঞ্জলির জন্য বাড়তি লোকবল চাই বলে ওদের পুরো গ্রুপটাকে ধরে বেঁধে হাতে হাতে সাহায্য করতে বসিয়ে দেওয়া, সন্ধিপুজোর জন্য পদ্ম বাছা, নবমীতে ভোগ বিতরণের সময়ে কুচেকাচারা মিলে সবার প্লেটে নুন আর বেগুনি দেওয়া। এই করেই কেটে যেত শুভর পুজোর কটা দিন। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেই বার কোন মাঝারী মাপের স্পন্সর জুটেছিল বুঝি, তাই একটু আড়ম্বরের সাথেই পুজোটা হয়েছিল। সকাল থেকেই রোজ মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নয়তো বাজলো তোমার আলোর বেণু। কান ঝালাপালা হয়ে যেত। তারই মধ্যে বিকেলের নাটকের জন্য শেষবার রিহার্সাল করা, সেখানে তখনও ডায়লগ ভুল বলার জন্য প্রীতিময় কাকুর থেকে বকা খাওয়া। তখন আবার চলত পাশের ঘরেই কাকিমার তত্বাবধানে সৌরভীদিদের নৃত্যনাট্যের প্র্যাকটিস। একটু আধটু উঁকিঝুঁকি যে হত না, তা নয়। সন্ধ্যেবেলায় এরা সবাই মাঞ্জা দিয়ে এসে স্টেজ কাঁপিয়ে অনুষ্ঠান করত। পুজোতে ওদের গোটা পাড়া পুরো একটা পরিবারের মত থাকত, ঠিক সেই সময়কার শালিমারের বিজ্ঞাপনের মতই। আরেকটু বড় হতে স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে একদিন কি দুদিন বেরোনো। ওই ম্যাডক্স স্কোয়ার, সমাজসেবী, বালীগঞ্জ কালচারাল, আর তারপরে হাটারিতে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়া। কবে যে পুজো মানেই কলকাতা আর ওদের পাড়ার ছোট্ট প্যান্ডেল একাকার হয়ে গেল, খেয়ালই করেনি।
ডেস্কটপে একটা কোড রান করতে দিয়ে ফেসবুকটা খুলতেই আবার যেন এক রাশ বিরক্তি গ্রাস করল শুভকে। টাইমলাইন জুড়ে শুধুই পুজো আর পুজো। পুজোয় কে কবে কোথায় ঠাকুর দেখতে যাবে, কোন প্যান্ডেলে কি হচ্ছে, বৃষ্টি পড়বে কি পড়বে না, কুমোরটুলির ছবি, বাপরে। Whatsapp খুললেও বিভিন্ন গ্রুপে শুধুই প্ল্যান আর প্ল্যান। বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে। সারা বছর কষ্ট করে ছুটি না নিয়ে কাজ করে করে শেষমেশ পুজোতেও এখানে কাটাতে হবে ভেবে ডিপ্রেশনে যায় যায় অবস্থা এখন শুভর। তারই মধ্যে লাঞ্চ টাইমে অফিস ক্যান্টিনে ওই জোলো সাম্বার আর ট্যামারিন্ড রাইস। ওয়াক উঠে আসার জোগাড়। সেদিন অনেকটা রাত্তির করেই শুভ ফিরল অফিস থেকে। খেতে খেতে চলল মায়ের সাথে ফোনে কথা।
" মা পুজোর তোড়জোড় কেমন চলছে?"
" ভালোই রে বাবু। এই তো জোর কদমে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। এবারে তোর নিলয় কাকু প্রেসিডেন্ট, বেশ জমজমাট আয়োজন করেছে। প্রচুর টাকা ঢেলেছে পুজোয়।"
" বাহ, ভারী ভালো কথা তো। ইস, খুব মিস করছি মা। জানো আজ টিকিটটা ক্যান্সেল করার সময় এত মন খারাপ লাগছিল কি বলব। কতদিন ধরে আশায় আশায় ছিলাম পুজোয় বাড়ি যাব। ধুর। ভাল্লাগেনা।"
" জানি তো বাবু। আমারও ভালো লাগছেনা।"
" বাবা এবারে নাটকে আছে?"
" না। এবারে তো পাড়ার ফাঙ্কশান খুব কম। নিলয় কিছু মাঝারি মাপের আর্টিস্ট আনাচ্ছে। তারাই করবে সব।"
" বাব্বাহ, আমাদের পুজোয় বাইরের আর্টিস্ট? বিরাট চেঞ্জ তো গো মা।"
" হ্যাঁ, তা আর বলতে?"
" ভাবতেই পারছিনা। যে স্টেজ একটা সময় ছিল আমাদের একমাত্র প্রতিভা প্রকাশের জায়গা, এখন সেটাও আর থাকলো না?"
" সেসব দিন আর কোথায় রে বাবু। আজকাল তো ফাঙ্কশান করার জন্য লোক পাওয়া যায় না। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। টাকায় কুলোলে কেন বাইরের আর্টিস্ট আনবেনা। অন্তত কিছু না হওয়ার থেকে ভালো।"
" বল কি! লোক পাওয়া যায় না? আর আমাদের রীতিমত অডিশন করাতে তোমরা।"
" দিন কাল বদলে গিয়েছে রে। এই পুজোতেও সব পাল্টে যাচ্ছে। মিটিংগুলোতেই তো দেখতাম। শুধুই দেখনদারি। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। "
" যাহ, তবুও।"
" হুম। "
" শোনো এক কাজ করো তাহলে। এবারে বরং তোমরা চারদিনে চারটে সিনেমা দেখে ফেলো। এত  ছবি রিলিজ করছে তো, ইউটিউবে ট্রেলার দেখছিলাম।"
" আইডিয়াটা মন্দ বলিসনি। দেখি।"
" কিন্তু শোন, প্লীজ, অষ্টমীর সকালে আমায় ঢাকের আওয়াজটা কিন্তু অবশ্যই শোনাবে।"
" ঠিক আছে, কিন্তু কি করে?"
" ফেসবুক লাইভ আসবে, বুঝেছ?"
" সে সব কি করে করে?"
" দাঁড়াও, তোমায় একটা ডিটেল্ড পি পি টি বানিয়ে পাঠাচ্ছি।"
" মুখে বল না রে। তোদের এই কথায় কথায় পি পি টি। কি রে।"
" কি করব, অভ্যেস। দাঁড়াও, ভিডিও কল করি। দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি ল্যাপটপে স্কাইপ অন করো। ফোনটা হাতে নাও, শেখাচ্ছি।"
মিনিট কুড়ি কসরত করে অবশেষে মা কে লাইভ আসাও শিখিয়ে দিল শুভ। খানিক নিশ্চিন্ত হয়েই ও মা কে বলল, " যাক, পুজোয় তাহলে ঢাকের আওয়াজটা মিস হচ্ছেনা।"
" একদমই তাই।"
" শুধু প্যান্ডেলে থাকতে পারব না।"
" তা কেন বাবু? আমি মাঝে মাঝেই লাইভ আসব, দেখে নিবি তখন।"
" তবুও।"
" কি তবুও তবুও করছিস? নতুন জামা পড়ে অফিস যাবি। হাতে ফেসবুকে পাড়ার প্যান্ডেল। একটুও মিস করবি না।"
" হ্যাঁ, আর যখন তোমরা খিচুরি লাবড়া খাবে আর আমি কার্ড রাইস?"
" খাবি না! সুইগি কি করতে আছে? কিছু ভালো মন্দ পছন্দসই অর্ডার করে নিবি। নিজে রান্না করতে জানলে এই অসুবিধেও হত না।"
" রাঁধতে তো পারি। তবে ইলাবোরেট পারব না। কিন্তু দেখি, কিছু সোজাসাপ্টা রান্না বলো তো, চেষ্টা করব। এই শনি রবিতে ট্রায়াল দেব। পুজোর কটাদিন ফাইনাল রান।"
" তাই ভালো। বলে দেব। যা অনেক রাত হল, এবার শুয়ে পড়। আমারও ঘুম পাচ্ছে।"
" হুম। ঠিক আছে মা। গুড নাইট। "

এই না হলে মা? মুহূর্তের মধ্যেই কিরকম সারাদিনের সমস্ত মন কেমন করা, বিরক্তি, রাগ, খারাপ লাগা...ভ্যানিশ! ঝটপট অনলাইন এসে ম্যান্ডেটরি স্ট্যাটাস আপডেটটা এবার করে ফেলতে হবে শুভকে, "এসো মা, আমি রেডি।" এবার মায়ের কল্যাণে, শারদোৎসবের আমেজ পাবে শুভ সাম্বার রসমের দেশে বসেও।

Sunday, September 17, 2017

বাহানা

"বুবুল ঘুম থেকে উঠবি কি না বল এবার? আমি কিন্তু আর ডাকব না। এরপরে বাস মিস করলে কিন্তু আমি পারব না স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতে। এই বলে রেখে দিলাম।"  সাতটা বেজে গিয়েছে, গত আধ ঘণ্টা ধরে ছেলের পিছনে টিকটিক করতে করতে মিতিন ক্লান্ত, বিরক্ত। সাড়ে পাঁচটার এলারমে চোখ খুলে আধ ঘণ্টা কোনমতে যোগব্যায়াম করেই শুরু হয়ে যায় দৈনিক যুদ্ধ। বুবুলকে স্কুলের জন্য তৈরি করা, ব্রেকফাস্ট বানানো, তিনজনের জন্য টিফিন প্যাক করা; ইতিমধ্যে শিউলি দি এসে পড়লে তার পিছনেও সমানে টিকটিক করে যাওয়া। মাঝে মাঝে তো মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে হয়, গড়িয়া থেকে এন্টালি, অফিস টাইমে মিনিবাসে প্রায় এক ঘণ্টা লাগালেও, অন্তত ওই একটি ঘণ্টা তো নিজের মত করে কাটানো যায়, একটু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচা। আবার তো তারপরে অফিসে ঢুকে ইস্তক শুধুই কাজ আর কাজ। অভিরূপ কিছু আলাদা করে দাবী দাওয়া করেনা বটে, কিন্তু তেমন ভাবে সাহায্যও করেনা। 
চায়ের কাপটা অভির সামনে রেখে একবার পাঁচ মিনিটের জন্য আনন্দবাজারটা মিতিন  উল্টেপাল্টে দেখবে, এমন সময়ে দেখল মোবাইলে একটা মিসড কল, শিউলিদির ছেলের নম্বর। ব্যাস, এই হল। সেই এক রুটিন, ফোন করলেই শুরু হবে কোন না কোন বাহানা দেওয়া। হয় নিজের জ্বর, নয় স্বামীর পেট ব্যাথা। আজকাল তো আবার নতুন কাঁদুনি শুরু হয়েছে, নাতির অসুখ। আরে বাবা, মাস গেলে টাকাটা নেওয়ার সময় তো হাত কাঁপে না একটুও, এদিকে চারদিনের চুক্তি করে আট দিন ছুটি, কথায় কথায় টাকা ধার চাওয়া, এরাই বেশ আছে। আধবেলা কাজ করো, তারপর বাড়ি ফিরে অবসর। ট্রাফিক জ্যাম, ভিড় বাস, অটো কিছুর ঝক্কি পোহাতে হয়না, ট্রেন ক্যান্সেল হলেও ছুটি। সি এল, ই এলের ধার ধারেনা, অথচ এদের দেখো হাজার একটা দাবী, সংগঠন চাই, আরও মাইনে চাই। টাকা কি গাছে ফলে নাকি যে বললেই মাইনে বাড়াতে হবে। একেই বারো মাস কাজ করে তেরো মাসের মাইনে, এ ছাড়াও পয়লা বৈশাখে শাড়ী, জ্বর ব্যাধি হলে ওষুধ পত্তর, লেগেই আছে। মাথাটা গরম হয়ে যায় মিতিনের। শিউলিদি না এলে আরেক প্রস্থ কাজ বাড়বে, উফ ওদিকে এতক্ষণেও বুবুল ওঠেনি। অভিরূপের দিকে তাকিয়ে প্রায় ঝাঁঝিয়েই উঠল ও, "বসে বসে কি তখন থেকে কাগজ পড়ে চলেছ বলো তো? দেখলে তো শিউলিদির মিসড কল, নির্ঘাত আসবে না। এক গাদা কাজ বেড়ে গেল আমার, যাও গিয়ে বুবুলকে রেডি করো। পারি না আর, মুক্তি চাই।"
"আহ মিতু, তুমি না বড্ড অল্পেই অধৈর্য হয়ে পড়ো। আমি বুবুলকে দেখছি, কিন্তু আগে ফোন তো করে দেখো শিউলিদিকে, কি বলছে শোনো।" ঠাণ্ডা স্বভাবের অভিরূপ মিতিনকে শান্ত করার একটা চেষ্টা করে বটে, কিন্তু সকালের এই হড়বড় তড়বড়ের সময়ে যে সেটা কোনভাবেই সম্ভব না,তা বুঝিয়ে দিল মিতিনের পরবর্তী বাক্যবাণ। " হ্যাঁ সে করছি। কিন্তু ওই তো একই বলবে। অসুখ বিসুখ। জানো গত সপ্তাহে আমার থেকে তিন হাজার টাকা ধার নিল, আগের মাসের দুই হাজার এখনো ফেরত পাইনি। এরপরে আবার বোনাস চাইবে। কাজে আসবেনা, কিন্তু টাকা নিতে ঠিক ছুটতে ছুটতে চলে আসে এরা, যতসব। অ্যামেরিকার মত যবে এখানেও রোবট চালু হবে, বেশ হবে। বুঝবে ব্যাটাগুলো তখন কত ধানে কত চাল। বেড়িয়ে যাবে ওদের যত চালাকি।"
"আচ্ছা সেসব পরে ভাববে। দেখো ফোনটা করে। আমি বুবুলকে দেখি। এদিকে কোন হেল্প লাগলে ডেকো।" অভিরূপ বুবুলের দায়িত্ব নিচ্ছে দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে শিউলি দিকে ফোন লাগাল মিতিন। পাঁচ মিনিট পর ফোন রেখে অভিরূপকে ডেকে বলল, " শিউলিদির নাতিটা নাকি কাল রাত্তিরে মারা গিয়েছে। তাই কটাদিন আর আসবে না ও।"
"সে কি? কি হয়েছিল?"
" কদিন জ্বরে ভুগছিল। বলছে নাকি টাইফয়েড হয়তো।"
" আহা রে।"
"ওসব আহা রে আহা রে করো না তো। প্র্যাক্টিকাল সমস্যাটা ভাবো। এ কদিন বাড়ি সামলাবে কে? অন্য লোকও কোন পুজোর মুখে পাব না। আর শিউলিদি কে কাজ থেকে ছাড়ালে অতগুলো পাওনা টাকাও আর ফিরবেনা। কি যে হয়? বিরক্তিকর।"


মাস খানেক পরের কথা। শিউলিদির জিম্মায় বাড়ি রেখে অফিস বেরোনোর মুখে মিতিন অভিরূপকে বলল, "দেখো, এখন আর শিউলিদি আর কামাই করেনা। বুঝলে অভি, একদিকে ভালোই হল কিন্তু। শিউলিদির কামাই আর টাকা ধার চাওয়ার একটা বাহানা তো কমল।" 



Friday, September 15, 2017

মধুবন

সজনী সজনী রাধিকা লো
দেখ অবহু চাহিয়া।

"না, হচ্ছে না শ্রীময়ী। গ্রেসফুল করতে হবে তো ব্যাপারটা। মুখে হাসি কই?" বড় হলঘরটা থেকে কানে আসল আমার। এই এক শুরু হয়েছে গত এক মাস ধরে। একাদশীতে কমপ্লেক্সের ফাংশানে ভানুসিংহের পদাবলী পরিবেশন করছে মঞ্জরী, তারই রিহার্সাল প্রতি উইকেন্ডে আমাদের বাড়িতে। মঞ্জরী, আমার মায়ের নাচের দল। খুব যত্নে লালিত ও পালিত বলা চলে মঞ্জরীকে, আর হবেই বা না কেন। বাবার সাথে মায়ের ঝগড়ার পরে যখন মা নাটকের দল ছেড়ে দিল, সেই সময় থেকে প্রায় মঞ্জরীর জন্ম। তখন তো আমি সবে ক্লাস সিক্স, মনে আছে, কি সাঙ্ঘাতিক দিন গিয়েছিল তখন। সারাদিন কান্নাকাটি, চীৎকার চেঁচামিচি। বাড়িতে থাকতেই কিরকম ভয় করত। তারপর একদিন হঠাৎ করে সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। মা আমায় বলল, "বুবু নাচ করবি?" আমি তখন অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে। নাচ করতে বলছে? আমায়? ছোট থেকে যখন স্কুলে নাচের অনুষ্ঠানে আমায় অংশগ্রহণ করতে দিত না বাবা, ধিঙ্গি মেয়ে, নাচ আবার কি, এইসব বলত ঠাকুমা, আর মা চুপ করে সায় দিত, সেই মা আমায় নাচ করতে বলছে? অবশ্য ততদিনে ঠাকুমা কাকাইদের কাছে চলে গিয়েছে, বাড়িতে শুধু আমি আর মা থাকি। বাবা শিলিগুড়িতে, মেডিকেল কলেজের রেডিয়োলজি বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে, মাসে হয়ত একবার আসে, কি তাও না। মা আলমারি থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে দেখালো নিজের ঘুঙ্গুর, আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর সেদিনই জানলাম মায়ের সবচেয়ে কাছের জিনিসের কথা। নাচ। যেই নাচ একটা সময়ে মাকে দিয়েছিল মুক্তি, প্রাণের আরাম। যেই নাচের শোতে চিত্রাঙ্গদা রূপে মা কে দেখে বাবা প্রেমে পড়ে যায় মায়ের, যেই নাচ মা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল দাদু আর ঠাকুমার জন্য।
সেই শুরু। মায়ের হাত ধরে, মঞ্জরী আসতে আসতে বড় হল। এখন আমার বি এস সি সেকেন্ড ইয়ার, এই সাত বছরে নাচ হয়েছে আমার ধ্যানজ্ঞান। জেনেটিক্স নাকি কি, জানিনা। কিন্তু মঞ্জরীতে সবচেয়ে ভালো নাচতাম আমি। আর তাই প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমি সব সময়ে লিড রোলে নেচেছি। গত পুজোয় তো আমার করা শ্রীমতি প্রচণ্ড হাততালি কুড়িয়েছিল। এই বছরও আমারই করার খুব ইচ্ছে ছিল রাধিকার রোল। কিন্তু বাধ সাধল এই শ্রীময়ী। ওরা জানুয়ারীতে এসেছে আমাদের বিল্ডিঙ্গে, এর আগে কটকে থাকত, ওড়িশিতে পারঙ্গমা। নাচের ক্লাসে ওর পারফরমেন্স দেখে মায়ের মনে হয়েছে, রাধিকার রোলটা নাকি ওকেই দিতে হবে। এই নিয়ে মায়ের সাথে আমার সাঙ্ঘাতিক কথা কাটাকাটি হল। এক বেলা রাগ করে দুজনেই কেউ খাবার মুখে তুললাম না, শেষমেশ মানদা দি আইস্ক্রিম এনে দুজনকে শান্ত করল। তবুও, রাধিকা হল শ্রীময়ী। আর আমারও হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে পুজোর পরে কলেজ খুললেই মিড টার্ম পরীক্ষা। তাই আমিও নাচ থেকে নিজেকে এবারের মত এক্সকিউজ করে নিলাম। যদিও রিহার্সালে আমি প্রায় রোজই থাকি। বসে বসে স্টেপ দেখি, অনেকের স্টেপ তোলাতে সাহায্য করি। মা আর শ্রীময়ীর এইরকম কথোপকথন প্রত্যেকদিন শুনি। কোনদিন হাসিটা ঠিক মত হচ্ছে না, তো কোনদিন তাল কেটে যাচ্ছে। আজ অবশ্য মায়ের গলার স্বর বেশ রাগী, আর হবে নাই বা কেন? দুটো উইকেন্ডও আর নেই, এখনো যদি নাচটা পারফেক্ট না হয়, মা রেগে তো যাবেই। আমার মা নাচের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। আর এক্ষুণি শ্রীময়ী ছুটতে ছুটতে যাবে বাথরুমে, মেয়েটা বড্ড আতুপুতু করে মানুষ। কিছুতেই বকাঝকা হজম করতে পারেনা। এক প্রস্থ কান্নাকাটি করবে। এরকম উইক হলে যে কি করে জীবনে এগোবে, কে জানে। যাই, রিহার্সাল দেখে আসি।


সাবানের কৌটোটা তাকে রেখে এসে বসলাম ঘরে। আর ঠিক যেমন বললাম, ওমনি শ্রীময়ী দেখি চোখ লাল করে ছুটল বাথরুমে। এই রে, মেঝেটার অবস্থাটা তো বলা হল না। যাক গে, আমার আবার ওই চিৎকার চেঁচামিচি কোনোদিনও ভালো লাগেনা, আর চেঁচিয়ে বলতে পারছিনা ওকে তাই। যা হওয়ার হবে, সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট। মায়ের তো তেমন অসুবিধে হবেনা, আমি তো স্টেপগুলো চোখ বুজেও করে দিতে পারব। মা কে কক্ষনো আমি বিপদে ফেলবই না।

Monday, September 11, 2017

মাতৃরূপেণ

ভোর চারটে। তখনো বাইরে আলো ফোটেনি। আশেপাশের বাড়িগুলি থেকে ভেসে আসছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর পরিচিত কণ্ঠ আর পদ্ম ঠাকুমাদের বাড়ি থেকে ধূপের গন্ধ। রুমা বৌদিদের ঘরে আলো জ্বলে উঠল। বাইরে তখনো টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ডোবার ধার থেকে ব্যাঙের ডাক ভেঙ্গেচুরে দিচ্ছে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা। ঝরে পড়া শিউলি ফুলের গন্ধে বাতাস মাতোয়ারা। পুণ্যির দু চোখের পাতা এক হয়নি সারা রাত, সমানে জল পট্টি দিতে হচ্ছে যে ওর দশ বছরের মেয়ে মুনিয়ার কপালে। গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে মুনিয়া। হাসপাতালের ডাক্তার সেই ঝড় জল শুরু হতেই যে চলে গিয়েছেন, আর দেখা নেই তার। ডিস্পেন্সারির মন্টু দা তাও জ্বরের ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু মুনিয়ার শরীর ভালোই হচ্ছেনা। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দুইবেলা পেট ভরে দু মুঠো ফ্যানা ভাতও জোটেনি কতদিন হয়ে গেল। বন্যার পর থেকে মাঠে ফসল নেই, জমানো যেটুকু পুঁজি ছিল, তাও নিঃশেষ। ধার বাকিতে আর কতদিন চালানো যাবে, ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে পুণ্যির।
গতকাল কোন বাড়ি থেকে দুপুরবেলা পায়েসের গন্ধ আসছিল। পুণ্যি তখন বাগানের পুঁই ডাঁটা কাটতে বসেছে, যদি বিক্রি করে দুটো টাকা আসে ঘরে। এমন সময়ে মুনিয়ার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, " মা, কি সুন্দর গন্ধ গো। তুমি কি পায়েস করছ?" বুক ফেটে আসা কান্নাটাকে অনেক কষ্টে চেপে রাখে পুণ্যি, মুনিয়ার সামনে চোখের জল ফেলা যাবেনা যে। " না রে মা, আজ না। কাল তো মহালয়া। আমি কাল করব। পেট ভরে খাস।" মুনিয়ার চোখের চকচক দেখে যে কি আনন্দ হয়েছিল, কিন্তু ভয়ে বুক দুরদুর করছিল। মেয়েকে কথা তো দিল, কিন্তু কি করে পারবে? হঠাৎ মনে পড়ল, রুমা দি বলেছিল, কলকাতায় নাকি এবারে কোন পুজোতে মা দুর্গাকে সোনার শাড়ী পড়াবে, নিশ্চয়ই ওদের খুব টাকা। ওদেরকে বললে ওরা দেবে না ওকে একটু কটা টাকা? শুনেছে তো এইসব পুজোর বাবুরা অনেক দান ধ্যান করে, তাতেও নাকি পুরস্কার।
রূপং দেহি, জয়ং দেহি দিয়ে শেষ হল মহিষাসুরমর্দিনী, ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটেছে। আকাশের মেঘও অল্প অল্প কেটেছে। পদ্ম ঠাকুমাকে মুনিয়াকে দেখতে বলে পুণ্যি বেরোল ষ্টেশনের দিকে। যে করেই হোক, আজ মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতেই হবে, জয়ী হতেই হবে সমস্ত বাধার বিরুদ্ধে।

Monday, September 4, 2017

প্রতিচ্ছবি

অনুর বয়স পঁচিশ, এম বি এ পড়া শেষ করে এবারে বছরখানেক হল ও কলকাতায় এসেছে পুণা থেকে। মা বাবা পুণাতেই থাকেন, প্রবাসী বাঙালি। মাস চারেক একটা হোস্টেলে থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে, দালালকে টাকা দিয়ে গড়িয়া মেট্রো ষ্টেশনের কাছেই তিনতলার ওপর এই ফ্ল্যাটবাড়িটি ভাড়া নিয়েছে। বাজেটের মধ্যে তো হয়েইছে, তার ওপর, অফিসের যাতায়াতেরও খুব সুবিধে। বাড়ীটা বেশ সুন্দর, দক্ষিণের একটা বারান্দা আছে। সন্ধ্যে হলে বারান্দার দিকের জানলা খুলে রাখলে, ঘরে আর পাখার প্রয়োজন হয়না। ছিমছাম দুই কামরার ফ্ল্যাট। পাশেই সুপারমার্কেট, নিজের বাজারহাট নিজে করে, রান্না করে দিব্যি চলছে। বিল্ডিঙের অন্যান্য পরিবারগুলির সাথে অল্প বিস্তর পরিচয় হয়েছে। তবে আশে পাশের বাড়ির লোকেদের এখনো চিনে ওঠেনি। শুধু জানে, উল্টোদিকের বাড়িতে চারতলায় একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা থাকেন, সাথে থাকে ওনার ছেলে। ছেলেটির বয়স আন্দাজ তিরিশ। কোন মানসিক রোগের শিকার, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে, জানলার ধারে। আর ওদের জানলা দিয়ে একদম অনুর শোওয়ার ঘর পরিষ্কার দেখা যায়। অনেকবার রাত্রে জানলার ধারে দাঁড়ালে অনু দেখেছে, ছেলেটি হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর ফ্ল্যাটের দিকে। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হত, সারাক্ষণ মনে হত কেউ যেন ওর প্রতিটা পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। ও কখন কি করছে, কোথায় যাচ্ছে বাড়ির মধ্যে, সব দিকে যেন কেউ নজর রাখছে, ঠিক যেমনটা সি সি টি ভি ক্যামেরা বসানো থাকলে হয়। বিরক্ত হয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিত অনু। কিন্তু গরম পড়লে উপায় নেই, জানলা খুলে পর্দা তুলে ঘর অন্ধকার করে শুত। আড়াল থেকে দেখত, ছেলেটি ঠায় তাকিয়েই আছে ওর ঘরের দিকে।
উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মানসী বৌদির কাছে এই কথাটা বলেছিল বটে। তবে বৌদি তেমন গা করেনি। নতুন লোক দেখেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল হচ্ছে, কদিন বাদে ঠিক কেটে যাবে, এইসব বলে প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়েছিল। অনুও সেই যুক্তি মেনে নিয়ে দিব্যি চালাচ্ছিল।
 কিন্তু এরপর একদিন বাধল গোলযোগ। সেইদিন অফিসের কাজ কম থাকায় বিকেল বিকেল ফিরে আসে অনু। চায়ের কাপ হাতে জানলার ধারে চেয়ার টেনে বসেছে, দেখে ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখল, ছেলেটিও একটা কাপে করে কি খাচ্ছে। বিকেলবেলা, চায়ের সময়। হতেই পারে। এ আর এমন কি। কিছু মনে হয়নি অনুর। খানিকক্ষণ পরে ও তাক থেকে গল্পের বইটা নিয়ে এসে বসল। কাজের চাপে অনেকদিন ধরে ওর বই পড়া হয়ে ওঠেনি, আজ সুযোগ পেয়ে বসল অনু বই নিয়ে। পড়তে পড়তে মনে হল, উল্টো দিক থেকে কেউ যেন জরিপ করছে ওকে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে, কি আশ্চর্য, ছেলেটিও হাতে একটা বই এনে পড়ার ভান করছে। বিরক্ত হয়ে অনু উঠে চলে গেল বসার ঘরে। একটু পরে আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখল, ছেলেটি তখনো হাঁ করে ওর জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা। মানুষের মন কত বিচিত্র, এইসব ভাবতে ভাবতে সেদিনের মত দিনটা কাটল।
 প্রায় দিন দশেক ধরে চলল এই উৎপাত। অনু খাচ্ছে, তো সেও খায়। অনু জল খাচ্ছে, তো তার হাতেও জলের বোতল, অনু ফোনে কথা বলছে, তার কানেও মোবাইল। অনু কাপড়জামা তুলছে বারান্দার দড়ি থেকে, তো সেও ন্যাকড়া জোগাড় করে তা নিয়ে জামা তোলার খেলা খেলছে। অনু যেন পাগল হয়ে যাবে এরকম চলতে থাকলে। এর কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। ঠিক করল, রবিবার ওদের বাড়ি যাবে ও। ছেলেটির মায়ের কাছে বলবে ঘটনাগুলি। কিন্তু অফিসের কিছু বাকি কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেই রবিবার ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আজ সোমবার, অফিসে মারাত্মক খাটুনি গিয়েছে। তার ওপর বৃষ্টি শুরু হওয়ায় রাস্তাঘাটে ট্রাফিক জ্যাম সাংঘাতিক ছিল। ভিড় বাসে বসার জায়গা পায়নি, তার ওপর বাড়িতে মায়ের সাথেও ফোনে এক প্রস্থ ঝগড়া হয়েছে। সব মিলিয়ে অনুর আজ মন মেজাজ খিঁচরে আছে। বারান্দায় একটু শান্তিতে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হবে বলে যেই দরজাটা খুলেছে, দেখে সেই ছেলেটা ওর দিকে একটা অদ্ভুত রকমের ব্ল্যাংক এক্সপ্রেশন দিয়ে তাকিয়ে আছে। মাথাটা এক্কেবারে গরম হয়ে গেল অনুর। এর শেষ দেখেই ছাড়তে হবে। হঠাৎ করে রেডিয়োতে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে গেল ওর, আর খেলে গেল একটা আইডিয়া। হন্তদন্ত হয়ে আলমারি থেকে একটা বড় ওড়না বের করল অনু। এরপরে ঘরের আলো নিভল। উলটো দিকেও ঘটল ঠিক একই ঘটনা, যেন আয়নার প্রতিচ্ছবি। সে আনল তার মায়ের জামার তাক ঘেঁটে একটা লাল ওড়না। তারপরে ওই ঘরেও আলো নিভল। অনু পর্দার আড়াল থেকে সবই দেখতে পাচ্ছিল ছায়ায়, উলটোদিকও ঠিক তাই। এরপরে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে পাখায় ফাঁস জড়াল অনু। গলায় পড়েও নিলো। তারপরে চট করে, প্রায় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ফাঁস খুলে হাতে রাখা ওর লাইফসাইজের মেয়ে পুতুলটার গলায় ফাঁস জড়িয়ে নিজে টুল থেকে নেমে, সঙ্গে সঙ্গে এক ধাক্কায় টুলটা ফেলে দিল। পুতুলটার গলা ভেঙ্গে ঝুলতে লাগল। জানলার বাইরে দিয়ে কেউ দেখলে বুঝত কেউ গলায় দড়ি দিয়েছে। গোটা ব্যাপারটা ভীষণ ক্ষিপ্রতার সাথে করল অনু, ওর ছোটবেলায় শেখা হাতসাফাইয়ের বিদ্যা কাজে লাগল অবশেষে।
এরপরে শুধুই অপেক্ষা। উলটোদিকে তখনো ছেলেটি দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে। অনু একবার ভাবল, আলোটা জ্বেলে ওর সামনে দেখা দেয়। পর মুহূর্তেই মনে হল যে না, ও এমনিও কোন কাজেই লাগছে না সমাজে। ঠায় বসে থেকে ওকে বিরক্ত করে ওর নজর দিয়ে। ওর জন্য ওর মাও নিশ্চয়ই খুবই ব্যাতিব্যস্ত। এ না বাঁচলেও খুব একটা কারুর ক্ষতি হবেনা। অন্তত নিজে তো শান্তি পাবে। এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অনুর চোখ গেল জানলায়। দেখল, সেখানে কোন ঝুলন্ত মানুষের ছায়া। যাক, আপদ বিদায় হল।
কোনমতে রাত্রের খাবারটা ফ্রিজ থেকে বের করে খেয়ে সবে শুতে যাবে অনু, এমন সময়ে শুনতে পেল উল্টোদিকের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ীর সাইরেন। মানসী বৌদি ওর ফ্ল্যাটে বেল বাজিয়ে এসে জানিয়ে গেল, ওই বাড়ির পাগল ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, কোন কারণ এখনো জানা যায়নি, পাওয়া যায়নি সুইসাইড নোট। ওর মা রাত্রে খাবার দিতে এসে অন্ধকার ঘরে আলোর সুইচ জ্বালিয়ে এই সাংঘাতিক দৃশ্য দেখে চীৎকার চেঁচামিচি করে আশে পাশের বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো করেন। এম্বুলেন্স পুলিশ সব এসে ছেলেটিকে মৃত ঘোষণা করে। "যাক, তুই এবার তাহলে বাঁচলি বল, আর তোকে কেউ অনুকরণ করবে না, তাই না?" এই বলে হাসতে হাসতে বৌদি চলে গেল।
একটা মিশ্র অনুভুতি কাজ করছিল অনুর মধ্যে। ওর জন্যই কি তাহলে একটা মানুষ মারা গেল? কিন্তু এ আবার কি? প্রাপ্তবয়স্ক, নিজের ভালো মন্দর কোন বাছ বিচার নেই? ও কুয়োয় ঝাঁপ দিলে সেও ঝাঁপ দেবে? অনুর কি দোষ? অনু কি একবারও ওকে বলেছিল যে বাবা, আমি যা করি, তুমিও ভাই সব করো। তুমি আমার মিরর ইমেজ হও? আমি মরতে গেলুম, তুমিও এসো? না না, নিজেকে এরকমভাবে দায়ী করলে চলবে না।
সেই রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না অনুর, বিছানায় শুয়ে খালি এ পাস আর ওপাশ করে চলেছিল। মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচিল উল্টো দিকের বাড়িতে। সেখানে তখনো অনেক লোকজনের ভিড়। প্রায় ভোর রাত্রির দিকে চোখে ঘুম নেমে এলো ওর। পরেরদিন যথারীতি সকালের চায়ের কাপ আর আনন্দবাজার হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল অনু। সাতের পাতায় একটা ছোট্ট কোণায় দুই লাইনের খবর চোখে পড়ল। গড়িয়ায় যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু।
আর হঠাৎই একটা পরিচিত অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে লাগল। ঠিক যেন সি সি টি ভি ক্যামেরা দিয়ে কেউ ওকে দেখছে। কিন্তু, এ কি, আবার কে দেখেছে ওকে? কেউ কি ওর দিকে তাকিয়ে আছে? এরকমটি মনে হতে চোখ তুলে সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়েই অনুর দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। ফ্যাকাশে মুখে ও দেখল, একটি অচেনা ছেলে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

Saturday, September 2, 2017

অল্প ভাঙ্গা গল্প গুলো

- হ্যালো? ব্যস্ত নাকি?
- না বল। আজ এলি না কেন ক্লাসে?
- আরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা বাড়ি ছিল না, ডাকারও কেউ ছিল না। তাই ক্লাসের টাইম মিস করে গিয়েছি।
- তুই না! কোন মানে হয়?
- স্যার কিছু বললেন?
- না না। এই এত বড় ব্যাচে অত লক্ষ্য করেওনা।
- হুম।
- হুম হুম করিস না। আসলে যে কি জানতে ফোন করেছিস, তা তো আমি জানি। বলছি।
- লাভ ইউ।
- থাক! সর্বত্র অত লাভ বিলি করতে হবে না। ভালোবাসা কি এতটাই সর্বজনীন নাকি?
- উফ, কি ডায়লগ!
- Whatever, সে এসছিল আজ, বটল গ্রীন কালারের টিশার্ট আর ক্রিম কালারের জিন্স পড়ে। দু তিনদিনের না কামানো হাল্কা স্টাবল ছিল গালে।
- Wow! নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগছিল?
- উম। কাইন্ড অফ।
- আহ মন খুলে না হয় একটু প্রশংসা করলিই।
- বয়ে গিয়েছে। যাক গে। ও হ্যাঁ, একবার জিজ্ঞেস করল তুই আসিসনি কেন আজ।
- সিরিয়াসলি?
- হ্যাঁ।
- অবাক কাণ্ড তো। ভারচুয়ালে এক, রিয়ালে আরেক ব্যবহার?
-  আবার কি হল? খুলে বল।
- আগে ফেসবুকে আমার হেঁজিপেঁজি সব লেখা, ছবি, পোস্টে লাভ দিত, আজকাল দেখি হয় নো রিয়েকশন, নয়তো শুধু লাইক। আর এদিকে ক্লাসে যাইনি বলে খোঁজ নিচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল না তোর?
- অত সর্বত্র লাভ বিলি করলে চলবে নাকি? লাভ কি এত সস্তা নাকি রে? সব জায়গায় শুধু বিলিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে?
- না তাও।
- শোন তোকে তো কতদিন ধরেই বলেছি, ডেকে কথা বললেই তো পারিস।
- কথা তো বলিই।
- ন্যাকা। যেন বুঝছিস না। এ কথা সে কথা না। 
- সাহস হয় না।
- আরে যতক্ষণ না বলবি, ততক্ষণ এই গুমরে গুমরেই রইবি।
- দ্যাট ইস অলসো ট্রু। স্টিল...
- ব্যাস, এবার স্টিল, সেরামিক বন্ধ কর। নেক্সট ক্লাসে কথাটা পেড়েই ফেল। ঠাকুর ঠাকুর করে কপালে যা আছে, দেখা যাবে।
- হুম। আজকাল দেখছি খুব ওই সঞ্চারীর পোস্টে ঘনঘন লাইক লাভ চলছে। আবহাওয়া ভালো না।
- উফ, আবার তোর ওই লাভ রিএকশন। এই ফেসবুককে এত যে কেন ইম্পরটেন্স দিস।
- তুই বুঝবি না। সুকান্ত দা নেহাত তোর প্রতিবেশী। নইলে দেখতি, তুইও এই ফেসবুক ফেসবুক করেই হেদিয়ে মরতি।
- Whatever...
- হ্যাঁ ছাড়। আছা ওকে ঠিক কি ভাবে বলব?
- যেমন করে কথা বলে! 
- আরে ধ্যাত, তুই তো জানিস, ওর সাথে নরমাল কথা বলতে গেলেই কিরকম বুকের ভিতর ধুকপুকুনিটা বেড়ে যায়।
- এক কাজ করবি, আগেরদিন রাত্রে হাল্কা খাবার খাবি। পারলে দুইদিন নো আমিষ। একটু স্যাক্রিফাইস কর, মন মেজাজ শান্ত থাকবে। ও হ্যাঁ, পারলে একটা দুটো খইয়ের মোয়া খেয়ে নিস।
- খইয়ের মোয়া? এখন কোথায় পাব? ও তো সরস্বতী পুজোয় প্রসাদে দেয়। আর খাবই বা কেন এখন?
- দশকর্মা দোকানে পেয়ে যাবি। সিয়োর। খেলে পরে দেখবি মুখে খই ফুটেছে।
- It was a terrible PJ কিন্তু।
- সে PJ DJ যাই বল না কেন। আমার কথামত চল। দেখবি এস্পার ওস্পার কিছু একটা ঠিক হবে।
- আচ্ছা, কি বলব?
- আমি তোকে ভালোবাসি।
- এ না না। এত স্ট্রেটকাট ভালো না।
- ভণিতা করে কি হবে। সোজা সাপটা যা বলার বলে দিবি। এটা তো রচনা লিখছিস না যে সুন্দর করে ভূমিকা, মূল বক্তব্য আর উপসংহার লিখতে হবে।
- তা বলে এরকম ডাকাবুকো ভাবে আমি তোকে ভালবাসি?
- ম্যাক্স টু ম্যাক্স ওই আগে এই একটু শোন, আর শেষে হ্যাঁ না at your discretion। আর কিচ্ছুটি না। এতে হলে হবে, না হলে না।
- বুঝলাম।
- কি বুঝলি?
- চাপ, জীবনে বেশ চাপ।
- তুই এই নিয়ে ভাবনা চিন্তা কর, আমি বরং দেখি মা কে রাজি করিয়ে মটন চাপটা আনানো যায় কিনা। আর হ্যাঁ, অল দা বেস্ট। না ছড়িয়ে, কনফিডেন্টলি, ভালো করে প্রোপোজ করিস। এবার রাখলাম।
- থ্যাঙ্ক ইউ। লাভ ইউ।
- ওরে সব লাভ আমায় দিস না, একটু বাঁচিয়ে বুচিয়ে রাখ ছেলেটার জন্য।
- হুম, চল,কাল দেখা হবে। টাটা।
- বাই।


"কি লিখছ বনি? আবার মিচকি মিচকি হাসি। কি ব্যাপার?" সুকান্তর কথায় টনক নড়ল বনির। পেনের খাপটা বন্ধ করে ডায়েরির পাতা থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে সে বলল, " পৃথা আর অভির জন্য 15th anniversary special একটা লেখা লিখছিলাম। ওদের আলাপ পর্বের ঠিক আগে আগের ঘটনা। অভিকে এইসব গল্প আদৌ ও বলেছে কি না কে জানে। বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার দৌলতে আমি আমার নৈতিক দায়িত্ব পালন করছি ওকে জানিয়ে। সেইসব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আর কি মনটা ভালো হয়ে যায়, automatically হাসি ফুটে ওঠে।" লেখাটা পড়ে সুকান্ত এক গাল হেসে বনিকে বলল, "এইবারে বুঝলাম কেন তুমি এত insist করছিলে অভির জন্য ওই গ্রীন টিশার্ট আর ক্রিম জিন্স কিনতে। অ। এই ব্যাপার। ভালো, বেশ ভালো।" "হুম, চল এবার রেডি হই। পার্টিটায় তো যেতে হবে, নাকি?"

Friday, September 1, 2017

আদরের নৌকো

প্রতিদিনের মতই আজও ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ছটায় ঘুম ভাঙল দিয়ার। বহু বছরের অভ্যেস, সেই মর্নিং স্কুলের আমল থেকে। তাই আলাদা করে অ্যালার্ম দিতে হয়না শোওয়ার আগে। চোখ মেলে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল, ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আকাশ কালো করে মেঘে ঢেকে আছে। যে কোন সময়ে ভারী বৃষ্টি নামবে। ওর ফ্ল্যাটের সামনেটায় তো পাঁচ মিনিটের বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। কোনমতে জোরে নামার আগে বেড়িয়ে পড়তে পারলে ভালো। নইলে সারাদিন অফিসে ওই ভিজে জল কাদা মাখা অবস্থায় কাজ করতে গেলে নির্ঘাত জ্বর এসে যাবে। দিয়ার ছোট থেকেই ঠাণ্ডা লাগার খুব ধাত। আর তাই বর্ষাকাল মোটেই পছন্দ না ওর। মে জুন মাস পড়তেই সারা দেশ যখন তৃষ্ণার্তর মত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ফোঁটা জলের জন্য, ওর ভিতরে ভিতরে শুরু হয় আসন্ন স্যাঁতস্যাঁতে কাদা জলের মরসুমের আগমনের জন্য বিরক্তি। কি করে যে লোকে এই বর্ষা নিয়ে এত রোম্যান্টিসাইজ করে, ভেবেই পায় না দিয়া।
হরবর করতে করতে কোনমতে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে দিয়া, এমন সময়ে আকাশ ভেঙ্গে নামল বৃষ্টি। একেই বাইরেটা কালো হয়ে ছিল। এখন বৃষ্টির তোড়ে দু হাত সামনের কিছুও দেখা যাচ্ছেনা। গেল, এই ভাবে তো দু মিনিট বৃষ্টি হলেও জল জমে যাবে। কান্না পেয়ে গেল দিয়ার। কতদিন পরে প্রিয় সাদা চুড়িদারটা পড়বে ভেবেছিল, সে গুঁড়ে বালি, থুড়ি, জল কাদা! ব্রেকফাস্ট খেয়ে, বর্ষার দিনের উপযোগী কেপ্রি আর টি শার্ট পড়ে, পার্স, ছাতা হাতে দিয়া রেডি। বৃষ্টিটা একটু ধরলেই বেড়িয়ে পড়বে। বাস পাওয়া আজ মুস্কিল, একগাদা টাকা খরচা করে অটো বা শেয়ার ট্যাক্সিতেই আজ যেতে হবে। মনে মনে একবার বসের চৌদ্দগুষ্টির যাচ্ছেতাই সুনাম করল এমন বর্ষার দিনে অফিসে ডাকার জন্য। আসলে আজ ওর উইক্লি অফ, কিন্তু বসকে আগামী সপ্তাহে জরুরি মিটিং করতে যেতে হবে হেড অফিসে, তাই টিমের সবার সব ছুটি ক্যান্সেল করে দিয়েছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিয়া বৃষ্টির অবস্থা দেখছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা হতে চলল। এই রে থামার যে কোন চিহ্নই নেই। বরং বেড়েই চলেছে।  উল্টে জোরে হাওয়া বওয়ার ফলে সামনের রাস্তাতে এক্ষুনি একটা বড় গাছ ভেঙ্গে পড়ল, যার ফলে রাস্তা আটকা। কমপ্লেক্সের মধ্যেও প্রায় যেন একটা নদীর সৃষ্টি হয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটের কাজের মাসি ভিজতে ভিজতে ছাতা মাথায় দিয়ে আসছিল, দিয়াকে বারান্দায় দেখে বলল, " ও দি, একদুম বেরুনর চেষ্টাও করোনিকো। বড় রাস্তা অবধি হাঁটু জল, অনেক জায়গায় ডাল ভেঙ্গে রাস্তা বন্ধ। গাড়ী চলছেনি গো।" মাসীর কথা শুনে মনে মনে একটু খুশী হল বই কি দিয়া। সটান বসকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিল, আজ ওর পক্ষে অফিস যাওয়া সম্ভব না। খুব প্রয়োজন হলে work from home করে দেবে না হয়। বস ভদ্রলোকের বেহাল অবস্থা, নিজেই জলবন্দী, ওকে আর কি বলেন, তাই সহজেই ছুটি মঞ্জুর। অনেকদিন বাদে সেই ছোটবেলার মতই রেনি ডে পেয়ে দিয়া খুব খুশী।
গরম গরম চা বানিয়ে, এফ এম চালিয়ে বারান্দায় এসে বৃষ্টি দেখতে লাগল দিয়া। আজ রেডিওতে পরপর বৃষ্টির গান। ভালোবাসার গান। কিছু কিছু পুরনো গান শুনতে শুনতে স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল দিয়ার। তখন বরশা ওর খুব প্রিয়। টিউশন থেকে ফেরার পথে তখন এই বৃষ্টি পড়লে কি খুশীই না হত। অভীকটা কোনদিনও মনে করে ছাতা আনত না আর ফেরার পথে বৃষ্টি পড়লেই ওর সাথে ছাতা শেয়ার করতে করতে লেকের ধার দিয়ে হাঁটা হত, আহা। কি দিন ছিল। এখন এই সব কথা ভাবলেও হাসি পায়। কত ছেলেমানুষিই না করেছে সেই সময়ে। চাকরী সূত্রে সবাই যে যার মত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন রয়েছে। গত শীতে অভীকের বিয়েতে খেয়েও এলো দিয়া।
বৃষ্টিটা একটু কমতে দেখল আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলি থেকে বাচ্চাগুলো নীচে নেমে কাগজের নৌকো ভাসিয়ে খেলছে। একটাকেও সেরকম ভাবে চেনে না। নাম জানেনা। কিন্তু কেন কে জানে, খুব আনন্দ হল হঠাৎ ওদের দেখে। বছর দেড়েক হতে চলল দিয়া এই কমপ্লেক্সে থাকে, কিন্তু খুব বেশী প্রতিবেশীদের সাথে আলাপ পরিচয় নেই ওর। কি মনে হতে, আলমারি থেকে নিজের ক্যামেরাখানা বের করল দিয়া। যত্ন করে পলিথিনের কাভার লাগিয়ে নীচে নামল ছবি তুলতে। কমপ্লেক্সের "নদীতে" তখন লাল নীল সবুজ হলুদ নানান রঙের নৌকো ভেসে চলেছে। বাচ্চাদের সাথে সাথে তাদের বাবা মায়েরাও সামিল এই খেলায়। জল, কাদা, নৌকো, হঠাৎ পাওয়া ছুটি, হাসি, খিচুরি, ডিম ভাজার সাথে সাথে বর্ষা যেন হারানো শৈশব ফেরত এনে দিয়েছে আজ সকলের। দিয়া অনেকক্ষণ ছবি তুলল আজ। অনেকদিন পর। সন্ধ্যেবেলা ছবিগুলো নিয়ে ল্যাপটপ চালু করতেই ফেসবুকে একটা নোটিফিকেশন এলো। জনৈক সম্রাট মিত্রর থেকে মেসেজ। সকালবেলা ও যখন মন দিয়ে ছবি তুলছিল, তখনের তোলা একটা ছবি। নিজে ছবি নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করেছে বলে বুঝল যে ফ্রেমিংটি অসামান্য। মন দিয়ে এক হাত দিয়ে নৌকো ভাসাচ্ছে দিয়া, অন্য হাতে ক্যামেরা ধরা। ছবির ক্যাপশন "আদরের নৌকো।" সাথে এক লাইন, "বন্ধু হতে পারি?"