Tuesday, September 26, 2017

বোধন

রথযাত্রার দিন থেকেই মজুমদার বাড়িতে একটা খুশীর হাওয়া বইতে থাকে। কাঠামো তৈরি হয় যে ওদিন থেকেই। শতাব্দী প্রাচীন এই মজুমদার বাড়ীর পুজো। এক কালে প্রায় একশো সদস্যর পরিবারের এখন বেশীরভাগই চাকরি, লেখাপড়া সূত্রে দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আশ্বিন মাস পড়লেই সবাই যে যার জায়গা থেকে ফিরে আসে এই বাড়ীতে, একসাথে পুজো করবে বলে। প্রাচীন এই পুজোয় নিয়ম কানুন মেনে চলা হয় প্রায় একদম প্রথম বছরের পুজোর মত করেই। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য সদস্যারা খেয়াল রাখেন যাতে ঐতিহ্যবাহী পুজোর নিয়মাবলী থেকে এক চুলও এদিক ওদিক না নড়ে। এই বছর এই দায়িত্বে রয়েছেন অশীতিপর সুরমা দেবী। বয়সেও যেমন প্রাচীন, তেমনি চিন্তাধারাতেও।  কাঠামো তৈরির দিন পুজোয় যেমন বাড়ির কাজের মেয়ে মলয়াকে ছুটি দিলেন, প্রথমে শুনে কেউ ভাবতেই পারেন যে হয়তো পূজা পার্বণ বলে ছুটি দিলেন, তা তো খুবই ভালো কথা। আসলে মলয়া সন্তানহীনা, আর তাই সুরমা দেবীর মতে, "অপয়া"। পুজোর কাজে কর্মে তাই তার আসা একদম বারণ। মিঠি, সুরমা দেবীর ছোট নাতনী, একবার বলার চেষ্টা করেছিল ঠাকুমাকে। ও ক্লাস এইটে পড়ে, ছোটবেলা থেকেই ঠাকুমার ন্যাওটা। পুজোর সমস্ত কাজে মা জেঠিমা ঠাকুমা পিসিদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে। তাই রথের দিন স্কুলে যায়নি, পুজোর কাজে সাহায্য করবে ভেবে। মলয়া মাসি ওর খুব প্রিয়, কিন্তু সেইদিন ওকে ছুটি দেওয়ায় ঠাকুমার কাছে কারণ জানতে পেয়ে খুব দুঃখ পেয়েছিল। " আচ্ছা ঠাম্মি, মলয়া মাসীর সন্তান হয়নি, তাহলে তো দেখো ওর কত দুঃখ। তার ওপর তুমি ওকে পুজোয় আসতে দিলে না কেন? আরো কষ্ট পেল তো মাসি।"
" শোন মিঠি, এই বাড়ির কিছু নিয়ম কানুন আছে। যা বুঝিস না, তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমাকে নিয়ম মানতে দে। "
" কিন্তু ঠাম্মি..."
" যা গিয়ে চন্দন কাঠটা ওপর থেকে নিয়ে আয়। তোর মাকে কখন থেকে বলেছি। স্কুলে গিয়ে যত ছাই পাঁশ শিখে আসে আর তারপর পটর পটর করা। আর হ্যাঁ, হাত পা ধুয়ে আমার পুজোর ঘরে ঢুকবি। যত অনাসৃষ্টি। "
মিঠি একদম একা, ওর দাদা দিদিরা কেউ আসেনি এখনো। সব্বাই বাইরে, হয় কলেজে নয় চাকরি করছে। ওর কথায় সায় দেওয়ার জন্য কেউ নেই। বাবা কে বললে বাবা বলবে, " নিয়ম যা, তা তো মানতেই হবে মা?" আর মা কে বললে সেই একই উত্তর, " মিঠি, গুরুজনদের কথা সব সময় মেনে চলতে হয়।" আচ্ছা, নিয়ম মানা, গুরুজনদের কথা শুনে চলা তো ভালো। কিন্তু নিয়মের তো কোন কারণ থাকা দরকার, তাই না? কে বোঝাবে।

মিঠি স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজ ঠাকুর দালান হয়ে আসে। পরাণ দাদু ঠাকুর বানায় আর ও বিভোর হয়ে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে পরাণ দাদুকেই দেখে চলেছে, কি নিখুঁত করে প্রতিমা গড়ে। প্রথমে খড়ের ওপর কাদামাটি লেপে, তারপরে আসতে আসতে সেই মাটি শুকিয়ে গেলে রঙ। কাঠামো সঠিক না হলে রঙও ভালো বসবে না। ঠিক যেন মানুষের মন, সঠিক ভাবে তাকে লালন পালন করলে তবেই তো বিকশিত হবে। এখন তো ছোট বলে কেউ ওর কথা শোনেনা, কিন্তু ওকে বোঝাতেই হবে সকলকে।
দিন যায়, এসে পড়ে মহালয়া। পুজোর তোড়জোড় ভালো করেই চলছে মজুমদার বাড়িতে। ফুল কাকারা কাল আসবে দিল্লী থেকে। বনি পিসিরা আসছে পরশু, লন্ডন থেকে। সুমি দিদি এবারে একা আসছে, জামাইবাবু ছুটি পায়নি। লাল্টুদা, ঊর্মিদিরা আজ বিকেলেই। ভাবতেই কী আনন্দ হচ্ছে মিঠির। পঞ্চমী অবধি স্কুল আছে বটে ওর, কিন্তু এই কটাদিন স্কুলে তেমনভাবে কারুরই মন বসে না। কবে কোন জামা পরবে, কোথায় কোথায় ঘুরবে, কী খাবে, এই নিয়ে চলছে প্ল্যানিং। কিন্তু এইসবের মধ্যেই আরেকটা টেনশন এবারে মিঠিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। গত মাসের মত চললে, এবারে ঠিক ষষ্ঠীর দিনে ওর পিরিয়ডের ডেট। সারাটা বছর এত মুখিয়ে থাকে পুজোর এই পাঁচদিনের জন্য, পুজোর কাজ করতে এত ভালো লাগে। কিন্তু এইবার ডেটে ডেটে ওর পিরিয়ডটা এলে ঠাম্মি কিছুতেই ওকে ঠাকুর দালানেই আসতে দেবেনা। মা কে বলেও লাভ হবে না। মা তো সেই ঠাম্মির ভয়েই কাটিয়ে দিল জীবনটা।

বলে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়। হলও ঠিক তাই। পঞ্চমীর দিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরেই টের পেল, শরীর ওকে জানিয়ে দিল আরো একবার, মেয়ে হওয়ার "জ্বালা"। মায়েরা সবাই মিলে বসে আনন্দনাড়ু গড়ছিল, কানে কানে মায়ের কাছে জানালো। আর ঠিক যেমন ভেবেছিল, মাও ওকে তক্ষুনি "কী সর্বনাশ, কেন এই অবস্থায় এই ঘরে ঢুকলি, এক্ষুণি এখান থেকে চলে যা। এই ঘরে আর আসবি না"  বলে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল। মুখ চুন করে মিঠি দোতলায় ওর নিজের ঘরে চলে গেল। জানলার ধারে বসে হাঁ করে নীচে ঠাকুর দালানে চোখ গেল ওর। দেখল, মা এক কড়াই নাড়ুর কাঁথ ফেলতে গেল রান্নাঘরের দিকে। দশমী অবধি ও থাকবে "অশুদ্ধ", আর পুজোর কোন কাজে তো থাকতে পারবেই না, তার ওপর আবার অষ্টমীর অঞ্জলিও দিতে পারবে না। ঠাম্মির এই বিধান। পুজোটা গেল ভেস্তে এইবারের মত।  মিঠি বুঝতে পারে না, এই যুগে এসেও কী করে পিরিয়ডের মতো অতি সাধারণ শারীরিক অবস্থাকে এমন বিচ্ছিরি নজরে দেখা হয়।

"কী মিঠি রানী? মুখ চুন করে বসে কেন? চল নীচে যাবি না? নাড়ু বানাচ্ছে তো সবাই।"
" সুমি দিদি? কখন এলে?"
" এই একটু আগে, একবার ভবানীপুরে গিয়েছিলাম। আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। ও কাল ইউ কে চলে যাবে,আর দেখা হত না পুজোয়, তাই। কিন্তু তুই নাড়ুর ওখানে না গিয়ে এখানে কেন?"
" আমার পুজোটা পুরো গেল সুমি দিদি। পিরিয়ড স্টার্ট হয়েছে আজকেই। "
" উফ, নিশ্চয়ই দিদান তার প্রাগৈতিহাসিক বিধান দিয়েছে?"
" হুম। কি করব বল।"
" আমি বুঝিনা, বাড়ির বাকি সকলে কেন এখনো এগুলো এলাউ করে। প্রত্যেকে শিক্ষিত, ঘরে বাইরে সমানভাবে পারদর্শী। তা সত্ত্বেও এই বস্তাপচা মনোভাব, শতাব্দী প্রাচীন নিয়ম মানে কেন?"
" গুরুজনদের অসম্মান হবে না মানলে দিদি। মা সারাক্ষণ এই বলে আমায়।"
" মামা মামীদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমার মাও কিছুই বলবে না। সব ওই সুরমা মজুমদারের চোখ রাঙানিতে কাত।"
" হ্যাঁ। নইলে ঠাম্মি এমন শুরু করবে। কে জানে হয়তো নির্জলা উপোস শুরু করে দিতে পারে। কিছুই বলা যায় না তাকে।"
"  তুই চিন্তা করিস না বাবু। আমি দেখছি কী করা যায়।"

খানিক বাদে ওদের সিংহবাহিনী দলের গভীর আলোচনা বসল মিঠির ঘরে। সিংহবাহিনী মানে ওরা সব খুড়তুতো পিসতুতো ভাই বোনেরা। মিঠির প্রতি এই অন্যায়ের কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। এবং ঠিক হল, ঠাম্মির পন্থাই অবলম্বন করা হবে। দল বেঁধে ওরা গেল ঠাকুরদালানে। সেখানে তখন সুরমা দেবীর নির্দেশে পুজোর ফাইনাল জোগাড়যন্ত্র করতে ব্যস্ত বাড়ির ছেলে বৌরা।

" কী হয়েছে দিদিভাই? সবাই হঠাৎ দল বেঁধে এখানে? আর এই মিঠি, তোকে বললাম না এইদিকে আসবি না। যা যা সরে দাঁড়া। সিঁড়িতে উঠিসনা। এক্ষুণি মোছা হয়েছে। চোদ্দবার মুছবার সময় নেই কারুর। "
" দিদান, আমরা একটা কথা জানাতে এসেছি তোমাদের। তোমার কথা অনুযায়ী, মিঠি যখন এইবারে পুজোর কোন কাজে থাকতে পারবেনা, পুজোয় কোনভাবেই অংশ নিতে পারবেনা, ওর বড় বড় দাদা দিদিরা হয়ে, আমরাও ওর সাথে থাকব। আমরাও কেউ কোনভাবেই পুজোয় থাকব না এইবারে। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।"
" এই এসব কী বলছিস সুমি?"
" মা, তুমি থামো। আমি দিদানের সাথে কথা বলছি। তুমি মাঝখান থেকে এসো না প্লীজ।"
" দেখলি বিনু? তোর মেয়ের কথার ছিরি? হ্যাঁ রে সুমি, তুই কি জানিস না কেন মিঠিকে আমি বারণ করেছি?"
" জানি, কিন্তু তোমার কারণ কোন কারণই না। তাই জন্যই ও যদি বিনা কারণে বাদ পড়ে পুজো থেকে, তাহলে আমরাও বাদ।"
" বিনা কারণে মানে? ও তো এখন অশুচি।"
" অশুচি আবার কি দিদান? পিরিয়ড হওয়া অশুচি?"
" অবশ্যই।"
" মোটেই না। পিরিয়ড একটি অতি সাধারণ শারীরিক অবস্থা। যেমন হাঁচি কাশি হয়, তেমনি। না, ভুল বললাম। হাঁচি কাশি তো অসুখ। যেমন হার্ট বিট করে প্রতি মুহূর্তে, যেমন শ্বাস প্রশ্বাস নিই মারা, ঠিক তেমনি মাসে একবার করে আমাদের মেয়েদের পিরিয়ড হয়। এতে অশুচির কি দেখলে?"
" না। শাস্ত্রে লেখা আছে। "
" কোথায় দেখাও? আর থাকলেও, সেই শাস্ত্রও গুলি মারো। আর হ্যাঁ শোন, অম্বুবাচীর সময়ে যে তোমার ঠাকুরেরও পিরিয়ড হয়? সেই বেলা? ঠাকুর তখন অশুচি? বলো?"

সুরমা দেবী কিচ্ছু বলেন না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন নিজের নাটি নাতনিগুলোর দিকে। সেদিন রাত্রে কোনোমতে সবাই খেয়ে ঘুমোল। পরের দিন সকাল সকাল সবাই উঠে স্নান সেরে ফেলল। বাড়ির বড়রা পুজোর দালানে বসে। কিন্তু সুরমা দেবীর তখনো দেখা নেই। ঠাকুরমশাই চণ্ডীপাঠ শুরুর জন্য তৈরি, সুরমা দেবী আসলেই হয়।

" কী রে দাদা? মা তো এখনো এলো না? কোথায় গেল?"
" হ্যাঁ রে বনি। আমিও তো তাই ভাবছি। মা তো লেট করেনা কখনো। হল কি?"
" বৌদি মা কে দেখেছো সকাল থেকে? "
" হ্যাঁ বনি। মা কে তো সকাল সকাল দেখলাম বাগানের দিকে যাচ্ছিল, ফুলের সাজি হাতে নিয়ে। হয়তো ঠাকুর ঘরে দেরী হয়ে গিয়েছে। দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি। "
" হ্যাঁ। বাচ্চাগুলোও কিরকম মিছিমিছি গোঁয়ারপনা করছে দেখো তো। আদ্যিকালের নিয়ম, যেমন চলে আছে, মেনে নে না বাবা। কি ফালতু ফালতু পুজো আচ্চার মধ্যে ব্যতিক্রমী হওয়ার চেষ্টা।"

" কিচ্ছু গোঁয়ারপনা না। আমার নাটি নাতনিরা যা করেছে, একদম ঠিক।"
ঠাকুর দালানে উপস্থিত সক্কলে তাকিয়ে দেখল, সুরমা দেবী, সাথে তার সিংহবাহিনী। সুরমা দেবী ডান হাত দিয়ে মিঠির হাত ধরে উঠলেন ঠাকুর দালানে।
" শোন, যে নিয়ম, আচার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, তা যে এখনো মানতে হবে, তা মোটেই না। এইসব নিয়মের না কোন মানেই নেই। কাল আমার নাতি নাতনিগুলোর কথা অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম। আর তখনই বুঝলাম, যে যা করছি, একদম ভুল। সব্বাই মিলে সব রকম ভেদাভেদ ভুলে আমরা এই কতাদিন আনন্দ করব, মায়ের পুজো করব। দুর্গা তো আমাদের মেয়ে, এক মেয়ের আদরে আরেক মেয়ে সুযোগ পাবে না কেন? আমাদের কি বুকে এতটুকু ভালোবাসা নেই? আর হ্যাঁ, মলয়ার প্রতিও আমি অন্যায় করেছি। আমি নিজে ওর কাছে ক্ষমা চাইব। ওকে ডেকে পাঠিয়েছি। ও আসুক। তারপর সবাই মিলে একসাথে পুজো শুরু করা হবে। "

ঠাকুর দালানে তখন দেবী দুর্গার সাথে সাথে মর্ত্যবাসীদেরও শুভ বুদ্ধির বোধন হল।







No comments:

Post a Comment