সজনী সজনী রাধিকা লো
দেখ অবহু চাহিয়া।
"না, হচ্ছে না শ্রীময়ী। গ্রেসফুল করতে হবে তো ব্যাপারটা। মুখে হাসি কই?" বড় হলঘরটা থেকে কানে আসল আমার। এই এক শুরু হয়েছে গত এক মাস ধরে। একাদশীতে কমপ্লেক্সের ফাংশানে ভানুসিংহের পদাবলী পরিবেশন করছে মঞ্জরী, তারই রিহার্সাল প্রতি উইকেন্ডে আমাদের বাড়িতে। মঞ্জরী, আমার মায়ের নাচের দল। খুব যত্নে লালিত ও পালিত বলা চলে মঞ্জরীকে, আর হবেই বা না কেন। বাবার সাথে মায়ের ঝগড়ার পরে যখন মা নাটকের দল ছেড়ে দিল, সেই সময় থেকে প্রায় মঞ্জরীর জন্ম। তখন তো আমি সবে ক্লাস সিক্স, মনে আছে, কি সাঙ্ঘাতিক দিন গিয়েছিল তখন। সারাদিন কান্নাকাটি, চীৎকার চেঁচামিচি। বাড়িতে থাকতেই কিরকম ভয় করত। তারপর একদিন হঠাৎ করে সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। মা আমায় বলল, "বুবু নাচ করবি?" আমি তখন অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে। নাচ করতে বলছে? আমায়? ছোট থেকে যখন স্কুলে নাচের অনুষ্ঠানে আমায় অংশগ্রহণ করতে দিত না বাবা, ধিঙ্গি মেয়ে, নাচ আবার কি, এইসব বলত ঠাকুমা, আর মা চুপ করে সায় দিত, সেই মা আমায় নাচ করতে বলছে? অবশ্য ততদিনে ঠাকুমা কাকাইদের কাছে চলে গিয়েছে, বাড়িতে শুধু আমি আর মা থাকি। বাবা শিলিগুড়িতে, মেডিকেল কলেজের রেডিয়োলজি বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে, মাসে হয়ত একবার আসে, কি তাও না। মা আলমারি থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে দেখালো নিজের ঘুঙ্গুর, আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর সেদিনই জানলাম মায়ের সবচেয়ে কাছের জিনিসের কথা। নাচ। যেই নাচ একটা সময়ে মাকে দিয়েছিল মুক্তি, প্রাণের আরাম। যেই নাচের শোতে চিত্রাঙ্গদা রূপে মা কে দেখে বাবা প্রেমে পড়ে যায় মায়ের, যেই নাচ মা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল দাদু আর ঠাকুমার জন্য।
সেই শুরু। মায়ের হাত ধরে, মঞ্জরী আসতে আসতে বড় হল। এখন আমার বি এস সি সেকেন্ড ইয়ার, এই সাত বছরে নাচ হয়েছে আমার ধ্যানজ্ঞান। জেনেটিক্স নাকি কি, জানিনা। কিন্তু মঞ্জরীতে সবচেয়ে ভালো নাচতাম আমি। আর তাই প্রতিটি অনুষ্ঠানে আমি সব সময়ে লিড রোলে নেচেছি। গত পুজোয় তো আমার করা শ্রীমতি প্রচণ্ড হাততালি কুড়িয়েছিল। এই বছরও আমারই করার খুব ইচ্ছে ছিল রাধিকার রোল। কিন্তু বাধ সাধল এই শ্রীময়ী। ওরা জানুয়ারীতে এসেছে আমাদের বিল্ডিঙ্গে, এর আগে কটকে থাকত, ওড়িশিতে পারঙ্গমা। নাচের ক্লাসে ওর পারফরমেন্স দেখে মায়ের মনে হয়েছে, রাধিকার রোলটা নাকি ওকেই দিতে হবে। এই নিয়ে মায়ের সাথে আমার সাঙ্ঘাতিক কথা কাটাকাটি হল। এক বেলা রাগ করে দুজনেই কেউ খাবার মুখে তুললাম না, শেষমেশ মানদা দি আইস্ক্রিম এনে দুজনকে শান্ত করল। তবুও, রাধিকা হল শ্রীময়ী। আর আমারও হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে পুজোর পরে কলেজ খুললেই মিড টার্ম পরীক্ষা। তাই আমিও নাচ থেকে নিজেকে এবারের মত এক্সকিউজ করে নিলাম। যদিও রিহার্সালে আমি প্রায় রোজই থাকি। বসে বসে স্টেপ দেখি, অনেকের স্টেপ তোলাতে সাহায্য করি। মা আর শ্রীময়ীর এইরকম কথোপকথন প্রত্যেকদিন শুনি। কোনদিন হাসিটা ঠিক মত হচ্ছে না, তো কোনদিন তাল কেটে যাচ্ছে। আজ অবশ্য মায়ের গলার স্বর বেশ রাগী, আর হবে নাই বা কেন? দুটো উইকেন্ডও আর নেই, এখনো যদি নাচটা পারফেক্ট না হয়, মা রেগে তো যাবেই। আমার মা নাচের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। আর এক্ষুণি শ্রীময়ী ছুটতে ছুটতে যাবে বাথরুমে, মেয়েটা বড্ড আতুপুতু করে মানুষ। কিছুতেই বকাঝকা হজম করতে পারেনা। এক প্রস্থ কান্নাকাটি করবে। এরকম উইক হলে যে কি করে জীবনে এগোবে, কে জানে। যাই, রিহার্সাল দেখে আসি।
সাবানের কৌটোটা তাকে রেখে এসে বসলাম ঘরে। আর ঠিক যেমন বললাম, ওমনি শ্রীময়ী দেখি চোখ লাল করে ছুটল বাথরুমে। এই রে, মেঝেটার অবস্থাটা তো বলা হল না। যাক গে, আমার আবার ওই চিৎকার চেঁচামিচি কোনোদিনও ভালো লাগেনা, আর চেঁচিয়ে বলতে পারছিনা ওকে তাই। যা হওয়ার হবে, সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট। মায়ের তো তেমন অসুবিধে হবেনা, আমি তো স্টেপগুলো চোখ বুজেও করে দিতে পারব। মা কে কক্ষনো আমি বিপদে ফেলবই না।
No comments:
Post a Comment