Saturday, September 23, 2017

গন্ধ


" হ্যাঁ দিদি, আমি এই মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ছি। চিন্তা করো না। সব রেডি। আজকের ইন্টার্ভিউটা দারুণ হবে। " ফোন নামিয়ে রেখে একবার আয়নায় নিজেকে জরিপ করল কস্তুরী, কস্তুরী সেন , ট্রেনী জার্নালিস্ট, তিতলি পত্রিকার। তিতলি একটি মহিলা কেন্দ্রিক পাক্ষিক পত্রিকা, মোটামুটি এই সেগমেন্টের প্রথম পাঁচের মধ্যে পড়ে। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, ভ্রমণ, রন্ধনশিল্প, সাহিত্যকলা ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগ নিয়ে তিতলি হাজির হয় পাঠকদের কাছে। কস্তুরী এতদিন সিনিয়র দিদিদের সাথে ইন্টার্ভিউগুলিতে যেত, শুনত, শিখত। আজও তাই যাওয়ার কথা ছিল। বিখ্যাত অন্ট্রেপ্রেনিউর, শ্রী সৌরভ বণিক অনেক টালবাহানা করে অবশেষে আজ দুপুর বারোটার সময় ওদের ম্যাগাজিন থেকে আসতে বলেছিলেন। শ্রুতিদির কথা ছিল এটা কাভার করার, সাথে থাকত কস্তুরী, কিন্তু গত সপ্তাহে একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটিয়ে শ্রুতিদি আপাতত শয্যাশায়ী। আর তার ফলে ইন্টার্ভিউয়ের দায়িত্ব এই প্রথম বার, পুরোটাই পড়েছে কস্তুরীর ঘাড়ে।

অনেকদিন ধরেই কস্তুরীর মনের কোণে একটা আশা ছিল, একদিন ও একা গিয়ে কোন বড় মাপের মানুষের ইন্টার্ভিউ নেবে, সেই ইন্টার্ভিউ ছাপার পর দিকে দিকে ওর নাম সবাই জেনে যাবে। তাই সৌরভ বণিকের ইন্টার্ভিউটা ওকে আজ যেমন করেই হোক, ভালো করতেই হবে। নিজের প্রিয় সুগন্ধী হাল্কা করে গায়ে লাগিয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কস্তুরী অফিসের পাঠানো ক্যাবে গিয়ে বসল। ভদ্রলোকের বাড়ি মালঞ্চগ্রাম নামে এক জায়গায়, কলকাতা থেকে প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ। গাড়িতে বসে অসে তাই কস্তুরী ওনার বিষয়ে জোগাড় করা সমস্ত তথ্যে আরেকবার চোখ বোলাতে লাগল। শ্রুতিদি যখন কোন কাজ করে, এত নিখুঁত ভাবে করে, এই ফাইলটা দেখে নতুন করে শ্রুতিদির প্রতি কস্তুরীর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

সৌরভ বণিকের পরিবারের ব্যবসা কেমিক্যালসের ও রঙের, প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি। অবশ্য সেই ব্যবসার হাল তেমন আহামরি কিছু নয়। সৌরভ  নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, বিদেশের নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে গবেষণা করে দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন এবং এক লাফে পাঁচ বছরের মধ্যেই বণিক কেমিক্যালসের নাম সারা দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। ব্র্যান্ডের নামী সুগন্ধীগুলোর মতই কোম্পানীর নাম যশ দিকে দিকে। বহু পুরস্কার এসেছে ঝুলিতে। আজকের এই ইন্টারভিউটির মাধ্যমে তিতলি থেকে এই নবীন ব্যবসায়ীর উত্তরণের কাহিনী জনগণের কাছে আসতে চলেছে।

সৌরভ বণিক তেমন বেশী প্রচারে থাকেন না। উনি তেমনই ব্যক্তি যিনি কাজ দিয়েই নিজেকে চেনাতে চান সকলের কাছে। তাই এই সাক্ষাৎকারটি দিতে তিনি সহজে রাজী হন নি। শ্রুতিদির পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা করার পরে আজ বেলা বারোটার সময় দিয়েছেন উনি তিতলিকে। তিতলির হয়ে কস্তুরীকে তাই আজ নিজের সেরাটুকু দিতেই হবে, বারবার করে পাখি পড়ার মত শ্রুতিদি বলেছিল। পৌনে বারোটা নাগাদ ওরা পৌঁছল মালঞ্চগ্রামে, বণিক বাড়ী। বিশাল তিনতলা বাড়ী, প্রায় অট্টালিকা বলা চলে। সামনে সুসজ্জিত বাগান। গাড়িটা উল্টোদিকের রাস্তায় গাছের তলায় রাখতে বলে কস্তুরী ধীর পায়ে এল সদর দরজায়। অদ্ভুত লাগল, এত বড় বাড়ি, অথচ কোন দারোয়ান নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খানিক অপেক্ষা করে, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজতে ও কলিং বেল বাজালো। একটা মিষ্টি পাখির ডাক, বেশ খানিকক্ষণ বাজল। দুই তিন মিনিট হয়ে গেল, অথচ কোন সাড়াশব্দ নেই কারুর। আরেকবার বেল বাজালো কস্তুরী। কিন্তু তারপরেও কোন শব্দ নেই প্রায় পাঁচ মিনিট। কি করবে, ফেরত যাবে, নাকি ভদ্রলোককে ফোন করবে, ভাবতে ভাবতে এমন সময় দরজা খুলে গেল। অপর প্রান্তে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, উনিই সৌরভ বণিক। গত তিন চারদিন ধরে ওনার বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে কতবার যে এই চেহারাটাকে দেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। এক মাথা কুচকুচে কালো চুল, ফর্সা গোল মুখ, কুতকুতে দুটো চোখ। আর সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যেটা, ঠোঁটের ওপরে একটা কালো আঁচিল।

"নমস্কার। আমি কস্তুরী সেন, তিতলি পত্রিকা থেকে আসছি।"

"আর শ্রুতি মুখোপাধ্যায়? উনি কই?"

"শ্রুতিদির একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, শয্যাশায়ী। তাই আসতে পারেননি, আপনার সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিয়েছিল গত কাল।"

"ও আচ্ছা। দিলীপ গত তিনদিন ধরে আসছেনা। তাই আমি জানতাম না। আসুন। বসুন।"

ঘরে ঢুকে কস্তুরীর দু চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এত সুন্দর আরটিস্টিক ভাবে সাজানো গোছানো ঘর, দেওয়াল জুড়ে দুর্দান্ত কিছু অয়েল পেন্টিং, ক্যাবিনেট জুড়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের থেকে জড়ো করা স্যুভেনির। বইয়ের তাকে ভর্তি ভর্তি রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, কোলরিজ, হেমিংওয়ে।

" বসুন। চা খাবেন তো? দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।"

" না না ঠিক আছে, লাগবে না। আপনি আবার কষ্ট করতে যাবেন কেন?"

" আরে কিছু হবে না। আমার কাজের লোকগুলো রবিবার করে ছুটি নেয়, আমার অভ্যেস আছে চা করার। পাঁচ মিনিট সময় দিন, আসছি।"

মিনিট দশেক পরে সৌরভ বণিক ঘরে ঢুকলেন, হাতে চায়ের ট্রে আর কিছু কুকিজ নিয়ে। সুগন্ধীর ব্যবসা বলে বোধহয়, বাড়িতে ঢোকা ইস্তক কস্তুরী একটা মিষ্টি সুবাস পাচ্ছে। চায়র কাপ হাতে নিয়ে সেখান থেকেও পেল জ্যাস্মিনের সুগন্ধ।

" দার্জিলিং থেকে আনানো, স্পেশাল জ্যাসমিন টি। খান। ভালো লাগবে। অপূর্ব গন্ধ। স্বাদও অতুলনীয়।"

" হ্যাঁ নিচ্ছি। ধন্যবাদ।"

"রিলাক্স করে বসুন। এত আড়ষ্ট হয়ে আছেন কেন? আরাম করে বসুন। হাতে অনেক সময় আছে। চা টা খান, তারপরে সাক্ষাৎকার শুরু হবে। "

" হ্যাঁ ঠিক আছে। আমি এমনিও গরমে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা, বরং আপনার ইন্টার্ভিউ শুরু করি? কিছু যদি মনে না করেন। আসলে সময় তো বেশী নেই, এক ঘণ্টার মোটে শিডিউল।"

" বেশ। তাহলে শুরু করুন প্রশ্ন। তবে একটা কথা। আমি কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারি, আর আগে পরেও দিতে পারি। ঠিক আছে?"

"বেশ, তাই হবে। তাহলে শুরু করি? আমি কিন্তু রেকর্ড করব উত্তর।"

" আপত্তি নেই।"

" আচ্ছা সৌরভ বাবু, প্রথম প্রশ্ন। আপনি ছোট থেকে কি ভেবেছিলেন পারিবারিক ব্যবসায় আসবেন?"

"অবশ্যই। বাবা দাদুকে ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করতে দেখে আমিও তখন থেকে ভাবতাম যে একদিন এই ব্যবসায় যোগদান করব। তবে, আমার কিন্তু সেকেলে নিয়ম কানুন, ব্যবসার নীতি ভালো লাগত না। আর তাই বিদেশ থেকে আমি পড়াশোনা করে আসি। এসে ব্যবসার হাল ধরে আজ একটা অনেক diversify করেছি। "

" ঠিকই। আপানদের তো আগে বোধহয় কেমিক্যালস আর রঙের ব্যবসা ছিল শুধু? এখন তো এ ছাড়াও অনেক অন্যান্য প্রোডাক্ট আছে। একটু সেই বিষয়ে বলুন।"

" দেখুন বিদেশে থাকাকালীন যেটা আমি রিয়েলাইজ করি, সেটা হল, দেশে ফিরলে পরে বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা যেই গিফট পেলে সবচেয়ে খুশী হয়, তা হল সুগন্ধী। তখনই এর কারণ ভাবতে গিয়ে বুঝলাম যে কস্তুরীমৃগের দেশ এখানে হলেও, আমাদের দেশে সুগন্ধীর প্রোডাকশন কোয়ালিটি মন্দ। তাই ডিমান্ড থাকলেও দেশীয় জিনিসের সাপ্লাই নেই, তাই এই সুগন্ধীর মার্কেটটা ট্যাপ করার খুব ইচ্ছে হল আমার। সেই ইচ্ছে থেকেই এরপর শুরু হল আমাদের কোম্পানির নতুন ডিভিশন যেখানে  আমরা মূলত এরোমাথেরাপি ও সুগন্ধী নিয়ে কারবার করি।"

" আচ্ছা। সৌরভ বাবু, এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আপনার সবচেয়ে প্রিয় ফ্রেগ্রেন্স কি?"

" বলব, রাদার, শোঁকাব। একটু সময় দিন। জিনিসটা আমার কাছে খুব স্পেশাল, তাই তাড়াহুড়ো করতে চাইনা। সময় লাগবে, কিন্তু আমি আপনাকে ডেমো দেব। অন্য কোন প্রশ্ন থাকলে করুন।"

 এরপর আরো খানিকক্ষণ চলতে লাগল কস্তুরীর প্রশ্নপর্ব। সৌরভ বণিকও হাসি মুখেই উত্তর দিলেন। ইতিমধ্যে চা শেষ হয়ে যাওয়ায় ভদ্রলোক বললেন, " চলুন তাহলে। আপনাকে আমার ল্যাবরেটরিটা দেখিয়ে আনি। ওখানেই আমার প্রিয় কিছু গন্ধ রাখা আছে। আপনি দেখতে পাবেন।"

যে আঁতুড়ঘরে সৃষ্টি হয়েছে কিছু বাজার কাঁপানো গন্ধ, যেখানে জন্ম নিয়েছে কিছু যুগান্তকারী বিউটি প্রোডাক্ট, সেইখানে যে সৌরভ বণিক কস্তুরীকে নিয়ে যাবেন, ও ভাবতেই পারেনি। তাই প্রস্তাবটা শুনে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

" কি হল? চলুন? দেখবেন না আমার ল্যাব?"

" হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আসলে আমি ভাবছিলাম যে এরকম একটা সুযোগ পেলাম। কিন্তু সাথে ক্যামেরাম্যানকে আনিনি। ছবি মিস হয়ে যাবে।"

" না না। ছবি তুলতে এমনিও দিতাম না। আপনাকে আলাদা করে দেখাচ্ছি। জনগণকে আমার ল্যাব, আমার কর্মকাণ্ড দেখাতে চাইছিনা এক্ষুনি। হ্যাঁ, আপনি বরং আপনার মোবাইলটাও এখানেই রেখে যান। ভিতরে গিয়ে সিগন্যাল পাবেন না। ভুল করে যদি ছবি তুলে ফেলেন, তখন মুশকিল হয়ে যাবে।"

" আমি ছবি তুলবনা আপনি বারণ করলে।"

" হ্যাঁ। সে ঠিক আছে। কিন্তু ফোনটা রেখে যান। চিন্তা করবেন না। আমার বাড়িতে এখন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। মেন গেটও লক করা আছে। ফোন চুরি যাবে না। আপনি আসুন।"

অগত্যা কস্তুরী বাধ্য হয়েই নিজের ফোনটা সেন্টার টেবিলে রেখে সৌরভ বাবুর পিছন পিছন হাঁটা শুরু করল বাড়ির ভিতর। একটা লম্বা করিডর, আর তার দুইদিকে সার দিয়ে কিছু ঘর। প্রত্যেকটা ঘরেই তালা বন্ধ। এক তলা বলে করিডরে তেমন আলো ঢুকছেনা। ঠাণ্ডা মেঝেতে পা ফেলে চলতে চলতে অবাক হয়েই চারিদিক দেখছিল কস্তুরী। ঘরগুলির পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটা অদ্ভুত ধরণের ভয় করছিল ওর। সম্বিৎ ফিরল সৌরভের কোথায়, " এই সমস্ত ঘরবাড়ি এক কালে লোকে ভর্তি থাকত। আমাদের যৌথ পরিবার এখন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সবাই এদিক সেদিকে ছড়িয়ে আছে। আমার বাবা মা বেনারসে গিয়েছেন। কালি পুজোর পরে ফিরবেন। এটাই ওনাদের প্রতি বছরের নিয়ম। তাই আর কি বাড়ি এত খালি দেখছেন। আমি একা থাকব, কাজের লোকদেরও তাই ছুটি দিয়েছি। একজন মাসি এসে সপ্তাহে তিনদিন ঘরদোর ঝাঁট মোছ করে যায়। আমার রান্নাবান্না আমি নিজেই করে নিই। রান্না আমার আরেকটা প্যাশন।"

" ও! তাই? বেশ, ইন্টারেস্টিং, যে রাঁধে সে গন্ধও বেচে।"

" ওই রকমই। চলুন। আমরা এসে পড়েছি, এই এইটা আমার ল্যাব। আপনি বসুন। আমি আরেকটা চেয়ার নিয়ে আসছি। "

এই বলে সৌরভ ল্যাবের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। সেখান থেকে তারপরে বেরোলেন একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা কাঠের বাক্স নিয়ে। কস্তুরীর সামনে বসে বাক্সটার লোক খুলতে খুলতে বললেন, " এই বাক্সের মধ্যেই রয়েছে আমার কিছু পছন্দের গন্ধ। আপনার চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখছেন তো কত শিশি ভর্তি তাক? সেইরকমই কিছু ভায়াল আমার এই বাক্সে আছে। "

কস্তুরী তাকিয়ে দেখল, ঘরের আলো কম হওয়ায়, এতক্ষণ নজরে আসেনি। ঘরময় বেশ কিছু শেল্ফ, আর প্রতিটি শেল্ফে রাখা সারি দিয়ে কাঁচের শিশি।

" এইটা দেখুন, শুরু করছি এইটা দিয়ে। এতে রয়েছে এক ধরণের জংলা ফুলের এসেন্স। আমি কিছু বছর আগে দার্জিলিং গিয়েছিলাম, তখন হঠাৎ করেই হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এই ফুলগুলির সন্ধান পাই। শুকে দেখুন। "

কস্তুরীর নাকের ডগায় কমলা রঙের তরলযুক্ত ভায়ালটা ধরলেন সৌরভ। একটা অদ্ভুত রকমের মাদকতা মিশ্রিত সুগন্ধ ওর শরীরে হিল্লোল তুলল।

" অপূর্ব। এটি আপনার কোন প্রোডাক্টে ব্যবহার করেছেন বলবেন? আমি কিনতে চাই। "

" নিজের সবচেয়ে প্রিয় গন্ধগুলো সম্পূর্ণ আমার কস্তুরী। আমি ওইগুলো বিক্রি করে কারুর সাথে ভাগ করে নিতে চাই না। দাঁড়ান, এর পরেরটা দেখুন। শান্ত হয়ে বসুন। "

একটা হাল্কা বেগুনি রঙের তরল ভর্তি ভায়াল এরপর ওর নাকের সামনে এনে ধরল সৌরভ।

" এটি আমি চায়নাতে পাই। যখন গ্রেট ওয়ালের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম, আবারও পথের ধারের কিছু জংলা ফুল কুড়িয়ে পাই। তবে আশ্চর্যভাবে ফুলের চেয়েও পাতার গন্ধ আমায় বেশী টানে। এটি সেই গন্ধ। "

প্রায় মিনিট দুই তিনেক সৌরভ ওর সামনে ওই ভায়ালের ঢাকনা খুলে কস্তুরীকে শুঁকতে দিল ওই গন্ধ।

" কি দুর্দান্ত! আপনি যে কেন এই গন্ধ বিক্রি করেন না। আমার তো মন চাইছে খালি এটাই শুঁকে যাই। মাথাটা কি সুন্দর হাল্কা লাগছে। "

" বেশ তো, খানিকক্ষণ শুঁকুন। আমি তো ধাপে ধাপে আমার প্রিয় গন্ধগুলি আপনাকে দেখাচ্ছি। এরপরের কয়েকটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওগুলোর লাইভ ডেমো দেব। আগে এইটা শেষ হোক। "

এরপরে হলুদ, খয়েরী, নীল বিভিন্ন রঙের ভায়ালের থেকে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কস্তুরীর দু চোখের পাতা কখন এক হয়ে গিয়েছিল, ও টেরই পায়নি। চোখ মেলে দেখল ওর সামনে সৌরভ বণিক বসে। নিজেকে একটু ধাতস্থ করতে গিয়ে টের পেল, হাত দুটো বাঁধা।

" এ কি? আমার হাত বাঁধা কেন?"

" আসলে এবারে আমার সবচেয়ে পছন্দের গন্ধ প্রস্তুত করব। তখন সেই গন্ধ তৈরির সময়ে আপনি পাগল হয়ে ছটফট করতে পারেন। আর তাতে আমার কিঞ্চিৎ অসুবিধে হবে। সেই জন্যই এই প্রিকশন। "

" সে আবার কি? ছটফট করব কেন? "

" আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা তাই বলছে। সুগন্ধীর সাবজেক্টরা ছটফট করে বইকি। তারপরে মিইয়ে যায়। বারবার বলা সত্ত্বেও শোনেনা। তাই এই পন্থাটি নিতে হল। দুঃখিত।  "

" সাবজেক্ট? তার সাথে আমার কি সম্পর্ক? কিছু বুঝছি না। "

" সব বুঝে যাবেন। একটু ধৈর্য রাখুন। "

" এ কি? আপনি ছুরি নিয়ে আসছেন কেন এদিকে? "

" চুপ। বললাম না। "

" আলো নেভাচ্ছেন কেন? "

" মোমবাতিটা জ্বালাবো, আর আলো লাগবে না। আপনি শান্ত হোন কস্তুরী। আমার সুগন্ধী তৈরির সময়ে এত কথা আমি একদম পছন্দ করিনা। আপনি কথা বললে কিন্তু মুখে কাপড় দিতে বাধ্য হব। প্লীজ আমায় দিয়ে অপ্রিয় কাজ করাবেন না। "

" আপনি ছুরিটা দূরে রাখুন। লেগে যাবে আমার। "

" দূরে রাখলে তো ম্যাডাম আমি সুগন্ধী পাব না। "

" প্লীজ সৌরভ বাবু, পাগলামি করছেন কেন? আমি চাই না আপনার প্রিয় সুগন্ধের হদিশ। আমার বাঁধন খুলুন। "

" তা বললে কি আর হবে ম্যাডাম? সিকুয়েন্স অনুযায়ী চলছি। মাঝপথে বেরোনো যাবে না। এখন আপনি চুপটি করে বসুন, নইলে বেশী ব্যথা লাগবে। ও মা আপনি এত তাড়াতাড়ি ঘামতে শুরু করে দিলেন? বাহ। অন্যান্যবার তো আমায় ফ্যান বন্ধ করতে হয়। আপনি ভারী লক্ষ্মী মেয়ে তো। ঘাম এসে গিয়েছে। এবারে একটু রক্ত আসুক। দুটো মিশুক।"

" সৌরভ বাবু, প্লীজ।"

" তখন থেকে কি প্লীজ প্লীজ করে চলেছেন বলুন তো?  আপনাকে কথা দিচ্ছি, খুব বেশী লাগবে না। ব্যস, একটা মোটে কাটব। পরে আপনাকে পেন কিলারও দিয়ে দেব। আপনি জানেন না, কাঁচা রক্ত আর তার সাথে মেশা ভয়ার্ত মানুষের শরীরের ঘাম...অনবদ্য এক পাগলকরা গন্ধ সৃষ্টি করে। আমি আগে বহুবার এটা অনুভব করেছি। ভারী ভালো লাগবে। একটু স্থির হয়ে বসুন, আপনাকেও শোঁকাব।"

" বাঁচাও। কে আছো? প্লীজ হেল্প!"

" চীৎকার করে লাভ নেই কস্তুরী। বাড়িতে আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বললাম না কাজের লোকেদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি?"

" প্লীজ, এরকম করবেন না। আমার লাগছে।"

" ছুরিটা ঠিক করে বসল না আর এর মধ্যেই লাগছে?"

" হেল্প! হেল্প! "

" আপনি চীৎকার করুন। নিজেরই ক্ষতি, ঠিক যেই গন্ধটা আমি চাই, সেটা আসতে আরো দেরী হবে। ভালো। আমার কি? দিনের শেষে আমার গন্ধ পেলেই হল!"

" আহা, লাফঝাঁপের চেষ্টা করবেন না প্লীজ। লেগে যাবে। আমি কিন্তু ছোট্ট একটা কাট করছি, আপনি এত নাড়ালে কিন্তু উন্ডটা বড় হয়ে যাবে। ঠিকঠাক গন্ধ পাব না। তখন আমায় আবার আপনার ডান হাতে এটেম্পট নিতে হবে। "

টুপ টাপ টুপ টাপ। কস্তুরীর রক্তের ফোঁটা, ভয়ের ঘাম মিলে মিশে একাকার। নতুন কাঁচের ভায়ালে বন্দী হতে থাকে আদিম সুগন্ধী। প্রিয় গন্ধ সঞ্চয় হতে দেখে সৌরভ বণিকের মুখে ফুটে ওঠে এক পৈশাচিক হাসি, মোমবাতির আলোয় যা মনে করিয়ে দেয় যে কোন হিংস্র পশুকে। চেয়ারে নেতিয়ে পড়ে থাকে সাবজেক্ট, কস্তুরী।

           *********************************************

( গল্পটা পড়ে হয়তো পারফ্যুম সিনেমাটির কথা মনে হতে পারে। আমার অবশ্য সিনেমাটির বিষয়ে কোন ধারণা ছিল না। আদ্ধেক লেখার পরে প্লটটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে জেনেছি। )

No comments:

Post a Comment