প্রতিদিনের মতই আজও ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ছটায় ঘুম ভাঙল দিয়ার। বহু বছরের অভ্যেস, সেই মর্নিং স্কুলের আমল থেকে। তাই আলাদা করে অ্যালার্ম দিতে হয়না শোওয়ার আগে। চোখ মেলে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল, ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আকাশ কালো করে মেঘে ঢেকে আছে। যে কোন সময়ে ভারী বৃষ্টি নামবে। ওর ফ্ল্যাটের সামনেটায় তো পাঁচ মিনিটের বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। কোনমতে জোরে নামার আগে বেড়িয়ে পড়তে পারলে ভালো। নইলে সারাদিন অফিসে ওই ভিজে জল কাদা মাখা অবস্থায় কাজ করতে গেলে নির্ঘাত জ্বর এসে যাবে। দিয়ার ছোট থেকেই ঠাণ্ডা লাগার খুব ধাত। আর তাই বর্ষাকাল মোটেই পছন্দ না ওর। মে জুন মাস পড়তেই সারা দেশ যখন তৃষ্ণার্তর মত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ফোঁটা জলের জন্য, ওর ভিতরে ভিতরে শুরু হয় আসন্ন স্যাঁতস্যাঁতে কাদা জলের মরসুমের আগমনের জন্য বিরক্তি। কি করে যে লোকে এই বর্ষা নিয়ে এত রোম্যান্টিসাইজ করে, ভেবেই পায় না দিয়া।
হরবর করতে করতে কোনমতে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে দিয়া, এমন সময়ে আকাশ ভেঙ্গে নামল বৃষ্টি। একেই বাইরেটা কালো হয়ে ছিল। এখন বৃষ্টির তোড়ে দু হাত সামনের কিছুও দেখা যাচ্ছেনা। গেল, এই ভাবে তো দু মিনিট বৃষ্টি হলেও জল জমে যাবে। কান্না পেয়ে গেল দিয়ার। কতদিন পরে প্রিয় সাদা চুড়িদারটা পড়বে ভেবেছিল, সে গুঁড়ে বালি, থুড়ি, জল কাদা! ব্রেকফাস্ট খেয়ে, বর্ষার দিনের উপযোগী কেপ্রি আর টি শার্ট পড়ে, পার্স, ছাতা হাতে দিয়া রেডি। বৃষ্টিটা একটু ধরলেই বেড়িয়ে পড়বে। বাস পাওয়া আজ মুস্কিল, একগাদা টাকা খরচা করে অটো বা শেয়ার ট্যাক্সিতেই আজ যেতে হবে। মনে মনে একবার বসের চৌদ্দগুষ্টির যাচ্ছেতাই সুনাম করল এমন বর্ষার দিনে অফিসে ডাকার জন্য। আসলে আজ ওর উইক্লি অফ, কিন্তু বসকে আগামী সপ্তাহে জরুরি মিটিং করতে যেতে হবে হেড অফিসে, তাই টিমের সবার সব ছুটি ক্যান্সেল করে দিয়েছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিয়া বৃষ্টির অবস্থা দেখছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা হতে চলল। এই রে থামার যে কোন চিহ্নই নেই। বরং বেড়েই চলেছে। উল্টে জোরে হাওয়া বওয়ার ফলে সামনের রাস্তাতে এক্ষুনি একটা বড় গাছ ভেঙ্গে পড়ল, যার ফলে রাস্তা আটকা। কমপ্লেক্সের মধ্যেও প্রায় যেন একটা নদীর সৃষ্টি হয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটের কাজের মাসি ভিজতে ভিজতে ছাতা মাথায় দিয়ে আসছিল, দিয়াকে বারান্দায় দেখে বলল, " ও দি, একদুম বেরুনর চেষ্টাও করোনিকো। বড় রাস্তা অবধি হাঁটু জল, অনেক জায়গায় ডাল ভেঙ্গে রাস্তা বন্ধ। গাড়ী চলছেনি গো।" মাসীর কথা শুনে মনে মনে একটু খুশী হল বই কি দিয়া। সটান বসকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিল, আজ ওর পক্ষে অফিস যাওয়া সম্ভব না। খুব প্রয়োজন হলে work from home করে দেবে না হয়। বস ভদ্রলোকের বেহাল অবস্থা, নিজেই জলবন্দী, ওকে আর কি বলেন, তাই সহজেই ছুটি মঞ্জুর। অনেকদিন বাদে সেই ছোটবেলার মতই রেনি ডে পেয়ে দিয়া খুব খুশী।
গরম গরম চা বানিয়ে, এফ এম চালিয়ে বারান্দায় এসে বৃষ্টি দেখতে লাগল দিয়া। আজ রেডিওতে পরপর বৃষ্টির গান। ভালোবাসার গান। কিছু কিছু পুরনো গান শুনতে শুনতে স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল দিয়ার। তখন বরশা ওর খুব প্রিয়। টিউশন থেকে ফেরার পথে তখন এই বৃষ্টি পড়লে কি খুশীই না হত। অভীকটা কোনদিনও মনে করে ছাতা আনত না আর ফেরার পথে বৃষ্টি পড়লেই ওর সাথে ছাতা শেয়ার করতে করতে লেকের ধার দিয়ে হাঁটা হত, আহা। কি দিন ছিল। এখন এই সব কথা ভাবলেও হাসি পায়। কত ছেলেমানুষিই না করেছে সেই সময়ে। চাকরী সূত্রে সবাই যে যার মত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন রয়েছে। গত শীতে অভীকের বিয়েতে খেয়েও এলো দিয়া।
বৃষ্টিটা একটু কমতে দেখল আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলি থেকে বাচ্চাগুলো নীচে নেমে কাগজের নৌকো ভাসিয়ে খেলছে। একটাকেও সেরকম ভাবে চেনে না। নাম জানেনা। কিন্তু কেন কে জানে, খুব আনন্দ হল হঠাৎ ওদের দেখে। বছর দেড়েক হতে চলল দিয়া এই কমপ্লেক্সে থাকে, কিন্তু খুব বেশী প্রতিবেশীদের সাথে আলাপ পরিচয় নেই ওর। কি মনে হতে, আলমারি থেকে নিজের ক্যামেরাখানা বের করল দিয়া। যত্ন করে পলিথিনের কাভার লাগিয়ে নীচে নামল ছবি তুলতে। কমপ্লেক্সের "নদীতে" তখন লাল নীল সবুজ হলুদ নানান রঙের নৌকো ভেসে চলেছে। বাচ্চাদের সাথে সাথে তাদের বাবা মায়েরাও সামিল এই খেলায়। জল, কাদা, নৌকো, হঠাৎ পাওয়া ছুটি, হাসি, খিচুরি, ডিম ভাজার সাথে সাথে বর্ষা যেন হারানো শৈশব ফেরত এনে দিয়েছে আজ সকলের। দিয়া অনেকক্ষণ ছবি তুলল আজ। অনেকদিন পর। সন্ধ্যেবেলা ছবিগুলো নিয়ে ল্যাপটপ চালু করতেই ফেসবুকে একটা নোটিফিকেশন এলো। জনৈক সম্রাট মিত্রর থেকে মেসেজ। সকালবেলা ও যখন মন দিয়ে ছবি তুলছিল, তখনের তোলা একটা ছবি। নিজে ছবি নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করেছে বলে বুঝল যে ফ্রেমিংটি অসামান্য। মন দিয়ে এক হাত দিয়ে নৌকো ভাসাচ্ছে দিয়া, অন্য হাতে ক্যামেরা ধরা। ছবির ক্যাপশন "আদরের নৌকো।" সাথে এক লাইন, "বন্ধু হতে পারি?"
No comments:
Post a Comment