Thursday, September 21, 2017

জিয়া নস্টাল

ধুর, অফিসের ছুটিটা স্যাঙ্কশন হল না। অনেক করে শুভ বলল ম্যানেজারকে, কিন্তু তিনি আর কি বুঝবেন দুর্গা পুজোর সেন্টিমেন্ট। সমানে বলে গেল, projectএর এখন যা অবস্থা, কিছুতেই ছুটি দেওয়া সম্ভব না। এত বড় উজবুক, আবার বলে কিনা "তুমি না হয় দীপাবলিতে যাও।" আরে বাবা, না হয় কালি পুজোয় বাজি ফাটানো, আলো দিয়ে বাড়ি সাজানোতে আনন্দ আছে, কিন্তু কোনভাবেই কি তা দুর্গা পুজোর সাথে তুলনা করা যায়? কে বোঝাবে। খুবই বিরক্তি সহকারে নিজের কিউবিকলে এসে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ের মেসেজ। " বাবু, ছুটি পেলি?" মেসেজটা দেখে হঠাৎ রাগ চলে গিয়ে শুভর প্রচণ্ড কান্না এলো। এই প্রথম ওর সারা জীবনে পুজোয় বাড়ির থেকে এত দূরে থাকবে। একটা দুঃখ দুঃখ স্মাইলি পাঠিয়ে মা কে উত্তর পাঠালো শুভ। কি আর করবে, দাঁতে দাঁত চিপে, বুকে পাথর রেখে মেনে নিয়েই চলতে হবে। এইটাই বোধহয় বড় হওয়ার সাইড এফেক্ট। কোচিতে পুজো হয় ঠিকই, কিন্তু ও যেখানে থাকে, তার চেয়ে অনেকটা দূরে। অফিসে ছুটি না পেলে সন্ধ্যেবেলা টায়ার্ড হয়ে আদৌ যাওয়া হবে কি না সন্দেহ। তেমন বিশেষ চেনাজানা কেউ নেই যে একসাথে যাবে। একা একা কি আর ভালো লাগে না কি।

মনে পড়ে গেল, ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সাত্যকিরা পুজোয় সিমলা কুলু মানালি বেড়াতে যাচ্ছে শুনে ওরও কি বায়না বাড়িতে। কি? না ওকেও পুজোয় বেড়াতে যেতে হবে। সেইবারে মা বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, পুজোর পাঁচটা দিন, কোনভাবেই পাড়ার পুজোটা ছেড়ে কোত্থাও যাবে না ওরা। খুব মন খারাপ হয়েছিল শুনে, তখন নিজেদের ওই ছোট্ট পুজোটাকেই ভিলেন মনে হত। সব বন্ধুরা কি সুন্দর হয় হোল নাইটের প্ল্যান করছে, নয়তো কেউ কাশ্মীর যাচ্ছে। অথচ বাবা মা পাড়ার প্যান্ডেল ছেড়ে কোথাও যাবেই না। শুভর জন্য পুজো মানেই তাই শুধুমাত্রই গলির মোড়ের প্যান্ডেল। পঞ্চমীর দিন দুপুর থেকেই মায়ের ব্যস্ততা শুরু, সন্ধ্যেবেলা আনন্দমেলার জন্য ঘুগনি আর মোচার চপ বানানোর তোড়জোড়। তারপর ষষ্ঠীতে বিকেলে বোধনের পুজো, সপ্তমীর সক্কাল সক্কাল কলাবউ স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া, ফিরে এসে আবার পুজো, অষ্টমীর ভোগ রাধা, অঞ্জলির জন্য বাড়তি লোকবল চাই বলে ওদের পুরো গ্রুপটাকে ধরে বেঁধে হাতে হাতে সাহায্য করতে বসিয়ে দেওয়া, সন্ধিপুজোর জন্য পদ্ম বাছা, নবমীতে ভোগ বিতরণের সময়ে কুচেকাচারা মিলে সবার প্লেটে নুন আর বেগুনি দেওয়া। এই করেই কেটে যেত শুভর পুজোর কটা দিন। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেই বার কোন মাঝারী মাপের স্পন্সর জুটেছিল বুঝি, তাই একটু আড়ম্বরের সাথেই পুজোটা হয়েছিল। সকাল থেকেই রোজ মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নয়তো বাজলো তোমার আলোর বেণু। কান ঝালাপালা হয়ে যেত। তারই মধ্যে বিকেলের নাটকের জন্য শেষবার রিহার্সাল করা, সেখানে তখনও ডায়লগ ভুল বলার জন্য প্রীতিময় কাকুর থেকে বকা খাওয়া। তখন আবার চলত পাশের ঘরেই কাকিমার তত্বাবধানে সৌরভীদিদের নৃত্যনাট্যের প্র্যাকটিস। একটু আধটু উঁকিঝুঁকি যে হত না, তা নয়। সন্ধ্যেবেলায় এরা সবাই মাঞ্জা দিয়ে এসে স্টেজ কাঁপিয়ে অনুষ্ঠান করত। পুজোতে ওদের গোটা পাড়া পুরো একটা পরিবারের মত থাকত, ঠিক সেই সময়কার শালিমারের বিজ্ঞাপনের মতই। আরেকটু বড় হতে স্কুল কলেজের বন্ধুদের সাথে একদিন কি দুদিন বেরোনো। ওই ম্যাডক্স স্কোয়ার, সমাজসেবী, বালীগঞ্জ কালচারাল, আর তারপরে হাটারিতে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়া। কবে যে পুজো মানেই কলকাতা আর ওদের পাড়ার ছোট্ট প্যান্ডেল একাকার হয়ে গেল, খেয়ালই করেনি।
ডেস্কটপে একটা কোড রান করতে দিয়ে ফেসবুকটা খুলতেই আবার যেন এক রাশ বিরক্তি গ্রাস করল শুভকে। টাইমলাইন জুড়ে শুধুই পুজো আর পুজো। পুজোয় কে কবে কোথায় ঠাকুর দেখতে যাবে, কোন প্যান্ডেলে কি হচ্ছে, বৃষ্টি পড়বে কি পড়বে না, কুমোরটুলির ছবি, বাপরে। Whatsapp খুললেও বিভিন্ন গ্রুপে শুধুই প্ল্যান আর প্ল্যান। বড্ড অসহায় লাগছিল নিজেকে। সারা বছর কষ্ট করে ছুটি না নিয়ে কাজ করে করে শেষমেশ পুজোতেও এখানে কাটাতে হবে ভেবে ডিপ্রেশনে যায় যায় অবস্থা এখন শুভর। তারই মধ্যে লাঞ্চ টাইমে অফিস ক্যান্টিনে ওই জোলো সাম্বার আর ট্যামারিন্ড রাইস। ওয়াক উঠে আসার জোগাড়। সেদিন অনেকটা রাত্তির করেই শুভ ফিরল অফিস থেকে। খেতে খেতে চলল মায়ের সাথে ফোনে কথা।
" মা পুজোর তোড়জোড় কেমন চলছে?"
" ভালোই রে বাবু। এই তো জোর কদমে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। এবারে তোর নিলয় কাকু প্রেসিডেন্ট, বেশ জমজমাট আয়োজন করেছে। প্রচুর টাকা ঢেলেছে পুজোয়।"
" বাহ, ভারী ভালো কথা তো। ইস, খুব মিস করছি মা। জানো আজ টিকিটটা ক্যান্সেল করার সময় এত মন খারাপ লাগছিল কি বলব। কতদিন ধরে আশায় আশায় ছিলাম পুজোয় বাড়ি যাব। ধুর। ভাল্লাগেনা।"
" জানি তো বাবু। আমারও ভালো লাগছেনা।"
" বাবা এবারে নাটকে আছে?"
" না। এবারে তো পাড়ার ফাঙ্কশান খুব কম। নিলয় কিছু মাঝারি মাপের আর্টিস্ট আনাচ্ছে। তারাই করবে সব।"
" বাব্বাহ, আমাদের পুজোয় বাইরের আর্টিস্ট? বিরাট চেঞ্জ তো গো মা।"
" হ্যাঁ, তা আর বলতে?"
" ভাবতেই পারছিনা। যে স্টেজ একটা সময় ছিল আমাদের একমাত্র প্রতিভা প্রকাশের জায়গা, এখন সেটাও আর থাকলো না?"
" সেসব দিন আর কোথায় রে বাবু। আজকাল তো ফাঙ্কশান করার জন্য লোক পাওয়া যায় না। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। টাকায় কুলোলে কেন বাইরের আর্টিস্ট আনবেনা। অন্তত কিছু না হওয়ার থেকে ভালো।"
" বল কি! লোক পাওয়া যায় না? আর আমাদের রীতিমত অডিশন করাতে তোমরা।"
" দিন কাল বদলে গিয়েছে রে। এই পুজোতেও সব পাল্টে যাচ্ছে। মিটিংগুলোতেই তো দেখতাম। শুধুই দেখনদারি। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। "
" যাহ, তবুও।"
" হুম। "
" শোনো এক কাজ করো তাহলে। এবারে বরং তোমরা চারদিনে চারটে সিনেমা দেখে ফেলো। এত  ছবি রিলিজ করছে তো, ইউটিউবে ট্রেলার দেখছিলাম।"
" আইডিয়াটা মন্দ বলিসনি। দেখি।"
" কিন্তু শোন, প্লীজ, অষ্টমীর সকালে আমায় ঢাকের আওয়াজটা কিন্তু অবশ্যই শোনাবে।"
" ঠিক আছে, কিন্তু কি করে?"
" ফেসবুক লাইভ আসবে, বুঝেছ?"
" সে সব কি করে করে?"
" দাঁড়াও, তোমায় একটা ডিটেল্ড পি পি টি বানিয়ে পাঠাচ্ছি।"
" মুখে বল না রে। তোদের এই কথায় কথায় পি পি টি। কি রে।"
" কি করব, অভ্যেস। দাঁড়াও, ভিডিও কল করি। দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি ল্যাপটপে স্কাইপ অন করো। ফোনটা হাতে নাও, শেখাচ্ছি।"
মিনিট কুড়ি কসরত করে অবশেষে মা কে লাইভ আসাও শিখিয়ে দিল শুভ। খানিক নিশ্চিন্ত হয়েই ও মা কে বলল, " যাক, পুজোয় তাহলে ঢাকের আওয়াজটা মিস হচ্ছেনা।"
" একদমই তাই।"
" শুধু প্যান্ডেলে থাকতে পারব না।"
" তা কেন বাবু? আমি মাঝে মাঝেই লাইভ আসব, দেখে নিবি তখন।"
" তবুও।"
" কি তবুও তবুও করছিস? নতুন জামা পড়ে অফিস যাবি। হাতে ফেসবুকে পাড়ার প্যান্ডেল। একটুও মিস করবি না।"
" হ্যাঁ, আর যখন তোমরা খিচুরি লাবড়া খাবে আর আমি কার্ড রাইস?"
" খাবি না! সুইগি কি করতে আছে? কিছু ভালো মন্দ পছন্দসই অর্ডার করে নিবি। নিজে রান্না করতে জানলে এই অসুবিধেও হত না।"
" রাঁধতে তো পারি। তবে ইলাবোরেট পারব না। কিন্তু দেখি, কিছু সোজাসাপ্টা রান্না বলো তো, চেষ্টা করব। এই শনি রবিতে ট্রায়াল দেব। পুজোর কটাদিন ফাইনাল রান।"
" তাই ভালো। বলে দেব। যা অনেক রাত হল, এবার শুয়ে পড়। আমারও ঘুম পাচ্ছে।"
" হুম। ঠিক আছে মা। গুড নাইট। "

এই না হলে মা? মুহূর্তের মধ্যেই কিরকম সারাদিনের সমস্ত মন কেমন করা, বিরক্তি, রাগ, খারাপ লাগা...ভ্যানিশ! ঝটপট অনলাইন এসে ম্যান্ডেটরি স্ট্যাটাস আপডেটটা এবার করে ফেলতে হবে শুভকে, "এসো মা, আমি রেডি।" এবার মায়ের কল্যাণে, শারদোৎসবের আমেজ পাবে শুভ সাম্বার রসমের দেশে বসেও।

No comments:

Post a Comment