Monday, September 4, 2017

প্রতিচ্ছবি

অনুর বয়স পঁচিশ, এম বি এ পড়া শেষ করে এবারে বছরখানেক হল ও কলকাতায় এসেছে পুণা থেকে। মা বাবা পুণাতেই থাকেন, প্রবাসী বাঙালি। মাস চারেক একটা হোস্টেলে থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে, দালালকে টাকা দিয়ে গড়িয়া মেট্রো ষ্টেশনের কাছেই তিনতলার ওপর এই ফ্ল্যাটবাড়িটি ভাড়া নিয়েছে। বাজেটের মধ্যে তো হয়েইছে, তার ওপর, অফিসের যাতায়াতেরও খুব সুবিধে। বাড়ীটা বেশ সুন্দর, দক্ষিণের একটা বারান্দা আছে। সন্ধ্যে হলে বারান্দার দিকের জানলা খুলে রাখলে, ঘরে আর পাখার প্রয়োজন হয়না। ছিমছাম দুই কামরার ফ্ল্যাট। পাশেই সুপারমার্কেট, নিজের বাজারহাট নিজে করে, রান্না করে দিব্যি চলছে। বিল্ডিঙের অন্যান্য পরিবারগুলির সাথে অল্প বিস্তর পরিচয় হয়েছে। তবে আশে পাশের বাড়ির লোকেদের এখনো চিনে ওঠেনি। শুধু জানে, উল্টোদিকের বাড়িতে চারতলায় একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা থাকেন, সাথে থাকে ওনার ছেলে। ছেলেটির বয়স আন্দাজ তিরিশ। কোন মানসিক রোগের শিকার, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে, জানলার ধারে। আর ওদের জানলা দিয়ে একদম অনুর শোওয়ার ঘর পরিষ্কার দেখা যায়। অনেকবার রাত্রে জানলার ধারে দাঁড়ালে অনু দেখেছে, ছেলেটি হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর ফ্ল্যাটের দিকে। প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হত, সারাক্ষণ মনে হত কেউ যেন ওর প্রতিটা পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। ও কখন কি করছে, কোথায় যাচ্ছে বাড়ির মধ্যে, সব দিকে যেন কেউ নজর রাখছে, ঠিক যেমনটা সি সি টি ভি ক্যামেরা বসানো থাকলে হয়। বিরক্ত হয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিত অনু। কিন্তু গরম পড়লে উপায় নেই, জানলা খুলে পর্দা তুলে ঘর অন্ধকার করে শুত। আড়াল থেকে দেখত, ছেলেটি ঠায় তাকিয়েই আছে ওর ঘরের দিকে।
উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মানসী বৌদির কাছে এই কথাটা বলেছিল বটে। তবে বৌদি তেমন গা করেনি। নতুন লোক দেখেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল হচ্ছে, কদিন বাদে ঠিক কেটে যাবে, এইসব বলে প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়েছিল। অনুও সেই যুক্তি মেনে নিয়ে দিব্যি চালাচ্ছিল।
 কিন্তু এরপর একদিন বাধল গোলযোগ। সেইদিন অফিসের কাজ কম থাকায় বিকেল বিকেল ফিরে আসে অনু। চায়ের কাপ হাতে জানলার ধারে চেয়ার টেনে বসেছে, দেখে ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখল, ছেলেটিও একটা কাপে করে কি খাচ্ছে। বিকেলবেলা, চায়ের সময়। হতেই পারে। এ আর এমন কি। কিছু মনে হয়নি অনুর। খানিকক্ষণ পরে ও তাক থেকে গল্পের বইটা নিয়ে এসে বসল। কাজের চাপে অনেকদিন ধরে ওর বই পড়া হয়ে ওঠেনি, আজ সুযোগ পেয়ে বসল অনু বই নিয়ে। পড়তে পড়তে মনে হল, উল্টো দিক থেকে কেউ যেন জরিপ করছে ওকে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে, কি আশ্চর্য, ছেলেটিও হাতে একটা বই এনে পড়ার ভান করছে। বিরক্ত হয়ে অনু উঠে চলে গেল বসার ঘরে। একটু পরে আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখল, ছেলেটি তখনো হাঁ করে ওর জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত মানুষ রে বাবা। মানুষের মন কত বিচিত্র, এইসব ভাবতে ভাবতে সেদিনের মত দিনটা কাটল।
 প্রায় দিন দশেক ধরে চলল এই উৎপাত। অনু খাচ্ছে, তো সেও খায়। অনু জল খাচ্ছে, তো তার হাতেও জলের বোতল, অনু ফোনে কথা বলছে, তার কানেও মোবাইল। অনু কাপড়জামা তুলছে বারান্দার দড়ি থেকে, তো সেও ন্যাকড়া জোগাড় করে তা নিয়ে জামা তোলার খেলা খেলছে। অনু যেন পাগল হয়ে যাবে এরকম চলতে থাকলে। এর কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। ঠিক করল, রবিবার ওদের বাড়ি যাবে ও। ছেলেটির মায়ের কাছে বলবে ঘটনাগুলি। কিন্তু অফিসের কিছু বাকি কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেই রবিবার ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আজ সোমবার, অফিসে মারাত্মক খাটুনি গিয়েছে। তার ওপর বৃষ্টি শুরু হওয়ায় রাস্তাঘাটে ট্রাফিক জ্যাম সাংঘাতিক ছিল। ভিড় বাসে বসার জায়গা পায়নি, তার ওপর বাড়িতে মায়ের সাথেও ফোনে এক প্রস্থ ঝগড়া হয়েছে। সব মিলিয়ে অনুর আজ মন মেজাজ খিঁচরে আছে। বারান্দায় একটু শান্তিতে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হবে বলে যেই দরজাটা খুলেছে, দেখে সেই ছেলেটা ওর দিকে একটা অদ্ভুত রকমের ব্ল্যাংক এক্সপ্রেশন দিয়ে তাকিয়ে আছে। মাথাটা এক্কেবারে গরম হয়ে গেল অনুর। এর শেষ দেখেই ছাড়তে হবে। হঠাৎ করে রেডিয়োতে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে গেল ওর, আর খেলে গেল একটা আইডিয়া। হন্তদন্ত হয়ে আলমারি থেকে একটা বড় ওড়না বের করল অনু। এরপরে ঘরের আলো নিভল। উলটো দিকেও ঘটল ঠিক একই ঘটনা, যেন আয়নার প্রতিচ্ছবি। সে আনল তার মায়ের জামার তাক ঘেঁটে একটা লাল ওড়না। তারপরে ওই ঘরেও আলো নিভল। অনু পর্দার আড়াল থেকে সবই দেখতে পাচ্ছিল ছায়ায়, উলটোদিকও ঠিক তাই। এরপরে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে পাখায় ফাঁস জড়াল অনু। গলায় পড়েও নিলো। তারপরে চট করে, প্রায় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই ফাঁস খুলে হাতে রাখা ওর লাইফসাইজের মেয়ে পুতুলটার গলায় ফাঁস জড়িয়ে নিজে টুল থেকে নেমে, সঙ্গে সঙ্গে এক ধাক্কায় টুলটা ফেলে দিল। পুতুলটার গলা ভেঙ্গে ঝুলতে লাগল। জানলার বাইরে দিয়ে কেউ দেখলে বুঝত কেউ গলায় দড়ি দিয়েছে। গোটা ব্যাপারটা ভীষণ ক্ষিপ্রতার সাথে করল অনু, ওর ছোটবেলায় শেখা হাতসাফাইয়ের বিদ্যা কাজে লাগল অবশেষে।
এরপরে শুধুই অপেক্ষা। উলটোদিকে তখনো ছেলেটি দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে। অনু একবার ভাবল, আলোটা জ্বেলে ওর সামনে দেখা দেয়। পর মুহূর্তেই মনে হল যে না, ও এমনিও কোন কাজেই লাগছে না সমাজে। ঠায় বসে থেকে ওকে বিরক্ত করে ওর নজর দিয়ে। ওর জন্য ওর মাও নিশ্চয়ই খুবই ব্যাতিব্যস্ত। এ না বাঁচলেও খুব একটা কারুর ক্ষতি হবেনা। অন্তত নিজে তো শান্তি পাবে। এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অনুর চোখ গেল জানলায়। দেখল, সেখানে কোন ঝুলন্ত মানুষের ছায়া। যাক, আপদ বিদায় হল।
কোনমতে রাত্রের খাবারটা ফ্রিজ থেকে বের করে খেয়ে সবে শুতে যাবে অনু, এমন সময়ে শুনতে পেল উল্টোদিকের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ীর সাইরেন। মানসী বৌদি ওর ফ্ল্যাটে বেল বাজিয়ে এসে জানিয়ে গেল, ওই বাড়ির পাগল ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, কোন কারণ এখনো জানা যায়নি, পাওয়া যায়নি সুইসাইড নোট। ওর মা রাত্রে খাবার দিতে এসে অন্ধকার ঘরে আলোর সুইচ জ্বালিয়ে এই সাংঘাতিক দৃশ্য দেখে চীৎকার চেঁচামিচি করে আশে পাশের বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো করেন। এম্বুলেন্স পুলিশ সব এসে ছেলেটিকে মৃত ঘোষণা করে। "যাক, তুই এবার তাহলে বাঁচলি বল, আর তোকে কেউ অনুকরণ করবে না, তাই না?" এই বলে হাসতে হাসতে বৌদি চলে গেল।
একটা মিশ্র অনুভুতি কাজ করছিল অনুর মধ্যে। ওর জন্যই কি তাহলে একটা মানুষ মারা গেল? কিন্তু এ আবার কি? প্রাপ্তবয়স্ক, নিজের ভালো মন্দর কোন বাছ বিচার নেই? ও কুয়োয় ঝাঁপ দিলে সেও ঝাঁপ দেবে? অনুর কি দোষ? অনু কি একবারও ওকে বলেছিল যে বাবা, আমি যা করি, তুমিও ভাই সব করো। তুমি আমার মিরর ইমেজ হও? আমি মরতে গেলুম, তুমিও এসো? না না, নিজেকে এরকমভাবে দায়ী করলে চলবে না।
সেই রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না অনুর, বিছানায় শুয়ে খালি এ পাস আর ওপাশ করে চলেছিল। মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচিল উল্টো দিকের বাড়িতে। সেখানে তখনো অনেক লোকজনের ভিড়। প্রায় ভোর রাত্রির দিকে চোখে ঘুম নেমে এলো ওর। পরেরদিন যথারীতি সকালের চায়ের কাপ আর আনন্দবাজার হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল অনু। সাতের পাতায় একটা ছোট্ট কোণায় দুই লাইনের খবর চোখে পড়ল। গড়িয়ায় যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু।
আর হঠাৎই একটা পরিচিত অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে লাগল। ঠিক যেন সি সি টি ভি ক্যামেরা দিয়ে কেউ ওকে দেখছে। কিন্তু, এ কি, আবার কে দেখেছে ওকে? কেউ কি ওর দিকে তাকিয়ে আছে? এরকমটি মনে হতে চোখ তুলে সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়েই অনুর দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। ফ্যাকাশে মুখে ও দেখল, একটি অচেনা ছেলে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

No comments:

Post a Comment