Sunday, September 17, 2017

বাহানা

"বুবুল ঘুম থেকে উঠবি কি না বল এবার? আমি কিন্তু আর ডাকব না। এরপরে বাস মিস করলে কিন্তু আমি পারব না স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতে। এই বলে রেখে দিলাম।"  সাতটা বেজে গিয়েছে, গত আধ ঘণ্টা ধরে ছেলের পিছনে টিকটিক করতে করতে মিতিন ক্লান্ত, বিরক্ত। সাড়ে পাঁচটার এলারমে চোখ খুলে আধ ঘণ্টা কোনমতে যোগব্যায়াম করেই শুরু হয়ে যায় দৈনিক যুদ্ধ। বুবুলকে স্কুলের জন্য তৈরি করা, ব্রেকফাস্ট বানানো, তিনজনের জন্য টিফিন প্যাক করা; ইতিমধ্যে শিউলি দি এসে পড়লে তার পিছনেও সমানে টিকটিক করে যাওয়া। মাঝে মাঝে তো মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে হয়, গড়িয়া থেকে এন্টালি, অফিস টাইমে মিনিবাসে প্রায় এক ঘণ্টা লাগালেও, অন্তত ওই একটি ঘণ্টা তো নিজের মত করে কাটানো যায়, একটু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচা। আবার তো তারপরে অফিসে ঢুকে ইস্তক শুধুই কাজ আর কাজ। অভিরূপ কিছু আলাদা করে দাবী দাওয়া করেনা বটে, কিন্তু তেমন ভাবে সাহায্যও করেনা। 
চায়ের কাপটা অভির সামনে রেখে একবার পাঁচ মিনিটের জন্য আনন্দবাজারটা মিতিন  উল্টেপাল্টে দেখবে, এমন সময়ে দেখল মোবাইলে একটা মিসড কল, শিউলিদির ছেলের নম্বর। ব্যাস, এই হল। সেই এক রুটিন, ফোন করলেই শুরু হবে কোন না কোন বাহানা দেওয়া। হয় নিজের জ্বর, নয় স্বামীর পেট ব্যাথা। আজকাল তো আবার নতুন কাঁদুনি শুরু হয়েছে, নাতির অসুখ। আরে বাবা, মাস গেলে টাকাটা নেওয়ার সময় তো হাত কাঁপে না একটুও, এদিকে চারদিনের চুক্তি করে আট দিন ছুটি, কথায় কথায় টাকা ধার চাওয়া, এরাই বেশ আছে। আধবেলা কাজ করো, তারপর বাড়ি ফিরে অবসর। ট্রাফিক জ্যাম, ভিড় বাস, অটো কিছুর ঝক্কি পোহাতে হয়না, ট্রেন ক্যান্সেল হলেও ছুটি। সি এল, ই এলের ধার ধারেনা, অথচ এদের দেখো হাজার একটা দাবী, সংগঠন চাই, আরও মাইনে চাই। টাকা কি গাছে ফলে নাকি যে বললেই মাইনে বাড়াতে হবে। একেই বারো মাস কাজ করে তেরো মাসের মাইনে, এ ছাড়াও পয়লা বৈশাখে শাড়ী, জ্বর ব্যাধি হলে ওষুধ পত্তর, লেগেই আছে। মাথাটা গরম হয়ে যায় মিতিনের। শিউলিদি না এলে আরেক প্রস্থ কাজ বাড়বে, উফ ওদিকে এতক্ষণেও বুবুল ওঠেনি। অভিরূপের দিকে তাকিয়ে প্রায় ঝাঁঝিয়েই উঠল ও, "বসে বসে কি তখন থেকে কাগজ পড়ে চলেছ বলো তো? দেখলে তো শিউলিদির মিসড কল, নির্ঘাত আসবে না। এক গাদা কাজ বেড়ে গেল আমার, যাও গিয়ে বুবুলকে রেডি করো। পারি না আর, মুক্তি চাই।"
"আহ মিতু, তুমি না বড্ড অল্পেই অধৈর্য হয়ে পড়ো। আমি বুবুলকে দেখছি, কিন্তু আগে ফোন তো করে দেখো শিউলিদিকে, কি বলছে শোনো।" ঠাণ্ডা স্বভাবের অভিরূপ মিতিনকে শান্ত করার একটা চেষ্টা করে বটে, কিন্তু সকালের এই হড়বড় তড়বড়ের সময়ে যে সেটা কোনভাবেই সম্ভব না,তা বুঝিয়ে দিল মিতিনের পরবর্তী বাক্যবাণ। " হ্যাঁ সে করছি। কিন্তু ওই তো একই বলবে। অসুখ বিসুখ। জানো গত সপ্তাহে আমার থেকে তিন হাজার টাকা ধার নিল, আগের মাসের দুই হাজার এখনো ফেরত পাইনি। এরপরে আবার বোনাস চাইবে। কাজে আসবেনা, কিন্তু টাকা নিতে ঠিক ছুটতে ছুটতে চলে আসে এরা, যতসব। অ্যামেরিকার মত যবে এখানেও রোবট চালু হবে, বেশ হবে। বুঝবে ব্যাটাগুলো তখন কত ধানে কত চাল। বেড়িয়ে যাবে ওদের যত চালাকি।"
"আচ্ছা সেসব পরে ভাববে। দেখো ফোনটা করে। আমি বুবুলকে দেখি। এদিকে কোন হেল্প লাগলে ডেকো।" অভিরূপ বুবুলের দায়িত্ব নিচ্ছে দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে শিউলি দিকে ফোন লাগাল মিতিন। পাঁচ মিনিট পর ফোন রেখে অভিরূপকে ডেকে বলল, " শিউলিদির নাতিটা নাকি কাল রাত্তিরে মারা গিয়েছে। তাই কটাদিন আর আসবে না ও।"
"সে কি? কি হয়েছিল?"
" কদিন জ্বরে ভুগছিল। বলছে নাকি টাইফয়েড হয়তো।"
" আহা রে।"
"ওসব আহা রে আহা রে করো না তো। প্র্যাক্টিকাল সমস্যাটা ভাবো। এ কদিন বাড়ি সামলাবে কে? অন্য লোকও কোন পুজোর মুখে পাব না। আর শিউলিদি কে কাজ থেকে ছাড়ালে অতগুলো পাওনা টাকাও আর ফিরবেনা। কি যে হয়? বিরক্তিকর।"


মাস খানেক পরের কথা। শিউলিদির জিম্মায় বাড়ি রেখে অফিস বেরোনোর মুখে মিতিন অভিরূপকে বলল, "দেখো, এখন আর শিউলিদি আর কামাই করেনা। বুঝলে অভি, একদিকে ভালোই হল কিন্তু। শিউলিদির কামাই আর টাকা ধার চাওয়ার একটা বাহানা তো কমল।" 



No comments:

Post a Comment