Monday, September 11, 2017

মাতৃরূপেণ

ভোর চারটে। তখনো বাইরে আলো ফোটেনি। আশেপাশের বাড়িগুলি থেকে ভেসে আসছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর পরিচিত কণ্ঠ আর পদ্ম ঠাকুমাদের বাড়ি থেকে ধূপের গন্ধ। রুমা বৌদিদের ঘরে আলো জ্বলে উঠল। বাইরে তখনো টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ডোবার ধার থেকে ব্যাঙের ডাক ভেঙ্গেচুরে দিচ্ছে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা। ঝরে পড়া শিউলি ফুলের গন্ধে বাতাস মাতোয়ারা। পুণ্যির দু চোখের পাতা এক হয়নি সারা রাত, সমানে জল পট্টি দিতে হচ্ছে যে ওর দশ বছরের মেয়ে মুনিয়ার কপালে। গত এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে মুনিয়া। হাসপাতালের ডাক্তার সেই ঝড় জল শুরু হতেই যে চলে গিয়েছেন, আর দেখা নেই তার। ডিস্পেন্সারির মন্টু দা তাও জ্বরের ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু মুনিয়ার শরীর ভালোই হচ্ছেনা। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দুইবেলা পেট ভরে দু মুঠো ফ্যানা ভাতও জোটেনি কতদিন হয়ে গেল। বন্যার পর থেকে মাঠে ফসল নেই, জমানো যেটুকু পুঁজি ছিল, তাও নিঃশেষ। ধার বাকিতে আর কতদিন চালানো যাবে, ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে পুণ্যির।
গতকাল কোন বাড়ি থেকে দুপুরবেলা পায়েসের গন্ধ আসছিল। পুণ্যি তখন বাগানের পুঁই ডাঁটা কাটতে বসেছে, যদি বিক্রি করে দুটো টাকা আসে ঘরে। এমন সময়ে মুনিয়ার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, " মা, কি সুন্দর গন্ধ গো। তুমি কি পায়েস করছ?" বুক ফেটে আসা কান্নাটাকে অনেক কষ্টে চেপে রাখে পুণ্যি, মুনিয়ার সামনে চোখের জল ফেলা যাবেনা যে। " না রে মা, আজ না। কাল তো মহালয়া। আমি কাল করব। পেট ভরে খাস।" মুনিয়ার চোখের চকচক দেখে যে কি আনন্দ হয়েছিল, কিন্তু ভয়ে বুক দুরদুর করছিল। মেয়েকে কথা তো দিল, কিন্তু কি করে পারবে? হঠাৎ মনে পড়ল, রুমা দি বলেছিল, কলকাতায় নাকি এবারে কোন পুজোতে মা দুর্গাকে সোনার শাড়ী পড়াবে, নিশ্চয়ই ওদের খুব টাকা। ওদেরকে বললে ওরা দেবে না ওকে একটু কটা টাকা? শুনেছে তো এইসব পুজোর বাবুরা অনেক দান ধ্যান করে, তাতেও নাকি পুরস্কার।
রূপং দেহি, জয়ং দেহি দিয়ে শেষ হল মহিষাসুরমর্দিনী, ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটেছে। আকাশের মেঘও অল্প অল্প কেটেছে। পদ্ম ঠাকুমাকে মুনিয়াকে দেখতে বলে পুণ্যি বেরোল ষ্টেশনের দিকে। যে করেই হোক, আজ মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতেই হবে, জয়ী হতেই হবে সমস্ত বাধার বিরুদ্ধে।

No comments:

Post a Comment