সবেমাত্র মিঃ সরখেল গেলেন হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিয়ে। এবং যা বললেন, তা মোটেই সুখকর না। নতুন করে কোন আয় নেই। জমা টাকাপত্র যা আছে, তাতে আর মেরেকেটে বছর পাঁচেক চলে যাবে। কিন্তু তারপর? এই এত বড় বাড়ির মেন্টেনেন্স? কিছুদিন আগেই উৎপাত শুরু। সকাল সকাল শোভা স্নান সেরে ঠাকুর পুজোর তোড়জোড় করছেন, সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ নীচতলা থেকে মলয়ার চীৎকার। "কি সব্বনাশ হল গো। শীগগির এসো কত্তা মা।" মলয়ার সবকিছুতেই বড্ড রঙ চড়িয়ে কথা বলার অভ্যেস। কাজেই প্রথম প্রথম তেমন গা করলেন না শোভা। ভাবলেন, একেবারে পুজো মিটিয়ে তারপরে নীচে নামবেন। কিন্তু তা আর হল না। খানিকক্ষণের মধ্যেই মলয়া ওপরে এসে হাজির। "ও কত্তা মা, সব্বনাশ হয়েছে। তোমায় নীচে ডাকছি, শুনতে পাওনি? এসো এসো, শীগগির এসো, দেখো কাণ্ড।"
"কেন কি হল আবার?"
"এক তলার ঘরে জল ঢুকে টইটুম্বুর অবস্থা। আমি ঘর পরিষ্কার করতে খুলেছি, আরেকটু হলেই মেঝেতে পা হড়কে পড়ছিলাম। মেঝেতে জলে জলাক্কার।"
"কোত্থেকে জল এলো? বাথরুমে কল খোলা ছিল নাকি?"
"না গো না। দেওয়াল ভেদ করে জল এসছে।"
" সে কি? বাহাদুর কে বল প্লাম্বার ডাকতে। চল তো দেখি।"
হাঁটুর ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। কোনমতে একতলায় এসে যা দেখলেন, বেশ চিন্তার বিষয়। লাল সিমেন্টের মেঝেতে প্রায় গোড়ালি অবধি জল। খানিক বাদে প্লাম্বার এসে যা বলল দেখেশুনে, তার সারমর্ম এই যে একটা বড় খরচের ধাক্কা। পাইপলাইনে কিছু আটকে আছে, জায়গায় জায়গায় মর্চেও ধরেছে। দেওয়াল ভেঙ্গে পাইপের কাজ করতে হবে। আপাতত অত খরচের জন্য টাকা হুঠ করে এরকম বের করা যে অসম্ভব, ভালোই বোঝেন শোভা। ছাদের জলের লাইন বন্ধ করে বালতি করে জল ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। তড়িঘড়ি সরখেল, অর্থাৎ পারিবারিক উকিলকে ডেকে পাঠালেন।
সরখেলও ওই আসছি, আজ কাল করতে করতে প্রায় এক সপ্তাহ পরে এসে যা হিসেব দিল, তা শুনে শোভার মাথায় হাত। বছর দুই আগে স্বামী মারা গিয়েছেন। প্রাইভেট ফার্মে চাকরীর সুবাদে কোন পেনশন নেই। উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল বনেদী বাড়ির মেয়ে ও বৌ হওয়ার সুবাদে অনার্স সহ গ্র্যাজুয়েশন পাস করলেও কোনোদিনও চাকরীর চিন্তা মাথায়ই আসেনি শোভার। কেবলমাত্র স্বামীর উপার্জন ও জমানো টাকার ওপর নির্ভর করে চললেও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন, এই চিন্তাই করছিলেন। বিমল বাবু কোনদিনও টাকা পয়সার হিসেব পরিস্থিতি কিছু কখনো শোভাকে বলতেন না। নিঃসন্তান হওয়ায়, শেষ দিকে এসে যখন রোগে ভুগে শয্যাশায়ী, তখন সরখেলকে ডেকে শোভার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ওনার মৃত্যুর পর খরচের লাগাম টেনে নিজের হাতে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে দিব্যি চলছিল। কখনো কল্পনা করেননি যে টাকার জন্য অসুবিধেয় পড়তে হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, ঘটে আরেক। এক বছর আগে শোভার এক দূর সম্পর্কের ভাই এসে কান্নাকাটি করে তার মায়ের চিকিৎসা বাবদ বেশ কিছু টাকা নিয়ে গেলেন। চিরকাল সকলের বিপদে আপদে দাঁড়িয়েছেন বিমল ও শোভা, তাই এখনো কেউ কোন বিপদে পড়লে আগে শোভার কাছে আসে। এই রকম করে আরো কয়েকজনকে সাহায্য করে শোভার ভাঁড়ার শূণ্যের দিকে। পাড়ার দুর্গা পুজোয় মোটা চাঁদা দেওয়া, কালী পুজোয় ক্লাবের ছেলেদের বাজি কিনে দেওয়া, দোলে আশেপাশের সমস্ত বাড়িতে ভীম নাগের মিষ্টি পাঠানো, কত কিছু চলত। আর এখন কি না সামান্য একটা রেনোভেশনের জন্য দশবার ভাবতে হচ্ছে। কি দিনকাল পড়ল। খরচ বাঁচাতে গাড়িটাও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যেটুকু যা বেরোন শোভা, বাহাদুর ট্যাক্সি ডেকে দিলে প্রয়োজন মিটে যায়।
কে জানে কী করে, কিন্তু এইসব খবর বুঝি বাইরে খুব সহজেই রটে যায়। মাস ছয়েক আগে কাজারিয়া বিল্ডারস থেকে একজন বাড়ি এসে ভালো মতন করে সরেজমিনে দেখে টেখে লোভনীয় অফার করেন। বাড়ি জমির পরিবর্তে এখানে যে নতুন ফ্ল্যাট উঠবে, তাতে দুখানা শোভার প্রাপ্য। আর নগদ পাঁচ লাখ টাকা। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন সেদিন এমন অফারের কথা শুনে। এই বাড়ি ওদের আভিজাত্য, ওদের গর্ব। বেঁচে থাকতে কখনোই বিক্রি হতে দেবেন না। রীতিমত রাগে গড়গড় করতে করতে কাজারিয়ার কর্মচারীকে বাড়ি থেকে সেদিন বিদায় করেছিলেন শোভা। দুইদিন পরে চিঠি আসে ওদের থেকে। অফারটি বহাল রয়েছে। উলটে পাঁচের জায়গায় সাত দেওয়া হবে। উনি যেন ভাবনা চিন্তা করেন। যখনই মত বদলাবেন, অবশ্যই যেন ফোন করেন ওদের। ওদের লোক সঙ্গে সঙ্গে এসে এগ্রিমেন্টের ব্যাপারে কথা বলে নেবে। আজ শোওয়ার ঘরের এসে কাঠের আলমারিটা খুলে কাপড়ের নীচে সযত্নে রাখা সেই চিঠিটি বের করলেন শোভা। বাড়িটি তবে বিক্রি করবেন কি? যদি ঠিক করে রাখতেই না পারেন, তাহলে রেখে কি হবে? অন্তত বিক্রি হলে কিছু টাকা আসবে, ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। কিন্তু...এই বাড়ী, তার শ্বশুর মশাইয়ের ঠাকুরদার নিজের বানানো বাড়ি, সান্যালদের এতদিনের ভিটে বিল্ডারদের হাতে চলে যাবে? এই দালান, গাড়ি বারান্দা, উঠোন, কড়ি বর্গা, কাঁচের ওপর রঙ করা জানলা, চিলেকোঠার ঘর, লম্বা লম্বা টানা পাখা, ঝাড়বাতি, দামী শেগুন কাঠের চেয়ার টেবিল সবার আয়ু ফুরোলো বুঝি?
চিঠিটি হাতে নিয়ে আরামকেদারায় বসে থাকতে থাকতে দুই চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙল শ্রীরাধার ডাকে। শ্রীরাধা ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। বছর তিরিশেক বয়স। আগে বম্বেতে থাকত, এক বছর হতে চলল কলকাতায়। ও আর ওর স্বামী পরিমল একটা স্টার্ট আপের সাথে যুক্ত। সারাদিন তাই অনেক খাটাখাটনি লেগেই আছে। কাজের জন্য অনেক সময়েই বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। সেইসব সময়ে ওদের চার বছরের বাচ্চা, রুমিকে শোভার কাছে রেখে যায়। রুমির সাথে শোভার খুব ভাব। আসলে নিজের কোন সন্তান না হলেও, বরাবরই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনিদের সাথে শোভার আলাপ, ভাব সহজেই হয়ে যায়। ওর মধ্যে কিছু একটা আছে, যাতে বাচ্চারা খুব সহজেই ওর সাথে মিশতে পারে। শ্রীরাধা প্রথম প্রথম দ্বিধা করত রুমিকে খালি খালি শোভার কাছে রেখে যেতে, কিন্তু শোভাই একদিন বলল, " হ্যাঁ রে শ্রী, তোর মেয়েকে ওই কাজের লোকের কাছে সারাক্ষণ রাখিস কেন রে? আমার কাছে তো দিব্যি থাকে। তুই যখন ব্যস্ত থাকবি, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। আমারও একটু সময় কাটে। রুমিরও ভালো লাগে।"
"আসলে মাসি, আমি তো খুবই নিশ্চিন্ত হব তোমার কাছে রুমিকে রাখতে, শুধু ভাবি যে তোমার অসুবিধে হয় যদি কোন।"
সঙ্গে সঙ্গে শোভার উত্তর, "ও, মাসী বলবি মুখে, কিন্তু ভাবিস না। এই তো? আজ যদি তোর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক হত, তাহলেও এমন দশবার ভাবতি তো?"
"আরে তা না মাসী। বেশ, ঠিক আছে। এবার থেকে রুমি তোমার কাছে থাকবে। কিন্তু সাথে আমি ওর আয়াকেও পাঠিয়ে দেব যাতে তোমার ওপর বাড়তি হ্যাপা না হয়। রাজি?"
" রাজি।"
সেই থেকেই রুমি শোভার কাছে দিনের মধ্যে বেশ খানিকটা সময় কাটায়। দুজনে মিলে চলে নানান খেলা, লাল কমল নীল কমলের গল্প। শোভার কাছে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে ছোট্ট রুমি তখন পৌঁছে যায় কল্পনার রাজ্যে। কিন্তু আজ শ্রীরাধা একা এসছে। একটু অবাক হলেন শোভা। জিজ্ঞেস করলেন, " কী রে, আজ তুই একা? আমার নাতনি কই?"
"নাতনি খেলছে তার বাবার সাথে। আমি তাই এমনিই এলাম তোমার খবরাখবর নিতে।"
" বেশ করেছিস। চা খাবি?"
"হ্যাঁ, দাঁড়াও মলয়া দি কে বলে আসি।"
মলয়াকে চায়ের কথা বলে এসে গুছিয়ে বসল শ্রীরাধা।
"কেমন আছ বল।"
"আর কেমন আছি। ওই আছি এক রকম রে। কবে ডাক পাব, সেই অপেক্ষায়।"
"আহ মাসী।"
" কি হবে বল বেঁচে থেকে? সমস্যাই সমস্যা।"
"কেন? কী হল?"
"টাকা পয়সা রে।"
"টাকা পয়সা কী হয়েছে?"
"বাড়িটা সারানোর জন্য তেমন ফান্ড নেই রে। এই এত বড় বাড়ি মেন্টেন করা চারটিখানি কথা না রে মা।"
" হ্যাঁ সে তো বটে। তা আঁকড়ে পড়ে আছ কেন? ওই কাজারিয়াদের দিয়ে দাও না। দিব্যি ছিমছাম ফ্ল্যাট পেয়ে যাবে। আরামে থাকবে।"
"না রে মা, তুই বুঝবি না। বিক্রি করে দাও বললেই হয়না। কত স্মৃতি এই বাড়ির সাথে।"
" ধুর সারাক্ষণ ওই স্মৃতি স্মৃতি করে গেলে হবে নাকি?"
" কী করব বল। চোখ বন্ধ করলেই যে পরিষ্কার দেখতে পাই সব ফেলে আসা দিনগুলি।"
" সে ঠিক আছে। কিন্ত প্র্যাক্টিকালি ভাবতে হবে তো। "
" দেখ তোর মেসো আর আমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের অবর্তমানে এই বাড়ি মিশনে দান করে যাব। তার আগে অবধি এখানে এই ভিটেতে না থাকলে কী করে চলবে বল তো?"
" সবই বুঝি মাসী, কিন্তু।"
" পঞ্চাশ বছর আগে এই বাড়িতে যখন প্রথম পা ফেলি, কতই বা বয়স আমার। উনিশ কি কুড়ি। কত জমজমাট তখন এই বাড়ি। লোকে ভর্তি থাকত সারাক্ষণ। শাশুড়ির তত্ত্বাবধানে কত মানুষের সেবা যত্ন করেছি। আত্মীয়স্বজনের আসা লেগেই থাকত গ্রামের বাড়ি থেকে। এই যে, এই চৌকাঠ, এটা পেরিয়ে এই বাড়িতে যখন ঢুকেছিলাম, আমার দিদিশাশুড়ি বলেছিলেন, ও নাতবৌ, এই যে এলে, আর কিন্তু কক্ষনো যাওয়ার কথা ভুলেও ভেবোনা। তুইই বল শ্রী, আমি কি করে এই বাড়ি ভাঙ্গতে দিই?"
" বুঝি, কিন্তু ওই যে। কিছু করার নেই তো। দাঁড়াও, তুমি এখুনি কাজারিয়াদের সাথে যোগাযোগ করোনা। আমি আর ধ্রুব একটু ভাবি। কিছু করা যায় কিনা।"
শ্রীরাধা চলে যাওয়ার পরে শোভা অনেকক্ষণ দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সামনের রাস্তাটা পার হলেই বড় রাস্তা। বিমল অফিস যেতেন যখন, ঠিক এইখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখতেন, যতক্ষণ না গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে যায়। আবার সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় হলেই ঠিক সব কাজের মধ্যেও চলে আসতেন। পথ চেয়ে রইতেন। এই অভ্যেস বিয়ের পরপরই। শাশুড়ির কাছে এই নিয়ে প্রথম প্রথম কথা শুনলেও আসতে আসতে সয়ে গিয়েছিল। পুজোর দিনগুলিতে এই বারান্দা থেকে সারা রাত রাস্তার আলো, লোক সমাগম দেখতেন। কাছেই কিছু ঐতিহ্যবাহী পুজোর প্যান্ডেল থাকায় গোটা রাত এই অঞ্চলে ভিড় থাকত। শমুর যখন চার বছর বয়সে হার্টের অসুখ ধরা পড়ল, রাতের পর রাত এইখানে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলেছেন শোভা। ভোর হতে না হতে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি ছুটেছেন, ছেলের প্রাণভিক্ষা করতে। অসুস্থ শমুর যখন বাড়ির বাইরে বেরোনো বারণ, গরম জামা জড়িয়ে ওকে কোলে নিয়ে বসতেন এই বারান্দায়। চাঁদের পাহাড়, জাতক, টিনটিন সব পড়ে শোনাতেন। শমুর নিথর দেহটা নিয়েও এই বাড়ি থেকে যখন বিমল গেল, একবার মাথা তুলে ওপরে তাকিয়ে দেখেছিলেন শোভাকে। পাথরের মত দাঁড়িয়ে তখন তিনি এই বারান্দায়। এই বারান্দাই ওনার বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ। কিছু টগর, জুঁই, বেল আর নয়নতারায় ভরিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন এদের পরিচর্যায় কেটে যায় অনেকটা সময়। খড়খড়ে ইটের দেওয়ালে হাত দিয়ে এই বাড়িটার ভেঙ্গে ফেলা ভাবতেই দু চোখ দিয়ে কখন জল নেমেছিল, খেয়ালই করেননি। টনক নড়ল, ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটার ঘণ্টা বাজায়। সেই আদ্যিকালের ঘড়ি। বিলেত থেকে শ্বশুরমশাই আনিয়ে দিয়েছিলেন, বিয়ের প্রথম বছরে। না, এই বাড়ি কিছুতেই ভাঙ্গতে দেওয়া যায় না। কিছু একটা করতেই হবে। এত স্মৃতি, এত টান। দুপুরে খাওয়ার পরে শোভা অনেকক্ষণ বসার ঘরে রইলেন। ভাবনা চিন্তা করলেন। বিকেল পাঁচটা বাজতেই সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধাকে ফোন করলেন।
" হ্যালো শ্রী? ধ্রুব আর তুই কি একবার আমার কাছে আসতে পারবি এখন? একটু জরুরি আলোচনা ছিল।"
" নিশ্চয়ই। আসছি আমরা। সব ঠিক আছে তো?"
" হ্যাঁ রে। সে ঠিক আছে। রুমিকে নিয়ে আসিস। ও খেলবে। আমরা কথা বলব।"
"বেশ। আসছি খানিকক্ষণের মধ্যে।"
আধ ঘণ্টা পরে ওরা এলো। রুমি তার দিদানকে দেখে খুশীতে ডগমগ। দিদিমা নাতনি একে অপরকে খানিক আদর করে তারপরে রুমিকে ওর খেলনার সাথে বসিয়ে দিয়ে শোভা এসে বসলেন শ্রীরাধাদের কাছে। প্রাথমিক কুশল সংবাদ আদান প্রদানের পর আসল কথায় অবতীর্ণ হলেন।
" তোদের যে জন্য আমার ডাকা, এবার বলে ফেলি।"
" হ্যাঁ বল।"
" এই বাড়িটার মেন্টেনেন্স, আমার আগামী দিনের বেঁচে থাকার খরচাপাতি সবের একটা আন্দাজ মোটামুটি করে আর সরখেলের দেওয়া হিসেব দেখে যেটা বুঝেছি, এই বাড়ি আমার পক্ষে রাখা খুব মুস্কিল। অথচ বাড়ির সাথে এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, বিক্রির কথাও ভাবতে পারছিনা। আমি তাই ঠিক করেছি, এই বাড়িটাকে ভাড়া দেব। ওই ধর পেয়িং গেস্ট মত। আর একতলারই আরেকটা অংশে একটা ক্রেশ খুলব। এই বিষয়ে এবারে তোদের মতামত চাইছি।"
ধ্রুব আর শ্রীরাধা খানিক একে ওপরের দিকে তাকাল, তারপর ধ্রুব মুখ খুলল।
" মাসী, এটা কিন্তু বেশ ভালো আইডিয়া, স্পেশালি ক্রেশের ব্যাপারটা। দেখো রুমি তোমার কাছে যতটা ভালো থাকে, আমার বিশ্বাস অনেক বাচ্চারাই তোমার কাছে তেমনি ভালো থাকবে। তোমার তত্ত্বাবধানে রেখে গেলে মায়েরাও নিশ্চিন্ত, তোমারও সময় কাটবে। আর সবেচেয়ে জরুরি যেটা, টাকাও রোজগার হবে। বাড়িতে বসে, যা করতে ভালোবাসো, তাই করে অর্থ উপার্জন, এটার যে কী আনন্দ, আমরা বুঝি।"
"যাক, আমি নিশ্চিন্ত হলাম শুনে। পেয়িং গেস্টের ছাত্রী রাখব, আমায় একটু লোকজন জোগাড় করে দিবি? তোরা তো অনেককে চিনিস টিনিস। "
" না না, ওই পেয়িং গেস্টের চক্করে যেওনা। কেমন না কেমন লোকজন হবে, তাদের কি উৎপাত হবে। তার চেয়ে একটা অফার দিই, ওই অংশটা তুমি আমাদেরকে যদি ভাড়া দাও, তাহলে আমাদের অফিসটা এখানে করতে পারি। এমনিও আমরা একটু এখন আমাদের অফিস বড় করতে চাইছি। নিজেদের ওই এক কামরার অফিসটা খুবই ছোট হয়ে যাচ্ছে। তোমার এখানে যদি দুটো ঘর পেয়ে যাই, তাহলে তোমারও সুবিধে। আমাদেরও সুবিধে। বাজারে যা রেট চলছে ভাড়ার, সেই টাকাই দেব তোমায়।"
" হ্যাঁ, মাসী। আমি আর ধ্রুব দুপুরে এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। শুধু তোমার কাছে কথাটা পাড়ব কি করে, বুঝে উঠছিলাম না। "
"মন্দ নয় প্রস্তাব। আমি কটাদিন একটু ভেবে তোদের জানাই?"
"নিশ্চয়ই।"
এক বছরের ওপর হতে চলল। আজ শোভার ক্রেশের প্রথম বার্ষিকী। সব বাচ্চাদের মা বাবারা নিমন্ত্রিত। শোভা নিজে হাতে সকলের জন্য রান্না করছেন আজ। অনেকদিন পরে আবার এতজনের জন্য রান্না। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেলেও, কড়াইয়ে গরম সর্ষের তেলে যখন প্রথম জিরে ফোড়নটা দিলেন, ওই গন্ধে ও শব্দে সব ভয় উধাও। ভয় কাটাতে আসলে প্রথম পদক্ষেপটাই আসল। ক্রেশটি শুরু করেছিলেন মাত্র চারটে বাচ্চা দিয়ে। এখন মোট ১২ জন বাচ্চা থাকে ওনার ক্রেশে। সারাদিন ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর সেবা যত্ন পরিচর্যা করতে করতেই দিন কেটে যায়। মাস গেলে খানিকটা টাকাও আসে। ধ্রুব আর শ্রীরাধার নতুন অফিসও ভালোই চলছে। বর্ষা শেষ হলে বাড়িটার বাইরেটা রঙ করাবেন। আজ বিকেলে এশিয়ান পেন্টসের লোকজন আসবে কোটেশন দিতে। জীবন অনেকটাই এখন মসৃণ গতিতে চলছে। বাড়িটায় এসেছে নতুন প্রাণ, নব কিশলয়ের কলকাকলিতে থাকে মুখরিত। বারান্দায় নতুন নতুন গাছ বসেছে, নীল অপরাজিতা গাছটা ফুলে ফুলে ভরে থাকে। রাত্রে জুঁইয়ের সুগন্ধে শোওয়ার ঘরটা তখন যেন নন্দনকানন ।
No comments:
Post a Comment