Monday, August 7, 2017

রেনেসাঁ

সালটা ১৯৯৮। উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যে পঞ্চম হওয়ার পরে, এবার জয়েন্টে তৃতীয় হল হুগলীর ছেলে অনন্য ভট্টাচার্য। বাড়িতে খুশীর জোয়ার। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব, স্কুলের মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমে ছেয়ে রয়েছে ওদের ছোট একতলা বাড়িটা। সারাদিন এই ভিড়ের মধ্যে ঠিক করে ছেলেকে আদরও করতে পারেননি মা বাবা। রাত্রে সবাই ফেরত যেতে খেতে বসে বাবা মা ঠাকুমা আর বোনের সাথে গল্প শুরু হল অনন্যর।
- হ্যাঁ রে দাদা তুই কি তাহলে শিবপুরে ভর্তি হবি? নাকি যাদবপুর?
- অনু কোন স্ট্রীম নিয়ে পড়বি কিছু ভেবেছিস? আমার অফিসের সুব্রত দা বলছিলেন যে আজকাল নাকি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়লে বেশ স্কোপ আছে চাকরীর।
- বাবু যেখানেই পড়বি, হোস্টেলে থাকতে হবে। একদম মাথা ঠাণ্ডা করে থাকবি। শান্ত ছেলের মত। কারুর কোন কথায় ড়া কাটবি না।
- দাদুভাই প্রতি সপ্তাহে কিন্তু তোমায় আসতে হবে বাড়ি। আমি নইলে যে খুব মন খারাপ করে থাকব। এই প্রথম তুমি বাড়ির থেকে দূরে থাকবে।
- মা, দাদার জন্য যখন নতুন জামাকাপড় কিনতে যাবে, আমায় নিয়ে যাবে কিন্তু সাথে। ওর ফ্যাশন সেন্স এত সেকেলে, কলকাতার কলেজে গেলে কিন্তু লোকজন ওকে নিয়ে মস্করা করবে এরকম দেখলে।
- এবার থাম তো, ছেলেটা কদিন বাদে চলে যাবে। হোস্টেলে কি খাবে না খাবে। ওকে কদিন শান্তিতে একটু খেতে দে।
নানান জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে অনন্য ভর্তি হল শিবপুরে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই। হোস্টেলে ওকে যেদিন পৌঁছে দিয়ে এলো মা বাবা আর বোন, চারজনেরই খুব মন খারাপ। বোন আর মা তো হাপুস নয়নে কেঁদেই চলেছে কতক্ষণ ধরে। শেষমেশ বাবার বকুনিতে কান্না থামল।
- দেখো তোমরা যদি এরকম কান্নাকাটি করো, অনু কি ভাবে পারবে বলো তো? ওকেও তো একা থাকতে হবে। দেখো আশেপাশে এত নতুন ছাত্র ছাত্রী। তাদের বাবা মায়েরা। কই কেউ কি এরকম করছে? 
- আহা তুমি বুঝছ না। অনু আমাদের ভারী লাজুক ছেলে।
- হ্যাঁ বাবা। ওই কাকিমাটা বলছিল শুনলে না? এখানে র‍্যাগিং হয় খুব। আর হোস্টেলে থাকলে আরোই।
- আহ মিনু, ওসব পুরনো খবর। এখন দেখলি না? ভর্তির সময় anti ragging ফর্মে সই সাবুদ করাচ্ছে? না না। এখানে সবাই পড়াশোনা করতে এসছে, পড়াশোনাই করবে। এছাড়া দেখ হোস্টেলেও আলাদা। কিছু চিন্তার কারণ নেই।
- দাদা শোন, গেটের বাইরেই একটা বুথ আছে। কোন অসুবিধে হলেই তুই বাড়িতে ফোন করে দিবি।
- হ্যাঁ অনু, কেউ কিছু বললে tactfully handle করবি।
- সিনিয়রদের কথার ওপর কথা বলবই না। চুপচাপ যা বলবে, শুনে নিবি। দেখবি দুদিনেই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
- মা, বোনু তোমরা খামোখা এত চিন্তা করোনা তো। সব ঠিকঠাক চলবে। এই তো প্রশান্ত, মলয় সব আছে। আমাদের ব্যাচের আরও সকলের সাথে দুদিনেই আলাপ হয়ে যাবে। একসাথে থাকবও। কোন চিন্তার কারণ নেই। এবার যাও। ফিরতে রাত হয়ে যাবে নইলে।
- দুগগা দুগগা।
- দাদা রাখীতে আসবি তো? ছুটি আছে।
- একদম। কি গিফট চাই, বলে দিবি আগে থেকে।

*********************************************************************************

- নমস্কার। উপস্থিত সকল শিক্ষক শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রী ও কর্মীদের স্বাগত জানাই। আজ আমাদের কলেজের anti ragging cell এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা পেয়েছি আমাদের মধ্যে স্বনামধন্যা social activist শ্রীমতী মীনাক্ষী ভট্টাচার্যকে। আসুন ওনার থেকে কিছু কথা শুনে নিই।
- ধন্যবাদ আপনাকে। আজ আপনাদের কিছু কথা বলি। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। হুগলীর এক অত্যন্ত মেধাবী ছেলে একটি সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিল কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। দুই চোখ ভরে ছিল অসীম স্বপ্ন; বড় হওয়ার, জীবনে উন্নতি করার। কলেজের প্রথম এক সপ্তাহেই ছেলেটির ওপর শুরু হল র‍্যাগিং এর নামে অকথ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। কিছু তথাকথিত সিনিয়র ছাত্র ছাত্রীরা তাদের সাময়িক মানসিক তৃপ্তির জন্য ছেলেটির ওপর যে অমানবিক অত্যাচার চালালো, ছেলেটি মুখ বুজে, বাবা মায়ের বোনের কথা মত  সহ্য করে যাচ্ছিল। রাতের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে, গায়ে হাতে ব্যথা নিয়ে সকাল সকাল ছুটত ক্লাসে। কোনমতে বিকেলের মধ্যে পড়া শেষ করে তৈরি হত রাতের বিভীষিকার জন্য। এই অবধি ঠিক ছিল। হয়তো সয়ে যেত। মিটে যেত। কিন্তু বাঁধ সাধল ক্লাসের দশম দিনে। সেদিন গোটা ব্যাচ, ছেলে ও মেয়ে নির্বিশেষে একসাথে শুরু হল র‍্যাগিং। সিনিয়র ছেলেরা কয়েকজন মিলে ওদের ব্যাচের একটি মেয়ের ওপর শুরু করল অশ্লীল ভাষায় কথা বলা। মেয়েটি এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা, জয়েন্টে ভালো র‍্যাঙ্ক করে এসেছিল শহরের কলেজে পড়াশোনা করতে। এই প্রথম ওর বাড়ির বাইরে আসা, সিনিয়র দাদাদের এই ব্যবহারে সে কান্নাকাটি শুরু করে। তাতে মজা পেয়ে ওর ওপর র‍্যাগিং এর মাত্রা বাড়ে। হুগলীর ছেলেটি আর চুপ করে থাকতে পারেনি। উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। মেয়েটিকে দেখে ওর যে বড় নিজের বোনের মুখ মনে পরে যাচ্ছিল, যে বোনের সাথে ওর দুদিন পরে রাখীতে দেখা হওয়ার কথা। দুদিন আগে আসা ছেলের মুখে কথা মেনে নিতে পারেনি সিনিয়র "দাদা"রা। সেই রাত্রে ওর ওপর চলল চূড়ান্ত অত্যাচার। হকি স্টিক, সাইকেলের চেন, লাঠি কিছুই বাদ পড়েনি। দিন পনেরো হাসপাতালে কাটিয়ে ছেলেটিকে তার বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল। এতটা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, যে আর কোনদিনও ও কোথাও পড়তে পারেনি। এখনো প্রায় জড়ভরতের মত বাড়িতে জানলার ধারে চুপ করে বসে থাকে, কারুর সাথে একটা কোথাও বলেনা। ওই সিনিয়রদের মধ্যে থেকে দশজন কে সনাক্ত করা হয়েছিল তদন্ত করে। ওদেরও কোর্স থেকে বের করে দেওয়া হয়। জানিনা ওরা পরে কে কি করেছে বা করছে জীবনে। শুধু এইটুকু জানি যে সাময়িক superiority দেখাতে গিয়ে এতগুলো ছাত্র ছাত্রীর কেরিয়ার তো নষ্ট হলই, সাথে সাথে এদের পরিবার পরিজনও কত ভুগল। সেদিনের ওই ছেলেটি আমার দাদা। আমি চাইনি আর কোন পরিবার এরকম ভাবে ভেঙ্গে পড়ুক। আর সেই জন্যই আমি এই anti ragging প্রতিষ্ঠান গুলির সাথে এত নিবিড় ভাবে যুক্ত। আমি চাই তোমরা সকলে ভালো মানুষ হও। সকলের সাথে সদ্ভাব রেখে চল। সিনিয়র হয়েছ, তার মর্যাদা দাও। দাদা দিদি সুলভ আচরণ করো, গুণ্ডাগিরি না। এটি একটি educational institute, শিক্ষার মর্যাদা দাও। মানুষের মত মানুষ হও। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো। ওদের গর্ব হও। ধন্যবাদ।

********************************************************************************

- এই দাদা, আজ আরেকটা কলেজে আমি বক্তব্য রাখলাম। জানিস তো, আমার মনে হয়, এখন awarenessটা অনেক বাড়ছে। শিবপুরে কত নতুন নিয়ম implemented হয়েছে। দেখবি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেশ ragging মুক্ত হবে।

বিকেলের পড়ন্ত রোদের আলো এসে পড়েছে অনন্যর মুখে। ভাবলেশহীন। পরিবর্তনের অপেক্ষায়।


No comments:

Post a Comment