মেঘদূত ৬
ইউনিভার্সিটি অফ এসেক্সে পড়ানোর চাকরীটা নিয়ে সুনন্দ যখন এ দেশে এলো, তখন ওদের বিয়ের এক মাসও হয়নি। বাবা মায়ের অমতে পালিয়ে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে। দেশ ছাড়ার আগে যখন বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল পূরবী, ওর বাবা তো কথাই বলেননি; উল্টে মায়ের মাধ্যমে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ওইদিন অর্থাৎ ৩০শে শ্রাবণ থেকে ওনার কাছে ওনার আদরের মেয়ে রুবি মৃত। আর কোনদিনও যেন সে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টাও না করে। কাঁদতে কাঁদতে ভবানীপুরের বাড়িটা ছেড়েছিল সেদিন পূরবী শেষবারের মত।
এরপর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ কুড়ি বছর। জীবনে এসেছে নানান পরিবর্তন। পি এইচ ডি শেষ করে এখন পূরবী এসেক্সের এক কলেজে পড়ায়। ওদের মেয়ে, সুরভী এই বছর কলেজে ভর্তি হবে। সুনন্দর মা বাবার জীবদ্দশায় নিয়ম করে প্রতি বছর কলকাতা যাওয়া হলেও কখনো আর ভবানীপুরে যাওয়া হয়নি। দুই পক্ষেরই সমান মান অভিমান। এখন তো শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যুর পরে আর কলকাতা যাওয়া হয় না। যদিও পাড়াতুতো দাদা বৌদিদের কাছ থেকে নিয়মিত এখনো নিজের বাবা মায়ের খোঁজ নেয় পূরবী, ফোন নম্বরও নিয়ে রেখেছে, কিন্তু তবুও সুনন্দ বা সুরভীর হাজার বার বলা সত্ত্বেও কক্ষনো একটা ফোন করে কথাও বলেনি। প্রতি পুজোয়, জন্মদিনে, মা বাবার জন্মদিনে মা কে সকাল থেকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে সুরভী কতবার ফোনটা নিয়ে ডায়ালও করে দিয়েছে নম্বর, কিন্তু সব সময় পূরবী কেটে দিয়েছে লাইন।
গতকাল যখন সুনন্দ অফিস থেকে ফিরে ওকে নিজের সপরিবারে সেরা বাঙালীর অনুষ্ঠানে কলকাতা যাওয়ার নিমন্ত্রণপত্র দেখাল, ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে গিয়েছিল পূরবী। কত বড় সম্মান প্রাপ্তি এটা সুনন্দর। কিন্তু তারপরেই সুনন্দ আর সুরভী যখন আবদার করল যে এই সুযোগে তিনজনেই ওরা কলকাতা যাবে, প্রায় দশ বছর পর, পূরবী যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। ও কিছুতেই যাবে না। রাগে দুঃখে রাত্রে খেলো পর্যন্ত না। ওরা যে কেন বুঝছেনা ওর কথা, ও ভেবেই পায় না। যে বাবার এত আদুরে মেয়ে ছিল ও, সেই বাবাই যখন ওকে সর্বজনসমক্ষে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন একদিন, তাদের কাছে গিয়ে কিই বা হবে? আবার তো বাবা রেগে যাবেন, এখন বয়স হয়েছে। এই বয়সে উত্তেজিত হয়ে পড়লে বাবার কিছু হয়ে গেলে? নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না যে ও। তাই হাজার ইচ্ছে থাকলেও কিছুতেই ও যাবে না কলকাতা, দেখা করবে না মা বাবার সাথে।
মন খারাপ নিয়েই সেদিন কলেজ গেল পূরবী। ক্লাস নিতে গিয়ে বুঝল যে মন মেজাজ ঠিক নেই, মাথা কাজ করছেনা। হাফ ডে লিভ নিয়ে বাড়ি ফিরে দুপুরবেলা লাঞ্চ সারছে, এমন সময় মেঘা বৌদির ফোন। তখন কলকাতায় সন্ধ্যে, অফিস থেকে ফিরে মেঘা বৌদির ফোনের এটাই সময়।
- হ্যাঁ বৌদি বল। কেমন আছ?
- হ্যালো? হ্যালো?
খানিকক্ষণ কোন শব্দ নেই ওদিকে। তারপর একটা হাল্কা ফোঁপানি।
- রুবি?
ছ্যাঁত করে এসে বুকের মধ্যে যেন বিঁধল মায়ের গলাটা।
-মা?
সন্ধ্যেবেলা কলেজ থেকে ফিরে সুরভী আর ওর বাবা দেখে পূরবী চোখ মুখ ফুলিয়ে নাক ফোচ ফোচ করতে করতে স্যুটকেস গোছাচ্ছে।
- এ কি মা? তুমি কোথায় চললে? ব্যাগ গুছাচ্ছ কেন? আবার সর্দি বাধালে কি করে? মুখ চোখ ফোলা কেন? কান্নাকাটি না ঠাণ্ডা লাগা?
- হ্যাঁ রুবি? কোথায় যাওয়ার প্যাকিং করছ? কোন কনফারেন্স নাকি? কি ব্যাপার?
বেশ একটা যুদ্ধ জয় সুলভ হাসি হেসে পূরবী বলল, "কলকাতা যাব। To be more precise, ভবানীপুর। সবাই মিলে। এবারের পুজোটা ওখানেই কাটাবো। এত বছর পর।"
- যাক, তাহলে আমি যে আজ মাকে ফোন করলাম সব জানিয়ে, তাহলে সেটা সার্থক হল! এবার দেখলে তো? মিছিমিছি এতগুলো বছর ইগোর লড়াইয়ে নষ্ট করলে। যাক গে।
- হুম। এটা একটা বিরাট প্রাপ্তি সুনন্দ। কৃতজ্ঞতা। এর চেয়ে ভালো এনিভারসারি গিফট আর কিচ্ছু হয় না সুনন্দ। Thank you so much!
অনেক বছর পর সেদিন পূরবী ওর প্রিয় বর্ষার রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোল। বাইরে টুপটাপ টিপটিপ বৃষ্টি, ঠোঁটে এক অনাবিল হাসি। দুই চোখে কলকাতা যাওয়ার স্বপ্ন।
"যে মিলনের মালাগুলি ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ তারই ভেসে আসে আজই সজল সমীরণে।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
No comments:
Post a Comment