Thursday, August 10, 2017

যাত্রাপথে

এক মাস গরমের ছুটিতে শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে রঞ্জনা ফিরছে নিজের বাড়ী, জামনগরে। পছন্দমত ফ্লাইট না পাওয়ায় ট্রেনে যাওয়া। সাথে রয়েছে চার বছরের ছেলে বিটলাই। সুনন্দর অফিসের ছুটি শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যাওয়ায় ওদের এসে নিয়ে যেতে পারেনি। বিটলাই ওদের দত্তক নেওয়া সন্তান, বলা চলে খানিকটা সুনন্দর জেদেই ওকে ওরা তিন বছর আগে একটি সরকারী সংস্থা থেকে দত্তক নিয়েছে। বিয়ের চার বছর পরেও নিজের সন্তান আসেনি ওদের। বরং তিনবার মিসক্যারেজ হওয়ার পরে ডাক্তার ওদের জবাব দিয়ে দেন। সুনন্দ চাকরী করে একটি তেলের কোম্পানিতে, বেশ সিনিয়র পোস্টে, তাই দিনের মধ্যে বারো চৌদ্দ ঘণ্টা কাজেকর্মে ডুবে থাকে। তখনও রঞ্জনা স্কুলের চাকরীটা পায়নি। অত বড় বাড়ীতে সারাদিন বসে বসে ও খুব একা বোধ করত, তার উপর বারবার মিসক্যারেজ হওয়ায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্তও হয়ে পড়ে। আর তখনই আত্মীয় বন্ধুদের পরামর্শে সুনন্দ ঠিক করে ওরা একটি বাচ্চা দত্তক নেবে। রঞ্জনা বড় হয়েছে অত্যন্ত গোঁড়া পরিবারে, তাই শুরু থেকে একদমই সায় দেয়নি দত্তক নেওয়ায়। না জানি কার সন্তান, কি তার ইতিহাস। সে বড় হলে কেমনই বা হবে তার স্বভাব চরিত্র। এই সমস্ত নানান চিন্তায় বারবার সুনন্দ কে বোঝানোর চেষ্টা করত, দত্তক নেওয়া থেকে বিরত করার প্রচেষ্টায় প্রায় উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু সুনন্দ ও ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অনেক বোঝানোয় অবশেষে একরকম বাধ্য হয়েই রাজি হয়। তিন বছরেও এখনো বিটলাইকে কেন জানিনা তেমন আপন করে উঠতে পারেনি রঞ্জনা। আসলে বরাবরই ওর স্বপ্ন ছিল, নিজের ছেলে মেয়ে হবে। তাদেরকে নিজে হাতে বড় করবে। প্রথম বার কনসিভ করার পর তো নাম পর্যন্ত ঠিক করে নিয়েছিল। ছেলে হলে তাতান, মেয়ে হলে তিতির। একজনকে নাচ শেখাবে, একজনকে গান। একজন ডাক্তার হবে, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার। বিটলাইকে যখন এজেন্সি থেকে আনল ওরা, কিছুতেই ওর জন্য তাতান নামটা ব্যবহার করতেই দেয়নি ও। সুনন্দ বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, এই তো ওদের সন্তান। হক না রঞ্জনার আপন গর্ভের না, কিন্তু এরপর থেকে তো এই শিশুর আপনজন বলতে ওরাই। রঞ্জনার বাপের বাড়ীর লোকজনও খুব একটা ভালো মনে মেনে নিতে পারেনি বিটলাইকে। দিদির মেয়েকে যখন ওর মা পুজোয় জামা কিনে দিত, সেই ফ্রিল দেওয়া পরীর মত ফ্রক দেখে ও ভাবত, কিছুদিন পরে মা ওকেও এরকম পাঠাবে। কিন্তু গত তিন বছর দুর্গা পুজোয় দিতে হয় বলে দেবে, এমন ধরণের পোশাক উপহার আসত ক্যুরিয়ারে, বিটলাইয়ের জন্য, ওর মামা বাড়ি থেকে। ওদিকে ঠাকুমার নয়নের মণি বিটলাই। রঞ্জনার স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে তাই এক মাস ওকে বিটলাই আর ওর দাদু  ঠাকুমার আবদার মেনে মালদায় থাকতেই হল।
ট্রেনে ওঠা ইস্তক বিটলাই একবার এই জানলা একবার ওই জানলা করে চলেছে। সেকেন্ড এসিতে ওদের আশেপাশে চলছে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। তারা ছোট্ট বাচ্চার সাথে একটু আধটু খেলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এত দুরন্ত বাচ্চা। রঞ্জনা মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে যায়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আধো আধো বুলিতে " মাম্মাম খিদে পেয়েছে"। "মাম্মাম কখন বাড়ি যাব?" " মাম্মাম ট্রেনটা উল্টো দিকে কেন যাচ্ছে?" " মাম্মাম আমি দরজার দিকে যাই?" "মাম্মাম আমার ওই খেলনাটা চাই।"

দুপুরবেলা প্যান্ট্রি কার থেকে যখন খাবার কিনে খাওয়াতে বসেছিল ও, বিটলাই এমন জেদ শুরু করল। কিছুতেই ও চিকেন ছাড়া খাবে না। এদিকে রঞ্জনাও ট্রেনের ওই তেল ঝাল খাবার ওকে দেবে না। মা ছেলেতে লাগল তুমুল লড়াই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সুনন্দ থাকলে কিন্তু বিটলাই কক্ষনো এমনটা করেনা। ওর যত জেদ আবদার সবই মায়ের কাছে। এমনিতেই প্লেনের জায়গায় ট্রেনে, তাও এই দুরন্ত বাচ্চাকে নিয়ে একা একা যেতে হচ্ছিল বলে রঞ্জনার মেজাজ খিঁচরে ছিল, এইবারে সব সহ্যশক্তি বাঁধ ভেঙ্গে মারল এক থাপ্পড় বিটলাইয়ের গালে। বেচারা মায়ের এই আকস্মিক রুদ্রাণী মূর্তি দেখে থ। দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল, বড় বড় ফোঁটায়।
- অনেক হয়েছে। তখন থেকে বলছি চুপ করে খেয়ে নিতে, তা না। আমাকে জ্বালানোর জন্য জুটেছে যত সব।
ছোট্ট বিটলাই চুপ করে এরপরে টুঁ শব্দটি না করে ভাত ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। মা গরস করে করে মুখে দিল আর ও টক করে খেল। হাত মুখ ধুয়ে এসে ওকে নিজের সীটে বিছানা করে শুইয়ে সবে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসে হাত ব্যাগ থেকে বই বের করে পড়তে যাবে, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল সুনন্দর নাম। ওর কথার শব্দে আবার বিটলাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলেই শুরু হবে তাণ্ডব। বড় ক্লান্ত লাগছে। আবার ওকে ঘুম পারানো কঠিন কাজ।  এখন যখন ও ঘুমিয়ে আছে, কি নিষ্পাপ লাগছে। অথচ এরই জাগ্রত অবস্থায় আরেক চেহারা। ভাবলেও অবাক লাগে। কি জেদ ছেলের। নির্ঘাত বাপ মা কেউ এমন ছিল। উল্টো দিকের সীটের এক বয়স্কা মহিলা কে একটু বিটলাইয়ের দিকে নজর রাখতে বলে ও ডানদিকের দরজার দিকে গেল। মিনিট কুড়ি পরে নিজের সীটে এসে দেখে বিটলা নেই। সীট খালি। উল্টো দিকের ভদ্রমহিলাও নেই। এদিক ওদিক খুঁজেও চোখে পড়ল না বিটলাইকে। আশেপাশের সীটের লোকজন ঘুমোচ্ছিল, তাদের ডেকে তুলে বিটলাই বা ওই মহিলার কোন খবরই পেল না। কি হল, বিটলাই কোথায় গেল। এদিক ওদিক দরজায় আশে পাশের সীট গুলিতেও কোথাও নেই। হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি চিন্তা মাথায় এলো।

তা হলে কি ওই মহিলা ছেলেধরা? বিটলাইকে চুরি করে লুকিয়ে আছে কোন কম্পারটমেন্টে? পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তো মনে হয় না। অবশ্য এটা ডেকয় হতে পারে। রেল পুলিশ কে টিটি কে ডেকে এক্ষুণি সার্চ করাতে হবে ট্রেন। ছি ছি ছি ছি ছি। কি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল ও। কি করে একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের ভরসায় বিটলাইকে ফেলে গেল ও? ওর জায়গায় সুনন্দ থাকলে এমন করত? করত না। কেন করল ও এরকম? বিটলাই ওর নিজের ছেলে না বলে? লোকে তো তাই বলবে? সুনন্দ কি বলবে? আদৌ ওকে ক্ষমা করবে? বাচ্চা চুরি করে না জানি কোথায় নিয়ে ফেলবে, কোথায় কোথায় ভিক্ষে করাবে। কি না কি অত্যাচার করবে, আজকাল যা সব দেখায় টিভিতে, খবরে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠল রঞ্জনার। আহা, দুধের শিশু। একটু না হয় দুরন্ত, কিন্তু বড্ড ন্যাওটা মায়ের। ও যখন স্কুলের জন্য বেরোয়, তখন সদর দরজা অবধি মায়ের আঁচল ধরে চলে। স্কুল থেকে ফিরলে পরে জড়িয়ে ধরে আদর খায়। ভয়ে মুখ চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে রঞ্জনার। একটাই নিশ্চিন্ত হওয়ার কথা, ট্রেন এখন মাঝে কোথাও থামেনি আর আগামী আধ ঘণ্টায় থামবেও না। কাজেই বিটলাইকে নিয়ে ওই মহিলা কোথাও পালিয়ে যেতে পারবেই না, যদি না চেন টেনে ট্রেন থামায়। এখুনি টিটি কে ডেকে ব্যাপারটা বলতে হবে। ভগবান। রক্ষা করো। হে মা বিপত্তারিনী চণ্ডী, বিটলাইকে খুঁজে দাও। টিটিকে দেখতে পেয়ে রঞ্জনা পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। ওর ফোনে বিটলাইয়ের ছবি ছিল, সেটিও দেখাল। সবে ওর নিজের সীটের দিকে এসছে, শুনতে পেল, " মাম্মাআআআআম"। বিটলাই। সাথে ওই মহিলা।
- কোথায় ছিলি?
- আপনি বিটলাই কে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলেন? জানেন আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি ওকে খুঁজতে খুঁজতে।

- আরে ম্যাডাম, আপনি যাওয়ার পরে পরেই বাচ্চাটা জেগে উঠে আপনাকে না দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। কিছুতেই থাকছিল না। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আমি ওর পিছন পিছন গিয়ে গোটা ট্রেন আপনাকে খুঁজে না পেয়ে এদিকে এলাম। ভাগ্যিস।

খানিক থতমত খেয়ে গেল রঞ্জনা।
- মাম্মাম তুমি আমায় ফেলে কোথায় গিয়েছিলে? প্রমিস করো, আর যাবে না?
- যাব না সোনা, যাব না। আমার সোনা তাতান।
- উফ মাম্মাম, my name is Bitlai, you may also call me Srinjan।
- তাইই তাইই তাই।

রঞ্জনা বিটলাইকে জড়িয়ে গালে কপালে চুমু খেয়ে লেপটে শুল। মা ছেলেতে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে জমিয়ে Peppa pigs দেখবে এবার ওরা। সামনে অনেক দীর্ঘ পথ বাকি।

No comments:

Post a Comment