অঙ্কুর চক্রবর্তী গত পনেরো বছর ধরে নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। বয়স আন্দাজ চল্লিশ বিয়াল্লিশ। বিয়ে করেননি। একার সংসার। চাকরী করেন অতি উচ্চ পদে, একটি ফরচ্যুন ৫০০ কোম্পানিতে। IIT Bombay ও তারপরে IIM Ahmedabadএর সুবাদে খুব সহজেই আজকের পোস্টে পৌঁছে গিয়েছেন। কেরিয়ারের দিক থেকে যতটা তরতর করে উঠেছেন, ততটাই ক্রমশ দূরে সরে এসেছেন পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবদের থেকে। কেয়াতলার ফ্ল্যাটে আছেন বয়স্ক মা ও বাবা। বার বার বলা সত্ত্বেও ওনাদেরকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারেননি। আগে তাও বছরে একবার করে দেশে আসতেন দিন দশেকের জন্য কিংবা বাবা মা যেতেন, মাস খানেক ঘুরে আসতেন। বয়সের অজুহাতে ওনাদের যাওয়া প্রায় গত পাঁচ বছর বন্ধ। অঙ্কুরও এসে উঠতে পারেনি। লন্ডন, প্যারিস, বার্সিলোনা, সিডনি, সিঙ্গাপুর করে বেড়ালেও, কলকাতা কোনদিনও ম্যাপে ছিল না।
আজ সকাল সকাল মানদা দি, মানে ওদের বাড়িতে সর্বক্ষণের যে লোক থাকে, বাবা মায়ের দেখাশোনার জন্য, তার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি এয়ারপোর্টে ছুটে এসে প্রথম ফ্লাইটের টিকিট কেটেছেন। বাবার খুব শরীর খারাপ। রাত্রের খাওয়ার পর হঠাৎ বুকে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলেন; মা যেহেতু বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী, মানদাদিই উল্টোদিকের বাড়ির পলাশ বাবুদের সাহায্যে বাবা কে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। ডাক্তার বলেছেন একটা মাইল্ড এট্যাক হয়েছে, কিছুদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে। মানদাদি ফোনে এত কান্নাকাটি করছিল, হঠাৎ করে নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল অঙ্কুরের।
সাতাশ ঘণ্টার ফ্লাইট থেকে নেমে আগেই ছুটলেন হাসপাতালে। সেখানে তখন দেখেন পলাশ বাবু ও তার স্ত্রী, মিনু বৌদি রয়েছেন। অঙ্কুরকে দেখে ওরা এগিয়ে এলেন কথা বলতে।
- শোন অঙ্কুর, চিন্তার কিছু কারণ নেই তেমন। ডাক্তার বাবুর সাথে এই এক্ষুণি কথা হল, বলেছেন everything is fine; vital parameters are stable; হয়তো আর কয়েকদিন observationএ রেখে release করে দেবেন।
- আপনাদের যে কী ভাবে ধন্যবাদ জানাবো, আমি বুঝতেই পারছিনা। আপনারা না থাকলে যে কি হত। আসলে অত দূরে বসে তো কিছুই করতে পারিনা।
- আরে না না, প্রতিবেশীর ধর্ম পালন করেছি। এতে এত ধন্যবাদের কি আছে। এছাড়া সুব্রত কাকু আর রুমা কাকিমার সাথে আমাদের তো পারিবারিক সম্পর্ক প্রায়। একদম নিজের কাকা কাকিমার মত আদর যত্নে রাখেন আমাদের। এইটুকু করব না?
- আচ্ছা, এখন কি বাবা কে একবার দেখা যাবে?
- ICUতে আছেন, এখন ঢুকতে দেবে না। তবে বাইরে থেকে দেখতে পারবে। এসো তোমায় নিয়ে যাই।
- আসুন।
কাঁচের জানলা দিয়ে দেখলেন অঙ্কুর, ওর বাবা, মানে একদা দাপুটে হেডমাস্টার, সুব্রত বাবু নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রয়েছেন। শরীরের বিভিন্ন অংশ নানান যন্ত্রপাতির সাথে লাগানো। হাতে চ্যানেল করে ওষুধ চলছে। দুই চোখ বন্ধ, কিন্তু মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি। কেন কে জানে, চোখের কোণগুলো চিকচিক করে উঠল।
- এসো অঙ্কুর। তোমার মা অপেক্ষা করছেন। বাড়ী চল, আবার সন্ধ্যেবেলা আসবে। তখন দেখাও করতে পারবে, ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নেবে।
- চলুন।
বাড়ি ঢুকে প্রথমেই মায়ের ঘরে গেলেন অঙ্কুর। মা ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। আহ! এতক্ষণে যেন শান্তি অনুভব করলেন। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। মানদাদি খানিক পরে ঘরে এলেন জলের গ্লাস নিয়ে।
- ও দাদা, এত কেঁদো না। মা কেও একটু থামতে বল। সেই পরশু থেকে কেঁদেই চলেছে, কিছুতেই থামছেনা।
- এই তুই চুপ কর মানদা। আমি আর কাঁদব না। আমার বাবু এসে গিয়েছে। ব্যস আর কোন চিন্তা নেই। দেখবি এবার তোর বাবাও খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবেন।
- তাই যেন হয় মা।
- হ্যাঁ মা, পলাশ বাবু বললেন ডাক্তার বলেছেন চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি বিকেলে যাব হাসপাতালে। তুমি একদম চিন্তা করো না।
- যা, তুই ফ্রেশ হয়ে নে। মানদা, ওকে খেতে দাও।
- মানদা দি, তুমি এই ঘরে দিয়ো। মা আর আমি আজ একসাথে খাবো।
- ঠিক আছে।
দুপুরে খেতে বসে মা ও ছেলে দুজনে দুজনকে খাইয়ে দিল। মায়ের চেহারাটা আগের থেকে অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে। সবে তো পঁয়ষট্টি, এখনই এইরকম জীর্ণ চেহারা।
- মা তুমি একদম নিজের খেয়াল রাখো না। দেখেছ চেহারার কি অবস্থা করেছ?
- ও মা, এ আজকের কথা নাকি। এরকম অনেকদিন হয়ে আছে। তুই বহু বছর পরে আমায় দেখলি। তাই এমন বলছিস।
- তা হবে। আসলে কাজের চাপে আর স্কাইপ করে ওঠা হয়না।
- ওসব ছাড়। আচ্ছা শোন বাবু। পলাশ বলছিল যে হাসপাতালে মেডিকালের কাগজ চেয়েছে।
- ইন্সিউরেন্স?
- হ্যাঁ। আজ যখন যাবি, তখন নিয়ে যাস। অবশ্য তাড়া নেই।
- কোথায় আছে?
- ওই ঘরের আলমারিতে আছে। একটা ব্রাউন কালারের ফাইলে।
- ঠিক আছে। দেখি, দুপুরে একটু ঘুমোই। খুব টায়ার্ড লাগছে। তেমন হলে রাত্রে খুঁজে নেব। কাল সকালে দেবো ওদের। এমনিও জেট ল্যাগের জন্য রাত্রে ঘুম আসবেনা।
- ঠিক আছে।
সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালে যখন গেল অঙ্কুর, বাবার সাথে কথা হয়নি। উনি ঘুমচ্ছিলেন, কড়া সেডেটিভের ফলে। তবে ডাক্তার বিশ্বাস খুবই খুশী পেশেন্টের উন্নতি দেখে। বললেন পরশুদিনই রিলিজ দিয়ে দেবেন। রাত্রে মা কে খাইয়ে শুইয়ে ও নিজে খেয়ে তারপরে অঙ্কুর গেলেন বাবার ঘরে। ওখানে কাঠের বড় আলমারিটা খুলতে গিয়ে ছেলেবেলার কথা মনে পরে যাচ্ছিল। কোনদিনও ওটিতে হাত দেওয়ার অনুমতি ছিলনা। একবার কি মনে করে চাবি চুরি করে আলমারি খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন অঙ্কুর, সেদিন কোন কারণে বাবার মন মেজাজ ভালো ছিল না, বাবার থেকে মার যা খেয়েছিলেন, সেটা ভেবে এখনো হাত কেঁপে উঠল আলমারি খুলতে গিয়ে। চোখে পড়ল দুটো ফাইল। একটা ব্রাউন, আরেকটা কালো। মা কোনটা বলেছিল, মনে পড়েনি। তাই প্রথমে কালোটা বের করল। এবং খুলে অবাক। সুন্দর করে ওখানে পরপর ফাইল করে রাখা এক গাদা হাতে লেখা চিঠি, তারপরে ইমেলের প্রিন্ট-আউট। প্রত্যেকেটাই লেখা অঙ্কুরের, তার মা কে। এয়ারমেলের চিঠি গুলো দেখে মনে পড়ে গেল, তখন সবে সবে আমেরিকা গিয়েছে। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখত মা কে। অবাক চোখে আশেপাশে যা দেখত, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে মা কে চিঠিতে জানাত। তারপরে আসতে আসতে সব চোখ সওয়া হয়ে গেল। ন মাসে ছ মাসে একটা করে চিঠি হয়তো আসতও। তখন তো ফোনের যুগ, আই এস ডি কলের দাম ক্রমশ কমছে। তাই চিঠির বদলে এলো ফোন। মা কে বলে বলেও কখনো ইমেল করানোটা শেখাতে পারেনি। রাশভারী বাবার সাথে খুবই কেজো কারণ ছাড়া ইমেল হতনা। তাহলে এইগুলি? প্রত্যেকটা সেন্ডার এড্রেস ankur.babu@ymail.com, মনে পড়ল, প্রথম একবার ইমেল এড্রেস খুলেছিল বটে এরকম; কিন্তু এটার পাসওয়ার্ড তো বাবা ছাড়া আর কেউ জানেন না। তবে কি বাবাই? প্রতি দুই সপ্তাহে একটা করে ইমেল। আজ নায়াগ্রা গিয়েছিলাম; আজ ইয়েলোস্টোন, আজ হাওয়াই গিয়েছিলাম। সাথে এটাচমেন্টে গুগুল থেকে নামানো ছবি। ছেলে হয়ে যে দায়িত্ব উনি পালন করেননি, সেই দায়িত্বও সুব্রত বাবু পালন করেছেন। চিরকালই স্নেহান্ধ ছিলেন, প্রতি পদে ছেলের দোষ ঢেকে ঢেকে চলতেন। ঠাকুমার কাছে তো বাবা কত বকাও খেয়েছেন, যে ছেলের কোন দোষই তিনি দেখেন না বলে। এই বয়সে এসেও, মায়ের প্রতি ছেলের কর্তব্যও তাই ওনাকেই পালন করতে হল।
পরেরদিন সকালে অবশেষে বাবার সাথে দেখা হল। অঙ্কুরকে দেখে সুব্রত বাবুর চোখে মুখে এক আলাদা হাসি ফুটল। কষ্ট করে দুই হাতে ছেলের হাত জড়িয়ে ধরতে অঙ্কুর বলে উঠলেন, "Thank you বাবা।"
No comments:
Post a Comment