প্রতিদিনের মত ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় মোবাইলে মিষ্টি করে কোকিলের ডাকে শুনে ঘুম ভাঙল রুপুর। আজ রবিবার, ছুটি। তাই খানিক আলসেমি করে কম্বলের তলায় পড়ে রইল ও। অন্যান্য দিনে অ্যালার্ম snooze করার বিলাসিতা টুকুও থাকে না। এক ঘণ্টার মধ্যে ছেলে মেয়ে দুটোকে স্কুলের জন্য তৈরি করতে হয়। তারপরে ঘরের কাজ টুকটাক সেরে নিজে রেডি হয়ে অফিস বেরোনো। বছর খানেক হতে চলল রুপু ইপসউইচে এসেছে; ব্যাঙ্গালোরের কোম্পানিটা থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। একা মা, তায় দু দুটো ছেলে মেয়ে, উঠতে বসতে প্রতিবেশীদের বাঁকা মন্তব্য, সব মিলিয়ে একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ, আর তার থেকে মুক্তি পেতেই ইপসউইচ। অফিসের কিছু কলিগ আর নেবারহুডের কয়েকজন ছাড়া তেমন বিশেষ কারুর সাথে আলাপ পরিচিতি নেই। এখানে কেউ কারুর ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলায় না, সাধারণ সৌজন্যতা ছাড়া খুব একটা আশে পাশের কারুর সাথে তেমন আলাপ পরিচয়ও নেই। ধারে কাছে ভারতীয়র সংখ্যা খুবই কম, বাঙালি পরিবার তো প্রায় হাতে গোনা যায়। শহরের থেকে একটু দূরে এপার্টমেন্ট নিয়ে মা ও ছেলে মেয়ের নিশ্চিন্তের সংসার। দিব্যি আছে। এখানের চাকরীটাও মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট, ছেলে মেয়ের স্কুল ডে কেয়ার, উইকেন্ডে সময় বের করে তিনজনে এদিক সেদিক গাড়ী নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, এই বেশ ভালো আছে।
আজ ওদের তেমন কোন প্ল্যান নেই। কদিন ধরেই খুব বৃষ্টি চলছে। আগামী দুদিন তো আবার ভারী বৃষ্টির ফোরকাস্ট। বাড়িতেই কিছু সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেবে ছুটির দিনটা। তাতান আর তিতির তখনও ঘুমোচ্ছে। ওদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা আসে। থাক, ওরা ঘুমোক। আসতে আসতে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রুপু। তখনো সকালের আলো তেমন ফোটেনি, আলো আঁধারির খেলায় সামনের লেকটা অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। ধারে ফুটে আছে অসংখ্য white lillies, ওর বড় প্রিয় ফুল। কোন কারণ নেই, কিন্তু দেখলেই ছোটবেলার পুজোর দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়। কাশ ফুলের মধ্যে দিয়েই শরতের আগমন হত। এখানে সেসব টের পাওয়ার প্রায় কোন অবকাশই নেই বলা চলে। এখনো তো বোধহয় শ্রাবণ চলছে, হিন্দু সমাজ থেকে এখনো পুজোর ফ্লায়ার আসেনি।
কি মনে হল, দৌড়ে গিয়ে স্কেচ প্যাড আর পেন নিয়ে বসে ঝটপট একে ফেলল সিনারিটা। বহুদিন বাদে আঁকল, তাই পারফেকশন আসেনি, কিন্তু আনন্দ নির্ভেজাল। খানিক বাদে তাতান তিতিরের ঘুম ভাঙ্গতেই ওরা রুপুকে জড়িয়ে ধরে খানিক আদর করল। "হ্যাপি বার্থডে মা" শুনে রুপুর খুশী আর ধরে না।
" তোদের মনে আছে বুঝি?"
"হ্যাঁ মা। আমাদের তো মনে আছে। তোমার বার্থডে ভুলব কি করে?"
" ইয়েস, তা ছাড়া স্তেফান আঙ্কেলও তো কাল রিমাইন্ডার দিল। আস- Oops! I almost let the secret out!"
"স্তেফান আসবে? এখানে? কখন? কই আমায় বলে নি তো?"
" না না মা, তাতান বাজে কথা বলছে। স্তেফান আঙ্কেল আসবে না।"
রুপুর চোখ এড়ালো না ভাই বোনের একে ওপরের দিকে চোখ রাঙানি। ও এই তাহলে ব্যাপার। কদিন ধরে মনেই হচ্ছিল স্তেফান আর বাচ্চা দুটো মিলে কিছু একটা নিয়ে সারাক্ষণ আলোচনা করছে। স্তেফান ওর কলিগ, জার্মান ছেলে। ইন্ডিয়া সম্পর্কে খুব আগ্রহ, ইউনিভার্সিটিতে ইন্ডিয়ান হিষ্ট্রি নিয়ে পড়াশোনাও করেছে। আর তাই রুপুর সাথে ভালোই ভাব। ছেলে মেয়ে দুটোও স্তেফান আঙ্কেল বলতে অজ্ঞান। মাঝে মাঝে ওরা চারজন একসাথে waterfrontএ ঘুরতে যায়।
" তা কখন আসবে স্তেফান আঙ্কেল?"
"না না মা, আঙ্কেল আসবে না।"
"আবার মিথ্যে তিতির? বল? আমি সেই মত ব্রেকফাস্ট লাঞ্চের ব্যবস্থা করব তো!"
তাতান আর তিতিরের তখন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, মা কে বলবে কি বলবে না। এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠতেই ভাই বোনে ছুট লাগাল, কে আগে দরজা খুলবে।
"আসতে যাও, পড়ে যাবে তো!"
কে শোনে কার কথা। এগিয়ে আসতে দেখে, সামনে একটা বড় ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে স্তেফান।
"Happy birthday Rup. I got you your favourite white lilies."
"Thank you. Do come in. I'll make you your favourite breakfast then. "
"Oh, loochi, is it?"
"Yep, wanna help?"
"Sure! Actually, it's better if you sit back and relax. It's your day today. We will manage."
"Are you sure? You will make luchi?"
"Just wait and watch Ma'am!"
রান্নাঘর থেকে হাসির খিল খিল আর স্তেফান আর বাচ্চা দুটোর অপটু হাতে ময়দা মাখা দেখে রুপুও আজ কত কাল বাদে যেন প্রাণ খুলে হাসল। তানপুরা অ্যাপ চালিয়ে মনের সুখে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল ওর প্রিয় গান।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে ॥
No comments:
Post a Comment