প্রায় বছর দেড়েক হতে চলেছে সুখদেব আর নয়নার বিয়ের। বিয়ের পরে পরেই নয়না এসেছিল বম্বে ওর বরের সাথে। সুখদেব চাকরী করে একটি বেসরকারী অফিসে, পিয়নের পদে। মাইনে পত্তর তেমন আহামরি না; সংসারে বারতি আয়ের কথা ভেবে নয়না একটি ডে কেয়ার সেন্টারে আয়ার কাজ করে। এক কামরার ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে মোটামুটি মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে ওরা। এই এলাকায় জলের একটু কষ্ট, এই যা। সকাল হতে না হতেই পাড়ার মোড়ে কলের লাইনে দাঁড়ায় দুজনে। এরপরে ঘরে ফিরে টুকটাক কাজ কর্ম করতে করতে একটা সময় দুজনেই কাজে বেরিয়ে যায়।
নয়না ফেরে বিকেল বিকেল, এসেই একটু জিরিয়ে নিয়ে ওদের পুঁচকি এক ফালি বারান্দায় মেলা শুকনো কাপড় জামা তুলে আনে। এরপরে এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। বাড়ির সামনের মাঠটা তখন ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে ভরপুর। সারাদিন বাচ্চাদের সাথে কাটিয়েও একটুও এক ঘেয়ে লাগে না ওর। বরং সারাদিনের ক্লান্তি, নানান চিন্তা ভাবনার থেকে যেন মুক্তি আসে ওর। ক্রমে বেলা পড়ে আসে। রাস্তার আলো জ্বলে। ছেলেমেয়েগুলো যে যার নিজের বাড়ী ফেরত যায়। আশে পাশের বাড়ি থেকে কানে ভেসে আসতে থাকে মারাঠি সিরিয়ালের শব্দ। নীচে চায়ের দোকানের থেকে শোনা যায় লোকজনের নানা বিষয়ে তর্ক বিতর্ক। নয়নাদের টিভি নেই, নানান খরচাপাতির জেরে এখনো টিভি, ফ্রিজ কেনা হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে আছে এই বারে গণপতিতে ডে কেয়ারে বোনাস পেলে অন্তত একটা টিভি কিনবে। সুখদেব এত খাটে, সারাদিন অফিসে চাকরীর পরে আবার সন্ধ্যায় এক উকিল বাবুর চেম্বারেও তিন চার ঘণ্টা কাজ করে। ওর ওপর তাই ইচ্ছে হলেও কোনদিনও কোন দাবী করেনি। নয়না ভারী লক্ষ্মী মেয়ে, টানাটানির সংসারেও দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে চালায়। দুইবেলা মাংস ভাত না খেলেও, রুটি ডাল সব্জীর ঠিক যোগান করে ফেলে। রেডিয়ো চালিয়ে ও রান্নাঘরে ঢুকে চটপট রান্না সেরে ফেলে। কোন কোন দিন, রাঁধতে রাঁধতে গুণগুণ করে গলাও মেলায় রেডিয়োর সাথে। তারপরে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরে সুখদেব। দুজনে একটু সুখ দুঃখের গল্প করে। এরপরে খেয়ে নিয়ে ওদের এক কামরার বাড়ির আলো নিভে যায়। পরের দিন আবার সকাল হয়। আবার একই নিয়মে চলতে থাকে ওদের অতি সাধারণ জীবন।
ওদের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ এলো এক বড় ঢেউ। ডাক্তারের রিপোর্ট এলো, "সুখবর" সহ। সবে এক মাস। দুই জনে বসল ওদের আয় ও ব্যয়ের হিসেব নিকেশ নিয়ে। রাত্তিরটা দুজনে দুজনকে পিঠ দেখিয়ে ঠায় জেগে কাটালো। পরের দিন ডে কেয়ারের দিদিমণি সদা হাস্যময়ী নয়নার গোমড়া মুখ, চোখের কোলের কালি দেখে অবাক হলেন। শুনলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। এ যে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সন্ধ্যেবেলা এক ক্লিনিকের ফোন নম্বর দিলেন। আর সাথে এও বললেন, খরচা একটু বেশী, তবে নিরাপদ। আপাতত দিদি টাকাটা ধার দেবেন, মাসে মাসে শোধ করে দিলেই হবে। নয়না এত গুছিয়ে কাজ করে, ওর এখন ছুটি নেওয়া কিছুতেই সামলে উঠতে পারবেনা দিদি। বিকেলে নয়না বাড়ি ফিরল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজ তেমন মন নেই কোথাও। আনমনা ভাবে বারান্দার বাগানে (যা আসলে ওই তিনতে টবে তুলসী, টগর আর নয়নতারা গাছ) পাতাগুলোর গায়ে হাত বোলাতে লাগল। ভরা বর্ষার মরসুম, গাছের পাতাগুলো সবুজ সতেজ। নজরে এলো, তুলসীর টবে দু তিনতে আগাছা। সবে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে, আকাশের পানে লম্বা হয়ে ঘাড় তুলবার অসীম প্রচেষ্টায়। উফ, একেই সাড় মাটির অভাব। কাঁচা তরি তরকারির খোসা ফেলে ফেলে যা একটু সাড় তৈরি হয়, এর মধ্যেও আবার ভাগ বসাতে আসবে নাকি। তাহলে তো তুলসী গাছের বরাদ্দ পুষ্টি কমে যাবে। টেনে তুলে ফেলল, তারপরে একদম নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল নয়না। কাজে মন নেই। সুখদেব এলে ওকে দিদির দেওয়া নম্বরটা দিয়ে একবার কাল কথা বলে আসতে বলবে। খবরাখবর সব যা নেওয়ার, নিয়ে আঁটঘাঁট বেঁধে এগোতে হবে। এই যাহ! গেল রুটিটা পুড়ে। রাত্রে খেতে বসে দুজনের কেউই টের পেল না শাক ভাজাটা নুনে পোড়া।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখল নয়না। দুটি বড় গাছ। একটি কাঁদছে, ওর মোটা গুঁড়ির থেকে অনবরত জল ঝরে পড়ছে। অন্যজন, ওর সঙ্গী, ভারী মমতাময় কণ্ঠে ওর দিকে স্নেহের হাত বাড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
- ওরা যে মরে শান্তি পেল। তুমি কেঁদো না। এই রুঢ় পৃথিবীতে ওরা পেরে উঠত না। সম্বল কোথায়?
- কেন পারত না গো? আমরা পারি নি?
- রসদ কমে এসেছে যে।
- সূর্য তো একই আছে, বৃষ্টিও এক। তাহলে? হতে পারে একটু লড়াইটা বেশী হত, সকলের। কিন্তু তবুও, বাঁচত তো।
No comments:
Post a Comment