আমার এই দীর্ঘ জীবনে (আরে বাবা দেখতে শুনতে একটু ইয়ং হলেই কি আর কচি বয়স হয় নাকি? সে না হয় ভগবানের কৃপায় আমায় ওই অ্যান্টি রিঙ্কল ক্রিম মাখতে হয় না, আদপে কিন্তু বয়সের গাছ পাথর নেই) কেবল মাত্র এক বছর (২০১৩) আমি পুজোর সময় কলকাতায় ছিলাম না। সবে চেন্নাইতে এসেছিলাম, তক্ষুনি ছুটি পাবোনা ভেবে দরখাস্তও করিনি। কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে, এত ডিপ্রেসিং কেটেছিল, কি বলব। যদিও ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমী অবধি চেন্নাইয়ের কেবলমাত্র দুটো মণ্ডপে "পরিক্রমা" করেছিলাম ( আজকাল প্রায় ১৫-১৬টা পুজো হয় এখানে), ২০০+ ছবি তুলেছিলাম, বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেয়েছি, ঘুরেছি, সব করেছি, কিন্তু তবুও খুব মন খারাপ করা একটা ভাব ছিল। আর তাই আমি ঠিক করে নিই যে আর কক্ষনো পুজোয় কলকাতার বাইরে থাকবনা। সারা বছর দাঁতে দাঁত চিপে পড়ে থাকব এখানে, কিন্তু পুজোয় কলকাতা যাওয়াটা মাস্ট! গত তিন বছর মেনেছি সেটা, দুর্ভাগ্যবশত এইবারে আর হচ্ছেনা। চেন্নাইতেই থাকব। যবে থেকে এটা স্থির হয়েছে (এবং আমি জানি, এর নড়ন চড়ন হবেনা। কারণ আমার বুকে অত ধক নেই যে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে যাতায়াত করব প্লেনে) তবে থেকে (মাস খানেকের ওপর হতে চলেছে) সারাক্ষণ একটা মন খারাপ করা আমায় ঘিরে রেখেছে। নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হবে, তাই ভাবলাম যে নাহ, অনেক হয়েছে। এর একটা বিহিত দরকার। ঠিক করলাম তাই যে পুজোয় কলকাতা গেলে কি কি অসুবিধে, সেই সব নিয়ে বরং চর্চা করি। অন্তত দিনের শেষে মনটা শান্ত হবে।
আমি যেহেতু গত তিন বছরে শুধু মাত্র পুজোয় বাড়ি গিয়েছি, তাই ছুটিটা একটু লম্বা হয়। সাধারণত মহালয়ার আশেপাশে যাই আর ফিরি লক্ষ্মী পুজোয়। তাই পুজোর কেনাকাটাগুলিও বাড়ি গিয়ে করি। এবার শেষ মুহূর্তে বাজার করতে গেলে যা হয়, প্রায়ই ঝটতি পটতি জামাকাপড় পড়ে থাকে। কিছু পছন্দ হলে তার সাইজ আসেনা, নয়তো সাইজ এলে রঙ আসেনা। কি যন্ত্রণা। তারপর আবার দর্জির দোকানে তিন মাস আগে থেকে অর্ডার ক্লোজডের চোখ রাঙানি। উফ। রেডিমেড জামা পড়ে কম্প্রোমাইজ করতেই হয়। তা আপনি বলতেই পারেন যে চেন্নাইতে শপিঙটা করে নিলেই হল। প্যান্টালুন্স ওইয়েস্টসাইড লাইফস্টাইল সবই সব জায়গায় আছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে, কিন্তু স্টক আলাদা। কলকাতায় যেটা ফ্যাশনেবল, সেটা মোটেই এখানে না। একটা জামা পড়লে তো সেই ফিলটা আসতে হবে যে হ্যাঁ, এটা সারা বছরের থেকে আলাদা। এটা শারদোৎসব। অগত্যা ওই লাস্ট মোমেন্ট শপিং। সন্ধ্যে হতেই এমন ভিড় শুরু হয়ে যায়, রাস্তায় ঘাটে চলা ফেরা করা মুস্কিল। তাই নিরুপায় হয়ে একদিন কি দুইদিন ওই দুপুর হতে না হতেই ছোট! ভাত ঘুমের জলাঞ্জলি একেবারে। হয় গনগনে রোদে পুড়ে কেনাকাটি করো, নয়তো বৃষ্টিতে ভেজো। Essay বইয়ের ওই শরতের নীল আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ আদপে যে কবে দেখা যায়, পাব্লিশারের ঠাকুরদাও জানেন কিনা কে জানে।
আর তারপরে ওই সারা রাত বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে পেরেক ঠোকার বিরক্তিকর শব্দ। বাচ্চাকাচ্চাগুলোর তৃতীয়া থেকেই ক্যাপ ফাটানো শুরু। আনন্দবাজার খুলতেই শুধুই ওই কোন প্যান্ডেলে কোন থিম, মহালয়া থেকে কোথায় কোথায় কে কোন পুজো উদ্বোধন করলেন, সেখানে কত লম্বা লাইন। আরে বাবা এসব দেখলে কমপ্লেক্স হয়ে যায় তো। আমি কিনা ক্লস্ট্রোফোবিক মানুষ। পাড়ার ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই অষ্টমীর সকালে (আজকাল আবার সাত সকালে হচ্ছে, ভালো করে মাঞ্জা দেওয়ার সময়টুকু পাওয়া যাচ্ছেনা) সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে, শিবে, সর্বার্থসাধিকে অবধি ঠিক আছি। নিদেনপক্ষে একদিন সকাল সকাল উত্তর কলকাতার কিছু সাবেকী ঠাকুর দেখব। ব্যস। তা না। কোন প্যান্ডেলে রাতের আলোয় কতটা মায়াবী লাগছিল এসব ছবি দেখিয়ে যত সব লোভ দেখানো। যাব তো না রাত্রে বাইরে, ওই ভিড় আর লোকের গুঁতোগুঁতি। মিছিমিছি ফ্রাস্ট্রেটেড করে দেওয়া। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবে ঠিক করো, সবাইকে একসাথে পাওয়া আরেক কীর্তি। দুই মাস আগে থেকে গ্রুপ চ্যাটে একেবারে ডিপ্লোম্যাটিক লেভেলের চেয়েও জরুরি ভাবে আলোচনা করে দিনক্ষণ ঠিক করেও ঠিক লাস্ট মোমেন্টে কেউ না কেউ ডুব মারবেই। তারপর কোনমতে দেখা হল, তো আরেক প্রস্থ বিরক্তিকর ব্যাপার শুরু। খালি খালি ওই সেলফি তোলো নয়তো ক্যামেরায় ছবি তুলে দাও, পোজ দাও। আরে বাবা এই ঢাউস ক্যামেরা বয়ে বেড়ানো চারটিখানি কথা নাকি? তারপরে রেস্টুরেন্টে যাও খেতে। একেই তো টাকার শ্রাদ্ধ, তার ওপরে লম্বা লাইন। সেই লাইন বুঝি কলকাতা থেকে প্রায় হনলুলু পৌঁছে যাওয়ার জোগাড়। খেতে বসে হয় এইটা নেই, নয় ওটা নেই। অনেক কষ্টে অর্ডার যাও বা করব, খাবার আসতে আরেক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে যাবে। এলেও টেস্টের তো মা বাপ নেই। ছ্যাঃ। তারপর হুজুগে পড়ে দেশপ্রিয় আর ম্যাডক্স যাওয়া। ট্যাক্সি পাওয়া তো প্রায় ডেটল দিয়ে ঘর মুছে জীবাণু পাওয়ার মত, বা তার চেয়েও কম চান্স হয়তো। আর বাই চান্স যদি বৃষ্টি পড়ে (ইদানীং তো তাই হচ্ছে প্রতি বছর), তাহলেই হল। ওই জল আর কাদায় আনারকলিটা তো গেলই, তারপরে ম্যাডক্সে গিয়েও খবরের কাগজ পেতে বসে যে আড্ডা দেওয়ার কথা, তাও মা ভবানীর ভোগে। কোন মানে হয়? এর চেয়ে এমনি সময়ে শান্তিতে বসে কোন কফি শপে আড্ডা মারলে কি ক্ষতি? পাতি সেন্টিমেন্ট যত।
এসব মিটিয়ে ফেলতে ফেলতেই নবমী। অনেক কষ্টে একটু শান্তিতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলাটা পড়ব, ওমনি মায়ের আদেশ ( catalysed by "গলফ গ্রীন পূজা মণ্ডপ থেকে বলছি। আমাদের নবমী ভোগ বিতরণ শুরু হয়েছে। দয়া করে আপনারা সপরিবারে আসুন...") যে বাবু প্লীজ একটু ক্যুপন নিয়ে যা। প্যাকড ভোগ দিচ্ছে এবারে (কত কিছুই দেখবো!)। নিয়ে আয়। দুই বার চেষ্টা করেও কাকুটি মিনতিতে কাজ হবেনা। সেই আমায় আবার ড্রেস চেঞ্জ করে প্যান্ডেলে যেতেই হবে। কি লাইন রে বাবা। এমন করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ এসেছে। ওই লাইনে দাঁড়ালেও লোকে তার মধ্যেও ক্যাচাল করবে। বসে খেলে আপনার পাতে খিচুরি পড়ার আগেই পরের ব্যাচের জন্য লোক চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। উফ। এ কি ভদ্রলোকের শোভা পায় বলুন? এমন হাঘরেপনা কেন? বুঝি না বাপু। চেন্নাইয়ে কি সুন্দর। স্টলে যাও, পছন্দসই খাবার খাও। আরো ভালো, পুজো মণ্ডপেই যেয়োনা। সাধারণ দিনের মত যে কোন রেস্টুরেন্টে যাও, খাও, চলে এসো। কোন ভিড় পাবে না। আরাম।
এতেই শেষ হলে বুঝতাম। আবার পরের দিন দর্পণে বিসর্জনের পরে প্যান্ডেলে যাও, ঠাকুরের পায়ের ফুল তুলে আন, নমস্কার করো। বাবা রে! তারপরে ওই সিঁদুর খেলা নিয়ে ন্যাকামি। দোলের দিন রঙ খেলে হয় না যেন এদের, আবার একটা এক্সট্রা দিন চাই। বিবাহিত অবিবাহিত পুরুষ নারী বাচ্চা বুড়ো সব এমন সিঁদুর মেখে থাকবে, আর তারপরে ডি এস এল আর নিয়ে কিছু পাবলিকের সেই ছবি তোলা। গা জ্বলে যায় যত ন্যাকামি দেখলে। গঙ্গার জল যে কি পরিমাণে দূষিত হয় এই ভাসানের পরে, কারুর খেয়াল আছে? শোভাযাত্রা করে রাস্তা দিয়ে যখন বাবুঘাটে যায়, তখন যে সাধারণ লোকের কি অবস্থা হয়, ট্রাফিক জ্যামে বাসে অটোতে বসে...তার হিসেব কেউ রাখে? পুজো বলে অটোর ভাড়া রিক্সার ভাড়া লাগামহীন ভাবে বেড়ে যায়, কত ট্যাঁক ফাঁকা হয়, সেই বেলা? পুজোয় কলকাতা না গেলে কত টাকা বাঁচে ভাবুন তো!
সবচেয়ে বিরক্তিকর তো ওই বিজয়া দশমীর নাম করে আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া। প্রণাম করো রে। মিষ্টি খাও রে। ক্যালোরিস। জঘন্য। I mean, who prefers নারকেল নাড়ু and চন্দ্রপুলি to wraps and rolls? এক গাদা ওই whatsapp facebook messages, বিরক্তিকর। আর সব শেষে ফেরার দিনে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি। কেউ যেচে এমন বাঁশ নেয় নিজের ওপর বলুন? এর চেয়ে বাবা পুজোয় কলকাতা যাব না। অন্তত ঘরে বসে ফেসবুক ডিএক্টিভেট করে চুপচাপ শারদীয়াগুলো পড়তে পারব। ওই মুহূর্তে মুহূর্তে ফেসবুকে ছবি দেওয়া, লোকের চেক-ইন দেখা এসব হবে না। এই আমার ভালো! অন্তত আফসোস থাকবেনা। এশিয়ান পেন্টসের সেরা দশ দেখা হল না বলে। বাগবাজারের মা কে না হয় ডি ড্রাইভের কোন পুরনো ফোল্ডারে দেখে নেব। মা তো মাই। সে সাত লক্ষ পঁচানব্বই হোক কি ছয় লক্ষ ছত্রিশ।
No comments:
Post a Comment