" বাপ রে, আজকের কাগজটা দেখেছিস তুয়া? পুরো আশি পাতা!"
" হ্যাঁ, দেখেছি। শুধুই বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। প্রত্যেকটা ফেস্টিভালকে এরা এত কমারশিয়ালাইজ করে, ভাবা যায় না।"
" বাট দ্যাট ইস বিজনেস, তাই না? লোকের এখন হাতে বোনাস, মনে ফুর্তি। এটাকে এনক্যাশ করতেই হবে!"
" হুম, ঠিকই। এনিওয়ে, আমি বেরোচ্ছি দীপ, তোর খাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখে গেলাম। খেয়ে নিস। আর আজ কখন বেরোবি?"
" থ্যাংকস! লাঞ্চের পর একটা মিটিং আছে। কাজারিয়ার সাথে। দেখি যদি ডিলটা ক্র্যাক করতে পারি।"
" অল দা বেস্ট। দেখ কাজারিয়ার মুড নিশ্চয়ই এই ফেস্টিভ সিজনে ভালো, যদি তুইও সেটা এনক্যাশ করতে পারিস দীপ।"
" হ্যাঁ। ক্র্যাক করতে পারলে একটা প্লে স্টেশন কিনব। প্রচুর অফার দিচ্ছে।"
" তুই ওই কর দীপ। তিরিশ বছর বয়স হয়েছে, কোন ম্যাচিউরিটি নেই। এখন না কি প্লে স্টেশন কিনবি। সিরিয়াসলি!!!"
" বাট ওয়াই নট? রোজগার করছি, ভোগ করব না কেন?"
" হ্যাঁ সেই তো। দিনের পর দিন আমি খেটে মরছি, আমাদের সব বিলস পে করছি, তোর খামখেয়ালিপনা সাপোর্ট করছি, আর উনি নাকি দু পয়সা এলে সঙ্গে সঙ্গে প্লে স্টেশন কিনবেন। সত্যি!"
" তুই এমন করছিস তুয়া যেন সবটা তোর কাছে সারপ্রাইজ? আমি যখন স্টার্ট আপটা শুরু করব বললাম, তুইই তো তখন বলেছিলি যে আমায় সাপোর্ট করবি। আর এখন এক বছর হতে না হতেই এই?"'
" দীপ, আমি কি একবারও বলেছি যে তোকে সাপোর্ট করব না? কিন্তু তুই বল, এক বছরে একটুও কি কিছু উন্নতি হয়েছে? আই এম টায়ার্ড দীপ, তুই প্লীজ রেগ্যুলার চাকরি খোঁজ। এনিওয়ে, আই এম গেটিং রিয়েলি ভেরি লেট। রাত্রে কথা বলব।"
মন মেজাজ তিক্ত করে তুয়া বেরোল অফিসের জন্য। একটা সরকারি ব্যাঙ্কে ক্লারিক্যাল পদে চাকরি করে। বাড়ি থেকে অফিস প্রায় ঘন্টাখানেকের রাস্তা। মিনিবাসে অফিসটাইমে ভিড়ে গাদাগাদি করতে করতে রোজ অফিস যাওয়া, একটা বিভীষিকাই বটে। একটা সময় ছিল যখন ও ভাবত চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজের মত করে পছন্দসই কিছু করবে, ক্রিয়েটিভ কিছু। ছোটবেলা থেকে শেখা নাচ বা গানকে পেশা করবে। কিন্তু দীপের আই টি ফার্মের চাকরিটা দু বছর আগে চলে যাওয়ার পর থেকে আর হাজার ইচ্ছে থাকলেও পারেনি ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়তে। দিনের পর দিন, শত বিরক্তি, ক্লান্তি নিয়েও করে গিয়েছে একই একঘেয়ে টাকাপত্তরের হিসেব।
ক'দিন ধরেই অফিস কলিগ শিপ্রাদি, মাধুদি আর পুণ্যিরা লাঞ্চ টাইমে শুধুই ধন্তেরসে কে কী কিনবে, কোন গয়নার দোকানে কী অফার চলছে, সেই নিয়েই আলোচনা করে চলেছে। এইসব ডিস্কাশানের সময়ে এত মন খারাপ হয়ে যায় তুয়ার। উঠে যে চলে যাবে, সে উপায়ও নেই। কেন যে ওরা একটু সেনসিটিভ হয় না, ওরাও তো জানে তুয়ার বর্তমান পরিস্থিতি। তুয়া আর দীপ দুজনেই ঠিক করেছিল, দুই পক্ষের বাবা মা কে কোনভাবেই বিরক্ত করবে না অর্থনৈতিক সাহায্য চেয়ে, যা করার, নিজেরাই করবে। এই কদিন দিব্যি মানিয়েও নিয়েছে, চলেও যাচ্ছে। আসলে মানিয়ে নেওয়াই হচ্ছে, সাধ আহ্লাদ দুজনেই তো বিসর্জন দিয়েছে কতদিন হল। উঠতে বসতে ট্যাক্সি ছাড়া চলত না যার, সেই দীপ এখন মেট্রো, বাসে করে ক্লায়েন্ট ইনভেস্টর মিটিং করছে, বাজার করে সন্ধ্যেবেলা কুড়িটা টাকা বাঁচানোর জন্য রিক্সা না নিয়ে তুয়া হেঁটে বাড়ি ফিরছে। এডজাস্ট করেও তো চলছে, ধৈর্য ধরে চলছে বটে, কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝেই বাঁধ ভাঙ্গছে। এই যেমন, একটা প্লে স্টেশন কেনা নিয়ে দীপকে সকাল সকাল কথা শুনিয়ে দিল ও, সত্যি তো, মানুষটা কতদিন তো নিজের জন্য কিচ্ছু কেনেনি।
আজ সকালে গয়নার দোকানের এড দেখে একটা নেকলেস ভীষণ পছন্দ হয়েছিল তুয়ার, ভেবেছিল ওই ডিজাইন দেখিয়ে পাড়ার দোকান থেকে মাসিক কিস্তিতে টাকা দিয়ে বানাবে, বড় বড় দোকানের মজুরি, ট্যাক্সের চক্করে যা আকাশছোঁয়া দাম হবে, ওর পক্ষে এফরড করা সম্ভব না এখন। আর ঠিক তখনই দীপ বলল প্লে স্টেশন কেনার কথা, হঠাৎ করেই তাই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। এখন ভীষণ খারাপ লাগছে। না, এর একটা বিহিত করতেই হবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গে অফিস কলিগ শুভ্রকে একটা মেসেজ পাঠালো, " এই শুভ্র, প্লে ষ্টেশনের মোটামুটি ভালোর মধ্যে কোন মডেলটা কেনা যায় বলবি? তোর জামাইবাবুর জন্য সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে কিনব। এমাজনের লিঙ্ক সমেত বল।" শুভ্র ওর খুব ন্যাওটা, বছর পাঁচেকের ছোট ওর থেকে, সবে কিছু মাস হয়েছে ওদের ব্রাঞ্চে যোগ দিয়েছে। সারাক্ষণ দিদি দিদি করে যায়। খুব টেক স্যাভি, তাই ওর থেকেই যথাযথ ইনফরমেশন পাবে জেনেই ওকে মেসেজটি করেছিল তুয়া। এবং যথারীতি দশ মিনিটের মধ্যেই বাস গড়িয়াহাটের মোড়ে জ্যামে যখন দাঁড়িয়ে আছে, তখনই ওর ফোনে ঢুকল শুভ্রর মেসেজ।
অফিসে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে ডেস্কটপ খুলে অর্ডার করে দিল। ভাগ্য ভালো ছিল, ই এম আই তে টাকা দেওয়া সত্ত্বেও ফেস্টিভ অফারে সেম ডে ডেলিভারি হবে। দীপের নম্বরটা আর বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে অর্ডার প্লেস করে তবে শান্তি পেল তুয়া। এইবারেও তাহলে নেকলেসটা হল না, যাক গে, বিয়েতে কিছু গয়না পেয়েছিল, সেইগুলোও তো ভল্টে রয়েছে, নতুন কিনেই বা কী করত, না হয় পরে কোন একটা গয়না এক্সচেঞ্জ করে এই নতুন বানিয়ে নেবে। এইসব ভাবতে ভাবতে দিনের কাজ শেষ করল। ফেরার পথে রাস্তায় খুব জ্যাম পেল। আজ ধন্তেরস, পথেঘাটে খুব ভিড়, স্পেশালি গয়নার দোকানগুলির কাছে। বৌবাজার পেরোতেই বাসটার আধ ঘণ্টা লেগে গেল। ছোট বড় দোকানগুলিতে ভর সন্ধ্যেয় ক্রেতা ভর্তি, পা ফেলার জায়গা নেই। আরো একবার হতাশার নিশ্বাসটা পড়ল তুয়ার। তখনই মোবাইলে ঢুকল এমাজনের মেসেজ, পার্সেল ডেলিভারির। বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে আটটা বেজে গেল ওর। বেল বাজানোর পর মিনিট দুই কেটে যাওয়ার পর এক মুখ চওড়া হাসি সহ দরজা খুলল দীপ। যাক, প্লে স্টেশনটা পেয়ে তাহলে সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছে ও।
কিন্তু এ কী, প্যাকেজটা তো টেবিলের ওপর পড়ে আছে, খোলাও হয়নি। তাহলে?
" তুয়া, আমি ডিলটা ক্র্যাক করেছি।"
" অসাম!!! Congrats দীপ। আই এম সো হ্যাপি ফর ইউ। "
" আই নো! আমার এতদিনের উদ্যম, চেষ্টা আজ স্বীকৃতি পেল। ভীষণ ভালো লাগছে।"
" কিন্তু তুই আমায় ফোন করে জানালি না কেন?"
" বিকজ আই ওয়ান্টেড ট সি দিস প্রেশাস স্মাইল অন ইয়োর ফেস ওয়েন আই break দিস নিউজ টু ইউ!"
" সত্যি রে দীপ। আমি খুব খুশী। আচ্ছা শোন, তাহলে তো ওই এমাজনের প্যাকেজটা একদম ডবল আনন্দ দেবে তোকে। জাস্ট খুলে দেখ! "
" দেখছি। কী আছে এতে? তুই এলে খুলব বলে আর এতক্ষণ অপেক্ষা করে আছি।"
" এবার দেখ। মনে হয় পছন্দ হবে।"
" দাঁড়া এক মিনিট। আমিও তোর জন্য একটা গিফট এনেছি। চল একসাথেই দুজনে খুলব নিজেদের গিফটস।"
" বেশ তো।"
দীপ বেডরুম থেকে ফিরল হাতে একটা গয়নার দোকানের প্যাকেট নিয়ে।
" এই নে, তোর জন্য।"
তুয়া খুলে দেখে ভিতরে ওর কদিন ধরে পছন্দ করা নেকলেসটি। আনন্দে দুই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে জলে।
" তুই কী করে জানলি...?"
" শোন, ব্যবসা করতে নেমেছি, চারিদিকে চোখ কান খোলা রাখাটা প্র্যাকটিস করতে হবে তো, নাকি? তুই মুখ ফুটে কিছু বলিসনা বলে কি আমি কিছুই বুঝিনা? ডিলটা ক্র্যাক করেছি, তাই আডভান্সের টাকাটা দিয়ে এটা তোর জন্য।"
" থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ দীপ। আই লাভ ইউ।"
" আই লাভ ইউ টু! আর হ্যাঁ, প্লে স্টেশনটার জন্যও মেনি থ্যাংকস।"
" কী করে জানলি?"
" হাম সব সমঝতে হ্যায় ম্যাডাম!"
" যতসব।"
" প্যাকেটের ওপর লেখা থাকে রে হাঁদা! ওটাই দেখেছি।"
" হুম। ব্যস, ওমনি দেখলি, আর তাই ছুটলি আমার জন্য রিটার্ন গিফট কিনতে।"
" তুয়া!!!!! তুই আর শুধরোবি না!!!"
দুজনের খুনসুটি ভরা হাসির ফোয়ারায় তখন উৎসবের আলো আরো ঝলমল করে উঠেছে।
No comments:
Post a Comment