"ধুর, জীবনটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেল রে শৌভিক। কিছু একটা করতে হবে, সামথিং ইন্টারেস্টিং!" প্রতি রবিবারের মতই গত রবিবারের সকালটাও আমার শুরু হয়েছিল ঠিক একই ভাবে। আমি শৌভিক চট্টোপাধ্যায়, বয়স ৩০, চাকরি করি একটি মাল্টিনেশন্যাল কোম্পানিতে, বিজনেস এনালিস্ট পদে। থাকি চেন্নাইতে। সোম থেকে শুক্র নয় ঘন্টা অফিস করে কোনোমতে দিন কাটাই, তাই শনিবারটা শুধুই ঘুমিয়ে শুয়ে টিভি দেখে বই পড়ে শেষ হয়ে যায়। এই একই অবস্থা মুকুলেরও। মুকুল বসু, আমার ফ্ল্যাটমেট, আমারই বয়সী। চাকরি করে একটি মোটর কোম্পানিতে, আমারই মত দশটা সাতটা রুটিনে বিপর্যস্ত। শনিবারের দিনটা ওরও এমনভাবেই কাটে। আর তারপর রবিবার ভোর (হ্যাঁ মানে ওই ধরুন সাতটা নাগাদ সকালে) হতে ঘুম ভেঙ্গে আমার জন্য কফি আর নিজের জন্য গ্রিন টি বানিয়ে আসে আমার ঘরে। কাপটা দিতে দিতেই ঠিক এই একই হতাশাময় বাক্য বলে। সত্যি বলছি, আইডেন্টিকাল, word to word same, বিশ্বাস না হয়, আমি পরপর কিছু সপ্তাহ না হয় রেকর্ড করে শোনাবো আপনাকে। তখন বুঝবেন। একটা মানুষের যে কী করে এত কন্সিসটেন্সি থাকে জীবনে, ভাবতেই অবাক লাগে।
তা প্রতি সপ্তাহে শুনি আর ভাবি, যে হ্যাঁ, সত্যিই তো। আমার বয়সীরা এখন কেউ অনসাইটে কাজের দৌলতে কোম্পানির টাকায় ইউ এস ইউ কে ভ্রমণ করছে, কেউ বা রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনে এখন হয় বৌয়ের সাথে যৌথ ডিনার পার্টি হোস্ট করছে প্রতি উইকেন্ডে। সেখানে আমি রবিবার হলে কাজের কাজ বলতে আডিয়ারে গিয়ে একটু মাছের বাজার করছি আর কে সি দাসে কচুরি জিলিপি খেয়ে ব্রেকফাস্ট সারছি। সারাদিনে তারপর দুটো সিনেমা ইউটিউবে আর দু চার লাইন কাব্য লিখছি। মাঝে রান্নার মাসীর রেঁধে যাওয়া অখাদ্য কুখাদ্য ভাত ডাল সব্জি খাচ্ছি। রাত্তির হলেই সুইগি দিয়ে কিছু ভালো মন্দ হয় অর্ডার করছি, নয়তো দুজনে বাইক হাঁকিয়ে ফিনিক্স মলে গিয়ে খেয়ে আসছি। এই কী কোন জীবন হল? না, এবারে কিছু তো করতেই হবে। কতটা এক্সাইটিং হবে, জানি না। কিন্তু অন্তত স্বাদবদল তো হবেই।
" চল মুকুল, আজ কিছু অন্যরকম করব।"
" কী করবি?"
" করবি না, বল করব।"
" ফালতু হ্যাজাস না তো। ওই একই হল। তা কী করব সেটা বল।"
" বাইক বের কর। একটা জায়গায় যাব। "
" কোথায়?"
" আগে বের কর, রাস্তায় বেরিয়ে বলছি।"
কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপে একটা প্রতিষ্ঠানের খবর পেয়েছিলাম, তারা কাজ করে এইডস আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে। মহাবালিপুরম যাওয়ার পথে মাঝে একটু বাঁক নিলে রয়েছে স্নেহাম নামের একটি আশ্রম। গুগুল ম্যাপ্সে সেই লোকেশন সেট করে আমরা দুই বন্ধু সেই রবিবার চললাম স্নেহামে। পথে একটা ডিপারট্মেন্টাল স্টোর থেকে বাচ্চাদের জন্য নিলাম অনেক চকোলেট, রঙ পেন্সিল, খাতা, পেন্সিল আর কিছু টুকটাক ছোটখাটো মুখরোচক খাবারদাবার। স্নেহামে পৌঁছলাম যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। বাইক পার্ক করে আমরা অফিসের ইন চার্জ, শ্রী ভেঙ্কটেসানের সাথে কথা বললাম। জানালাম যে বাচ্চাগুলোর সাথে আজকের সারাদিন কাটাতে চাই। ওদের জন্য কিছু জিনিস এনেছি, সেইগুলি দিয়ে দিলাম। ভেঙ্কটেসানের মুখের হাসি দেখে কে বলবে যে একটু আগেই তার চকচকে কৃষ্ণবর্ণ চেহারায় বিশাল মোটা একখানা গোঁফ দেখে আমরা তামিল সিনেমার ভিলেন ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম! ভানাক্কাম ভানাক্কাম (নমস্কার) , নান্দ্রী (ধন্যবাদ) , রোম্বা নাল্লা (খুব ভালো) ইত্যাদি ইত্যাদি শুনেটুনে আমরা যখন একেবারে গদগদ, ছাতি প্রায় দশ ইঞ্চি বেড়েছে, বাচ্চাদের প্লেরুমে ঢুকতে যাবো, এমন সময় কানে ভেসে এলো, " উফ, কী প্যাথেটিক, বাইকটাকে পার্ক করেছে দেখ, যেন পার্সোনাল গ্যারেজ। এক্সকিউজ মি, ইস দা বাইক ইয়োরস? কুড ইউ প্লিজ মুভ ইট এ লিটল, আই এম আনেবল টু পার্ক মাই স্কুটি।" দক্ষিণদেশে বঙ্গতনয়ার সুমিষ্ট কন্ঠস্বর শুনে তো ততক্ষণে আমি আর মুকুল থ। তাকিয়ে দেখি হাল্কা বাদামী রঙের কুর্তি আর নীল জিন্স পরিহিতা এক অপূর্ব সুন্দরীর কন্ঠ, পাশে রয়েছে একইরকম সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার আরেক তনয়া, পরনে লাল টপ আর হলুদ সালোয়ার। দুজনেরি হাতে হেলমেট। ঘোর ভাঙল, বলা চলে ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা থেকে বিঘ্ন ঘটাল ভেঙ্কটেসানের কথা, " সার, প্লীজ পার্ক ইয়োর বাইক কেয়ারফুলি, দিস ম্যাডাম ক্যানট পার্ক হার স্কুটি।"
" ও হ্যাঁ, করছি, আই মিন, ইয়েস, ডুইং ডুইং।" বলতে বলতে মুকুল এগিয়ে গেল।
" আপনারা বাঙ্গালী দেখছি! (কোনো বোনাস পয়েন্ট দেব না, মুকুলের উচ্চারণে পরিষ্কার বাংলা টান আছে, যে কোন বাঙালি ওই ইংরেজি শুনে বুঝে যাবে যে বক্তা বঙ্গতনয়।)
" হ্যাঁ, নমস্কার। আমি শৌভিক চট্টোপাধ্যায়, আর ও আমার বন্ধু মুকুল বসু। আমরা চেন্নাইতে চাকরি করি, থাকি।"
" তুলিকা মুখোপাধ্যায়। আন্না ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিকাল ডিপারট্মেন্টে লেকচারার। আমার বান্ধবী, সহচরী সান্যাল, ও সি এম আই তে রিসার্চ করে, ফিসিক্স ডিপার্টমেন্টে।" গড়্গড় করে বলে চলল লাল হলুদ, প্রিয় দল ইস্টবেঙ্গলের রঙ্গে রঙ্গীন মেয়েটি।
" আলাপ করে ভালো লাগল।"
" দাঁড়ান, আপনার বন্ধু দেখছি বাইকটা সরিয়েছে, আমি স্কুটিটা পার্ক করে আসছি। তুলি তুই ভেঙ্কটেসানকে জিনিসগুলো দে, আমি আসছি।" এই বলে বাদামী জামা পরিহিতা শ্রীমতী সহচরী বেরিয়ে গেলেন। শ্রীমতি বললাম কারণ হঠাৎ করেই ওকে দেখে আর ওর রাগ রাগ কথা প্রথমে শোনা ইস্তক আমার শতাব্দী রায়ের শ্রীমতি ভয়ঙ্করী সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল! তা বলে নিজেকে চিরঞ্জিতের প্রলয়শঙ্কর মনে হয়নি অবশ্যই! সে যাই হোক। ইতিমধ্যে ভেঙ্কটেসানের পিছু পিছু আমি আর তুলিকা প্লে রুমে গেলাম। জানতে পারলাম যে এই দুই বন্ধু মাঝে মাঝেই এখানে আসে, বাচ্চাগুলো তাই ওদের খুব ভালো করে চেনে, ওদের দেখলেই খুশি হয়ে যায়। খানিকবাদে সহচরী আর মুকুল ঢুকল বেশ হাসি গল্প করতে করতে।
স্নেহামে মোট ২৯টি বাচ্চা থাকে, বয়স পাঁচ থেকে পনেরো। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওদের স্কুলে পাঠানো হয়, নিয়মিত ডাক্তার এসে চেক-আপ করে যান। মাঝে মাঝে এরকম আমাদের মত কেউ কেউ আসে, সারা দিন ওদের সাথে কাটায়। ওদেরও ভালো লাগে।
সেইদিনটা আমরা ভীষণ ভালো কাটালাম, উপভোগ করলাম এই বাচ্চাগুলোর সাহচর্য। ভেঙ্কটেসান সহ আরো যারা এই মহৎ কাজে লিপ্ত, তাদের সকলের সাথে পরিচয় হল। বাচ্চাগুলোর নির্মল হাসি, সহস্র দুঃখ কষ্টের মধ্যেও হার না মানার অদম্য প্রচেষ্টা, মন জয় করা ব্যবহার, সব আমাদের মুগ্ধ করল। প্রতিজ্ঞা করলাম যে এইখানে আবারও ফিরে আসব। সেইদিন অবশ্য এদের সাথে সাথে মদ্রদেশে দুই বঙ্গতনয়ার সাথে আলাপ হয়েও আমাদের দুই বন্ধুর নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা হলেও হিল্লোল উঠেছিল। গত ছয়দিন আমরা দুই বন্ধুই রাত জেগে শ্রীমতী ভয়ঙ্করী ও তুলির সাথে দেদার আড্ডা দিয়েছি। এখনো অবধি আড্ডাতে চারজনেরই অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। তবে মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই সহচরী আর মুকুল বোধহয় একটু রাইট টু প্রাইভেসি আওড়াবে, সেদিন মুকুলকে দেখছিলাম কি না ইন্টারনেটে এসব সার্চ করছিল। আর আমি? দেখা যাক, কপালে কী আছে! আর কিছু হোক না হোক, মুকুলের সাথে সাথে সবাই যে সহচর সহচরী পেলাম অনেকগুলো, এতেই আপাতত খুশি।
No comments:
Post a Comment