১৫ই অগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছিল, আমি ওইদিনে বাড়ি থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দিলাম মাদ্রাসের উদ্দেশ্যে, শুরু করতে চেন্নাইতে আমার দ্বিতীয় ইনিংস। জানিনা সেটা আমারও স্বাধীনতা নাকি পরাধীনতার নতুন শৃঙ্খলাবদ্ধ হলাম। তখনো পি এইচ ডি এডমিশন হয়নি, তাই আবারও পাট্টির বাড়িতেই উঠলাম। মাস দেড়েক থাকলাম। ৩রা সেপ্টেম্বর, আমার মায়ের জন্মদিনের দিনে জয়েন করলাম বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট, জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে। দুই চোখে তখন অনেক স্বপ্ন, বিশাল কেউকেটা হব। হোস্টেল পেয়ে গেলেও কেন জানিনা ওই পিজি ছেড়ে আসতে একদম ইচ্ছে করছিল না। তার মূল কারণ বোধহয় খাবার। মেসে দুপুরবেলাগুলো খেতে যেতাম, ওরে বাবা রে, ওই কুমড়োর ঘ্যাঁট, বেগুনের কিছু একটা, মূলো দেওয়া সাম্বার। সেখানে পিজিতে বেশ ইচ্ছেমতো মাছ মাংস সবজি ডিম যা প্রাণ চায়, রাঁধো, খাও। কিন্তু দুই জায়গার খরচা চালানোটা খুব বোকামি হয়ে যাচ্ছিল, তাই ঠিক করলাম অক্টোবরের শুরুতেই হোস্টেলে শিফট করব। ঘর দেখতে এসে তখন প্রথম আলাপ হল পরিচিতার সাথে। ওর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট ওই একই সেমিস্টারে ভর্তি হয়েছে পি এইচ ডি তে। ইতিমধ্যে ল্যাবে সুজাতার সাথে গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল (সে বন্ধুত্ত্ব এখনো বহাল আছে, ও সুদূর ইউ এস এতে পি এইচ ডি করছে। প্রতি রবিবার সকালে নিয়ম করে আমরা স্কাইপে কথা বলি, সারা সপ্তাহ মেসেজ। মানে সারাক্ষণ আপডেটেড থাকতেই হয় নিজেদের। সুজাতা আর আমি একবার তিরুপতি দর্শনে গিয়েছিলাম, সাত আট ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কী মারাত্মক অবস্থা। ওই ভিড়ের মধ্যেই কিছু মানুষজনের আজব ব্যবহার, প্রায় পারলে ওই লাইনে দাঁড়িয়েই যত পারে সোহাগ করে ফেলে। বাবা রে। গরমে ঘামতে ঘামতে ভিড়ে চিড়েচ্যাপটা হয়েও প্রেমের কমতি নেই। উফ!!! সেইবারে অবশেষে যখন দেবদর্শন হয়, ভগবানকে বলেছিলাম, ক্ষমা করবেন, খুব শিগগিরি আর আসছি না। এমনি মনে মনেই ভক্তি প্রার্থনা চলবে। তবে ওই যে মানুষ ভাবে এক, হয় এক। তারপরে আবারও একবার গিয়েছিলাম দর্শনে। আমার এক তামিল বান্ধবী, অমৃতা আর ওর মা বাবা বোনের সাথে। সেইবারে সুষ্ঠুভাবেই মিটেছিল। প্রসঙ্গত বলি, অমৃতা আমার খুব কাছের বান্ধবী। ও এখন হিউস্টনে পি এইচ ডি করছে। মেসের জঘন্য খাবার, ডিপারট্মেন্টের কিছু লোকজনের পি এন পি সি এই ছিল আমাদের হৃদ্যতার বেসিস, যা এখন বেশ বেশ পাকাপোক্ত। ও আমায় তামিল গান শেখায়, আমি ওকে বাংলা। আমরা একসাথে হোস্টেলের প্রোগ্রামে গেয়েওছিলাম। আমাদের ক্যাম্পাসের সরস্বতী পুজোতে ও একবার আমার সাথেই ভোরবেলা উঠে আমায় শাড়ি পড়িয়ে, নিজেও তৈরি হয়ে পুজোর যাবতীয় কাজকর্ম করেছিল। খুব লক্ষ্মী মেয়ে ও) , সুজাতা কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টারস করে আমাদের ল্যাবে প্রোজেক্টে ছিল, তাই ওর সুত্রে (আর কিছুটা নিজে গ্র্যাজুএশনে ওই একই সাব্জেক্ট পড়ার সুবাদে) পরিচিতার সাথে বেশ একটা একাত্মভাব অনুভব করেছিলাম। তবে আমার অত্যন্ত স্বভাববিরুদ্ধভাবে শুরুতে শিফটিঙ্গের আগেই পরিচিতার সাথে ছোট করে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস মায়ের কথামতো তারপরে ওর কাছে সরি টরি বলে সেসব মিটিয়ে নিয়েছিলাম। নইলে যে কী করে থাকতাম হোস্টেলে!
কেন, বলি। আমাদের তখন হোস্টেলের কমতি পড়েছিল ক্যাম্পাসে। বিভিন্ন আইনি প্যাঁচে পড়ে নতুন হোস্টেল আদ্ধেক তৈরি হয়ে ফেলে রেখেছিল, আমাদের মেয়েদের থাকতে দিচ্ছিল কোয়ার্টারে। 1BHK ফ্ল্যাটের মতো, হলে দুটো বেড আর বেড্রুমে দুখানা। আমার আর পরিচিতার ছিল হলে, বাকি যেই দুইজন ছিল ভিতরে, তারা অন্ধ্র প্রদেশের। তাদের মধ্যে একজন, সুস্মিতা তার নাম, সে যে কী প্রচন্ড জ্বালাতন করে মেরেছে আমাদের, কী বলব! মানে ওকে নিয়ে লিখতে গেলে একটা গোটা পর্ব হয়ে যাবে, আর ও মোটেই সেটা পাওয়ার যোগ্য না। তাই এক দুই শব্দেই বলি, ওর মতো অসহযোগী, নিয়মকানুনের ধার না ধরা, ইচ্ছে করে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা মেয়ে আর দুটো দেখিনি। পরিচিতা যতদিন ছিল আমার রুমমেট, কোন কারণে সুস্মিতা ওকে একটু সমঝে চলত। ও চলে যেতেই সুস্মিতার দৌরাত্ম্য শুরু হত। তখন একেই লেখাপড়ার সাঙ্ঘাতিক প্রেশার, অন্যদিকে প্রতিদিন হোস্টেলে ফিরে এই মানসিক অত্যাচার। সত্যি, কীসব দিনই না গিয়েছে।
যাই হোক, ২০১৩'র ডিসেম্বরে আমি বাড়ি ফিরি, ভাই (মানে দিব্যেন্দু) আর আমি, একসাথেই টিকিট কেটেছিলাম। গোটা জার্নি গল্প করে মজা করেই কাটিয়েছিলাম। সেইবারে তো বাড়ি ফিরে একেবারে প্রায় যাকে বলে গ্র্যান্ড ওয়েলকাম পাই আর কি! ইউনিভারসিটির বন্ধুরা, স্কুলের বন্ধুরা সকলের সাথে এতদিন বাদে দেখা করে কী আনন্দ আমার। মনে আছে, ওই প্রথমদিন মা আর বাবাকে খালি ডেকে ডেকে দেখিয়েছিলাম আই আই টির সবুজ রঙের আই ডি কার্ডটি, সেটি যে তখন আমার একটু "সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসের" চাবিকাঠি!
যাই হোক, তা কাজে কর্মে, কোর্সের চাপে দিন কাটছিল বেশ। ইতিমধ্যে একবার ভাই আর সুজাতার সাথে তদানীন্তন চেন্নাইয়ের একমাত্র অথেন্টিক বাঙালি খাবারের ঠেক, শ্রী অন্নপূর্ণাতে গিয়ে খেয়ে এসেছিলাম। কলকাতা ছাড়ার আগেই জায়গাটির মাহাত্ম্য সম্বন্ধে জেনে গিয়েছিলাম (ওই যে বললাম, হোমওয়ার্ক)। যেহেতু এগমোরে দোকানটি অবস্থিত ছিল, আর আমরা ছিলাম আডিয়ারে, অনেকটাই দূর ছিল। গিয়ে খাবার পাবো কি পাবো না, জানার জন্য দুই তিনবার ফোন করে এমন ধ্যাতানি খেয়েছিলাম, বাপ রে। তবে দোকানে বসে ভাত ডাল তরকারি মাছ খেয়ে সেই বকাঝকা কখন বেমালুম ভুলে গিয়েছি, তার খেয়াল নেই।
এপ্রিল মাস আমার জন্মমাস। ২০১৪'র জন্মদিন ছিল প্রথমবার যেবার আমি বাড়ির বাইরে, কলকাতায় বসে বাবা মায়ের যেমন মন খারাপ, তেমনই মন খারাপ আমারও। কিন্তু ওই যে, আমার বন্ধুরা কিছুতেই জন্মদিনে আমার মন ভালো না করে থাকবেনা, সেইদিন আমরা কিছুজন মিলে গিয়েছিলাম সকালে সিনেমা দেখতে। যতদূর মনে পড়ছে, টু স্টেটস, মন্দ লাগেনি (আমার আবার রমকম বেশ উপভোগ্য লাগে)। আর বিকেলবেলা দিব্যেন্দু আর সুজাতাকে নিয়ে ঠিক করলাম একটি নতুন বাঙালি রেস্টুরেন্টে খেতে যাব। আগেরদিন থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম, পায়েস খাওয়াটা আমার খুব দরকার ছিল জন্মদিনে, ইতিমধ্যে অন্যান্য বাঙালি স্টুডেন্ট যারা ক্যাম্পাসে ছিল, তাদের থেকে হদিস পেয়েছিলাম পেটুকের। খানিক দূরে, জৈন কলেজের স্টপে এইট সিটার রেস্টুরেন্ট। এক বাঙালি দম্পতির যৌথ প্রয়াস, আমাদের মতো ঘরের থেকে এত দূরে পরে থাকা পাব্লিকদের জন্য। সেই সময়েই আলাপ অনির্বাণদা ও মৈত্রীদির সাথে। পরেরদিন যেন অবশ্য করে আমার জন্য পায়েস রাখা থাকে, দুই তিন রকমের মাছ, মাংস, বিরিয়ানি, সব যেন থাকে, জন্মদিন বলে কথা, এইভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে প্রায় খাবার রেডি রাখিয়েছিলাম। দে দম্পতির সাথে এখনো সাঙ্ঘাতিকভাবে যোগাযোগ আছে, ওনারা তো আবার আমার ভারচ্যুয়াল পালিত বাবা-মা। সেইবারে আমরা তিনজনের জন্য এত খাবার অর্ডার করেছিলাম, অনেকেই বোধহয় ওইদিনে আর পেটুকে খাবার পায়নি। ওই জন্যই আজও পেটুক গেলে আমি আগেভাগেই যাওয়ার চেষ্টা করি, যাতে খাবারের শর্টেজ না পড়ে! পেটুক এখন মস্ত বড় হয়েছে, দুটো ব্রাঞ্চ আর একটি স্ন্যাক্সের দোকান হয়েছে। চেন্নাইয়ের আইকনিক বাঙালি খাবারের জায়গা বলতে পেটুক অন্যতম। চেন্নাইতে বাঙালি বেড়াতে এলেও পেটুক খোঁজে। পেটুকের খাবার আমার খুব প্রিয়, পেটুক আছে বলেই আজও চেন্নাইতে দিব্যি হেসেখেলে, গায়েগতরে ভালোই পাইল আপ করে আছি।
দিন দিন চেন্নাইতে বাঙালি খাবারদাবারের দোকান অনেক নতুন নতুন হয়েছে, এপোলো হাসপাতালের ওইদিকে প্রচুর পাইস হোটেল। আসলে চেন্নাইতে বাঙালি জনসংখ্যা দিনদিন বাড়ছে বই কমছেনা।
বাঙালি ওড়িয়া বিহারি রাঁধুনের অভাব নেই, অবশ্যই খরচ বেশী অনেকটাই, তাও। পোস্তো থেকে শুরু করে ইলিশ মাছ, কচু শাক থেকে শুরু করে কাঁকরোল, এঁচোড় থেকে শুরু করে কই মাছ, সমস্ত কিছু পাওয়া যায় আজকাল এখানে। এমনকি গোবিন্দভোগ চাল যা কিছু বছর আগে অবধি তেমন চল ছিল, জিরাসাম্বা রাইস দিয়ে কাজ চালাতে হত, সেটাও এখন পাওয়া যায়। কুলের আচার থেকে শুরু করে শুক্তো মিক্স, খিচুরি মিক্সস সব। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ডালের বড়ি, মুড়ি, নতুন গুড়, নাহুমের কেক, গাঙ্গুরামের সন্দেশ সব হাতের মুঠোয়। ওহ ক্যালকাটা বা ভজহরি মান্না নেই বটে, কিন্তু এখানে আছে বে লিফ, যেখানে খেয়ে ও খাইয়ে আলাদা রকমের ভালোলাগা আসে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন ক্যুজিনের রেস্টুরেন্ট রয়েছে চেন্নাইতে। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, বিহার, গুজরাট, রাজস্থান, কর্ণাটক, অন্ধ্র যেমন আছে, তেমনই বিদেশির মধ্যে ইথিয়োপিয়ান, পার্সি, আরবি, চাইনিজ, নেপালি, থাই সব পাওয়া যায়। আর এইসব খাবার যে শুধুমাত্রই ভিন রাজ্যের মানুষগুলোই খায়, তা না। স্থানীয় লোকেদেরও আমি চেটেপুটে এইসব খেতে দেখেছি। কে এফ সি, পিতজা হাট, ডমিনোজ, ওয়াও মোমো চুটিয়ে ব্যবসা করছে এখানে। ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ দিল্লি বম্বের মতো এখনো না হলেও, দিনদিন চেন্নাইতে বাঙালির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এত কিছু বললাম, একটাই উদ্দেশ্য, গত চার বছরে শহরটার ভোল পালটাতে দেখলাম। সব ভালো, এমনকি খুঁজলে পরে বিকেলে তেলেভাজা মুড়ি আর চপ কাটলেট এগ রোলও যেমন পাওয়া যায়, তেমনই সকাল সকাল কচুরি জিলিপি দিয়েও ব্রেকফাস্ট সারা যায়। হে হে, এমনি এমনি কী আর শহরটার এত গুণগান গাই নাকি? সময় পেলেই, সপ্তাহের মাঝে, সপ্তাহান্তে আমার কিছু ভাই বোনদের সাথে বেরিয়ে পড়ি খেতে আর ঘুরতে। চেন্নাইতে এসে আমার ভাই বোন ভাগ্যটা বেশ খুলেছে ভালোই। আগামী পর্বে ওদের কথা বলব আপনাদের।
No comments:
Post a Comment