১৫ই মে ভোর চারটের আগেই মাদ্রাজ মেল পৌঁছল চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশন। প্রায় তিরিশ ঘন্টা সময় দেওয়া থাকে বলে ট্রেনটা সচরাচর লেট করেনা। ভোরের আলো ফুটলে পর স্টেশন থেকে একটা অটো নিয়ে রওনা দিলাম ভেলাচেরির দিকে, যেখানে আমার পিজিটি অবস্থিত। সেই প্রথম শুরু ভাষার সমস্যা (এই সমস্যা আজ চার বছরেও খুব বেশী কমেনি) । হিন্দি এখানের সাধারণ লোকে খুব বেশী বলেন না, ইংরেজিটাও অদ্ভুত। কারুর কারুর যাকে বলে "ইম্পেকেবেল" তো কারুর আবার সাঙ্ঘাতিক রকমের ভাঙ্গা ইংরেজি। যাই হোক, হাত পা নেড়ে একে তাকে বলে জিজ্ঞেস করে অবশেষে এলাম পিজিতে। যেই আন্টির সাথে মেইলে যোগাযোগ ছিল, ফোন করে দিতে উনি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। একটি একতলা বাড়ি, লাল রঙের। সামনে অনেকটা উঠোন। ওনার মা, মানে যার বাড়ি, তার সাথে আমার আর বাবার আলাপ করিয়ে দিলেন। ওই পাট্টি (তামিল ভাষায় ঠাকুমা নাকি দিদিমাকে পাট্টি বলে) এক বর্ণও ইংরেজি বা হিন্দি বলতে বা বুঝতে পারেননা। বাবার দিকে দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্ন করলেন, "তামিল তেরি মা?" আমি তো শুনেই থ। বলে কী?? এসেই এরকম মা বাপ তুলে গালি? বোধহয় আমার মুখটা খানিক হলেও ভেবলে গিয়েছিল, সেইটা দেখে আন্টি বললেন যে উনি জিজ্ঞেস করছেন আমরা তামিল বলতে/বুঝতে পারি কি না। মাথা নেড়ে আমাদের অপারগতার অবস্থা উল্লেখ করলাম। সেদিন থেকে শুরু হল আমাদের প্রথম তামিল শেখা। এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলতে হবে, সেটাও তখনই জানলাম। "তামিল তেরিয়াদা", অর্থাৎ, তামিল জানিনা। যাই হোক, যেই ঘরে আমায় থাকতে দেওয়া হল, সেটা দেখেই তো আমি প্রথম নাক সিটকে একাকার। কীরকম সিঁড়ির তলার ঘরের মত ছোট্ট একটা ঘর, অনেকটা পাট্টির ঘরের এন্টি-রুম গোছের (পরে বুঝেছিলাম কী এডভান্টেজ, রাত্রে গরমে হাঁসফাঁস করতে হতোনা অন্যদের মতো, পাট্টির ঘরের এসির ঠান্ডা বাতাস এসে যেতো আমাদের ঘরেও)। আমার রুম মেট ছিল স্মৃতি, ও ভুবনেশ্বরের মেয়ে, আই আই টি লাইব্রেরিতে ইন্টার্নশিপ করছিল তখন। ঘর ও থাকার ব্যবস্থা দেখেই আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে অন্য পিজিতে খোঁজ নিলাম। তবে কোথাও আর থাকার জায়গা না পাওয়ার জন্য এখানেই আগামী আড়াই মাস থাকার জন্য নিজের মনকে বোঝালাম।
বেলার দিকে তারপরে হেঁটে হেঁটে (মিনিট দশেক লাগত) গেলাম আই আই টি। ঢুকেই তো একটা অদ্ভুত রকমের মনের ভাব হল । এই তাহলে সেই বিখ্যাত জায়গা, যেখানে নাকি সব জ্ঞানের ভাণ্ডাররা থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি (এই একই অবস্থা হত যখন ক্যাম্পাস বাসে চেপে ডিপার্টমেন্ট যেতাম। সহযাত্রীদের দেখে ভাবতাম, এরাই তাহলে দেশের ব্রেনিয়েস্ট অফ দা ব্রেনি? সত্যি বলছি, খুব সৌভাগ্যবতী লাগত নিজেকে, এদের সাথে একসাথে কাজ করছি বলে। পরে অবশ্য বুঝলাম এসব কিছুই না।)। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে টরে তারপরে ক্যাম্পাস বাসে করে পৌঁছলাম আমার ডিপার্টমেন্টে। পরিচয় পর্ব করে স্যারের সাথে কথাবার্তা বলে কাজ কর্ম বুঝে নিলাম। বাবা চেন্নাইতে ছিল আমার পরীক্ষার দিন অবধি। তারপরে ফিরে গেল কলকাতা। আমি প্রথম, বাড়ি থেকে এত দূরে, সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় এক্কেবারে একা। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে পিজি থেকে ভাত সাম্বার আর সবজি, টক দই খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম। পিজিতে একটা রান্না করার আক্কা (দিদিকে তামিল ভাষায় আক্কা আর দাদাকে আন্না বলে। বোনাস তথ্য দিই, ভাইকে তাম্বি আর বোনকে তাঙ্গাচ্ছি ডাকে। তবে দুই ক্ষেত্রেই ত এর উচ্চারণটা ত আর থ এর মাঝে।) সকাল ছটায় এসে রেঁধে যেত সারাদিনের খাবার। ব্রেকফাস্টের জন্য বেশিরভাগ দিন থাকত ইডলি বা পোঙ্গাল আর চাটনি। আর দুপুরের খাবারের ভাত তরকারি সাম্বার রসম আর দই। পিজির অন্যান্য মেয়েরা টিফিন কেরিয়ারে গুছিয়ে ভাত ডাল নিয়ে গেলেও আমার কখনোই তা করা হয়ে ওঠেনি। গোটা স্কুল কলেজ লাইফ সকালে ভাত খেয়ে দুপুরে হাল্কা টিফিন নেওয়ার অভ্যেস এখানেও কায়েম রইল। চেন্নাইতে দেখেছি, সকলে দুপুরের খাবারটা খুব গুছিয়ে প্যাক করে আনে। তারপরে লাঞ্চ টাইমে সব নিজের নিজের ফ্রেন্ড সারকেলের সাথে বসে এরটা ওরটা শেয়ার করে খায়। অবশ্য সকলেরই লাঞ্চ বক্সে তো ওই এক সাম্বার রসম আর কুরমা। আমার এক সিনিয়র দিদি ডে স্কলার ছিল, ও ও বাড়ি থেকে খাবার আনত, ওর সাথে সাথে আমিও লাঞ্চ রুমে গিয়ে বসতাম প্রথম প্রথম। একসাথে মিলে মিশে খেতাম। আমি ইডলি খেতে খুব ভালোবাসি, কিন্তু সাথের নারকেল চাটনিটা অতক্ষণে নষ্ট হয়ে যেত বলে খেতে পারতাম না। সেই দিনগুলো অন্যদের থেকে সাম্বার নিয়ে খেতাম। এমনি একদিন একজন আক্কা নিয়ে এসছে চাউমিন। বেশ সুন্দর ব্রোকলি দিয়ে বানানো। সবাইকে দিয়ে খাচ্ছে। আমার পাশে বসা একটি মেয়েকে পরিষ্কার দেখলাম সাম্বার ঢেলে সেই চাউমিন খেলো। ব্যস, আর খুব একটা ওই গ্রুপে বসতাম না। নানান অছিলায় দেরীতে খেতে যেতাম। আমার মা তখনো অফিস যায়, ওই সময়টা তাই মা কে মিসড কল দিতাম। তারপরে মা ফোন করলে একসাথে দুজনে গল্প করতে করতে খেতাম। সারাদিনের যাবতীয় গল্প করার তখন সময়। কে কী বলল, কী খেলাম, কোথায় গেলাম সব আলোচনা তখন হত। তখন বিকেল হলে ক্যাম্পাসেই গুরুনাথ বলে একটি চত্ত্বর আছে, সেখানে নানান জ্যুস, চাট, ইত্যাদি পাওয়া যায়, ওখানে চলে যেতাম জ্যুস খেতে। ওইখানে প্রচুর হরিণের ঘোরাঘুরি তখন। আসলে আই আই টি মাদ্রাস ক্যাম্পাসটি গিন্ডি ন্যাশনাল পার্কের একটা অংশ কেটে বানানো। তাই প্রচুর হরিণ, বাঁদর, শিয়াল, নানান প্রজাতির পাখি, সাপ বেজি পোকামাকড়ের আড্ডা। আমার হাত থেকে নিয়ে ওই হরিণগুলো কেমন করে আমার হাত থেকে তরমুজ খেতো, সেইসব গল্প মা কে বলার জন্য মুখিয়ে থাকতাম!
যে আমি কোনদিনও বাবা মা কে ছেড়ে এক রাতও কাটাইনি, দিব্যি কিরকম চেন্নাইতে এডজাস্ট করে ফেলেছিলাম, আসলে তার পিছনে কিছু কারণ ছিল। প্রথমত, জানতাম যে মোটে দশ সপ্তাহের ব্যাপার, এরপরে তো ঠিক ফেরত আসব বাড়ি। দ্বিতীয়ত, শাসনের বাইরে। আনলিমিটেড ফ্রী হাই স্পীড ইন্টারনেট (তখনও মোবাইল ইন্টারনেটের এই এখনকার মতো রেভোলিউশন আসেনি, ডেটার অনেক খরচা), প্রচুর সিনেমা ডাউনলোড করে নিতাম। মনে আছে ওই আড়াই মাসে প্রায় একশো জিবি ব্লু রে কোয়ালিটির প্রিন্টের সিনেমা নামিয়েছিলাম। ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টরাই একটা রিপোসিটরি মতো মেইন্টেইন করে। যা চাই, তাই পাই আর কী। তাই মনের সুখে রাত জেগে সিনেমা দেখা, বই পড়া, ফেসবুকে গল্প করা, গেম খেলা, সব চলত চুটিয়ে। ল্যাবেও খুব উপভোগ করতাম সকলের সাথে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একসাথে হইহই করে মাঝে মাঝে বিকেলে মাঠে খেলাধুলো করা, চা খেতে যাওয়া, স্যারের বাড়ি গিয়ে ওনার স্ত্রী আর মেয়ের সাথে গল্প করা...দারুন অভিজ্ঞতা।
আমার ল্যাবে দুইজন বাঙালি ছিল, দেবস্তুতি দি আর দিব্যেন্দু। দিদি বেশিরভাগ সময়ে পড়াশোনা কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকত, তাই বেশিরভাগ গল্প আড্ডা যা হত, তা ওই ভাই মানে দিব্যেন্দুর সাথে। ক্যাম্পাসে কোথায় গেলে ভালো খাবার পাওয়া যায় যা খেলে ওই রোজের সাম্বার আর রসমের থেকে মুক্তি পাবো, তার হদিস পেতাম ভাইয়ের কাছেই। পি এইচ ডি এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বেরোল যেদিন, দেখলাম ওয়েট লিস্টে নাম। যদিও এসেছিলাম একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ে যে কিছুতেই রিসার্চে আসবনা, কেন জানিনা, ওই রেজাল্ট দেখে সাঙ্ঘাতিক মন খারাপ করেছিল। সেদিন মন ভালো করতে ভাই নিয়ে যায় সুপ্রিয়া বিরিয়ানি নামক একটি দোকানে। আমাদের ক্যাম্পাসের একটা গেট দিয়ে বেরোলেই উল্টোদিকেই। অন্ধ্র স্টাইলের বিরিয়ানি, বেশ ঝাল ঝাল, সাথে বালতি করে রায়তা আর বেগুন/টমেটোর কারি দেওয়া। সেইদিন থেকে আজ অবধি ওই রায়তা আমার খুবই পছন্দের, এখন তো এমনও হয় যে রায়তা খাব বলে বিরিয়ানি অর্ডার করি, অন্য কাউকে বিরিয়ানিটা খাইয়ে দিই।
যখন এসেছিলাম এখানে, তার মাসখানেক আগে রোহিতের সাথে দেখা করে কিছু বিগিনারস টিপ্স জেনে নিয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল যে যে কোন ইংরেজি শব্দের শেষে আ-কার যোগ করলেই নাকি তামিল ভাষীদের সাথে সহজেই কথা বলতে পারব। উদাহরণ দিই, জেরক্স করতে হবে, দোকানে গিয়ে জেরক্সা বললেই লোকে বুঝবে। আমার স্যার আমায় বলেছিলেন যে ভাঙ্গা ইংরেজি বললে মোটামুটি কাজ চালানো যাবে। আমিও এই দুই রকম পদ্ধতি দিয়ে আর সব জায়গায় কাজ চালাতে পারলেও আসল অসুবিধে হত পিজিতে ফিরে। পাট্টি তামিল ছাড়া বোঝেন না, আমি এক লাইনও তামিল বলতে পারিনা। রীতিমতো হাত নেড়ে নেড়ে আন্দাজে কথা চালাতাম। মূকাভিনয় করা যে কতটা কঠিন, সেটা আমি বুঝেছিলাম ওই দিনগুলিতে। হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না যখন, তখন দিব্যি বাংলায় কথা বলতাম। তাতে হত কি, অঙ্গভঙ্গীগুলো বেশ সহজেই হয়ে যেতো। পাট্টির কিচেনেই আমি নিজের ইচ্ছেমতো টুকটাক রান্নাবান্না করতাম। ওখানে কয়েকদিন মাছও খেয়েছি, কিন্তু রান্নার স্টাইল পছন্দ হতনা। তাই একদিন করলাম কী, স্পেন্সারস গিয়ে এক কেজির রুই মাছ কাটিয়ে কিনে আনলাম। এক কেজি ওজন ছিল পুরো মাছটার, আর ওখানে গোটা ছাড়া মাছ বিক্রি হত না, তাই পিজির বাকি মেয়েরা নিরামিষাশী হলেও আমায় গোটাটাই কিনতে হল। দোকানদার আবার আমায় জিজ্ঞেস করছেন, "এটা কে রুই মাছ বলে, জানেন তো?" আ মলো যা! বাঙ্গালিকে নাকি এসছেন উনি মাছ চেনাতে। যত্তসব। কোনদিনও বাড়িতে থাকাকালীন মাছ রান্না করিনি, কিন্তু মাকে দেখতাম তো রাঁধতে, আর টিভিতেও কুকারি শোগুলি আমার প্রিয়, তাই দিব্যি ম্যানেজ করে দেখলাম মাছের ঝোল রেঁধে ফেললাম। ফ্রিজে রেখে প্রায় দিন চারেক দুইবেলা মাছের ঝোল ভাত খেয়েছি। ল্যাবের দুই দিদির জন্য একদিন টিফিন বক্সে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, ওরাও খুব খুশি হয়েছিল। চেন্নাইতে বসে, দুপুরবেলা, তাও মেসে বসে ভাতের সাথে মাছের ঝোল, এ যেন কল্পনাতীত। অবশ্য আজকাল দিনকাল পালটেছে। বিভিন্ন অপশন এখন বাঙালি মাছভাত খাওয়ার আর নানান অ্যাপ আছে বলে ডেলিভারি সিস্টেমও দারুণ। সেইসব গল্প অন্য কোন পর্বে বলব।
রোহিতের থেকে শুনেছিলাম যে বেসন্ত নগর বিচটা আমাদের ক্যাম্পাস থেকে সবথেকে কাছে। যদিও তখন হাতে স্মারটফোন আছে, তাও কেন জানিনা সেইসবের তোয়াক্কা না করে একদিন নিজে নিজে বিকেলবেলা বেরোলাম হাঁটা লাগিয়ে। উদ্দেশ্য বিচে যাওয়া। সে তো আমি হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। রাস্তায় বড় করে এরো দিয়ে লেখা বেসন্ত নগর, কিন্তু তার আর দেখা পাইনা। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা বালির কণা দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, বালি দেখা গিয়েছে যখন, তখন জলও নিশ্চয়ই দেখতে পাবো এবারে! ভাগ্যিস সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, তাই সেই যাত্রায় ফেরত আসি পিজিতে। (পরে জেনেছিলাম যে আদৌ বিচ যাওয়ার রাস্তা মোটেই ওটা না।) আসলে আমার রাস্তাঘাটের ডিরেকশন সেন্সটা অত্যন্ত খারাপ, তাই দিকভ্রান্তের মতো হেঁটে বেরানো যে কী ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা নিশ্চয়ই বুঝছেন। আমার এই কান্ডকারখানার কথা শুনে আমার বান্ধবী পায়েল দায়িত্ব নেয় আমায় সমুদ্র দেখানোর। পায়েল আমার সাথে স্কুল লাইফে ট্যুশানে পড়ত, তখন চেন্নাইতে টি সি এসে চাকরি করছিল। খুব দূরে থাকত না আমার ক্যাম্পাস থেকে, একটা রবিবার দেখে ও এলো আর আমায় নিয়ে বিচে গেলো, তিরুভন্ম্যুর বিচ। কী ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার বালি, চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র দেখে আমি মুগ্ধ। সেদিন আকাশে ঘন মেঘ করে বৃষ্টিও হয়েছিল অল্প। পায়েলের ফোনে দারুণ দারুণ ছবি তোলা হয়েছিল। ওর সাথে তারপরে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরি। চেন্নাই যাওয়ার আগে দিদি বলে দিয়েছিল (আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি হোমওয়ার্ক করেই যাই সরবত্র, যথাসাধ্য) একটি রেস্টুরেন্টের নাম, সেখানেই আমরা খেলাম। কী অসাধারণ চাইনিজ ক্যুজিন। আহা!
সপ্তাহখানেক পরে আমার রুম মেট আমায় নিয়ে বেসন্ত নগর বিচ ঘুরিয়ে আনে। ওর সাথে তারপরে সেদিন একটি গয়নার দোকানেও গিয়েছিলাম, ওর আংটি কেনার ছিল। দোকানে ঢুকে আমি হতবাক। বলে কী? বিভিন্ন ক্যাটেগোরির কাউন্টার, কোথাও ৫গ্রামের হার তো কোথাও ১০০গ্রামের হার। সেইগুলি দেখে সত্যি বলছি, নারকেল দড়ির কথা মনে হয়েছিল! আমি আর মা এখনো একটু মোটা চেনের কথা উঠলেই নারকেল দড়ির উদাহরণ দিই। এখানে নাকি বিয়েতে মঙ্গলসূত্রের জায়গায় এরকম মোটা সোনার চেইন পরানো হয়, চোরের বাড়িতেও অঢেল সোনা। তাই চুরি ছিন্তাই অনেকটাই কম চেন্নাইতে। ইদানীং ভিন রাজ্য থেকে বেশ কিছু মানুষজনের আগমন ঘটায় অবশ্য ক্রাইম রেট একটু হলেও বেড়ে গিয়েছে।
এইসব করতে করতে কখন যে আড়াই মাস কেটে গেল, বুঝেই উঠিনি। শুধু শেষ দশদিন কাজ নিয়ে প্রচন্ড চাপে ছিলাম, প্রেজেন্টেশন ভালো করে দিয়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। বাবা চলে এলো চেন্নাই, আমাদের ফেরার দিন এসে গেল। তখনো ওয়েট লিস্টেই আছি, এদিকে স্যার পুরোপুরি মোটিভেট করে পি এইচ ডি জয়েন করার জন্য রাজী করিয়ে দিয়েছেন (এদিকে হাতে অফার নেই কিন্তু! আবার নেক্সট চান্স সেই ডিসেম্বরের সেমেস্টারের ইন্টার্ভিউ)। স্টেট ব্যাঙ্কের পি ও পরীক্ষার ইন্টারভ্যু স্কিপ করেছি, ইউ বি আইয়ে ক্লারকশিপের অফার লেটার রিজেক্ট করেছি। মন টানছে মাদ্রাসে। জানিনা ফিরব কবে, ফিরলেও কতদিনের জন্য। ফেরত গিয়েই রাজাবাজারে ফাইনাল পরীক্ষা। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। যেই পিজিতে প্রথম দিনই ভেবেছিলাম যে থাকব না, অন্যত্র জায়গা খুঁজব, যেই ল্যাব, যেই রিসার্চ জীবন নিয়ে প্রথম থেকে ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলাম, হঠাৎ করেই যেন সবাই ভীষণ বেশী করে টানতে লাগল। ফেরার দিন প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থায় ট্রেনে চাপলাম।
এইভাবেই মিটল আমার চেন্নাইতে হানিমুন পর্ব। আবার ফিরব অগস্টের মাঝামাঝি, প্রোজেক্টে। এই মর্মে ছাড়া পেলাম ল্যাব থেকে। তখন শুরু হবে আরেকপ্রস্থ লড়াই। একটা নতুন জীবন। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।
No comments:
Post a Comment