Friday, October 27, 2017

আজি দখিন দুয়ার খোলা: যেখান থেকে সব শুরু

সালটা ২০১৩, ওই জানুয়ারির মাঝামাঝি (নাকি শেষের দিকে) একদিন নেহাতই অনিচ্ছে সহ গেট পরীক্ষা দিতে গেলাম সোনারপুরে। সেই নিয়ে ছিল ওটা আমার তৃতীয় এটেম্পট এই জঘন্য পরীক্ষার। গত দুইবারে একটুর জন্য কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাই, তাই এইবারে একদমই মন ছিল না পরীক্ষাটা দেওয়ার। ইতিমধ্যে তখন ব্যাঙ্গালোরে একটি স্টার্ট আপ কোম্পানিতে চাকরির অফারও পেয়েছিলাম, আর MSc শেষ করার পরে দুই বছর ধরে চেষ্টা করে করেও যখন PhD করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না, তখন প্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়েই গিয়েছিলাম। তবুও, নেহাত ওই বছর মেয়েদের জন্য পরীক্ষার ফর্ম বিনামূল্যে দিয়েছিল এবং অন্যান্য বন্ধুদের পরীক্ষাকেন্দ্র প্রায় এক রাত্তির ট্রেনে করে গিয়ে পৌঁছনোর মত জায়গা আর আমারটা লোকাল ট্রেনে কয়েকটা স্টেশন গেলেই যাওয়া যাবে বলে, যাব না যাব না করেও অবশেষে গেলাম। পরীক্ষা সেই বছর প্রথম পুরোপুরি কম্পিউটারাইজড ছিল, প্রথম সব কিছু নিয়ে মানুষজন যতই ভালোলাগা ভালবাসাবাসি করুক না কেন, এই ক্ষেত্রে প্রায় কুরুক্ষেত্র লাগার জোগাড়। যে পরীক্ষা দুপুর দুটোয় শুরু হওয়ার কথা, তা শুরু হলে গিয়ে প্রায় সাড়ে তিনটেতে। বিঘ্ন দিয়ে শুরু হল, তাই এর থেকে তেমন প্রত্যাশা ছিল না। ভুলে মেরে দিলাম।
এই ফেব্রুয়ারি মার্চ মাস নাগাদ, রাজাবাজারের স্যারেরা বললেন মাদ্রাজ পাঠাবেন, প্রোজেক্টে। ওরে বাবা, শোনা ইস্তক সে যে আমার কী আনন্দ কী আনন্দ, বলে বোঝাতে পারব না। আই আই টি নামক প্রতিষ্ঠানের ও সেখানে পড়াশোনা করে যারা, তাদের ওপর সে কী অসীম শ্রদ্ধা তখন আমার। আমি তো প্রায় নাচতে নাচতে সব বন্ধুদের বলতে লাগলাম, এই জানিস আমি IIT Madras যাচ্ছি, আড়াই মাস থাকব। প্রচুর বাহবা টাহবা পেলামও (যদিও স্যারেরা পাঠাচ্ছেন, এতে যে আমার কি এলিজিবিলিটি প্রশংসা পাওয়ার, তা জানিনা! ) ওমা, আমার এমন সুন্দর স্বপ্নের দিনগুলিতে হঠাৎ পিন মেরে ফুস করে সব হাওয়া বের করে আমার স্যার বললেন, " শোনো, তোমায় অমুকের সাথে কথা বলতে হবে। আন্না ইউনিভার্সিটিতে, ও প্রজেক্ট করাবে। এই নাও ইমেল আই ডি। যোগাযোগ করে নিয়ো।" হায় আমার পোড়া কপাল রে, এবারেও বিড়ালের ভাগ্যে শিক ছিঁড়ল না!  এই প্রসঙ্গে বলি, আমি যখন কোনকিছু নিয়ে বেশ ভাবনা চিন্তা করে ফেলি, তখন কিন্তু জান প্রাণ লড়িয়ে দিতে পারি সেটা হাসিল করতে, অন্তত নিজের দিক সমস্ত চেষ্টা করি, ফলের আশা করেই। সেই শুরু হল আমার প্রজেক্ট আই আই টি। তড়িঘড়ি ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট খুলে দুমদাম গোটা দশ পনেরো জনকে মেল করে দিলাম। চার পাঁচজন উত্তর দিল না, কয়েকজন লিখে দিল, না, জায়গা নেই। কেবলমাত্র একজন বাঙালি ভদ্রলোক, অত্যন্ত সদয় হয়ে  বললেন, আরে এসো এসো। অবশ্যই এসো, সুস্বাগতম, ইত্যাদি ইত্যাদি। আহা সেদিন সে আমার প্রচণ্ড মন ভালো, বেশ একটা প্রজেক্ট/মিশন সফল হল বলে কথা। আহা, কি না কি বিশ্বজয় করে ফেলেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজাবাজারে গিয়ে স্যারদের বলে দিলাম, ওইসব আন্না বান্না ছাড়ুন, আমি যাব আই আই টি। ওনারাও দেখলাম হাসিমুখেই পারমিশন দিলেন। সেই শুরু হল আমার দিন গোনা।
তখন একেবারে ফেসবুক খুলে ফ্রেন্ডলিস্ট স্ক্যান করতে শুরু করলাম, কে কে আছে চেনা পরিচিতদের মধ্যে, যারা চেন্নাইতে থাকে বা থাকত। আমার এক বন্ধু, রোহিত, ও বেশ কিছু মাস (নাকি বছর?) চেন্নাইতে থেকেছে, চাকরিসূত্রে। সেই সময়ে ওই হয়ে দাঁড়ালো আমার মুশকিল আসান। ওর সূত্রেই আলাপ হল অর্কদীপ আর রিম্পার সাথে। ওরা দুজনেই তখন আই আই টিতেই MS পড়ছে। ব্যস, সেই থেকে যে ওদেরকে জ্বালাতন করা শুরু করলাম, এখনো ছাড়িনি (ওরা দুজনে আমার চেন্নাইয়ের লোকাল গার্জেন)। তখন প্রথম চিন্তা, কোথায় থাকব। ক্যাম্পাসে হোস্টেল পাবো কি না, পেলেও কিভাবে কোথায় কার কাছে এপ্লাই করব। কিছুদিন খোঁজাখুঁজির পরে জানা গেল যে ক্যাম্পাসে আপাতত হোস্টেলের আকাল চলছে, অগত্যা আমায় নিজের ব্যবস্থা অন্যত্রই করতে হবে। অন্তত শুরুতে বাইরেই থাকতে হবে, তারপরে না হয় ওখানে পৌঁছে কাকুতি মিনতি করে যদি কিছু ব্যবস্থা হয়। শুরু হল ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাসস্থান খোঁজার পর্ব। কিছু জায়গা সিলেক্ট করি তো খরচে পোষায় না, কিছু খরচে আসে তো দূরত্বে বাদ পড়ে যায়। অনেক অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তারপরে একদিন একটি অনলাইন বিজ্ঞাপনের সাইট থেকে খবর পেলাম একটি পিজির। প্রথমে মেল চালাচালি করলাম। জানলাম এক বয়স্কা ভদ্রমহিলার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা, পাশেই ওনার মেয়ে তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। মেয়েই মেলে যোগাযোগ করছিলেন।  কথাবার্তা বলে টলে প্রায় ফাইনাল করে রাখলাম।
এত কিছু হয়ে গেল, কিন্তু মাস তখনো মধ্য মার্চ। আমার আসলে সবেতেই একটু বেশী হুড়োহুড়ি তাড়াতাড়ি। একদিন (১৩ই মার্চ সম্ভবত) রাত্রে দিব্যি শুয়ে পড়েছি, এমন সময়ে ফোনে মেসেজ এলো বান্ধবীর, "গেটের রেজাল্ট লিক হয়েছে। খড়গপুরের পেজে দেখা যাচ্ছে, তোমার কত র‍্যাঙ্ক এলো, দেখো। আমার অমুক।" আগেই বলেছি, গেট পরীক্ষা নিয়ে আর উৎসাহ ছিল না। কিন্তু ওই যে,রেজাল্ট, কিরকম পেটের মধ্যে গুঁড়িগুঁড়ি শুরু হল। জানি যাই হোক না কেন, ওই রেজাল্টে কিচ্ছু যায় আসবে না আমার, তবুও, নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আধ ঘণ্টা ধরে কাল সকালে দেখবো, এখন দেখে কি করব ভেবে ভেবেও সেই উঠে ডেস্কটপটা অন করলাম। মেল থেকে আই ডি পাসওয়ার্ড বের করে লগ ইন করলাম সাইটে। ওই মিনিট খানেক যা সময় লাগল রেজাল্ট বেরোনোর, মনে হচ্ছিল যেন, এখনো সময় আছে, পালিয়ে যাই, দেখবো না। ডিসিশন নিতে আমি খুবই অপারগ, তাই যতক্ষণে ঠিক করলাম সিস্টেম ষাট ডাউন করব, ততক্ষণে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল আমার রোল নম্বর এবং একটি র‍্যাঙ্ক, এমন র‍্যাঙ্ক, যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি পেতে পারি। প্রথম রিএকশন কি ছিল জানেন? এক ছুট্টে এসে মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে সেটা জানানো, আর তারপরে যেই কথাটা বলেছিলাম আমি, আজও মনে পড়লে কেমন একটা মনে হয় যে Man proposes, God disposes বাগধারাটি সত্য! মা কে সেদিন বেলছিলাম, " মা শোনো, ভালো র‍্যাঙ্ক এসছে। কিন্তু প্লীজ, আমি PhD করব না। আমায় দয়া করে বলবে না কোথাও এপ্লাই করতে। " এই কথাকটি বলার পিছনে একটা বিরাট চিন্তাভাবনা ছিল। তখন ভাবতাম যে কলকাতায় থেকে PhD করতে গেলে বাবা মা আত্মীয় স্বজনরা ধরে বেঁধে কিছু বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেবে, বরং ব্যাঙ্গালোর গেলে তখন হাতের নাগালের মধ্যে থাকব না, আরামে থাকব। পরেরদিন সকালে রফা হল বাবা মায়ের সাথে। যেহেতু মাদ্রাজে যাচ্ছিই সামার প্রোজেক্টে, অন্তত IIT Madrasএ এপ্লাইটা করি। আমার তো নিজের ওপর ও নিজের কর্মক্ষমতার ওপর ফুলপ্রুফ ভরসা, জানি এপ্লাই করলেও চান্স পাবোই না। তাই কোন বাড়তি কথা খরচা না করে দিলাম এপ্লিকেশন ফর্ম ভরে। ২০শে মে পরীক্ষা (যেটা শিয়োর ছিলাম ক্লিয়ার করব না), আমার ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল ১৩ই মে, মাদ্রাজ মেলের। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে ভেবে মনে মনে নিশ্চিন্তও হলাম।
এরপর ব্যস্ত হয়ে গেলাম কোর্সের পরীক্ষা নিয়ে। কখন যে মে মাস এসে গেল, খেয়ালই করিনি প্রায়। আই আই টি আসব, তার তোড়জোড় শুরু হল জোর কদমে এপ্রিল শেষ হতেই। প্রথম কাজ যেটা করলাম, একটা ল্যাপটপ কিনলাম। তারপরে বন্ধুদের সাথে আত্মীয়স্বজনদের সাথে আহা, আগামী আড়াই মাস দেখা হবে না, ভালো থাকিস/থেকো এই করতে করতে অবশেষে ১৩ই মে রাত্রের ট্রেন ধরতে রওনা দিলাম বাবা আর আমি।

No comments:

Post a Comment