Monday, October 30, 2017

আজি দখিন দুয়ার খোলা ৪ঃ জীবন যেমন চলছে চলুক

আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, ছোট থেকেই বন্ধুবান্ধবদের মুখে তাদের ভাই বোন দাদা দিদিদের কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হত,আমার নিজের একখানা দাদা/দিদি/ভাই/বোন থাকলে তো বেশ হয়। তারপরে আই আই টিতে এসে যখন দেখলাম এই সিব্লিং পাতানোর স্যাম্পল সাইজটা বেশ বেশ ভালো এবং বড়, আমি আর বেশী দেরি করিনি। বোনের সংখ্যা একটু কম (সবচেয়ে বেশী যাদের নাম বলব, ভাস্বতী আর অনিন্দিতা। অমৃতার কথা আগের পর্বেই বলেছি।  এছাড়া সায়ন্তীর কথা না বললেই না। মেয়েটা আমায় এত ভালোবাসে, এত যত্ন করে আমার, খুব খেয়াল রাখে। গত শীতে আমি সাইকেল থেকে উল্টে চিতপটাং যখন, ও ছিল সাক্ষাৎ আমার সান্টা ক্লজ।), দাদা দিদি প্রায় নেইই বলা চলে (এর কারণ হল আমি নিজেই তো প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ, এখানে আমার চেয়ে বয়সে বড় খুব বেশী লোকজন নেই, থাকলেও চেনা না।) । তবে ভাইয়ের সংখ্যা এত বেশীমাত্রায় অধিক যে আমার চারপাশে মাঝেমধ্যেই "দিদি দিদি" বলে হাঁকপাঁক শোনা যায়। এবং সেই ডাক এতটাই জোরে হয় যে দুই হাজার কিমি দূরে বসেও মানুষ কাজ করতে করতে একবার ভেবে ফেলেন, নিশি ডাকল নাকি।
ক্যাম্পাসে আমাদের একটি বাঙালি এসোসিয়েশন আছে, নাম দিগন্ত। দিগন্ততে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়েই মূলত এদের সাথে আলাপ। অয়ন, চন্দন, ঋতেন্দু, শরণ্য এরা হচ্ছে যাকে বলে একদম প্রাণাধিক প্রিয়। এদের সাথে উঠতে বসতে যেমন ঝগড়া হয়, তেমনি এরা না থাকলে মনে হয় কিছু একটা মিসিং। আমার যত দাবী ওদেরই কাছে আর ওদেরও যত আবদার আমার কাছে। যেমন তেড়ে ঝগড়া করি, তেমনি আবার চোখ বন্ধ করে ভরসা করে মন খারাপ হলেই দুঃখর ঝাঁপি ওদের কাছেই পেশ করি। এছাড়া আরো আছে কয়েকজন, যেমন সৌরভ, নীলাঞ্জন, দেবজ্যোতি। একসাথে এদের অনেকের সাথেই  খুচখাচ বেড়াতে টেরাতে (ইয়েলাগিরি, কোল্লি হিলস, পন্ডিচেরি, মহাবলিপুরম) গিয়েওছি। ওদের সাথে এই হৃদ্যতা বাড়ে আরো বেশী করে বন্যার সময়ে।
২০১৫ সালে ডিসেম্বর মাস নাগাদ আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে  ভারী বৃষ্টি হয়ে রাস্তাঘাট জলমগ্ন, সাবস্টেশন জলে ডুবে বলে কম্পালসরি পাওয়ার কাট। বাহাত্তর ঘণ্টা আমরা বিনা বিদ্যুতে ছিলাম। আই আই টিতে হোস্টেলগুলির নাম সব নদীর নামে। যেমন কৃষ্ণা, কাবেরি, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, তুঙ্গ-ভদ্রা, সরযূ, সবরমতি, অলকানন্দা, যমুনা, গঙ্গা (কখনো কোন দরকারে গঙ্গা জল লাগবে শুনলে প্রথম যে পিজেটা মাথায় আসে, গঙ্গা হোস্টেলের কলের জল আনলেই হয়!!) ইত্যাদি।  আমার হোস্টেল সবরমতি। পরিচিতা থাকত অন্য হোস্টেলে, সরযূতে। যেহেতু আমরা বাকি মেয়েরা থাকতাম সবরমতিতে, ও তাই আমাদের এখানে চলে এসেছিল। বাইরে যখন হোস্টেলগুলি নিজেদের নামের মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যস্ত  (ভালোমতো স্রোতস্বিনী নদী বইত) , তখন আমরা হস্টেলের ভিতরে ব্যস্ত রাজ্যের গল্প নিয়ে। পি এন পি সি থেকে শুরু করে গভীর জীবনদর্শন কিচ্ছুটি বাদ যায়নি। কারেন্ট নেই, রাস্তাঘাটে জল থইথই, ওই অবস্থায় তো আর ল্যাবে যাওয়া যায়না। কাজেই হঠাৎ পাওয়া ছুটি। সকাল হতে হতেই আমরা কোনোমতে মেসে ব্রেকফাস্ট করে বেরোতাম এডমিন বিল্ডিং। সারা ক্যাম্পাসে তখন শুধুই ওখানে এমারজেন্সি পাওয়ার থাকত, উদ্দেশ্য ফোনটা একটু চার্জ দেওয়া। এবং কষ্টেসৃষ্টে যদি একটু ফোনের টাওয়ার পাওয়া যায়, তাহলে বাড়িতে কথা বলা। মোবাইলে সিগন্যাল পাওয়া ভারী দুষ্কর ছিল, ল্যান্ডফোন ওই কটাদিন দারুণ সার্ভিস দিয়েছিল। সারা বছর হোস্টেলের ল্যান্ডলাইনে কোন রিং শোনা যায়না, আর ওই কদিন একের পর এক শুধু ফোন এসে যাচ্ছে। কখনো ৪৩২, কখনো ৪৪০। যেই ধরছে, যার জন্য ফোন তাকে ডেকে দিচ্ছে। ভাগ্যক্রমে আমার বি এস এন এল কানেকশন থেকে এস এম এস যাচ্ছিল, বাড়িতে ওইভাবেই যোগাযোগ রেখেছিলাম। অন্যান্যদিনে মেসে যেই উপমা দেখলে নাক সিটকে চলে যাই, বন্যার সময় ওই কটাদিন সেই খাবারই সোনামুখ করে খেতাম। প্রতিটা মিল খেতে যাওয়ার সময় ভাবতাম, কে জানে এরপরেরটা পাবো কি না। একেই তো বৃষ্টি থামার কোন সিন নেই, তার উপর দোকান বাজার বন্ধ, মেসেই বা কোথা থেকে খাবার আসবে। ওই ডাল ভাত আর আঁচার পেলেই তখন কী খুশী। পাওয়ার নেই, পাম্পে জল উঠবে না, তাই স্নান করা নিয়েও প্রায় রেস্ট্রিকশন, এর মধ্যেও দেখতাম কিছু লোকজন কোমরছাপানো লম্বা চুল শ্যাম্পু করছে, বালতি বালতি জামাকাপড় কাচছে, সত্যি বাবা, কত বিভিন্ন ধরণের মানুষ যে হতে পারে, হোস্টেল লাইফ না হলে বোঝা যায় না।
তো যাই হোক, যা বলছিলাম, আমি এত এক কথা বলতে অন্য কথায় চলে যাই, কি বলি। ক্ষমা করে দেবেন মাঝে মাঝে। হ্যাঁ, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একদিন হয়েছে কি, আমার ভারী চিন্তা শুরু হয়েছে, আমার ভাইগুলো সব ঠিক আছে তো? কোন খবর পাচ্ছিনা, ফোনে কথা হচ্ছেনা, হোস্টেলের নাম জানি, কিন্তু রুম নম্বর জানিনা, অগত্যা ওই চত্বরে ঘুরে ফিরে এলাম, বাই চান্স যদি দেখা পাই আর খবর পাই। কপাল খারাপ, কারুর সাথেই দেখা হলো না। পরেরদিন কিভাবে, এখন আর মনে নেই, যোগাযোগ হল। তারপর ঠিক হল, অমুক জায়গায় অমুক সময়ে সকলের জমায়েত হবে। আর হলও তাই। তারপর গান গল্প এই করেই কাটত সন্ধ্যেগুলো। অন্ধকার হয়ে এলে টর্চ হাতে করে ওরা আমাদের হোস্টেল অবধি পৌঁছে যেত, আমার ভাইগুলো খুব শিভাল্রাস কিন্তু! ইতিমধ্যে একদিন খুব হিড়িক পড়ল লোকের, দল বেঁধে সব ভাইজাগ ব্যাঙ্গালোর চলে যাবে, বড় বড় বাসে ক্যাম্পাস ভরে গেল, নাকি দুদিনের ওপর কারেন্ট নেই, আর রিস্ক নেওয়া যায়না। বাইরে অবস্থা খুব খারাপ। সকলের বাড়ি থেকে খবর আসছে, টিভিতে ভয়াবহ সব চিত্র দেখাচ্ছে, আমরা তো ক্যাম্পাসে অনেকটাই নিরাপদে ছিলাম। ওই কারেন্ট ছিল না আর জল ভেঙ্গে এদিক ওদিক করছিলাম আর মেসের (অমৃত) খাবার খাচ্ছিলাম। আমরা তাই ঘটনার ভয়াবহতা অতটা আন্দাজ করতে পারিনি, কিন্তু যখন একটা মাস এক্সোডাস শুরু হল, আমরা তখন যেন একটু হলেও চিন্তা করতে শুরু করলাম, উৎকণ্ঠা হতে লাগল। যে যার বন্ধুবান্ধবরা আছে ব্যাঙ্গালরে, খবর নেওয়া শুরু করলাম, একটু আশ্রয় পাওয়া যাবে কি না গেলে। বাড়ির থেকে অবশ্যই বারবার বলছিল যে ক্যাম্পাসের মত সেফ আর কোত্থাও না, যেয়ো না হ্যানাত্যানা। এদিকে আমাদের তখন হঠাৎ করেই যেন ভয় বেড়ে গিয়েছে, ক্যাম্পাস খালি হয়ে যাচ্ছে, ঘুটঘুট্টি অন্ধকার, এক বন্ধুর তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, সব মিলিয়ে সকলেই টেন্সড। এমনিতেই আমাদের ক্যাম্পাস যেহেতু জঙ্গলের মধ্যে, হাজার একটা পোকামাকড় আছে, বৃষ্টির জমা জলে যে কত সাপখোপ, বিছে ইত্যাদি থাকছে, ভাবলেইগা শিরশির করে উঠছে। এমন অবস্থায় এমারজেন্সি পাওয়ার দিয়ে হঠাৎ পুরো "Let there be light" বলে যেন আলো এলো, সেই আলো দেখে প্রচণ্ড কলরব শুরু হল। যে যার নিজের নিজের ঘরে তখন ছোটো, ফোনে চার্জ দাও, অথচ চার্জ দিয়ে বা কি হবে, টাওয়ার বাবাজীর দেখা আসতে আরো দিন দুইএক লেগেছিল। ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল,তারপরে ইন্টারনেট আসতে খবরের মাধ্যমে দেখলাম, সত্যি, এমন সব ভিস্যুয়ালস, বাড়ির লোক ভয় পাবে না কেন!
এই বন্যার সময়েই চেন্নাই বেঙ্গলী ফেসবুক গ্রুপের অন্যতম মেম্বার, পুন্ডরিকদা একটা whatsapp গ্রুপ বানিয়েছিল, উদ্দেশ্য ছিল ম্যাক্সিমাম লোককে একসাথে রাখা, সকলের খবর যাতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকে তখন একে অপরকে যতটা পেরেছে সাহায্যও করেছে, কোথায় জল নেমেছে, কার বাড়িতে খুব জল, তাই অন্যের বাড়ি এসে থাকার আমন্ত্রণ, এটিএমে টাকা কোথায় আছে, আরও কত কিছু।
২০১৬ ডিসেম্বরে এলো সাইক্লোন Vardah, জনজীবনের সেইভাবে ক্ষতি করতে পারেনি খুব বেশী, আসলে বন্যার পর সকলেই মোটামুটি প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আমার সাধের ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। ঝড়ে এত গাছ পড়েছিল, জায়গায় জায়গায় ন্যাড়া দেখলে এখনো মন খারাপ হয়। নভেম্বর ডিসেম্বর আসলে North East Monsoon বা Retreating Monsoonএর সময়, তাই এই কটা মাস চেন্নাইবাসী বেশ তটস্থ থাকি আমরা। এই যেমন গত কয়েকদিন তুমুল বৃষ্টি হল, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেন্নাই বেঙ্গলী ফেসবুক পেজ সক্রিয় হয়ে গেল। যে যেখান থেকে পারছে (মোটামুটি) জেনুইন তথ্য সরবরাহ করতে থাকে, মুহূর্তে মুহূর্তে। আমরা আসলে ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই, আকাশ একটু কালো হতেই শুকনো খাবার স্টক করি, এখনো ফোন প্রায় সর্বক্ষণ চার্জে বসিয়ে রাখি।
এই চেন্নাই বেঙ্গলী (সিবি বলেই বেশী পরিচিত) গ্রুপ হল একটা অন্যতম ব্যাপার যার জন্য আমার চেন্নাইতে থাকাটা খুবই সুখকর হয়েছে এ যাবৎ। ২০১৩ সালে তেমনভাবে কাউকেই চিনতাম না, তাই আমি সেইবারে পুজোয় খুব মনমরা ছিলাম। রিম্পা অর্ক (ওদের কথা একেবারে শুরুতে বলেছিলাম, মনে আছে? বাবা রে, ওদের বিয়েটা হয়েছিল একদম বন্যার পরেপরে। ওরা কত এডভেঞ্চার করে চেন্নাই থেকে ব্যাঙ্গালোর হয়ে তারপরে হায়দ্রাবাদ থেকে ফ্লাইট পেয়ে কলকাতা গিয়েছিল বিয়ে করতে!!) সুজাতা অরিজিতা কস্তূরী এদের সাথে এঞ্জয় করলেও সেই কলকাতার ফিলটা আসেনি। তাই সেইবারে পণ করেছিলাম, দাঁতে দাঁত চিপে সারা বছর ছুটি না নিয়ে পুজোয় বাড়ি যাবো। তবে এবার ছুটি নিইনি পুজোয়, কিন্তু এই বছর এই চেন্নাই বেঙ্গলীর সূত্রে এত বন্ধু পেলাম, সকলে মিলে প্রচণ্ড আনন্দ করে পুজো কাটিয়েছি, মানে আমি নিজে ভাবতেই পারিনি যে পুজোটা চেন্নাইতে বসেও এত ভালো করে উপভোগ করা যায়। প্রায় ১৪-১৫টা পুজো হয়, অবশ্যই সব কটা বিশাল কিছু না। বড় বড়গুলোর মধ্যে ওই হাতে গোনা কয়েকটা, বেসন্ত নগরে একটা, টি নগর বেঙ্গল এসোসিয়েশনের একটা। এছাড়া নাভালুরেও হয়, তবে সেটা এত বেশী দূর বলে সুজয় দার (সুজয় দার সাথেও পরিচয় এই চেন্নাই বেঙ্গলী গ্রুপেরই সূত্রে, সজ্জন মানুষ, দাদাসুলভ ) বহু নিমন্ত্রণ সত্ত্বেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মনে আছে পুজোয় বাড়ি যাচ্ছিনা বলে যখন খুব মন খারাপ, তখন তৃণাদি আশ্বাস দিয়েছিল, সবাই মিলে দারুণ কাটবে,আর সত্যিই হলোও তাই! সুজয় দা, রূপম দা, তৃণা দি, বিভেন্দু দা, ধ্রুব দা, রজত, ঈপ্সিতা, কাকীমা (মানে তৃনাদির মা), প্রিয়াঙ্কা  সকলে মিলে খুব খুব আনন্দ করেছি। চারটে গাড়ি করে পুজো পরিক্রমা, প্যান্ডেলে আড্ডা, খাওয়া।
 পুজোর কিছুদিন আগে হয়েছিল সিবি গ্রুপের এন্যুয়াল ফাংশান, সাগরিকা। গত বছর দর্শক হলেও এবারে মূলত তৃণাদির উদ্যোগেই আমিও একটু আধটু অংশ নিলাম। রিহার্সালের দিনগুলো ভারী আনন্দে কাটত, সত্যি বলছি, সারাদিন সারা সপ্তাহ এই রিসার্চের চক্করে পড়ে এইসবই একটু নিঃশ্বাস ফেলার রসদ যোগায়। নতুন করে কত বন্ধু পেলাম, তৈরি হল স্মৃতি।
 এই তো, এই করেই চার চারটে বছর কাটিয়ে দিলাম এখানে। প্রথম এসেছিলাম যখন, শহরটা ছিল দুই চোখের বিষ। খালি কলকাতা ভালো, ব্যাঙ্গালোর ভালো এই করে যেতাম। এখন যেন মনে হয়, এ শহর আমার দ্বিতীয় বাড়ি, আমার ঠিকানা। বন্ধু বান্ধব হই হুল্লোড় ঘুরে বেড়ানো (প্রচুর জায়গা আছে এখান থেকে বেড়ানোর, অন্যতম হল শহরের মধ্যে কয়েকটা বিচ, যেমন বিশ্ববিখ্যাত মেরিনা বিচ; এছাড়া তো ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট মহাবলিপুরম, কাঞ্চীপুরম, পন্ডিচেরি,  টাডা ফলস, তিরুপতি, হরস্লে হিলস, ইয়ারকাড, ইয়েলাগিরি, কোল্লি হিলস; একটু দূরে গেলে ওইয়ানাড, মুন্নার, ব্যাঙ্গালোর, মাইসোর, উটি, কোদাইকানাল) সিনেমা দেখা (বাংলা সিনেমা পর্যন্ত চারটে এখানে স্ক্রিন হয়েছে, যার মধ্যে একটি, প্রাক্তন , আনানোর দলে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলাম এই আমি আর ইয়েতি অভিযান দেখেছিলাম গোটা হলে শুধুমাত্র দুইজন দর্শক আমরা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা বটে।), দুর্গা পুজো, ইলিশ (হ্যাঁ সিজনে সেটাও ভালো মতই পাওয়া যায়, দাম অবশ্যই বেশী, কিন্তু পাওয়া যায়) সব মিলিয়ে চেন্নাই সত্যি সত্যি হয়ে উঠেছে "নাম্মা চেন্নাই", অর্থাৎ, আমার চেন্নাই। এই শহরকে বন্যা সাইক্লোনের সময়ে দেখেছি কীভাবে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে বিপর্যয়ের মুখে, তেমনি প্রিয় আম্মার মৃত্যুতে কেঁদেও ভাসিয়েছে এই শহর, এই শহরের মধ্যে যেমন আছে বহু প্রাচীন মন্দিরের ঐতিহ্য, তেমনি রয়েছে ফিনিক্স মলের মতো আধুনিকতা, মার্সিডিজ বি এম ডাব্লিউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে ঠ্যালাগাড়ি নিয়ে "তাতা" (দাদু) ফুল বিক্রি করতে করতে, সন্ধ্যে হলে মন্দির থেকে ভেসে আসে পবিত্র ধূপের গন্ধ, আবার অন্যদিকে সমুদ্রের মিষ্টি হাওয়া জুড়িয়ে দেয় প্রাণকে।

এই শহর দিয়েছে অনেক কিছু, নিয়েছেও কিছু, তবে পাওয়ার ঝুলিটাই কানায় কানায় ভরে আছে। আর তাই, গর্ব করে বলতে পারি, আমি এই শহরে থেকেছি, আমি চেন্নাইবাসী।

আজি দখিন দুয়ার খোলাঃ গুটি গুটি পায়ে পথ চলা শুরু

১৫ই অগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছিল, আমি ওইদিনে বাড়ি থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দিলাম মাদ্রাসের উদ্দেশ্যে, শুরু করতে চেন্নাইতে আমার দ্বিতীয় ইনিংস। জানিনা সেটা আমারও স্বাধীনতা নাকি পরাধীনতার নতুন শৃঙ্খলাবদ্ধ হলাম। তখনো পি এইচ ডি এডমিশন হয়নি, তাই আবারও পাট্টির বাড়িতেই উঠলাম। মাস দেড়েক থাকলাম। ৩রা সেপ্টেম্বর, আমার মায়ের জন্মদিনের দিনে জয়েন করলাম বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট, জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে। দুই চোখে তখন অনেক স্বপ্ন, বিশাল কেউকেটা হব। হোস্টেল পেয়ে গেলেও কেন জানিনা ওই পিজি ছেড়ে আসতে একদম ইচ্ছে করছিল না। তার মূল কারণ বোধহয় খাবার। মেসে দুপুরবেলাগুলো খেতে যেতাম, ওরে বাবা রে, ওই কুমড়োর ঘ্যাঁট, বেগুনের কিছু একটা, মূলো দেওয়া সাম্বার। সেখানে পিজিতে বেশ ইচ্ছেমতো মাছ মাংস সবজি ডিম যা প্রাণ চায়, রাঁধো, খাও। কিন্তু দুই জায়গার খরচা চালানোটা খুব বোকামি হয়ে যাচ্ছিল, তাই ঠিক করলাম অক্টোবরের শুরুতেই হোস্টেলে শিফট করব। ঘর দেখতে এসে তখন প্রথম আলাপ হল পরিচিতার সাথে। ওর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট ওই একই সেমিস্টারে ভর্তি হয়েছে পি এইচ ডি তে। ইতিমধ্যে ল্যাবে সুজাতার সাথে গাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল (সে বন্ধুত্ত্ব এখনো বহাল আছে, ও সুদূর ইউ এস এতে পি এইচ ডি করছে। প্রতি রবিবার সকালে নিয়ম করে আমরা স্কাইপে কথা বলি, সারা সপ্তাহ মেসেজ। মানে সারাক্ষণ আপডেটেড থাকতেই হয় নিজেদের। সুজাতা আর আমি একবার তিরুপতি দর্শনে গিয়েছিলাম, সাত আট ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কী মারাত্মক অবস্থা। ওই ভিড়ের মধ্যেই কিছু মানুষজনের আজব ব্যবহার, প্রায় পারলে ওই লাইনে দাঁড়িয়েই যত পারে সোহাগ করে ফেলে। বাবা রে। গরমে ঘামতে ঘামতে ভিড়ে চিড়েচ্যাপটা হয়েও প্রেমের কমতি নেই। উফ!!! সেইবারে অবশেষে যখন দেবদর্শন হয়, ভগবানকে বলেছিলাম, ক্ষমা করবেন, খুব শিগগিরি আর আসছি না। এমনি মনে মনেই ভক্তি প্রার্থনা চলবে। তবে ওই যে মানুষ ভাবে এক, হয় এক। তারপরে আবারও একবার গিয়েছিলাম দর্শনে। আমার এক তামিল বান্ধবী, অমৃতা আর ওর মা বাবা বোনের সাথে। সেইবারে সুষ্ঠুভাবেই মিটেছিল। প্রসঙ্গত বলি, অমৃতা আমার খুব কাছের বান্ধবী। ও এখন হিউস্টনে পি এইচ ডি করছে। মেসের জঘন্য খাবার, ডিপারট্মেন্টের কিছু লোকজনের পি এন পি সি এই ছিল আমাদের হৃদ্যতার বেসিস, যা এখন বেশ বেশ পাকাপোক্ত। ও আমায় তামিল গান শেখায়, আমি ওকে বাংলা। আমরা একসাথে হোস্টেলের প্রোগ্রামে গেয়েওছিলাম। আমাদের ক্যাম্পাসের সরস্বতী পুজোতে ও একবার আমার সাথেই ভোরবেলা উঠে আমায় শাড়ি পড়িয়ে, নিজেও তৈরি হয়ে পুজোর যাবতীয় কাজকর্ম করেছিল। খুব লক্ষ্মী মেয়ে ও) , সুজাতা কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টারস করে আমাদের ল্যাবে প্রোজেক্টে ছিল, তাই ওর সুত্রে (আর কিছুটা নিজে গ্র্যাজুএশনে ওই একই সাব্জেক্ট পড়ার সুবাদে) পরিচিতার সাথে বেশ একটা একাত্মভাব অনুভব করেছিলাম। তবে আমার অত্যন্ত স্বভাববিরুদ্ধভাবে শুরুতে শিফটিঙ্গের আগেই পরিচিতার সাথে ছোট করে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস মায়ের কথামতো তারপরে ওর কাছে সরি টরি বলে সেসব মিটিয়ে নিয়েছিলাম। নইলে যে কী করে থাকতাম হোস্টেলে!
কেন, বলি। আমাদের তখন হোস্টেলের কমতি পড়েছিল ক্যাম্পাসে। বিভিন্ন আইনি প্যাঁচে পড়ে নতুন হোস্টেল আদ্ধেক তৈরি হয়ে ফেলে রেখেছিল, আমাদের মেয়েদের থাকতে দিচ্ছিল কোয়ার্টারে। 1BHK ফ্ল্যাটের মতো, হলে দুটো বেড আর বেড্রুমে দুখানা। আমার আর পরিচিতার ছিল হলে, বাকি যেই দুইজন ছিল ভিতরে, তারা অন্ধ্র প্রদেশের। তাদের মধ্যে একজন, সুস্মিতা তার নাম, সে যে কী প্রচন্ড জ্বালাতন করে মেরেছে আমাদের, কী বলব! মানে ওকে নিয়ে লিখতে গেলে একটা গোটা পর্ব হয়ে যাবে, আর ও মোটেই সেটা পাওয়ার যোগ্য না। তাই এক দুই শব্দেই বলি, ওর মতো অসহযোগী, নিয়মকানুনের ধার না ধরা, ইচ্ছে করে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা মেয়ে আর দুটো দেখিনি। পরিচিতা যতদিন ছিল আমার রুমমেট, কোন কারণে সুস্মিতা ওকে একটু সমঝে চলত। ও চলে যেতেই সুস্মিতার দৌরাত্ম্য শুরু হত। তখন একেই লেখাপড়ার সাঙ্ঘাতিক প্রেশার, অন্যদিকে প্রতিদিন হোস্টেলে ফিরে এই মানসিক অত্যাচার। সত্যি, কীসব দিনই না গিয়েছে।
যাই হোক, ২০১৩'র ডিসেম্বরে আমি বাড়ি ফিরি, ভাই (মানে দিব্যেন্দু) আর আমি, একসাথেই টিকিট কেটেছিলাম। গোটা জার্নি গল্প করে মজা করেই কাটিয়েছিলাম। সেইবারে তো বাড়ি ফিরে একেবারে প্রায় যাকে বলে গ্র্যান্ড ওয়েলকাম পাই আর কি! ইউনিভারসিটির বন্ধুরা, স্কুলের বন্ধুরা সকলের সাথে এতদিন বাদে দেখা করে কী আনন্দ আমার। মনে আছে, ওই প্রথমদিন মা আর বাবাকে খালি ডেকে ডেকে দেখিয়েছিলাম আই আই টির সবুজ রঙের আই ডি কার্ডটি, সেটি যে তখন আমার একটু "সেলিব্রিটি স্ট্যাটাসের" চাবিকাঠি!
যাই হোক, তা কাজে কর্মে, কোর্সের চাপে দিন কাটছিল বেশ। ইতিমধ্যে একবার ভাই আর সুজাতার সাথে তদানীন্তন চেন্নাইয়ের একমাত্র অথেন্টিক বাঙালি খাবারের ঠেক, শ্রী অন্নপূর্ণাতে গিয়ে খেয়ে এসেছিলাম। কলকাতা ছাড়ার আগেই জায়গাটির মাহাত্ম্য সম্বন্ধে জেনে গিয়েছিলাম (ওই যে বললাম, হোমওয়ার্ক)। যেহেতু এগমোরে দোকানটি অবস্থিত ছিল, আর আমরা ছিলাম আডিয়ারে, অনেকটাই দূর ছিল। গিয়ে খাবার পাবো কি পাবো না, জানার জন্য দুই তিনবার ফোন করে এমন ধ্যাতানি খেয়েছিলাম, বাপ রে। তবে দোকানে বসে ভাত ডাল তরকারি মাছ খেয়ে সেই বকাঝকা কখন বেমালুম ভুলে গিয়েছি, তার খেয়াল নেই।
এপ্রিল মাস আমার জন্মমাস। ২০১৪'র জন্মদিন ছিল প্রথমবার যেবার আমি বাড়ির বাইরে, কলকাতায় বসে বাবা মায়ের যেমন মন খারাপ, তেমনই মন খারাপ আমারও। কিন্তু ওই যে, আমার বন্ধুরা কিছুতেই জন্মদিনে আমার মন ভালো না করে থাকবেনা, সেইদিন আমরা কিছুজন মিলে গিয়েছিলাম সকালে সিনেমা দেখতে। যতদূর মনে পড়ছে, টু স্টেটস, মন্দ লাগেনি (আমার আবার রমকম বেশ উপভোগ্য লাগে)। আর বিকেলবেলা দিব্যেন্দু আর সুজাতাকে নিয়ে ঠিক করলাম একটি নতুন বাঙালি রেস্টুরেন্টে খেতে যাব। আগেরদিন থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম, পায়েস খাওয়াটা আমার খুব দরকার ছিল জন্মদিনে, ইতিমধ্যে অন্যান্য বাঙালি স্টুডেন্ট যারা ক্যাম্পাসে ছিল, তাদের থেকে হদিস পেয়েছিলাম পেটুকের। খানিক দূরে, জৈন কলেজের স্টপে এইট সিটার রেস্টুরেন্ট। এক বাঙালি দম্পতির যৌথ প্রয়াস, আমাদের মতো ঘরের থেকে এত দূরে পরে থাকা পাব্লিকদের জন্য। সেই সময়েই আলাপ অনির্বাণদা ও মৈত্রীদির সাথে। পরেরদিন যেন অবশ্য করে আমার জন্য পায়েস রাখা থাকে, দুই তিন রকমের মাছ, মাংস, বিরিয়ানি, সব যেন থাকে, জন্মদিন বলে কথা, এইভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে প্রায় খাবার রেডি রাখিয়েছিলাম।  দে দম্পতির সাথে এখনো সাঙ্ঘাতিকভাবে যোগাযোগ আছে, ওনারা তো আবার আমার ভারচ্যুয়াল পালিত বাবা-মা। সেইবারে আমরা তিনজনের জন্য এত খাবার অর্ডার করেছিলাম, অনেকেই বোধহয় ওইদিনে আর পেটুকে খাবার পায়নি। ওই জন্যই আজও পেটুক গেলে আমি আগেভাগেই যাওয়ার চেষ্টা করি, যাতে খাবারের শর্টেজ না পড়ে! পেটুক এখন মস্ত বড় হয়েছে, দুটো ব্রাঞ্চ আর একটি স্ন্যাক্সের দোকান হয়েছে। চেন্নাইয়ের আইকনিক বাঙালি খাবারের জায়গা বলতে পেটুক অন্যতম। চেন্নাইতে বাঙালি বেড়াতে এলেও পেটুক খোঁজে।  পেটুকের খাবার আমার খুব প্রিয়, পেটুক আছে বলেই আজও চেন্নাইতে দিব্যি হেসেখেলে, গায়েগতরে ভালোই পাইল আপ করে আছি।
দিন দিন চেন্নাইতে বাঙালি খাবারদাবারের দোকান অনেক নতুন নতুন হয়েছে, এপোলো হাসপাতালের ওইদিকে প্রচুর পাইস হোটেল। আসলে চেন্নাইতে বাঙালি জনসংখ্যা দিনদিন বাড়ছে বই কমছেনা।
বাঙালি ওড়িয়া বিহারি রাঁধুনের অভাব নেই, অবশ্যই খরচ বেশী অনেকটাই, তাও। পোস্তো থেকে শুরু করে ইলিশ মাছ, কচু শাক থেকে শুরু করে কাঁকরোল, এঁচোড় থেকে শুরু করে কই মাছ, সমস্ত কিছু পাওয়া যায় আজকাল এখানে। এমনকি গোবিন্দভোগ চাল যা কিছু বছর আগে অবধি তেমন চল ছিল, জিরাসাম্বা রাইস দিয়ে কাজ চালাতে হত, সেটাও এখন পাওয়া যায়। কুলের আচার থেকে শুরু করে শুক্তো মিক্স, খিচুরি মিক্সস সব। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে ডালের বড়ি, মুড়ি, নতুন গুড়, নাহুমের কেক, গাঙ্গুরামের সন্দেশ সব হাতের মুঠোয়।  ওহ ক্যালকাটা বা ভজহরি মান্না নেই বটে, কিন্তু এখানে আছে বে লিফ, যেখানে খেয়ে ও খাইয়ে আলাদা রকমের ভালোলাগা আসে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন ক্যুজিনের রেস্টুরেন্ট রয়েছে চেন্নাইতে। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, বিহার, গুজরাট, রাজস্থান, কর্ণাটক, অন্ধ্র যেমন আছে, তেমনই বিদেশির মধ্যে ইথিয়োপিয়ান, পার্সি, আরবি, চাইনিজ, নেপালি, থাই সব পাওয়া যায়। আর এইসব খাবার যে শুধুমাত্রই ভিন রাজ্যের মানুষগুলোই খায়, তা না। স্থানীয় লোকেদেরও আমি চেটেপুটে এইসব খেতে দেখেছি। কে এফ সি, পিতজা হাট, ডমিনোজ, ওয়াও মোমো চুটিয়ে ব্যবসা করছে এখানে। ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ দিল্লি বম্বের মতো এখনো না হলেও, দিনদিন চেন্নাইতে বাঙালির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এত কিছু বললাম, একটাই উদ্দেশ্য, গত চার বছরে শহরটার ভোল পালটাতে দেখলাম। সব ভালো, এমনকি খুঁজলে পরে বিকেলে তেলেভাজা মুড়ি আর চপ কাটলেট এগ রোলও যেমন পাওয়া যায়, তেমনই সকাল সকাল কচুরি জিলিপি দিয়েও ব্রেকফাস্ট সারা যায়। হে হে, এমনি এমনি কী আর শহরটার এত গুণগান গাই নাকি? সময় পেলেই, সপ্তাহের মাঝে, সপ্তাহান্তে আমার কিছু ভাই বোনদের সাথে বেরিয়ে পড়ি খেতে আর ঘুরতে। চেন্নাইতে এসে আমার ভাই বোন ভাগ্যটা বেশ খুলেছে ভালোই। আগামী পর্বে ওদের কথা বলব আপনাদের।

Sunday, October 29, 2017

আজি দখিন দুয়ার খোলাঃ হানিমুন পিরিয়ড

১৫ই মে ভোর চারটের আগেই মাদ্রাজ মেল পৌঁছল চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশন। প্রায় তিরিশ ঘন্টা সময় দেওয়া থাকে বলে ট্রেনটা সচরাচর লেট করেনা। ভোরের আলো ফুটলে পর স্টেশন থেকে একটা অটো নিয়ে রওনা দিলাম ভেলাচেরির দিকে, যেখানে আমার পিজিটি অবস্থিত। সেই প্রথম শুরু ভাষার সমস্যা (এই সমস্যা আজ চার বছরেও খুব বেশী কমেনি) । হিন্দি এখানের সাধারণ লোকে খুব বেশী বলেন না, ইংরেজিটাও অদ্ভুত। কারুর কারুর যাকে বলে "ইম্পেকেবেল" তো কারুর আবার সাঙ্ঘাতিক রকমের ভাঙ্গা ইংরেজি। যাই হোক, হাত পা নেড়ে একে তাকে বলে জিজ্ঞেস করে অবশেষে এলাম পিজিতে। যেই আন্টির সাথে মেইলে যোগাযোগ ছিল, ফোন করে দিতে উনি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। একটি একতলা বাড়ি, লাল রঙের। সামনে অনেকটা উঠোন। ওনার মা, মানে যার বাড়ি, তার সাথে আমার আর বাবার আলাপ করিয়ে দিলেন। ওই পাট্টি (তামিল ভাষায় ঠাকুমা নাকি দিদিমাকে পাট্টি বলে) এক বর্ণও ইংরেজি বা হিন্দি বলতে বা বুঝতে পারেননা। বাবার দিকে দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্ন করলেন, "তামিল তেরি মা?" আমি তো শুনেই থ। বলে কী?? এসেই এরকম মা বাপ তুলে গালি? বোধহয় আমার মুখটা খানিক হলেও ভেবলে গিয়েছিল, সেইটা দেখে আন্টি বললেন যে উনি জিজ্ঞেস করছেন আমরা তামিল বলতে/বুঝতে পারি কি না। মাথা নেড়ে আমাদের অপারগতার অবস্থা উল্লেখ করলাম। সেদিন থেকে শুরু হল আমাদের প্রথম তামিল শেখা। এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলতে হবে, সেটাও তখনই জানলাম। "তামিল তেরিয়াদা", অর্থাৎ, তামিল জানিনা। যাই হোক, যেই ঘরে আমায় থাকতে দেওয়া হল, সেটা দেখেই তো আমি প্রথম নাক সিটকে একাকার। কীরকম সিঁড়ির তলার ঘরের মত ছোট্ট একটা ঘর, অনেকটা পাট্টির ঘরের এন্টি-রুম গোছের (পরে বুঝেছিলাম কী এডভান্টেজ, রাত্রে গরমে হাঁসফাঁস করতে হতোনা অন্যদের মতো, পাট্টির ঘরের এসির ঠান্ডা বাতাস এসে যেতো আমাদের ঘরেও)। আমার রুম মেট  ছিল স্মৃতি, ও ভুবনেশ্বরের মেয়ে, আই আই টি লাইব্রেরিতে ইন্টার্নশিপ করছিল তখন। ঘর ও থাকার ব্যবস্থা দেখেই আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে অন্য পিজিতে খোঁজ নিলাম। তবে কোথাও আর থাকার জায়গা না পাওয়ার জন্য এখানেই আগামী আড়াই মাস থাকার জন্য নিজের মনকে বোঝালাম।
বেলার দিকে তারপরে হেঁটে হেঁটে (মিনিট দশেক লাগত) গেলাম আই আই টি। ঢুকেই তো একটা অদ্ভুত রকমের মনের ভাব হল । এই তাহলে সেই বিখ্যাত জায়গা, যেখানে নাকি সব জ্ঞানের ভাণ্ডাররা থাকে, ইত্যাদি ইত্যাদি (এই একই অবস্থা হত যখন ক্যাম্পাস বাসে চেপে ডিপার্টমেন্ট যেতাম। সহযাত্রীদের দেখে ভাবতাম, এরাই তাহলে দেশের ব্রেনিয়েস্ট অফ দা ব্রেনি? সত্যি বলছি, খুব সৌভাগ্যবতী লাগত নিজেকে, এদের সাথে একসাথে কাজ করছি বলে। পরে অবশ্য বুঝলাম এসব কিছুই না।)। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে টরে তারপরে ক্যাম্পাস বাসে করে পৌঁছলাম আমার ডিপার্টমেন্টে।  পরিচয় পর্ব করে স্যারের সাথে কথাবার্তা বলে কাজ কর্ম বুঝে নিলাম। বাবা চেন্নাইতে ছিল আমার পরীক্ষার দিন অবধি। তারপরে ফিরে গেল কলকাতা। আমি প্রথম, বাড়ি থেকে এত দূরে, সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় এক্কেবারে একা। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে পিজি থেকে ভাত সাম্বার আর সবজি, টক দই খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম। পিজিতে একটা রান্না করার আক্কা (দিদিকে তামিল ভাষায় আক্কা আর দাদাকে আন্না বলে। বোনাস তথ্য দিই, ভাইকে তাম্বি আর বোনকে তাঙ্গাচ্ছি ডাকে। তবে দুই ক্ষেত্রেই ত এর উচ্চারণটা ত আর থ এর মাঝে।) সকাল ছটায় এসে রেঁধে যেত সারাদিনের খাবার। ব্রেকফাস্টের জন্য বেশিরভাগ দিন থাকত ইডলি বা পোঙ্গাল আর চাটনি। আর দুপুরের খাবারের ভাত তরকারি সাম্বার রসম আর দই। পিজির অন্যান্য মেয়েরা টিফিন কেরিয়ারে গুছিয়ে ভাত ডাল নিয়ে গেলেও আমার কখনোই তা করা হয়ে ওঠেনি। গোটা স্কুল কলেজ লাইফ সকালে ভাত খেয়ে দুপুরে হাল্কা টিফিন নেওয়ার অভ্যেস এখানেও কায়েম রইল। চেন্নাইতে দেখেছি, সকলে দুপুরের খাবারটা খুব গুছিয়ে প্যাক করে আনে। তারপরে লাঞ্চ টাইমে সব নিজের নিজের ফ্রেন্ড সারকেলের সাথে বসে এরটা ওরটা শেয়ার করে খায়। অবশ্য সকলেরই লাঞ্চ বক্সে তো ওই এক সাম্বার রসম আর কুরমা। আমার এক সিনিয়র দিদি ডে স্কলার ছিল, ও ও বাড়ি থেকে খাবার আনত, ওর সাথে সাথে আমিও লাঞ্চ রুমে গিয়ে বসতাম প্রথম প্রথম। একসাথে মিলে মিশে খেতাম। আমি ইডলি খেতে খুব ভালোবাসি, কিন্তু সাথের নারকেল চাটনিটা অতক্ষণে নষ্ট হয়ে যেত বলে খেতে পারতাম না। সেই দিনগুলো অন্যদের থেকে সাম্বার নিয়ে খেতাম। এমনি একদিন একজন আক্কা নিয়ে এসছে চাউমিন। বেশ সুন্দর ব্রোকলি দিয়ে বানানো। সবাইকে দিয়ে খাচ্ছে। আমার পাশে বসা একটি মেয়েকে পরিষ্কার দেখলাম সাম্বার ঢেলে সেই চাউমিন খেলো। ব্যস, আর খুব একটা ওই গ্রুপে বসতাম না।   নানান অছিলায় দেরীতে খেতে যেতাম। আমার মা তখনো অফিস যায়, ওই সময়টা তাই মা কে মিসড কল দিতাম। তারপরে মা ফোন করলে একসাথে দুজনে গল্প করতে করতে খেতাম। সারাদিনের যাবতীয় গল্প করার তখন সময়। কে কী বলল, কী খেলাম, কোথায় গেলাম সব আলোচনা তখন হত। তখন বিকেল হলে ক্যাম্পাসেই গুরুনাথ বলে একটি চত্ত্বর আছে, সেখানে নানান জ্যুস, চাট, ইত্যাদি পাওয়া যায়, ওখানে চলে যেতাম জ্যুস খেতে। ওইখানে প্রচুর হরিণের ঘোরাঘুরি তখন। আসলে আই আই টি মাদ্রাস ক্যাম্পাসটি গিন্ডি ন্যাশনাল পার্কের একটা অংশ কেটে বানানো। তাই প্রচুর হরিণ, বাঁদর, শিয়াল, নানান প্রজাতির পাখি, সাপ বেজি পোকামাকড়ের আড্ডা। আমার হাত থেকে নিয়ে ওই হরিণগুলো কেমন করে আমার হাত থেকে তরমুজ খেতো, সেইসব গল্প মা কে বলার জন্য মুখিয়ে থাকতাম!
যে আমি কোনদিনও বাবা মা কে ছেড়ে এক রাতও কাটাইনি, দিব্যি কিরকম চেন্নাইতে এডজাস্ট করে ফেলেছিলাম, আসলে তার পিছনে কিছু কারণ ছিল। প্রথমত, জানতাম যে মোটে দশ সপ্তাহের ব্যাপার, এরপরে তো ঠিক ফেরত আসব বাড়ি। দ্বিতীয়ত, শাসনের বাইরে। আনলিমিটেড ফ্রী হাই স্পীড ইন্টারনেট (তখনও মোবাইল ইন্টারনেটের এই এখনকার মতো রেভোলিউশন আসেনি, ডেটার অনেক খরচা), প্রচুর সিনেমা ডাউনলোড করে নিতাম। মনে আছে ওই আড়াই মাসে প্রায় একশো জিবি ব্লু রে কোয়ালিটির প্রিন্টের সিনেমা নামিয়েছিলাম। ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টরাই একটা রিপোসিটরি মতো মেইন্টেইন করে। যা চাই, তাই পাই আর কী। তাই মনের সুখে রাত জেগে সিনেমা দেখা, বই পড়া, ফেসবুকে গল্প করা, গেম খেলা, সব চলত চুটিয়ে। ল্যাবেও খুব উপভোগ করতাম সকলের সাথে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একসাথে হইহই করে মাঝে মাঝে বিকেলে মাঠে খেলাধুলো করা, চা খেতে যাওয়া, স্যারের বাড়ি গিয়ে ওনার স্ত্রী আর মেয়ের সাথে গল্প করা...দারুন অভিজ্ঞতা।
আমার ল্যাবে দুইজন বাঙালি ছিল, দেবস্তুতি দি আর দিব্যেন্দু। দিদি বেশিরভাগ সময়ে পড়াশোনা কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকত, তাই বেশিরভাগ গল্প আড্ডা যা হত, তা ওই ভাই মানে দিব্যেন্দুর সাথে। ক্যাম্পাসে কোথায় গেলে ভালো খাবার পাওয়া যায় যা খেলে ওই রোজের সাম্বার আর রসমের থেকে মুক্তি পাবো, তার হদিস পেতাম ভাইয়ের কাছেই। পি এইচ ডি এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বেরোল যেদিন, দেখলাম ওয়েট লিস্টে নাম। যদিও এসেছিলাম একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ে যে কিছুতেই রিসার্চে আসবনা, কেন জানিনা, ওই রেজাল্ট দেখে সাঙ্ঘাতিক মন খারাপ করেছিল। সেদিন মন ভালো করতে ভাই নিয়ে যায় সুপ্রিয়া বিরিয়ানি নামক একটি দোকানে। আমাদের ক্যাম্পাসের একটা গেট দিয়ে বেরোলেই উল্টোদিকেই। অন্ধ্র স্টাইলের বিরিয়ানি, বেশ ঝাল ঝাল, সাথে বালতি করে রায়তা আর বেগুন/টমেটোর কারি দেওয়া। সেইদিন থেকে আজ অবধি ওই রায়তা আমার খুবই পছন্দের, এখন তো এমনও হয় যে রায়তা খাব বলে বিরিয়ানি অর্ডার করি, অন্য কাউকে বিরিয়ানিটা খাইয়ে দিই।
যখন এসেছিলাম এখানে, তার মাসখানেক আগে রোহিতের সাথে দেখা করে কিছু বিগিনারস টিপ্স জেনে নিয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল যে যে কোন ইংরেজি শব্দের শেষে আ-কার যোগ করলেই নাকি তামিল ভাষীদের সাথে সহজেই কথা বলতে পারব। উদাহরণ দিই, জেরক্স করতে হবে, দোকানে গিয়ে জেরক্সা বললেই লোকে বুঝবে। আমার স্যার আমায় বলেছিলেন যে ভাঙ্গা ইংরেজি বললে মোটামুটি কাজ চালানো যাবে। আমিও এই দুই রকম পদ্ধতি দিয়ে আর সব জায়গায় কাজ চালাতে পারলেও আসল অসুবিধে হত পিজিতে ফিরে। পাট্টি তামিল ছাড়া বোঝেন না, আমি এক লাইনও তামিল বলতে পারিনা। রীতিমতো হাত নেড়ে নেড়ে আন্দাজে কথা চালাতাম। মূকাভিনয় করা যে কতটা কঠিন, সেটা আমি বুঝেছিলাম ওই দিনগুলিতে। হাজার চেষ্টা করেও পারতাম না যখন, তখন দিব্যি বাংলায় কথা বলতাম। তাতে হত কি, অঙ্গভঙ্গীগুলো বেশ সহজেই হয়ে যেতো। পাট্টির কিচেনেই আমি নিজের ইচ্ছেমতো টুকটাক রান্নাবান্না করতাম। ওখানে কয়েকদিন মাছও খেয়েছি, কিন্তু রান্নার স্টাইল পছন্দ হতনা। তাই একদিন করলাম কী, স্পেন্সারস গিয়ে এক কেজির রুই মাছ কাটিয়ে কিনে আনলাম। এক কেজি ওজন ছিল পুরো মাছটার, আর ওখানে গোটা ছাড়া মাছ বিক্রি হত না, তাই পিজির বাকি মেয়েরা নিরামিষাশী হলেও আমায় গোটাটাই কিনতে হল। দোকানদার আবার আমায় জিজ্ঞেস করছেন, "এটা কে রুই মাছ বলে, জানেন তো?"  আ মলো যা! বাঙ্গালিকে নাকি এসছেন উনি মাছ চেনাতে। যত্তসব। কোনদিনও বাড়িতে থাকাকালীন মাছ রান্না করিনি, কিন্তু মাকে দেখতাম তো রাঁধতে, আর টিভিতেও কুকারি শোগুলি আমার প্রিয়, তাই দিব্যি ম্যানেজ করে দেখলাম মাছের ঝোল রেঁধে ফেললাম। ফ্রিজে রেখে প্রায় দিন চারেক দুইবেলা মাছের ঝোল ভাত খেয়েছি।  ল্যাবের দুই দিদির জন্য একদিন টিফিন বক্সে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, ওরাও খুব খুশি হয়েছিল। চেন্নাইতে বসে, দুপুরবেলা, তাও মেসে বসে ভাতের সাথে মাছের ঝোল, এ যেন কল্পনাতীত। অবশ্য আজকাল দিনকাল পালটেছে। বিভিন্ন অপশন এখন বাঙালি মাছভাত খাওয়ার আর নানান অ্যাপ আছে বলে ডেলিভারি সিস্টেমও দারুণ।  সেইসব গল্প অন্য কোন পর্বে বলব।
রোহিতের থেকে শুনেছিলাম যে বেসন্ত নগর বিচটা আমাদের ক্যাম্পাস থেকে সবথেকে কাছে। যদিও তখন হাতে স্মারটফোন আছে, তাও কেন জানিনা সেইসবের তোয়াক্কা না করে একদিন নিজে নিজে বিকেলবেলা বেরোলাম হাঁটা লাগিয়ে। উদ্দেশ্য বিচে যাওয়া। সে তো আমি হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। রাস্তায় বড় করে এরো দিয়ে লেখা বেসন্ত নগর, কিন্তু তার আর দেখা পাইনা। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা বালির কণা দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, বালি দেখা গিয়েছে যখন, তখন জলও নিশ্চয়ই দেখতে পাবো এবারে! ভাগ্যিস সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, তাই সেই যাত্রায় ফেরত আসি পিজিতে। (পরে জেনেছিলাম যে আদৌ বিচ যাওয়ার রাস্তা মোটেই ওটা না।) আসলে আমার রাস্তাঘাটের ডিরেকশন সেন্সটা অত্যন্ত খারাপ, তাই দিকভ্রান্তের মতো হেঁটে বেরানো যে কী ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা নিশ্চয়ই বুঝছেন। আমার এই কান্ডকারখানার কথা শুনে আমার বান্ধবী পায়েল দায়িত্ব নেয় আমায় সমুদ্র দেখানোর। পায়েল আমার সাথে স্কুল লাইফে ট্যুশানে পড়ত, তখন চেন্নাইতে টি সি এসে চাকরি করছিল। খুব দূরে থাকত না আমার ক্যাম্পাস থেকে, একটা রবিবার দেখে ও এলো আর আমায় নিয়ে বিচে গেলো, তিরুভন্ম্যুর বিচ। কী ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার বালি, চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র দেখে আমি মুগ্ধ। সেদিন আকাশে ঘন মেঘ করে বৃষ্টিও হয়েছিল অল্প। পায়েলের ফোনে দারুণ দারুণ ছবি তোলা হয়েছিল। ওর সাথে তারপরে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরি। চেন্নাই যাওয়ার আগে দিদি বলে দিয়েছিল (আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি হোমওয়ার্ক করেই যাই সরবত্র, যথাসাধ্য) একটি রেস্টুরেন্টের নাম, সেখানেই আমরা খেলাম। কী অসাধারণ চাইনিজ ক্যুজিন। আহা!
সপ্তাহখানেক পরে আমার রুম মেট আমায় নিয়ে বেসন্ত নগর বিচ ঘুরিয়ে আনে। ওর সাথে তারপরে সেদিন একটি গয়নার দোকানেও গিয়েছিলাম, ওর আংটি কেনার ছিল। দোকানে ঢুকে আমি হতবাক। বলে কী? বিভিন্ন ক্যাটেগোরির কাউন্টার, কোথাও ৫গ্রামের হার তো কোথাও ১০০গ্রামের হার। সেইগুলি দেখে সত্যি বলছি, নারকেল দড়ির কথা মনে হয়েছিল! আমি আর মা এখনো একটু মোটা চেনের কথা উঠলেই নারকেল দড়ির উদাহরণ দিই। এখানে নাকি বিয়েতে মঙ্গলসূত্রের জায়গায় এরকম মোটা সোনার চেইন পরানো হয়, চোরের বাড়িতেও অঢেল সোনা। তাই চুরি ছিন্তাই অনেকটাই কম চেন্নাইতে। ইদানীং ভিন রাজ্য থেকে বেশ কিছু মানুষজনের আগমন ঘটায় অবশ্য ক্রাইম রেট একটু হলেও বেড়ে গিয়েছে।
এইসব করতে করতে কখন যে আড়াই মাস কেটে গেল, বুঝেই উঠিনি। শুধু শেষ দশদিন কাজ নিয়ে প্রচন্ড চাপে ছিলাম, প্রেজেন্টেশন ভালো করে দিয়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। বাবা চলে এলো চেন্নাই, আমাদের ফেরার দিন এসে গেল। তখনো ওয়েট লিস্টেই আছি, এদিকে স্যার পুরোপুরি মোটিভেট করে পি এইচ ডি জয়েন করার জন্য রাজী করিয়ে দিয়েছেন (এদিকে হাতে অফার নেই কিন্তু! আবার নেক্সট চান্স সেই ডিসেম্বরের সেমেস্টারের ইন্টার্ভিউ)। স্টেট ব্যাঙ্কের পি ও পরীক্ষার ইন্টারভ্যু স্কিপ করেছি, ইউ বি আইয়ে ক্লারকশিপের অফার লেটার রিজেক্ট করেছি। মন টানছে মাদ্রাসে। জানিনা ফিরব কবে, ফিরলেও কতদিনের জন্য। ফেরত গিয়েই রাজাবাজারে ফাইনাল পরীক্ষা। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। যেই পিজিতে প্রথম দিনই ভেবেছিলাম যে থাকব না, অন্যত্র জায়গা খুঁজব, যেই ল্যাব, যেই রিসার্চ জীবন নিয়ে প্রথম থেকে ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলাম, হঠাৎ করেই যেন সবাই ভীষণ বেশী করে টানতে লাগল। ফেরার দিন প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থায় ট্রেনে চাপলাম।
এইভাবেই মিটল আমার চেন্নাইতে হানিমুন পর্ব। আবার ফিরব অগস্টের মাঝামাঝি, প্রোজেক্টে। এই মর্মে ছাড়া পেলাম ল্যাব থেকে। তখন শুরু হবে আরেকপ্রস্থ লড়াই। একটা নতুন জীবন। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।

Friday, October 27, 2017

Dakshayani



নমস্কার। সাগরিকার এই অনুষ্ঠানে আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই। গত বছরের মহালয়ার অনুষ্ঠানের পরে এই বছর দাক্ষায়ণী টিমের সকলে আপনাদের সামনে এক ভিন্ন আঙ্গিকের নৃত্য পরিবেশনে প্রয়াসী।

মেঘ রঙে রঙে বোনা, আজ রবির রঙে সোনা।
আজ আলোর রঙ যে বাজল পাখির রবে।
আজ রঙ সাগরে তুফান ওঠে মেতে।

মানবজীবন বর্ণময়। সেই মানবজীবনে আবেগের আতিশয্যই আমাদের আজকের নৃত্যানুষ্ঠানের প্রেরণা। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইরকম আবেগেই পরিপূর্ণ এই জীবন। এই বিভিন্ন আবেগ ও অনুভূতির নানান বর্ণচ্ছটায় মানবজীবন হয়ে ওঠে রঞ্জিত। এর প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন অভিব্যক্তির মাধ্যমে। কখনো সে খুশীতে উদ্বেলিত, কখনো ঈর্ষান্বিত, কখনো বা

উচ্ছ্বসিত তো কখনো সে ক্রোধানলে
জর্জরিত। কখনো সে জীবনের শূন্যতায় বিমর্ষ তো কখনো ধ্বংসলীলায় মত্ত। 



১। ক।  যুগ যুগ ধরে সুন্দরী বসুন্ধরার পানে চেয়ে কত মানুষের প্রাণ গেয়ে উঠেছে প্রকাণ্ড উল্লাসভারে। যৌবন দিয়েছে এই সৌন্দর্যকে এক অনন্ত ব্যাপী অনন্যতা, যা দিকে দিকে অরণ্যে ভূধরে নবপল্লবে হিল্লোল তুলেছে। এই প্রাণোচ্ছ্বল যৌবনেরই রঙ সবুজ। অসীম ক্ষমতা তার।

ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
ওরে সবুজ ওরে অবুঝ
আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।


যৌবন তার প্রাণবন্ত আবেগে সারাবেলা যে আনন্দদোলায় মনকে স্পর্শ করে, সেই নৃত্যই আমাদের প্রথম পরিবেশন।






১/ খ যৌবন ক্ষণস্থায়ী। আর তাই যৌবনের সৌন্দর্যও স্বল্পায়ু। নবপল্লবের কাঁচা রঙ যে কখন মানে পাল্টে কাঁচা পাকা চুলের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে, তা উপলব্ধি করা কঠিন, মানব মন মানতে পারেনা।

আমাদের পাকবে না চুল গো - মোদের পাকবে না চুল।
আমাদের ঝরবে না ফুল গো - মোদের ঝরবে না ফুল।

অবশিষ্ট যৌবনকে বৃথা আঁকড়ে ধরার বিফল চেষ্টা ও আশেপাশের সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত প্রাণকে দেখে, মানব মন হয়ে ওঠে ঈর্ষান্বিত। না পাওয়ার তৃষ্ণা দগ্ধে দগ্ধে মারে তাকে, ছুটি পায় প্রাণের আরাম। নব যৌবনের সবুজ তখন প্রতীক হয়ে ওঠে ঈর্ষার। আমাদের দ্বিতীয় পরিবেশনা - " ঈর্ষার সবুজ চোখ"।





২/ক।  যা পায়নি, তাকে পাওয়ার জন্য মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত চলতে থাকে একটা যুদ্ধ। তারপর আপাত যুদ্ধশেষে কাঙ্খিত বস্তু মিললে মন কিছুটা হলেও পায় সাময়িক স্বস্তি, ।


তোমারি ওই অমৃত পরশে আমার হিয়াখানি
হারাল সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী।

এই ঝলমলে আনন্দেরই রঙ কমলা। এই আনন্দ বিশ্বভুবনকে ছন্দে নাচায়, নাড়িয়ে দেয় চিত্তবীণা। এই প্রবল সন্তুষ্টিই ফুটে উঠবে আমাদের পরবর্তী নিবেদনে।






২। খ।  যাহা পাস তাই ভালো
    হাসিটুকু, কথাটুকু
  নয়নের দৃষ্টিটুকু, প্রেমের আভাস।
সমগ্র মানব তুই পেতে চাস,
এ কী দুঃসাহস!
কী আছে বা তোর!

কাঙ্খিত বস্তুর প্রাপ্তিসুখ ক্ষণস্থায়ী। একটা যুদ্ধ জয় মনকে করে তোলে ক্ষুধার্ত। তার আরো চাই, আরো চাইয়ের মত আগ্রাসী মনোভাব জন দেয় লিপ্সাকে। চিত্তমাঝে এক অজ্ঞাৎ ব্যাথা ভরে ওঠে অচেনা প্রত্যাশায়।  তৃপ্তিহীন এক মহা আশা মনের মধ্যে সঞ্চারণ করে লোভ ও লিপ্সাকে। হলুদ রঙ এই লোভ ও লিপ্সার প্রতীক। এই দীপ্তোজ্জ্বল লিপ্সার অনল পরিবেশিত হতে চলেছে আমাদের পরবর্তী নিবেদনে।










৩/
একটা সময় পর মন এই দ্বন্দ্বেও হয় জয়ী। হিংসা লোভ লিপ্সাকে জয় করার হর্ষ জাগে পৃথিবীতে। জীবনে লাগে এক প্রাপ্তির পরশ, আসে স্থিতিশীলতা। এই
প্রাপ্তি এনে দেয় এক রাজকীয় , যে আভিজাত্য মনের ব্যাপ্তি ঘটায়; নীল সমুদ্রের ম্পতই যা অনন্ত, গভীর ও বিশাল। অসীম এই অভিজাত্যের আপন সুর তাল ছন্দ ও বর্ণের প্রকাশই আমাদের পরবর্তী নিবেদনে।








৪। আভিজাত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তিত্ব। আর এই ব্যক্তিত্বময় সত্ত্বার থেকেই সৃষ্টি হয় তীব্র  আবেগ ও অনুভূতির। রাগে অনুরাগে আকর্ষণে আকুল আর্তস্বর ওঠে, যা জাগিয়ে তোলে মানব মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে। সে অনুভূতি একদিকে যেমন প্রেমময়, কোমল, তেমনি আবার তার তীব্রতা নটরাজের ক্রোধের সাথে তুলনীয়। তীব্র আবেগের রঙ গোলাপী, ক্রোধের রঙ লাল। রাগ ও অনুরাগের মধ্যে চলতে থাকে এক চিরদ্বন্দ্ব। জগত চরাচর কাঁপিয়ে  এই দুই সত্ত্বার স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে এক প্রচণ্ড কল্লোল। তীব্রতা ও কোমলতার এই নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও একে অপরকে অতিক্রম করে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসই ধরা দেবে আমাদের পরবর্তী পরিবেশনায়।







৫। নাই সুর, নাই ছন্দ, অর্থহীন নিরানন্দ
জড়ের নরটন।
সহস্র জীবনে বেঁচে ওই কি এছে নেচে
প্রকাণ্ড মরণ।

যখন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করতে করতে মানব মন হয়ে পড়ে রণক্লান্ত, যখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ ফোটাতে পারেনা হাসি, মানবমন এক উদাসমূর্তি বিষাদশান্ত শোভায় আচ্ছন্ন থাকে, তখন চারিদিকে শুধুই কালিমা, শুধুই হাহাকার, শুধুই শূন্যতা। রজনী গভীর হয়, দীপ নিভে আসে। চারিদিকে কেবলই কালো। মনের শূন্যতা,  তাকে করে তোলে অশান্ত ও ধ্বংসাত্মক। বাদ প্রতিবাদের নিনাদ ঘোষণা করে সে লিপ্ত হয় ধ্বংসলীলায়। আমাদের আগামী উপস্থাপনায় মনের সেই অশান্তিই ব্যক্ত হয়ে উঠবে।











৬। আবেগ অনুভূতি চাওয়া পাওয়ার অন্ধকারের শেষে ঊষার পুণ্য লগ্নে গগনে ওঠে নবীন সূর্য। এই নবীন সূর্য আনে নব আশা ও নবজাগরণের বার্তা। পুরাতনকে ভুলে, অতৃপ্ত গোপনমর্মদাহিনী বাসনাকে ট্যাগ করে এগিয়ে নিয়ে চলে চিরপরিচয়মাঝে এক নব পরিচয়ে। এই নবীন সূর্যের শুভ্র রশ্মিতেই ধুয়ে মুছে যায় সমস্ত কালিমা, ঘুচে যায় দুঃখ। সমস্ত অনুভূতির সংমিশ্রণে এক মায়াময় প্রশান্তি সৃষ্টি হয়। সব রঙ মিলে যেমন তৈরী হয়  সাদা, তেমনি জীবনের নানাবিধ আবেগ ও অনুভূতির মিলনেই বহমান জীবনের সার্থকতা। এদের মিলনঘাতের বিচিত্র বেদনা নিত্য রচনা  চলেছে নব বর্ণ গন্ধ গীতি।

আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো,
তবু শিশিরটুকুরে ধরা দিতে পারি, বাসিতে পারি যে ভালো।

এই মায়াবী শুভ্র আলোর হাসির রেশটুকু থেকে যাক আমাদের প্রত্যেকের জীবনে, প্রতি মুহূর্তে। জীবন পরিপূর্ণ হোক, এই আশা নিয়েই আমাদের সর্বশেষ উপস্থাপনা - "মায়াবী জীবন।" 






আজি দখিন দুয়ার খোলা: যেখান থেকে সব শুরু

সালটা ২০১৩, ওই জানুয়ারির মাঝামাঝি (নাকি শেষের দিকে) একদিন নেহাতই অনিচ্ছে সহ গেট পরীক্ষা দিতে গেলাম সোনারপুরে। সেই নিয়ে ছিল ওটা আমার তৃতীয় এটেম্পট এই জঘন্য পরীক্ষার। গত দুইবারে একটুর জন্য কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাই, তাই এইবারে একদমই মন ছিল না পরীক্ষাটা দেওয়ার। ইতিমধ্যে তখন ব্যাঙ্গালোরে একটি স্টার্ট আপ কোম্পানিতে চাকরির অফারও পেয়েছিলাম, আর MSc শেষ করার পরে দুই বছর ধরে চেষ্টা করে করেও যখন PhD করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না, তখন প্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়েই গিয়েছিলাম। তবুও, নেহাত ওই বছর মেয়েদের জন্য পরীক্ষার ফর্ম বিনামূল্যে দিয়েছিল এবং অন্যান্য বন্ধুদের পরীক্ষাকেন্দ্র প্রায় এক রাত্তির ট্রেনে করে গিয়ে পৌঁছনোর মত জায়গা আর আমারটা লোকাল ট্রেনে কয়েকটা স্টেশন গেলেই যাওয়া যাবে বলে, যাব না যাব না করেও অবশেষে গেলাম। পরীক্ষা সেই বছর প্রথম পুরোপুরি কম্পিউটারাইজড ছিল, প্রথম সব কিছু নিয়ে মানুষজন যতই ভালোলাগা ভালবাসাবাসি করুক না কেন, এই ক্ষেত্রে প্রায় কুরুক্ষেত্র লাগার জোগাড়। যে পরীক্ষা দুপুর দুটোয় শুরু হওয়ার কথা, তা শুরু হলে গিয়ে প্রায় সাড়ে তিনটেতে। বিঘ্ন দিয়ে শুরু হল, তাই এর থেকে তেমন প্রত্যাশা ছিল না। ভুলে মেরে দিলাম।
এই ফেব্রুয়ারি মার্চ মাস নাগাদ, রাজাবাজারের স্যারেরা বললেন মাদ্রাজ পাঠাবেন, প্রোজেক্টে। ওরে বাবা, শোনা ইস্তক সে যে আমার কী আনন্দ কী আনন্দ, বলে বোঝাতে পারব না। আই আই টি নামক প্রতিষ্ঠানের ও সেখানে পড়াশোনা করে যারা, তাদের ওপর সে কী অসীম শ্রদ্ধা তখন আমার। আমি তো প্রায় নাচতে নাচতে সব বন্ধুদের বলতে লাগলাম, এই জানিস আমি IIT Madras যাচ্ছি, আড়াই মাস থাকব। প্রচুর বাহবা টাহবা পেলামও (যদিও স্যারেরা পাঠাচ্ছেন, এতে যে আমার কি এলিজিবিলিটি প্রশংসা পাওয়ার, তা জানিনা! ) ওমা, আমার এমন সুন্দর স্বপ্নের দিনগুলিতে হঠাৎ পিন মেরে ফুস করে সব হাওয়া বের করে আমার স্যার বললেন, " শোনো, তোমায় অমুকের সাথে কথা বলতে হবে। আন্না ইউনিভার্সিটিতে, ও প্রজেক্ট করাবে। এই নাও ইমেল আই ডি। যোগাযোগ করে নিয়ো।" হায় আমার পোড়া কপাল রে, এবারেও বিড়ালের ভাগ্যে শিক ছিঁড়ল না!  এই প্রসঙ্গে বলি, আমি যখন কোনকিছু নিয়ে বেশ ভাবনা চিন্তা করে ফেলি, তখন কিন্তু জান প্রাণ লড়িয়ে দিতে পারি সেটা হাসিল করতে, অন্তত নিজের দিক সমস্ত চেষ্টা করি, ফলের আশা করেই। সেই শুরু হল আমার প্রজেক্ট আই আই টি। তড়িঘড়ি ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট খুলে দুমদাম গোটা দশ পনেরো জনকে মেল করে দিলাম। চার পাঁচজন উত্তর দিল না, কয়েকজন লিখে দিল, না, জায়গা নেই। কেবলমাত্র একজন বাঙালি ভদ্রলোক, অত্যন্ত সদয় হয়ে  বললেন, আরে এসো এসো। অবশ্যই এসো, সুস্বাগতম, ইত্যাদি ইত্যাদি। আহা সেদিন সে আমার প্রচণ্ড মন ভালো, বেশ একটা প্রজেক্ট/মিশন সফল হল বলে কথা। আহা, কি না কি বিশ্বজয় করে ফেলেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজাবাজারে গিয়ে স্যারদের বলে দিলাম, ওইসব আন্না বান্না ছাড়ুন, আমি যাব আই আই টি। ওনারাও দেখলাম হাসিমুখেই পারমিশন দিলেন। সেই শুরু হল আমার দিন গোনা।
তখন একেবারে ফেসবুক খুলে ফ্রেন্ডলিস্ট স্ক্যান করতে শুরু করলাম, কে কে আছে চেনা পরিচিতদের মধ্যে, যারা চেন্নাইতে থাকে বা থাকত। আমার এক বন্ধু, রোহিত, ও বেশ কিছু মাস (নাকি বছর?) চেন্নাইতে থেকেছে, চাকরিসূত্রে। সেই সময়ে ওই হয়ে দাঁড়ালো আমার মুশকিল আসান। ওর সূত্রেই আলাপ হল অর্কদীপ আর রিম্পার সাথে। ওরা দুজনেই তখন আই আই টিতেই MS পড়ছে। ব্যস, সেই থেকে যে ওদেরকে জ্বালাতন করা শুরু করলাম, এখনো ছাড়িনি (ওরা দুজনে আমার চেন্নাইয়ের লোকাল গার্জেন)। তখন প্রথম চিন্তা, কোথায় থাকব। ক্যাম্পাসে হোস্টেল পাবো কি না, পেলেও কিভাবে কোথায় কার কাছে এপ্লাই করব। কিছুদিন খোঁজাখুঁজির পরে জানা গেল যে ক্যাম্পাসে আপাতত হোস্টেলের আকাল চলছে, অগত্যা আমায় নিজের ব্যবস্থা অন্যত্রই করতে হবে। অন্তত শুরুতে বাইরেই থাকতে হবে, তারপরে না হয় ওখানে পৌঁছে কাকুতি মিনতি করে যদি কিছু ব্যবস্থা হয়। শুরু হল ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাসস্থান খোঁজার পর্ব। কিছু জায়গা সিলেক্ট করি তো খরচে পোষায় না, কিছু খরচে আসে তো দূরত্বে বাদ পড়ে যায়। অনেক অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তারপরে একদিন একটি অনলাইন বিজ্ঞাপনের সাইট থেকে খবর পেলাম একটি পিজির। প্রথমে মেল চালাচালি করলাম। জানলাম এক বয়স্কা ভদ্রমহিলার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা, পাশেই ওনার মেয়ে তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। মেয়েই মেলে যোগাযোগ করছিলেন।  কথাবার্তা বলে টলে প্রায় ফাইনাল করে রাখলাম।
এত কিছু হয়ে গেল, কিন্তু মাস তখনো মধ্য মার্চ। আমার আসলে সবেতেই একটু বেশী হুড়োহুড়ি তাড়াতাড়ি। একদিন (১৩ই মার্চ সম্ভবত) রাত্রে দিব্যি শুয়ে পড়েছি, এমন সময়ে ফোনে মেসেজ এলো বান্ধবীর, "গেটের রেজাল্ট লিক হয়েছে। খড়গপুরের পেজে দেখা যাচ্ছে, তোমার কত র‍্যাঙ্ক এলো, দেখো। আমার অমুক।" আগেই বলেছি, গেট পরীক্ষা নিয়ে আর উৎসাহ ছিল না। কিন্তু ওই যে,রেজাল্ট, কিরকম পেটের মধ্যে গুঁড়িগুঁড়ি শুরু হল। জানি যাই হোক না কেন, ওই রেজাল্টে কিচ্ছু যায় আসবে না আমার, তবুও, নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আধ ঘণ্টা ধরে কাল সকালে দেখবো, এখন দেখে কি করব ভেবে ভেবেও সেই উঠে ডেস্কটপটা অন করলাম। মেল থেকে আই ডি পাসওয়ার্ড বের করে লগ ইন করলাম সাইটে। ওই মিনিট খানেক যা সময় লাগল রেজাল্ট বেরোনোর, মনে হচ্ছিল যেন, এখনো সময় আছে, পালিয়ে যাই, দেখবো না। ডিসিশন নিতে আমি খুবই অপারগ, তাই যতক্ষণে ঠিক করলাম সিস্টেম ষাট ডাউন করব, ততক্ষণে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল আমার রোল নম্বর এবং একটি র‍্যাঙ্ক, এমন র‍্যাঙ্ক, যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি পেতে পারি। প্রথম রিএকশন কি ছিল জানেন? এক ছুট্টে এসে মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে সেটা জানানো, আর তারপরে যেই কথাটা বলেছিলাম আমি, আজও মনে পড়লে কেমন একটা মনে হয় যে Man proposes, God disposes বাগধারাটি সত্য! মা কে সেদিন বেলছিলাম, " মা শোনো, ভালো র‍্যাঙ্ক এসছে। কিন্তু প্লীজ, আমি PhD করব না। আমায় দয়া করে বলবে না কোথাও এপ্লাই করতে। " এই কথাকটি বলার পিছনে একটা বিরাট চিন্তাভাবনা ছিল। তখন ভাবতাম যে কলকাতায় থেকে PhD করতে গেলে বাবা মা আত্মীয় স্বজনরা ধরে বেঁধে কিছু বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেবে, বরং ব্যাঙ্গালোর গেলে তখন হাতের নাগালের মধ্যে থাকব না, আরামে থাকব। পরেরদিন সকালে রফা হল বাবা মায়ের সাথে। যেহেতু মাদ্রাজে যাচ্ছিই সামার প্রোজেক্টে, অন্তত IIT Madrasএ এপ্লাইটা করি। আমার তো নিজের ওপর ও নিজের কর্মক্ষমতার ওপর ফুলপ্রুফ ভরসা, জানি এপ্লাই করলেও চান্স পাবোই না। তাই কোন বাড়তি কথা খরচা না করে দিলাম এপ্লিকেশন ফর্ম ভরে। ২০শে মে পরীক্ষা (যেটা শিয়োর ছিলাম ক্লিয়ার করব না), আমার ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল ১৩ই মে, মাদ্রাজ মেলের। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে ভেবে মনে মনে নিশ্চিন্তও হলাম।
এরপর ব্যস্ত হয়ে গেলাম কোর্সের পরীক্ষা নিয়ে। কখন যে মে মাস এসে গেল, খেয়ালই করিনি প্রায়। আই আই টি আসব, তার তোড়জোড় শুরু হল জোর কদমে এপ্রিল শেষ হতেই। প্রথম কাজ যেটা করলাম, একটা ল্যাপটপ কিনলাম। তারপরে বন্ধুদের সাথে আত্মীয়স্বজনদের সাথে আহা, আগামী আড়াই মাস দেখা হবে না, ভালো থাকিস/থেকো এই করতে করতে অবশেষে ১৩ই মে রাত্রের ট্রেন ধরতে রওনা দিলাম বাবা আর আমি।

Thursday, October 26, 2017

আত্মপ্রকাশের জন্য

#নিজস্বীতে_আত্মপ্রকাশ

গুরুদেবের একটি লেখার দ্বিতীয় পর্ব আমি লিখেছিলাম, সেইটা যাতে আপনারা সকলে পড়তে পারেন, সেই জন্যই মূলত আত্মপ্রকাশে আমার আসা। আর ব্যস, তারপরে তো... এই একটা এত্ত বড় পরিবার পেলাম, সে যে কী আনন্দ আমার! নিজে ছোট যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে গল্প করে গল্প শুনে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে। বলা যায়, শুধু কিছু সমমনস্ক মানুষ পেয়ে গেলেই আমি যে সেই বকবক শুরু করব, যে কোন রেডিয়ো ষ্টেশনের আর জে হার মেনে যাবে! আর তাই আত্মপ্রকাশে দিনের মধ্যে অন্তত সাত আটবার ঢুঁ মারাটা আমার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সকলের লেখা পড়ি, অনেক সময় কমেন্ট করা হয়ে ওঠেনা (আমি আদপে খুবই অলস কি না, এই আলস্যের জন্যই আমি এখনো চেন্নাইতে পড়ে রইলাম। নইলে তো এতদিনে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে যেতাম, সলমা মাসীর মত অত এলেম নই, তাই প্লুটো অনেকটা বেশী দূর।), কিন্তু অবশ্যই পড়ি। কবিতা তেমন বুঝিনা, তবে গল্প (যে কোন সাইজেরই হোক, গোগ্রাসে গিলি। হ্যাঁ খেতে যে বড্ড ভালোবাসি, আমার সাইজ দেখেই বুঝবেন। ও সরি, কী করেই বা বুঝবেন, ছবি তুলি যখন নিঃশ্বাস চেপে ভুঁড়ি কমানোর মোটামুটি successful attempt নিয়েই ছবি তোলাই যে)
নাম মনে রাখতে পারিনা সহজে, যদি না খুব বেশিভাবে interact করি, বা সামনাসামনি আলাপ হয়, তাই হয়তো সকলের নাম নিয়ে বলতে পারছিনা। এই ইভেন্টটা খুব মনে ধরেছে, অন্তত ডিপির আড়াল থেকে বেড়িয়ে অনেকজনকে দেখবো, চিনব।
এই রে, দেখলেন তো, already বকবকের সুযোগ পেয়ে কিরকম bore করা শুরু করে দিলাম? আর তেমনি কিরকম অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা শুরু করলাম? আসলে মাধ্যমিক থেকেই এই অবস্থা। পঃবঃমঃশিঃপঃ (আরে ধুর, ওই যে, State Board) এ পড়লে সুস্থ মানুষেরও হাল এইরকম হয়। তার ওপরে আবার শহুরে কনভেন্ট ইশকুলে পড়লে এমনিই এটা বেড়ে যায়। কুড়িয়ে বাড়িয়ে পরীক্ষায় নম্বর তুলতে গেলে এই হ্যাজানোটা পুরো রক্তে মজ্জায় ঢুকে যায়, আমিও তার কোন ব্যতিক্রম নই। সারাংশ আর ভাব সম্প্রসারণের প্রশ্নে ১০ নম্বর থাকত, কয়েকবার পাথফাইন্ডারের পরীক্ষায় সারাংশ লিখবার চেষ্টা করলাম, নিয়ম মত তো ১/৩ হওয়া উচিত লেখার মাপ, আমার হল গিয়ে ১৩ গুণ। তারপর থেকে আর কোনদিনও চেষ্টা করার দুঃসাহস দেখাইনি। এক্কেবারে পাতার পর পাতা লিখে যেতাম। এখনো সেই অভ্যেস যায়নি। প্রথম প্রথম বাংলা টাইপ করতে কষ্ট হত, অনলাইন একটি সাইট থেকে লিখতাম, তারপর লিনাক্সে অভ্র লাগালাম। আর কি! মাঝে মাঝেই আপনাদের বিরক্ত করে মারি।
এত কিছু বলার পরেও এখনো বললাম না প্রশ্নপত্রের সব উত্তর। ধুর ধুর, প্লীজ adminরা আমার নম্বর কাটবেন না। এত বছরের অভ্যেস কি না।
১। আমি আসলে দক্ষিণ কলকাতার মেয়ে। কিন্তু উত্তর খুব টানে। (জানি না কেন, জাতিস্মর নই, তাই confirm করতে পারছিনা আগে থাকতুম কি না ওই ঠনঠনিয়া চত্বরে)
২। আপাতত থাকি চেন্নাইতে। একটি জঘন্য বিষয়ে (না না বিষয়টা ভালো, আমার আজকাল একঘেয়ে লাগে) রিসার্চ করি। বছরখানেকের মধ্যে ডিগ্রী লাভ করতে চাই।
৩। বই পড়তে, গান শুনতে, খেতে, লোকজনকে ধরে জ্ঞান দিতে আমি ওস্তাদ।
৪। বেড়াতে ভালোবাসি।
৫। ছবি তুলতে ভালবাসি। প্রচুর চেষ্টা করে টাকা পয়সা জমিয়ে জন্মদিনে একটি DSLR কিনলাম, কিন্তু এখনো ৬ মাস পরেও Auto modeএ ছবি ওঠাই।
৬। অল্প বিস্তর লিখি আর রোজ গান গাই।
৭। বন্ধু পাতাতে পারি মোটামুটি।
৮। কুকুর বিড়াল দেখলেই আদেখলাপনা চাগাড় দিয়ে ওঠে।
৯। আমি খুব খুব ভীতু, রাত বিরেতে হোস্টেলের অন্ধকার করিডোরে একা বেরোতে খুব কষ্ট হয়।
থাক, দশ নম্বরটা না হয় বললাম না আর। সব বলে দিলে একেবারে তাহলে আর কি হবে??

আচ্ছা থাক, ১০ নম্বরটা বলেই দিই, অত ভাও খাবও না, সবে কেক আর মাইসোর পাক খেয়ে গুরুভোজন করলাম। খিদে নেই আপাতত।
১০। সিনেমা কেবলমাত্র শাহরুখ খানের হলে, তবেই আস্ত দেখি, তাও হলে। নইলে সব সিনেমা হয় ডাউনলোড করে (অপরাধ, আজকাল কমিয়ে ফেলেছি), Amazon Primeএ বা Youtubeএ দেখলেও গান স্কিপ করে যাই। অত ধৈর্য নেই যে, কি করব!

ব্যস, প্লীজ, অনেক লিখে ফেলেছি। আর পারছিনা। এবার বাকিদের গুলো পড়ি। আর হ্যাঁ, প্লীজ, আমায় ক্ষমা করবেন এত লম্বা essay লিখলাম বলে। মানে লেখাটা ঠিকঠাক হলে কিছু না, এটায় কোনরকম সারমর্ম নেই কি না, তাই।

আচ্ছা, টাটা।

পুনশ্চঃ ছবিটি গত শনিবার দুপুরে আমার ডিপার্টমেন্টের নীচে বাগানে pose দিয়ে তোলা। হলুদ আমার প্রিয় রঙ (হলুদ রঙের চশমার ফ্রেম অর্ডার দিলাম গতকাল), তাই সেই ছবিটিই দিলাম।

ডবল পুনশ্চঃ আত্মপ্রকাশকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা (এত বাজে বকতে গিয়ে আসল কথাই লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম)

ট্রিপল পুনশ্চঃ গুরুদেব মানে আপনাদের সকলের প্রিয়পাত্র, আপনাদের হিরো, শ্রীযুক্ত অর্ণব ভৌমিক (যার পপ্যুলারিটি অর্ণব গোস্বামীর চেয়ে কোন অংশে কম না। পুনশ্চ ৩ক।দুজনেই খুব প্রিয় আমার :)  )

Wednesday, October 18, 2017

ছকভাঙা

#ইভেন্ট
#ছকভাঙা

ইভেন্টের নামই যখন ছকভাঙা, তখন তো নিজের দিক থেকেও কিছু নিয়ম ভাঙ্গতেই হয়। তাই রবিবারের আগে লেখা দেব না ভেবেও উৎসবের মরসুম (আর তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ, চেন্নাইতে আজ দীপাবলির ছুটি হওয়ায় একটু সময় পেলাম লেখার) বলে আজকের এই ছোট্ট নিবেদন। ছক ভাঙল কি না, জানিনা। চেষ্টা করলাম বাঁধা ধরা নিয়ম মাফিক গড়পড়তা জীবন থেকে একটু বেরিয়ে আসতে। মতামত জানাবেন।

১।

" মা মা, আমার জন্য কী কী বাজি কিনে আনবে?" সাত বছরের ছোট্ট মেয়ের প্রশ্নে এক লহমায় তনুশ্রী পৌঁছে যায় নিজের ছোটবেলায়। তখন কালী পুজো মানেই চতুর্দশীর দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত জমিয়ে ফুলঝুরি, রঙ মশাল, সাপবাজি, ছুঁচোবাজি, চকোলেট বোমা, কালিপটকা, চরকি, দোদোমা, হাউয়ের তাণ্ডব। আশেপাশের বাড়ির বন্ধুদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা, কার বাজি কতক্ষণ ফাটে, কত জোরে আওয়াজ হয়। তারপর একটা বছর, ঠাকুরদা বাজির শব্দে আর ধোঁওয়ায় প্রচণ্ড অসুস্থ হলেন, প্রায় যমে মানুষে টানাটানি। কী সাংঘাতিক দিন গিয়েছে তখন, আদরের নাতনি তনুশ্রীর এখনো ভাবলেই ভয়ে শিউরে ওঠে।

" সোনা আমরা কোন বাজি ফাটাবো না। দীপাবলি তো আলোর উৎসব, আমরা খুব করে আলো দিয়ে সাজাবো বাড়ি। ঠিক আছে? আমি কিছু প্রদীপ কিনে আনব, তারপরে তুই আর আমি মিলে সুন্দর করে রঙ করে ডেকোরেট করব। ওকে? "

" মা, রঙ্গোলী করব না? মীনাক্ষীদের বাড়িতে তো হয়, সুমথি আনটি কী সুন্দর করে আঁকে দিওয়ালীর আগে। "

" বেশ, তাও করব। হ্যাপি? "

" ভেরি! "

২।

" কবে থেকে তোকে বলছি যে ঘর পরিষ্কার করবি। এখনো করিসনি কেন? "

" উফ মা। করলাম তো। কাল সারাদিন ধরে করেছি। এর চেয়ে বেশী আর পারব না। দিব্যি পরিষ্কার আছে। "

" মোটেই না। ড্রেসিং টেবিলের অবস্থাটা দেখ। গুচ্ছের শিশি বোতল। "

" মা ওইগুলো সব দরকারি। ফেলা যাবে না। "

" ওই ফেয়ারনেস ক্রিমের টিউবগুলো ফেলে দে। কালীপুজোর সাফ সাফাই তবেই তো কমপ্লিট হবে। "

নিজের চেয়েও বেশী আধুনিকা মায়ের দিকে অপলকে এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রিনি।

৩।

সকাল থেকে একের পর এক লাড্ডু বানিয়েই চলেছে শুক্লা, যদিও আজ ওর সুইট স্টোর বন্ধ।

ওর বর, অভিজিৎ তো অবাক, " কী ব্যাপার, আজও তুমি মিষ্টি বানিয়ে চলেছ? আজ না তোমার স্টোর বন্ধ? "

"  হ্যাঁ স্টোর বন্ধ। কিন্তু এগুলো কিছু ডেলিভারি করার রয়েছে। অনেক পুরনো অর্ডার। "

"  কোথায়? কার অর্ডার? "

"  সারা বছর আমাদের ডেলিভারি করে যারা, তাদের বাড়ি বাড়ি আজ আমি আর তুমি গিয়ে ডেলিভারি করব এইগুলি। সারা বছর এত খাটে, উৎসবের দিনে ওদেরও তো কিছু প্রাপ্য, বলো? "

ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের স্ত্রীর প্রতি অভিজিতের জন্মায় এক নতুন শ্রদ্ধা। 



সকলকে জানাই শুভ দীপাবলি।

Monday, October 16, 2017

একটি সাংসারিক গপ্পো (কহানী ঘর ঘর কি )

সকাল ছটার এলারমে ঠিক রোজের মতই আজও ঘুম ভেঙ্গে গেল বিদিশার। টের পেল, বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছে। সারা রাত ধরে গ্যারেজের টিনের চালে সমানে টিপটিপ টাপটুপ করে পড়েই চলেছে। ছোটবেলায় এরকম সারাদিন বৃষ্টি পড়লেই সে কী আনন্দ বিদিশার, "মা আজ কিন্তু রেইনি ডে, আজ স্কুল যাব না।" সারাদিন তারপরে মা মেয়েতে কত গান, কত গল্প কত বইয়ের রাজ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলত। এখনো সখ হয় তো আগের মতোই, শুধু পূর্ণ হয়না। পাঁচটা মিনিট বাড়তি শোয়ার অবকাশ নেই, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে কাজ করে যেতে হয়। পাশে শোয়া অর্ঘ্যর যাতে এতটুকু ব্যাঘাত না ঘটে ঘুমের, আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে উঠল বিদিশা। হাত মুখ ধুয়ে সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে গেল, শুরু হবে আবার একটা নতুন দিনের যুদ্ধ। সারা রাত যা বৃষ্টি হয়েছে, কাজের লোকেরা কেউ আসবে বলে মনে হচ্ছেনা, বাড়তি কাজ হল। গ্যাসে চায়ের জলটা বসিয়ে বিদিশা ফ্রিজ থেকে সারাদিনের রান্নার জন্য সব্জি বের করতে লাগল। শ্বশুরমশাই আর অর্ঘ্যর লাঞ্চ, টুকাইয়ের টিফিন, ননদ মিন্তির ব্রাঞ্চ, টুকাইকে স্কুলের জন্য তৈরি করা...সব করতে করতে কখন যে সারাটা সকাল কেটে যায়, খেয়ালই পড়েনা। আগে বাপের বাড়ি থাকতে দুটো খবরের কাগজ না পড়ে দিন শুরু হত না যে মেয়ের, সে এখন খবরের কাগজ দেখে বোধহয় সংবাদ বাসি হয়ে যাওয়ার পর।
ট্রে করে চায়ের কাপ নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির ঘরে এলো বিদিশা। বউমার হাতের চা না খেলে ওনাদের দিন শুরু হয় না। টুকাই তার দাদু ঠাকুমার কাছে রাত্রে থাকে, এইবারে মায়ের ডাকে রোজের মতই ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে শুরু হল এক প্রস্থ লড়াই।
" থাক না বিদিশা, একটা দিন একটু ঘুমোক না ও।"
" না মা, আর ঘুমোলে স্কুল বাস মিস করবে। কে আবার পৌঁছোতে যাবে ওকে তখন বলুন? একেই যা বিচ্ছিরি ওয়েদার।"
" ওই জন্যই তো বলছি, ওকে আজ রেইনি ডে করে দাও না। একদিন স্কুল না গেলে কিচ্ছু হবে না।"
" হ্যাঁ বউমা, কি সুন্দর শুয়ে আছে আরাম করে। একটা তো দিন। আমরা ছোটবেলায় কত এরকম স্কুল কামাই করতাম বৃষ্টি হলেই।"
" সে তো আমিও করতাম বাপি। তবে আপনার ছেলেকে বলুন। ও রাগারাগি করবে শুনলে।"
" চিন্তা করো না বউমা, তোমার শাশুড়ি বলবে বাবুকে। কি, বলবে তো? "
" হ্যাঁ, বাবু উঠেছে? ওকে পাঠিয়ো এই ঘরে। ইন ফ্যাক্ট, আমার একটা প্রস্তাব আছে।"
" কী প্রস্তাব মা?"
" আজকে সবাই রেইনি ডে পালন করবে। কেউ কাজে বেরোবে না। স্কুল কলেজ অফিস সব ছুটি।"
" ওরে বাবা, এ তো বেশ যুগান্তকারী আদেশ মা। "
" তুমি পাগল হলে নাকি ঝুমুর? টুকাইয়ের ওপর না হয় এই ফরমান চলতে পারে, আর কেউ মানবে নাকি?"
" অবশ্যই মানবে। বাবুরটা আলাদা ব্যাপার। কোন ইম্পরট্যান্ট কেস থাকলে ওকে ছেড়ে দেব। নইলে আর কেউ না। তুমি কাল বাদে পরশু রিটায়ার করতে বসেছ, এখনো এত কী? আজ একটা সি এল নেবে। মিন্তি রোজ এত কত ক্লাস করে, আমার সব জানা আছে। আজ তাই ডুব দেবে। এই বলে দিলাম। "
" আপনার আর আজ অফিস যাওয়া হল না বাপি। দাঁড়ান। আমি আপনাদের ছেলেকে পাঠাচ্ছি এই ঘরে। আপনারা বলুন। আমি রান্নাঘরে যাই। প্রচুর কাজ। টুকু ঘুমো তুই আরো। "


নিজেদের বেডরুমে এসে অর্ঘ্যকে ঘুম থেকে তোলাটা আরেক পর্ব যেন যুদ্ধের। যেমন বাবা, তেমন ছেলে, দুজনের কেউই সকালবেলা উঠতে চায় না। প্রায় দশ মিনিট চেষ্টা করার পর যখন অর্ঘ্য চোখ খুলল, বিদিশা বলল, " শোনো, মা আজ রেইনি ডের ফরমান জানিয়েছেন। সবার ছুটি। "
" মানে? টুকাই কে রেডি করেছো?"
" আরে সেটাই তো বলছি। মা বলে দিয়েছেন আজ সবাই বাঙ্ক করবে স্কুল কলেজ অফিস। তোমায় ও ঘরে ডেকেছেন। যাও। টুকাই এখনো ঘুমোচ্ছে। "
" সে যা ইচ্ছে বলুক মা। আমার ওসব সুযোগ নেই। টুকাইয়ের স্কুলটা মিছিমিছি কামাই করালে। "
" আমায় বলছ কেন? মা বাপিকে বল! "
"  হুম, যাচ্ছি। তুমি তাহলে আমার চা আর টেলিগ্রাফটা ওই ঘরে এনে দাও। "
" হ্যাঁ। আসছি। "


" কী ব্যাপার মা? আজ নাকি তুমি সবার ছুটি ডিক্লেয়ার করেছো? "
" হ্যাঁ, করেছিই তো। এরকম ভালো ওয়েদার, একটু বাড়ি বসে আরাম করতে কী হয়? "
" ওইসব আরাম ইত্যাদি তোমাদেরই হয়। আমার হবে না। আমি হসপিটালে না গেলে হবে না। "
" বেশ, তুই যাস। নেহাত পেশেন্টরা তোদের মুখ চেয়ে বসে থাকে, নইলে ছাড়তাম না তোকেও।  যত তাড়াতাড়ি পারিস ফেরত আসিস। আমরা বাকিরা আজ এঞ্জয় করব। "

ইতিমধ্যে মিন্তির ঘুম ভেঙ্গেছে, বৌদির কাছে শুনেছে মায়ের এই অদ্ভুত বিধান। আজ কি না সুজিতের সাথে সিনেমা দেখতে যাবে ভেবেছিল, এমনিও ক্লাস কম আজ। মা যদি কলেজ যেতে না দেয়, তাহলে সেই প্ল্যান ক্যান্সেল। সুজিত বেশ রেগে যাবে, জানে। দেখা যাক, মা কে রাজি করানো যায় কি না। ব্রাশ করে মা বাবার ঘরে এলো মিন্তি। সেখানে ইতিমধ্যে ভাইপো টুকাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। স্কুল যেতে হবে না শুনে ভারী আনন্দ তার। ঘরময় ছোটাছুটি করছে। ওরই সব চেয়ে যেন মন ভালো। বাবার মিশ্র অভিব্যক্তি, বোধহয় অফিসের শেষ কটা মাস জমিয়ে কাজ করে গল্প করে কাটাতে চান সহকর্মীদের সাথে। বৌদির অবশ্য মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সপ্তাহের মাঝে একটা হঠাৎ করে আসা ছুটির দিনের আগমনে খুব খুশী না, আসলে হবেই বা কী করে। সকলে বাড়ি থাকলেই তো বেচারির ওপর একটার পর একটা অর্ডার আসতে থাকে। দাদার লুচি আলুর দম চাই তো বাবার দিনের মধ্যে পনেরো বার চা। মায়ের পুজোর ঘরে হাজারটা দরকার, মিন্তির নিজেরই বা কম আবদার থাকে না কি? নেল পেন্ট লাগানো থেকে মাথায় হেনা করা, বৌদি ছাড়া কে বা করবে। এর ওপর আবার টুকাইয়ের পিছনে পিছনে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি। আহা রে, মা যে কী করে না!

" মা, তুমি না কি কীসব মাস বাঙ্কের নিয়ম করেছো আজকের জন্য? বৌদির কাছে শুনলাম।"
" হ্যাঁ, আজ রেইনি ডে পালন হবে। তোমার বাবা ভাইপো সবাই ছুটি নিলো। তুমিও কলেজ যাবে না আজ। দাদা নেহাত রুগী দেখবে, তাই আটকাতে পারলাম না। "
" কিন্তু মা, আমার যে ক্লাস আছে কয়েকটা আজ। খুব ইম্পরট্যান্ট টপিকস চলছে। "
"  কী যেমন?  জুড়য়া ২ নাকি গোলমাল? "
" ধ্যাত, যত বাজে কথা। "
" আহা, আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না কি?"
" আরে না, আজ স্ট্যাট মেকের কয়েকটা ইম্পরট্যান্ট লেকচার আছে। মিস করা যাবে না। প্লীজ বোঝো। "
" শোন, বই খুলে পড়ে নিবি নিজে। না বুঝলে ক্লাসমেটদের থেকে কাল বুঝে নিস। আজ ছুটি, বলে দিয়েছি, ব্যস। এর আর অন্যথা শুনব না। "
" মা তুমি না! আরে আমরা বাড়িতে থাকলে বৌদির ওপর এক্সট্রা কাজের হ্যাপা হয়। কেন বেচারীকে প্রেশার দিচ্ছ? "
" এই না না ননদিনী, আমার কোন অসুবিধেই হবে না। থাকো না বাড়ি। বাপি আর টুকাই আছে। তুমিও থাকো। ভালো হবে কিন্তু। তোমার দাদাকেও বলো যত তাড়াতাড়ি পারে, ম্যানেজ করে চলে আসতে। সবাই মিলে বেশএকটা ছুটি কাটানো যাবে। "

" এই মিন্তি, তখন থেকে পটর পটর করে চলেছিস। চুপ কর। আমার একটা প্ল্যান আছে। বলছি শোন। আগে বোস এখানে। বাবু তুই যাবি না এক্ষুনি, আগে আমার কথা শুনে যা। বিদিশা তুমিও বসো। "
" মা অনেক কাজ বাকি। ওর টিফিন বানাতে হবে। "
" তুমি আগে বসো। শাশুড়ির মুখে মুখে আবার কথা, ভারী পাজি বৌ তো! "

মিন্তির ফিচকে হাসি দেখে শাশুড়ি একবার কড়া নজর দিলেন, তারপরে আবার শুরু করলেন বলা। " প্রতিদিন আমাদের বিদিশা তো খেটে খেটে একসা হয়ে যায়। মেয়েটার তো কোন ছুটিই হয় না। আজ আমরা সব্বাই মিলে ওকে ছুটি দেব। "
" হয়েছে! দেখেছো বৌমা? তোমায় ছুটি করে দেবে তোমার শাশুড়ি। কাল সিরিয়ালের সময়ে বিরক্ত করেছো, এই তার পানিশমেন্ট। "
" থামবে? আমায় কথা শেষ করতে দাও।" এই বাড়িতে ঝুমুর মুখোপাধ্যায়ের কথার ওপর এখনো অবধি কেউ কথা বলতে পারে না, সে তার স্বামী, এত বড় পোস্টের বি সি এস অফিসারই হোক, কি ছেলে যে কিনা মস্ত বড় ডাক্তার। তাই ঝুমুর দেবী নিজের মত করে আবার বলা শুরু করলেন।
" আজ আমি আর মিন্তি মিলে রান্নাবান্না করব। বাবু তুই কখন আসতে পারবি বল? "
" আমার যদি হঠাৎ করে এমারজেন্সি কোন কেস না আসে, তাহলে দুটোর মধ্যে ম্যানেজ হবে মনে হয়। '
" বেশ, তাই আসবি। আসার পথে কিছু জিনিস বলে দেবো, নিয়ে আসবি।"
"কী?"
" কিছু পছন্দের খাবার আমাদের বিদিশা রাণীর জন্য। "
" আচ্ছা। তা আজ কি বৌমা ষষ্ঠী না কি?"
" একটা মার খাবি। ৩৬৫ দিন যখন ও সবার জন্য এত করে, তখন কেউ জিজ্ঞেস করিস যে আজ কী উপলক্ষ্য? "
 ডঃ অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়ের মাথা হেঁট হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। বিদিশা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে ওঠে, " আহা মা, ও তো আমি করি সংসারকে ভালোবেসে। এসব কথা উঠছে কেন। থাক না। "
" না থাকবে না বিদিশা। সবার চেতনা হওয়াটা দরকার। তুমি না থাকলে দেখতাম সবাই কে কী করে নিজেদের বাইরের জগতটা সামাল দিত। "
" ঠিকই বলেছ গিন্নি। চলো আজ আমরা মেয়েটাকে সেলিব্রেট করি। "

খেলতে খেলতে কানে হঠাৎ টুকাইয়ের কানে ঢুকল " সেলিব্রেট" শব্দটি, সঙ্গে সঙ্গে ও জিজ্ঞেস করে উঠল, " আজ কি মাম্মামের জন্মদিন ঠামি? আজ কিসের সেলিব্রেশন? "
" আজ আমরা তোমার মাম্মাম কে ভালোবাসি বলে সারাদিন মাম্মামকে সেলিব্রেট করব। ওকে? "
" ওকে!"
" শোন, তুমি বসে থেকো না তো ঠায়। যাও ছাতা মাথায় দিয়ে বাজারে যাও। আমি কিছু ফর্দ করে দিচ্ছি। নিয়ে এসো। "
" এই বৃষ্টিতে দোকান বাজার বসবে না মা। আজকের দিনটা থাক না। যা যেমন আছে, সেই দিয়ে করে ম্যানেজ করে নিই। এসব সেলিব্রেশনের দরকার নেই কিন্তু কোন।"
" খুব আছে। তুমি চুপ করে বসো তো। তোমায় যদি আজ কাজ করতে দেখি একটুও তো দেখো কী করি আমি। "

" হ্যাঁ বাবা, মা কে রাগিয়ো না। " ফুট কাটল মিন্তি।
" স্পেন্সারস, মোর সব খোলা। আমি যেমন লিস্ট করে দিচ্ছি, তেমন আনো জিনিসপত্র। আমি আজ রান্না করব। আর হ্যাঁ, বিশুর দোকান থেকে জিলিপি আর কচুরি এনো, ওটাই ব্রেকফাস্ট। তাড়াতাড়ি এস, বাবুকে বেরোতে হবে খেয়ে।"

" এই দাদা, জলদি আসবি। একসাথে খাবো। তারপরে সিনেমা দেখবো। নেটফ্লিক্সে ভালো কিছু সিনেমা এসছে রে। "
" ঠিক আছে রে, চেষ্টা  করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার। "


সেদিন সকালের ওই হেভি ব্রেকফাস্টের পর অর্ঘ্য হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর বাকি সবাই মিলে শুরু করল কত গল্প আর গান। অনেক দিন বাদে গলা ছেড়ে গান গাইলও বিদিশা, সংসারের ঠেলায় তো গানের পাট এতদিন উঠেই গিয়েছিল। মিন্তি আবার ফেসবুক লাইভও করল ওদের গানের আসর। সেখানে কত লাইক আর কমেন্ট। বিদিশার বোন অস্ট্রেলিয়া থেকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেও ফেলল, " দিদি তোকে আজ কী খুশী দেখাচ্ছে রে। দারুণ। চালিয়ে যা। আমি মা বাবা কে রাত্রে বাড়ি ফিরে দেখাবও ভিডিয়ো।"
" রাত্রে কেন রে মলি? আমি এক্ষুনি বেয়াই কে স্কাইপে ডাকছি। ওনারাও শুনুন নিজেদের মেয়েকে। "
দুপুরবেলা অর্ঘ্য এলো আরসালান থেকে বিরিয়ানি আর মঞ্জিনিস থেকে বিদিশার পছন্দের ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক নিয়ে। ইতিমধ্যে শাশুড়ি মা বানিয়ে ফেলেছিলেন মটন চাপ ফিস ফ্রাই আর পেঁপের চাটনি। আহা, কতদিন পরে এমন সুন্দর খাওয়াদাওয়া করল বিদিশা, এমন আরামে। রেঁধে বেড়ে তো ওই খাওয়ায় সকলকে, আজ এতদিন পর কেউ ওকেও এত যত্ন করে খাওয়াল। তারপরে সবাই মিলে একসাথে ওদের প্রিয় সিনেমা দেখল। বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরতে হই হই করে ওরা বেরোল কাছের শপিং মলে। চলল জমিয়ে কেনাকাটা, প্রত্যেকের জন্য। তারপরে রেস্টুরেন্টে খেয়ে রাত্রে যখন ওরা ছয়জন ফিরল, প্রত্যেকেই ক্লান্ত। তবে এ ক্লান্তি মধুর, এ আনন্দের, সারাদিন একে ওপরের সাথে কাটানোর মজাই আলাদা। কাজের ফাঁকে কেউই তো আজকাল একে অপরকে তেমন সময়ে দিয়ে উঠতে পারে না। নিয়মের মধ্যে চলতে চলতে সবাই হাঁপিয়ে ওঠে।  আজ হঠাৎ সেই বাঁধাধরা নিয়ম ভেঙ্গে কেমন আনন্দে দিন কাটল ওদের। এর জন্য ঝুমুর মুখোপাধ্যায় আর বরুণদেবের সব কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য। রেইনি ডের মজা যে এখনো নেওয়া যায়, তারই জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ পেল আজ মুখোপাধ্যায় বাড়ির সদস্যরা। আজ বিদিশার মুখের থেকে হাসির রেশ যেন যেতেই চাইছেনা। লেগে থাকুক এই অমলিন হাসি, চিরকাল। মাঝে মাঝেই এমন ছকে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আনন্দের স্বাদ পাক ওরা সবাই। 

Saturday, October 14, 2017

আয় তবে সহচরী

"ধুর, জীবনটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেল রে শৌভিক। কিছু একটা করতে হবে, সামথিং ইন্টারেস্টিং!" প্রতি রবিবারের মতই গত রবিবারের সকালটাও আমার শুরু হয়েছিল ঠিক একই ভাবে। আমি শৌভিক চট্টোপাধ্যায়, বয়স ৩০, চাকরি করি একটি মাল্টিনেশন্যাল কোম্পানিতে, বিজনেস এনালিস্ট পদে। থাকি চেন্নাইতে। সোম থেকে শুক্র নয় ঘন্টা অফিস করে কোনোমতে দিন কাটাই, তাই শনিবারটা শুধুই ঘুমিয়ে শুয়ে টিভি দেখে বই পড়ে শেষ হয়ে যায়। এই একই অবস্থা মুকুলেরও। মুকুল বসু, আমার ফ্ল্যাটমেট, আমারই বয়সী। চাকরি করে একটি মোটর কোম্পানিতে, আমারই মত দশটা সাতটা রুটিনে বিপর্যস্ত। শনিবারের দিনটা ওরও এমনভাবেই কাটে। আর তারপর রবিবার ভোর (হ্যাঁ মানে ওই ধরুন সাতটা নাগাদ সকালে) হতে ঘুম ভেঙ্গে আমার জন্য কফি আর নিজের জন্য গ্রিন টি বানিয়ে আসে আমার ঘরে। কাপটা দিতে দিতেই ঠিক এই একই হতাশাময় বাক্য বলে। সত্যি বলছি, আইডেন্টিকাল, word to word same, বিশ্বাস না হয়, আমি পরপর কিছু সপ্তাহ না হয় রেকর্ড করে শোনাবো আপনাকে। তখন বুঝবেন। একটা মানুষের যে কী করে এত কন্সিসটেন্সি থাকে জীবনে, ভাবতেই অবাক লাগে।
তা প্রতি সপ্তাহে শুনি আর ভাবি, যে হ্যাঁ, সত্যিই তো। আমার বয়সীরা এখন কেউ অনসাইটে কাজের দৌলতে কোম্পানির টাকায় ইউ এস ইউ কে ভ্রমণ করছে, কেউ বা রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনে এখন হয় বৌয়ের সাথে যৌথ ডিনার পার্টি হোস্ট করছে প্রতি উইকেন্ডে। সেখানে আমি রবিবার হলে কাজের কাজ বলতে আডিয়ারে গিয়ে একটু মাছের বাজার করছি আর কে সি দাসে কচুরি জিলিপি খেয়ে ব্রেকফাস্ট সারছি। সারাদিনে তারপর দুটো সিনেমা ইউটিউবে আর দু চার লাইন কাব্য লিখছি। মাঝে রান্নার মাসীর রেঁধে যাওয়া অখাদ্য কুখাদ্য ভাত ডাল সব্জি খাচ্ছি। রাত্তির হলেই সুইগি দিয়ে কিছু ভালো মন্দ হয় অর্ডার করছি, নয়তো দুজনে বাইক হাঁকিয়ে ফিনিক্স মলে গিয়ে খেয়ে আসছি। এই কী কোন জীবন হল? না, এবারে কিছু তো করতেই হবে। কতটা এক্সাইটিং হবে, জানি না। কিন্তু অন্তত স্বাদবদল তো হবেই।
" চল মুকুল, আজ কিছু অন্যরকম করব।"
" কী করবি?"
" করবি না, বল করব।"
" ফালতু হ্যাজাস না তো। ওই একই হল। তা কী করব সেটা বল।"
" বাইক বের কর। একটা জায়গায় যাব। "
" কোথায়?"
" আগে বের কর, রাস্তায় বেরিয়ে বলছি।"

কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপে একটা প্রতিষ্ঠানের খবর পেয়েছিলাম, তারা কাজ করে এইডস আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে। মহাবালিপুরম যাওয়ার পথে মাঝে একটু বাঁক নিলে রয়েছে স্নেহাম নামের একটি আশ্রম। গুগুল ম্যাপ্সে সেই লোকেশন সেট করে আমরা দুই বন্ধু সেই রবিবার চললাম স্নেহামে। পথে একটা ডিপারট্মেন্টাল স্টোর থেকে বাচ্চাদের জন্য নিলাম অনেক চকোলেট, রঙ পেন্সিল, খাতা, পেন্সিল আর কিছু টুকটাক ছোটখাটো মুখরোচক খাবারদাবার। স্নেহামে পৌঁছলাম যখন, ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। বাইক পার্ক করে আমরা অফিসের ইন চার্জ, শ্রী ভেঙ্কটেসানের সাথে কথা বললাম। জানালাম যে বাচ্চাগুলোর সাথে আজকের সারাদিন কাটাতে চাই। ওদের জন্য কিছু জিনিস এনেছি, সেইগুলি দিয়ে দিলাম। ভেঙ্কটেসানের মুখের হাসি দেখে কে বলবে যে একটু আগেই তার চকচকে কৃষ্ণবর্ণ চেহারায় বিশাল মোটা একখানা গোঁফ দেখে আমরা তামিল সিনেমার ভিলেন ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম! ভানাক্কাম ভানাক্কাম (নমস্কার) , নান্দ্রী (ধন্যবাদ) , রোম্বা নাল্লা (খুব ভালো)  ইত্যাদি ইত্যাদি শুনেটুনে আমরা যখন একেবারে গদগদ, ছাতি প্রায় দশ ইঞ্চি বেড়েছে, বাচ্চাদের প্লেরুমে ঢুকতে যাবো, এমন সময় কানে ভেসে এলো, " উফ, কী প্যাথেটিক, বাইকটাকে পার্ক করেছে দেখ, যেন পার্সোনাল গ্যারেজ। এক্সকিউজ মি, ইস  দা বাইক ইয়োরস? কুড ইউ প্লিজ মুভ ইট এ লিটল, আই এম আনেবল টু পার্ক মাই স্কুটি।" দক্ষিণদেশে বঙ্গতনয়ার সুমিষ্ট কন্ঠস্বর শুনে তো ততক্ষণে আমি আর মুকুল থ। তাকিয়ে দেখি হাল্কা বাদামী রঙের কুর্তি আর নীল জিন্স পরিহিতা এক অপূর্ব সুন্দরীর কন্ঠ, পাশে রয়েছে একইরকম সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার আরেক তনয়া, পরনে লাল টপ আর হলুদ সালোয়ার। দুজনেরি হাতে হেলমেট।  ঘোর ভাঙল, বলা চলে ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা থেকে বিঘ্ন ঘটাল ভেঙ্কটেসানের কথা, " সার, প্লীজ পার্ক ইয়োর বাইক কেয়ারফুলি, দিস ম্যাডাম ক্যানট পার্ক হার স্কুটি।"
" ও হ্যাঁ, করছি, আই মিন, ইয়েস, ডুইং ডুইং।" বলতে বলতে মুকুল এগিয়ে গেল।
" আপনারা বাঙ্গালী দেখছি! (কোনো বোনাস পয়েন্ট দেব না, মুকুলের উচ্চারণে পরিষ্কার বাংলা টান আছে, যে কোন বাঙালি ওই ইংরেজি শুনে বুঝে যাবে যে বক্তা বঙ্গতনয়।)
" হ্যাঁ, নমস্কার। আমি শৌভিক চট্টোপাধ্যায়, আর ও আমার বন্ধু মুকুল বসু। আমরা চেন্নাইতে চাকরি করি, থাকি।"
" তুলিকা মুখোপাধ্যায়। আন্না ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিকাল ডিপারট্মেন্টে লেকচারার। আমার বান্ধবী, সহচরী সান্যাল, ও সি এম আই  তে রিসার্চ করে, ফিসিক্স ডিপার্টমেন্টে।" গড়্গড় করে বলে চলল লাল হলুদ, প্রিয় দল ইস্টবেঙ্গলের রঙ্গে রঙ্গীন মেয়েটি।
" আলাপ করে ভালো লাগল।"
" দাঁড়ান, আপনার বন্ধু দেখছি বাইকটা সরিয়েছে, আমি স্কুটিটা পার্ক করে আসছি। তুলি তুই ভেঙ্কটেসানকে জিনিসগুলো দে, আমি আসছি।" এই বলে বাদামী জামা পরিহিতা শ্রীমতী সহচরী বেরিয়ে গেলেন। শ্রীমতি বললাম কারণ হঠাৎ করেই ওকে দেখে আর ওর রাগ রাগ কথা প্রথমে শোনা ইস্তক আমার শতাব্দী রায়ের শ্রীমতি ভয়ঙ্করী সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল! তা বলে নিজেকে চিরঞ্জিতের প্রলয়শঙ্কর মনে হয়নি অবশ্যই! সে যাই হোক। ইতিমধ্যে ভেঙ্কটেসানের পিছু পিছু আমি আর তুলিকা প্লে রুমে গেলাম। জানতে পারলাম যে এই দুই বন্ধু মাঝে মাঝেই এখানে আসে, বাচ্চাগুলো তাই ওদের খুব ভালো করে চেনে, ওদের দেখলেই খুশি হয়ে যায়। খানিকবাদে সহচরী আর মুকুল ঢুকল বেশ হাসি গল্প করতে করতে।
স্নেহামে মোট ২৯টি বাচ্চা থাকে, বয়স পাঁচ থেকে পনেরো। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওদের স্কুলে পাঠানো হয়, নিয়মিত ডাক্তার এসে চেক-আপ করে যান। মাঝে মাঝে এরকম আমাদের মত কেউ কেউ আসে, সারা দিন ওদের সাথে কাটায়। ওদেরও ভালো লাগে।
সেইদিনটা আমরা ভীষণ ভালো কাটালাম, উপভোগ করলাম এই বাচ্চাগুলোর সাহচর্য। ভেঙ্কটেসান সহ আরো যারা এই মহৎ কাজে লিপ্ত, তাদের সকলের সাথে পরিচয় হল। বাচ্চাগুলোর নির্মল হাসি, সহস্র দুঃখ কষ্টের মধ্যেও হার না মানার অদম্য প্রচেষ্টা, মন জয় করা ব্যবহার, সব আমাদের মুগ্ধ করল। প্রতিজ্ঞা করলাম যে এইখানে আবারও ফিরে আসব। সেইদিন অবশ্য এদের সাথে সাথে মদ্রদেশে দুই বঙ্গতনয়ার সাথে আলাপ হয়েও আমাদের দুই বন্ধুর নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা হলেও হিল্লোল উঠেছিল। গত ছয়দিন আমরা দুই বন্ধুই রাত জেগে শ্রীমতী ভয়ঙ্করী ও তুলির সাথে দেদার আড্ডা দিয়েছি। এখনো অবধি আড্ডাতে চারজনেরই অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। তবে মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই সহচরী আর মুকুল বোধহয় একটু রাইট টু প্রাইভেসি আওড়াবে, সেদিন মুকুলকে দেখছিলাম কি না ইন্টারনেটে এসব সার্চ করছিল।  আর আমি? দেখা যাক, কপালে কী আছে! আর কিছু হোক না হোক, মুকুলের সাথে সাথে সবাই যে সহচর সহচরী পেলাম অনেকগুলো, এতেই আপাতত খুশি।

ধন্তেরস

" বাপ রে, আজকের কাগজটা দেখেছিস তুয়া? পুরো আশি পাতা!"
" হ্যাঁ, দেখেছি। শুধুই বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। প্রত্যেকটা ফেস্টিভালকে এরা এত কমারশিয়ালাইজ করে, ভাবা যায় না।"
" বাট দ্যাট ইস বিজনেস, তাই না? লোকের এখন হাতে বোনাস, মনে ফুর্তি। এটাকে এনক্যাশ করতেই হবে!"
" হুম, ঠিকই। এনিওয়ে, আমি বেরোচ্ছি দীপ, তোর খাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখে গেলাম। খেয়ে নিস। আর আজ কখন বেরোবি?"
" থ্যাংকস! লাঞ্চের পর একটা মিটিং আছে। কাজারিয়ার সাথে। দেখি যদি ডিলটা ক্র্যাক করতে পারি।"
" অল দা বেস্ট। দেখ কাজারিয়ার মুড নিশ্চয়ই এই ফেস্টিভ সিজনে ভালো, যদি তুইও সেটা এনক্যাশ করতে পারিস দীপ।"
" হ্যাঁ। ক্র্যাক করতে পারলে একটা প্লে স্টেশন কিনব। প্রচুর অফার দিচ্ছে।"
" তুই ওই কর দীপ। তিরিশ বছর বয়স হয়েছে, কোন ম্যাচিউরিটি নেই। এখন না কি প্লে স্টেশন কিনবি। সিরিয়াসলি!!!"
" বাট ওয়াই নট? রোজগার করছি, ভোগ করব না কেন?"
" হ্যাঁ সেই তো। দিনের পর দিন আমি খেটে মরছি, আমাদের সব বিলস পে করছি, তোর খামখেয়ালিপনা সাপোর্ট করছি, আর উনি নাকি দু পয়সা এলে সঙ্গে সঙ্গে প্লে স্টেশন কিনবেন। সত্যি!"
" তুই এমন করছিস তুয়া যেন সবটা তোর কাছে সারপ্রাইজ? আমি যখন স্টার্ট আপটা শুরু করব বললাম, তুইই তো তখন বলেছিলি যে আমায় সাপোর্ট করবি। আর এখন এক বছর হতে না হতেই এই?"'
" দীপ, আমি কি একবারও বলেছি যে তোকে সাপোর্ট করব না? কিন্তু তুই বল, এক বছরে একটুও কি কিছু উন্নতি হয়েছে? আই এম টায়ার্ড দীপ, তুই প্লীজ রেগ্যুলার চাকরি খোঁজ। এনিওয়ে, আই এম গেটিং রিয়েলি ভেরি লেট। রাত্রে কথা বলব।"

মন মেজাজ তিক্ত করে তুয়া বেরোল অফিসের জন্য। একটা সরকারি ব্যাঙ্কে ক্লারিক্যাল পদে চাকরি করে। বাড়ি থেকে অফিস প্রায় ঘন্টাখানেকের রাস্তা। মিনিবাসে অফিসটাইমে ভিড়ে গাদাগাদি করতে করতে রোজ অফিস যাওয়া, একটা বিভীষিকাই বটে। একটা সময় ছিল যখন ও ভাবত চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নিজের মত করে পছন্দসই কিছু করবে, ক্রিয়েটিভ কিছু। ছোটবেলা থেকে শেখা নাচ বা গানকে পেশা করবে। কিন্তু দীপের আই টি ফার্মের চাকরিটা দু বছর আগে চলে যাওয়ার পর থেকে আর হাজার ইচ্ছে থাকলেও পারেনি ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়তে। দিনের পর দিন, শত বিরক্তি, ক্লান্তি নিয়েও করে গিয়েছে একই একঘেয়ে টাকাপত্তরের হিসেব। 

ক'দিন ধরেই অফিস কলিগ শিপ্রাদি, মাধুদি আর পুণ্যিরা লাঞ্চ টাইমে শুধুই ধন্তেরসে কে কী কিনবে, কোন গয়নার দোকানে কী অফার চলছে, সেই নিয়েই আলোচনা করে চলেছে। এইসব ডিস্কাশানের সময়ে এত মন খারাপ হয়ে যায় তুয়ার। উঠে যে চলে যাবে, সে উপায়ও নেই। কেন যে ওরা একটু সেনসিটিভ হয় না, ওরাও তো জানে তুয়ার বর্তমান পরিস্থিতি। তুয়া আর দীপ দুজনেই ঠিক করেছিল, দুই পক্ষের বাবা মা কে কোনভাবেই বিরক্ত করবে না অর্থনৈতিক সাহায্য চেয়ে, যা করার, নিজেরাই করবে। এই কদিন দিব্যি মানিয়েও নিয়েছে, চলেও যাচ্ছে। আসলে মানিয়ে নেওয়াই হচ্ছে, সাধ আহ্লাদ দুজনেই তো বিসর্জন দিয়েছে কতদিন হল। উঠতে বসতে ট্যাক্সি ছাড়া চলত না যার, সেই দীপ এখন মেট্রো, বাসে করে ক্লায়েন্ট ইনভেস্টর মিটিং করছে, বাজার করে সন্ধ্যেবেলা কুড়িটা টাকা বাঁচানোর জন্য রিক্সা না নিয়ে তুয়া হেঁটে বাড়ি ফিরছে। এডজাস্ট করেও তো চলছে, ধৈর্য ধরে চলছে বটে, কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝেই বাঁধ ভাঙ্গছে।  এই যেমন, একটা প্লে স্টেশন কেনা নিয়ে দীপকে সকাল সকাল কথা শুনিয়ে দিল ও, সত্যি তো, মানুষটা কতদিন তো নিজের জন্য কিচ্ছু কেনেনি।

আজ সকালে গয়নার দোকানের এড দেখে একটা নেকলেস ভীষণ পছন্দ হয়েছিল তুয়ার, ভেবেছিল ওই ডিজাইন দেখিয়ে পাড়ার দোকান থেকে মাসিক কিস্তিতে টাকা দিয়ে বানাবে, বড় বড় দোকানের মজুরি, ট্যাক্সের চক্করে যা আকাশছোঁয়া দাম হবে, ওর পক্ষে এফরড করা সম্ভব না এখন।  আর ঠিক তখনই দীপ বলল প্লে স্টেশন কেনার কথা, হঠাৎ করেই তাই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। এখন ভীষণ খারাপ লাগছে। না, এর একটা বিহিত করতেই হবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গে অফিস কলিগ শুভ্রকে একটা মেসেজ পাঠালো, " এই শুভ্র, প্লে ষ্টেশনের মোটামুটি ভালোর মধ্যে কোন মডেলটা কেনা যায় বলবি? তোর জামাইবাবুর জন্য সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে কিনব। এমাজনের লিঙ্ক সমেত বল।" শুভ্র ওর খুব ন্যাওটা, বছর পাঁচেকের ছোট ওর থেকে, সবে কিছু মাস হয়েছে ওদের ব্রাঞ্চে যোগ দিয়েছে। সারাক্ষণ দিদি দিদি করে যায়। খুব টেক স্যাভি, তাই ওর থেকেই যথাযথ ইনফরমেশন পাবে জেনেই ওকে মেসেজটি করেছিল তুয়া। এবং যথারীতি দশ মিনিটের মধ্যেই বাস গড়িয়াহাটের মোড়ে জ্যামে যখন দাঁড়িয়ে আছে, তখনই ওর ফোনে ঢুকল শুভ্রর মেসেজ।

অফিসে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে ডেস্কটপ খুলে অর্ডার করে দিল। ভাগ্য ভালো ছিল, ই এম আই তে টাকা দেওয়া সত্ত্বেও ফেস্টিভ অফারে সেম ডে ডেলিভারি হবে। দীপের নম্বরটা আর বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে অর্ডার প্লেস করে তবে শান্তি পেল তুয়া। এইবারেও তাহলে নেকলেসটা হল না, যাক গে, বিয়েতে কিছু গয়না পেয়েছিল, সেইগুলোও তো ভল্টে রয়েছে, নতুন কিনেই বা কী করত, না হয় পরে কোন একটা গয়না এক্সচেঞ্জ করে এই নতুন বানিয়ে নেবে। এইসব ভাবতে ভাবতে দিনের কাজ শেষ করল। ফেরার পথে রাস্তায় খুব জ্যাম পেল। আজ ধন্তেরস, পথেঘাটে খুব ভিড়, স্পেশালি গয়নার দোকানগুলির কাছে। বৌবাজার পেরোতেই বাসটার আধ ঘণ্টা লেগে গেল। ছোট বড় দোকানগুলিতে ভর সন্ধ্যেয় ক্রেতা ভর্তি, পা ফেলার জায়গা নেই। আরো একবার হতাশার নিশ্বাসটা পড়ল তুয়ার। তখনই মোবাইলে ঢুকল এমাজনের মেসেজ, পার্সেল ডেলিভারির। বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে আটটা বেজে গেল ওর। বেল বাজানোর পর মিনিট দুই কেটে যাওয়ার পর এক মুখ চওড়া হাসি সহ দরজা খুলল দীপ। যাক, প্লে স্টেশনটা পেয়ে তাহলে সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছে ও।
কিন্তু এ কী, প্যাকেজটা তো টেবিলের ওপর পড়ে আছে, খোলাও হয়নি। তাহলে?
" তুয়া, আমি ডিলটা ক্র্যাক করেছি।"
" অসাম!!! Congrats  দীপ। আই এম সো হ্যাপি ফর ইউ। "
" আই নো! আমার এতদিনের উদ্যম, চেষ্টা আজ স্বীকৃতি পেল। ভীষণ ভালো লাগছে।"
" কিন্তু তুই আমায় ফোন করে জানালি না কেন?"
" বিকজ আই ওয়ান্টেড ট সি দিস প্রেশাস স্মাইল অন ইয়োর ফেস ওয়েন আই break দিস নিউজ টু ইউ!"
" সত্যি রে দীপ। আমি খুব খুশী। আচ্ছা শোন, তাহলে তো ওই এমাজনের প্যাকেজটা একদম ডবল আনন্দ দেবে তোকে। জাস্ট খুলে দেখ! "
" দেখছি। কী আছে এতে? তুই এলে খুলব বলে আর এতক্ষণ অপেক্ষা করে আছি।"
" এবার দেখ। মনে হয় পছন্দ হবে।"
" দাঁড়া এক মিনিট। আমিও তোর জন্য একটা গিফট এনেছি। চল একসাথেই দুজনে খুলব নিজেদের গিফটস।"
" বেশ তো।"
দীপ বেডরুম থেকে ফিরল হাতে একটা গয়নার দোকানের প্যাকেট নিয়ে।
" এই নে, তোর জন্য।"
তুয়া খুলে দেখে ভিতরে ওর কদিন ধরে পছন্দ করা নেকলেসটি। আনন্দে দুই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে জলে।
" তুই কী করে জানলি...?"
" শোন, ব্যবসা করতে নেমেছি, চারিদিকে চোখ কান খোলা রাখাটা প্র্যাকটিস করতে হবে তো, নাকি? তুই মুখ ফুটে কিছু বলিসনা বলে কি আমি কিছুই বুঝিনা? ডিলটা ক্র্যাক করেছি, তাই আডভান্সের টাকাটা দিয়ে এটা তোর জন্য।"
" থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ দীপ। আই লাভ ইউ।"
" আই লাভ ইউ টু! আর হ্যাঁ, প্লে স্টেশনটার জন্যও মেনি থ্যাংকস।"
" কী করে জানলি?"
" হাম সব সমঝতে হ্যায় ম্যাডাম!"
" যতসব।"
" প্যাকেটের ওপর লেখা থাকে রে হাঁদা! ওটাই দেখেছি।"
" হুম। ব্যস, ওমনি দেখলি, আর তাই ছুটলি আমার জন্য রিটার্ন গিফট কিনতে।"
" তুয়া!!!!! তুই আর শুধরোবি না!!!"
দুজনের খুনসুটি ভরা হাসির ফোয়ারায় তখন উৎসবের আলো আরো ঝলমল করে উঠেছে।