Tuesday, February 27, 2018

টিয়ার মিশন

দূর দূর দূর। বেঁচে থেকে আর কী হবে? জীবনটার কোন মূল্যই রইলো না। একে তো ট্যুশানে ওইরকম ভাবে বেইজ্জত হতে হল স্যারের সামনে, কী না মেকানিক্সে দশের মধ্যে মাইনাস দুই এসছে টিয়ার। তার ওপর আবার মিলির সাথে ইনটু পিন্টু করতে দেখল ও শুভমকে। মরে যাই মরে যাই। ছিঃ। তাও আবার দেখাল কে না সন্ধ্যা, যাকে কিনা এমনিতেই দু চক্ষে দেখতে পারেনা টিয়া। প্রেস্টিজের এক্কেবারে গ্যামাক্সিন হয়ে গেলো। সন্ধ্যার নিশ্চয়ই এতক্ষণে দোয়েল, শিপ্রা সবাইকে ডেকে ডেকে বলা হয়ে গিয়েছে। কাল স্কুলে মুখ দেখানোর জো থাকবেনা। সরস্বতী পুজোয়, ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে বড় মুখ করে যাদের টিয়া শুভমের সাথে ডেটে যাওয়ার গল্প বলেছিল (ওমা, গল্প কেন, সত্যি সত্যিই তো ওরা সিটি সেন্টার, এক্রোপোলিস গিয়েছিলও), তাদের কাছে ইতিমধ্যেই ও হাসির খোরাক হয়ে গিয়েছে। খেতে বসেও পাতে সেই বেগুন পোড়া (যাকে আবার মা পোশাকি নামে ডাকে, বেঙ্গন ভর্তা। দূর ব্যাঙ) আর আটার রুটি। কোথায় একটু ঝাল ঝাল ডিমের কষা বানাবে, তা না। বললেই বলবে,হুহ, আজ মঙ্গলবার। আজ নিরামিষ। এই এত মঙ্গল শনি শুক্র সোম করে কী হচ্ছে? কোন আখেরটা গুছিয়েছে মা? মিছিমিছি যত অত্যাচার সইতে হয় ওকে। এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আর এমন সহ্য করা যায়না। অনেক হল। ব্যস। বেঁচে থাকা যাবেনা।
কিন্তু টিয়া মরবে কী করে? মরতে চাইলেই মরা যায় নাকি? এ তো আর পিতামহ ভীষ্ম কেস না যে ইচ্ছামৃত্যু হবে। তবে? ব্লেডে হেবি ভয় টিয়ার। রক্তারক্তি কাণ্ড ওর দ্বারা হওয়ার না। গলায় ফাঁস টাঁস দিতেও পারবেনা, হাইটেও ভয়। বাড়ির ধারেকাছে রেল লাইন নেই যে মাথা পাতবে। বড় রাস্তায় মাঝ রাতে বড় বড় লড়ি যায়, তার সামনে ঝাঁপ মারাই যায়, কিন্তু বেরোবে কী করে? বাবা যে মেইন গেটের তালার চাবি নিজের কাছে নিয়ে ঘুমোয়। ভাল্লাগেনা, সবেতেই ফেল ফেল ফেল। এই জন্যই কেউ ওকে পাত্তা দেয়না।
ইউরেকা! ঘুমের ওষুধ খেলে তো শুনেছে মরা টরা যায়। ওই যে, হেমলক সোসাইটিতে কোয়েল মল্লিককে দেখাচ্ছিল না, মাঝ রাত্রে ওষুধের দোকান থেকে অতগুলো বড়ি কিনছে। তারপর ওই আনন্দ কর রুপী পরমব্রত এসে ওকে বাঁচালো (আহা, ওর জীবনের হিরোটাও ঠিকঠাক জুটল না গো। কী পোড়া কপাল। ইচ্ছে করে বেগুন পোড়ার চেয়ে একদিন ওর কপাল পোড়া খাওয়াবে সবাইকে। হুহ!)। বাড়িতে অনেক ঘুমের ওষুধ আছে। টিয়া জানে। ঠামের রোজ রাত্রে লাগে। বাবা তো এই গত পরশু গিয়ে চিত্ত ডাক্তারের কাছ থেকে মাসের ওষুধ নিয়ে এসছে। কপাল ভালো, ঠাম এবার বড় পিসির বাড়ি যাবে দু সপ্তাহর জন্য, তাই বাবা বোধহয় বেশিদিনেরই ওষুধ এনেছে, তাই তো আনার কথা ছিল যা শুনেছিল টিয়া। ব্যস, বুড়ি ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমবে। সেই ফাঁকে গিয়ে টেবিল থেকে বড়িগুলো আনলেই হবে। ততক্ষণে গুছিয়ে একটা সুইসাইড নোট লিখে ফেলতে হবে।
আচ্ছা, সুইসাইড নোটেরও কী ফরম্যাট আছে? মানে ফর্মাল না ইনফরমাল, কোন ফরম্যাটে লিখবে? রাইটিং প্যাড নিয়ে বসে এটাই প্রথমে মাথায় এলো। কে জানে, এসব তো আর স্কুলে শেখায়না। নিকুচি করেছে স্কুল। কোন ব্যাঙ্কে কে লোন নেবে, কার কারখানায় মিস্ত্রি লাগবে, সেই সব চিঠি শেখাবে। জীবনে কাজে লাগে এসব কারুর? ফালতু এসব না করিয়ে গুছিয়ে একটা সুইসাইড নোট লেখানো শেখাত, কাজে দিত। গোগোল মামাকে জিজ্ঞেস করলেই হয়, তিনি কি না ইংরেজির মাস্টার। কিন্তু মামা ঠিক মায়ের কানে তুলবেই কথাটা। তারপর মায়ের যে রণচণ্ডী মূর্তি হবে, সে আর বলতে? অগত্যা একটু অক্ষরের হেরফের। গোগোলের জায়গায় গুগুল, মামার জায়গায় ভায়া। গুগুল ভায়া কে জিজ্ঞেস করা। অনেক লেখাপড়া করে (এত তো টিয়া ট্রিগনোমেট্রির অঙ্কেও খাটেনা) লেখা শুরু করল ও।
প্রিয় মা
না না, প্রিয় আবার কী? শ্রীচরণেষু মা।
এই রে, ষ না শ? বানান ভুল করলে মা বলেছিল পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙবে। তার চেয়ে ডিয়ার মা লিখবে? হ্যাঁ, সেই ভালো।
ডিয়ার মা
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে, ততক্ষণে আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছি। জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে কোথায় যে আমি পৌঁছে গেছি, আমিও জানিনা। শুধু এইটুকুই বলার মা, বড্ড আক্ষেপ নিয়ে গেলাম আমি। আমায় কেউ ভালোবাসেনা। বন্ধুরাও তো আজকাল হ্যাটা করে আমায়। তুমিই বা কম যাও নাকি? কবে থেকে একটু বলছি চাউমিন দিতে টিফিনে, দিয়ে যাচ্ছ ওই ব্রেড জ্যাম নয় ব্রেড মারজারিন। বাটার দিলেও নয় বুঝতাম। যাক গে। পরে কখনো কোথাও কোন জন্মে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। ভালো থেকো তোমরা।
যাই। ও সরি, আসি। আবার তো নইলে সেটা নিয়েও বকবে, "যাওন নাই, আসো গিয়া।' উফফ।
ইতি
তোমার টিয়া।
ভেবে ভেবে লিখতে লিখতে এগারোটা বেজে গেল। টিভিতে "রাঙিয়ে দিয়ে যাও"ও শেষ। এবার বন্ধ করে সবাই ঘুমোতে যাবে। টিয়া জলদি জলদি নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে " মা শুতে গেলাম। গুড নাইট" বলে মশারির মধ্যে ঢুকে গেল। বড় ঘড়িতে শুনলও বারোটার বারোটা ঢং ঢং। সাড়া বাড়ি নিঃশব্দ, শান্ত। খালি পায়ে চুপি চুপি টিয়া গেল ঠাকুমার ঘরে। রাস্তার আলোয় টেবিলটা ভালো করেই দেখা যায়। পেলও ওষুধের কৌটোটা। হ্যাঁ, ক্যালি ফস। দেখে নিলো ঠিক করে নাম। আশে পাশে এত একই দেখতে শিশি। হ্যাঁ, এটাই খায় ঠাম। আর পায় কে ওকে! ঘরে এসে, কাঁদো কাঁদো চোখে নাক ফোঁসফোঁস করতে করতে এক গ্লাস জল দিয়ে পুরো বোতলটা শেষ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। ব্যস, আর খানিকক্ষণ। এরপরেই এক গভীর শান্তি ওকে ঢেকে ফেলবে। আর কোন ঝুটঝামেলা, কূটকাচালি, ঝগড়াঝাঁটি কিচ্ছু ওকে ভাবাবে না, ঘাঁটাবে না। শান্তির চিরনিদ্রায় মগ্ন হবে টিয়া। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে। আহ, কী আরাম। আহা।
"এই টিয়া, উঠেছিস?
সকাল সাতটা বেজে গেলো, এখনো উঠিসনি কী রে? স্কুল টুল যেতে হবে না নাকি? উঠে আয় এদিকে। ঠামের ঘরে যা। কী ওষুধ খুঁজে পাচ্ছেনা বলছে। দেখ গে। আমি আর পারিনা। ধুর বাবা। কতদিক সামলাবো। মরণ দশা যত।"
যাচ্চলে। সেই ঘুম ভাঙল? মানে এই মরার অভিযানেও ফেল? চিত্ত ডাক্তার কী ভুলভাল ওষুধ দেয় যে ওতে মানুষ মরেওনা (আহা টিয়া কি আর জানে নাকি কে অতগুলো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেলে শুধু ঘুমটাই ভালো হবে, আর কিছু না?)? ধুর ধুর। কিসসু হলো না জীবনে। ধুস। তাড়াতাড়ি উঠে ডায়েরির নীচে চাপা দেওয়া চিঠিটা তুলে কুচি কুচি করে ছিঁড়ল টিয়া, ডাস্টবিনে ফেলা যাবেনা। বাই চান্স মা জননীর চোখে পড়লেই শেষ। পাতা নষ্ট করার জন্য আরেক প্রস্থ বকুনি। এর চেয়ে স্কুলে গিয়ে ফেলবে। এই ভেবে ব্যাগের ভিতরের চেনে পুড়ল কুচিগুলো।

আবার একটা দিন। আবার এক প্রস্থ মন খারাপ। বন্ধুদের টিটকিরি। ম্যাডামের বকা (অঙ্কগুলো শেষ হয়নি তো। ভেবেছিল আর ঘুম ভাঙবেনা, তাই করেওনি। সেই সময়ে বসে ফন্দী আঁটছিল, তাও আবার ফেল।), পি এন পি সি, দলাদলি।কবে যে এসব থেকে মুক্তি পাবে টিয়া। কবে বড় হবে।
যাক, আপাতত আগে ঠামের ওদিকে দেখুক ও। ওষুধের শিশিটা মনে করে ফেলল না রে টিয়া, এ বাবা। মা যেই আসবে, দেখবে। ন্যস।
সুপার ডুপার ফেল হল যে টিয়ার মিশন!!!

Saturday, February 24, 2018

তিতিরের গল্প



১।

"মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।" ঠিক এই কথাটাই বলে বুবুন বেরিয়েছিল বিয়ে করতে। কতটা মজার ছলে, কতটা পুরনো রীতি রেওয়াজ মেনে, তা ভাববার তখন সময় পাননি মানসী। শুধু হেসে বুবুনের মাথার টোপরটা ঠিক করতে গিয়ে বলেছিলেন, "ধুর, ওইসব বলতে নেই। তিতির তো আমার আদরের রাজকন্যে। তুই বল বরং, তোমার জন্য মেয়ে আনছি।" "এই দাদা, বৌদিভাই কে আবার কাকিমণি নিজের মেয়ে বলছে রে। খেয়েছে, তোরা ভাই বোন হবি নাকি?" মাঝখান থেকে ফুট কেটেছিল তুলতুল, বুবুনের জেঠতুতো বোন, যে নিজে ঘোরতর সংসারী। বুবুন কিছু উত্তর দেয়নি, হেসেছিল শুধু। ততক্ষণে যে বিয়ের লগ্ন এসে যাচ্ছে বলে তাড়া পড়ছিল জ্যাঠা কাকাদের দিক থেকে।


২।

বুবুন, তিতির আর স্বামী প্রমথেশকেকে নিয়ে মানসীর ভরা সংসার। সক্কাল থেকে সেখানে ব্যস্ততা শুরু। মানসীর স্কুল, প্রমথেশের চেম্বার, বুবুনের অফিস বেরোনোর তাড়া। আগে মানসীর ওপর সকালটা ভীষণ চাপ পড়ত, তিতির আসায় অনেকটাই যেন সুরাহা হয়েছে। বুবুনের বিয়ের আজ দেখতে দেখতে আট মাস হতে চলল। এই আট মাসে নিয়ম করে প্রতিদিন হাসি মুখে বাড়ির সব কাজ সামলে দিয়েছে তিতির। সকাল হতে না হতেই চা, তারপর টেবিলে জলখাবার পরিবেশন করা, তিনজনের মুখরোচক টিফিন প্যাক করে দেওয়া, ঠিকে লোকের ওপর তদারকি করা, এইসব কাজ নিয়ে আর মানসীকে মাথা ঘামাতেই হয়না। মানসী একটু ধীরেসুস্থে স্কুল যেতে পারে, শাড়ির প্লিটটা ঠিকঠাক ভাবে পড়ে, চুলের খোঁপাটা সাজানো হয়। ম্যাচিং ক্লিপ আর কানের দুলও ড্রেসিং টেবিল থেকে সহজেই বেরিয়ে পড়ে। সেদিন তো ওঁর বহু পুরনো কলিগ, হিস্ট্রির দিদিমণি, শিপ্রাদি মন্তব্যও করেই দিলেন, " বাবা মানসী, তুই তো আজকাল বেশ ঝাড়া হাত পা হয়ে গিয়েছিস মনে হচ্ছে। দিব্যি সেজেগুজে গুছিয়ে আসছিস। ব্যাপার কী? বৌমার সাথে কম্পিটিশন নাকি? কে কত সুন্দরী?"

" ধুর শিপ্রাদি, কী যে বলো না। মেয়ে আমার অনেক ফিটফাট। আমি সাত বুড়ির এক বুড়ি হতে গেলাম গিয়ে। ওর সাথে কীসের কম্পিটিশন। আসলে আজকাল সকালে আমার কাজ থাকেনা। তিতির পুরোটা সামলে দেয় যে। তাই সময় পাই একটু। তিরিশটা বছর ধরে তো সংসারের ঘানি টেনে গেলাম। এবার মেয়ে এসে গিয়েছে, নিশ্চিন্ত আমি। পুরো রেস্ট। নিজের মত করে উপভোগ করবো বাকি দিন কটা।"

"বেশ তো। কিন্তু হ্যাঁ, পুরো লাগাম ছাড়িস না কিন্তু। দিনের শেষে সংসারের আসল মালকিন কিন্তু তুইই। মাথায় রাখিস মানসী।" শিপ্রা তাঁর অভিজ্ঞ মতামত জানান মানসীকে। মানসী মুখে কিছু বলেন না, হাসেন।

বিকেলবেলা তিতির চায়ের কাপ হাতে মানসীর ঘরে ঢুকতে তিনি বলেন, " তিতির, আজ কী রাঁধতে দিচ্ছিস রে কমলাকে?"

" মা, আজ একটু পালং শাক করাবো ভাবছি। অনেকদিন খাওয়া হয়নি, খুব প্রিয় তো। আমাদের বাড়িতে ঠাকুমা একটা ঘণ্ট বানায়, ওটা দারুণ লাগে। আর বাজারে ভালো শাক দেখলাম। তাই। সাথে ওই পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল আর আমুদি মাছের ঝাল। ভাতটা আমি পরে করে নেবো, নইলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। "

" পালং শাক? আমরা কেউ ভালোবাসি না। ঠিক আছে, শাক কেটে রেখেছিস যখন ঠিক আছে। আজকে করা। কিন্তু এরপর থেকে জেনে নিবি সকালে আমার কাছে। সবে তো ক'মাস এসছিস। এখনো সবার পছন্দ অপছন্দ জানিস না। আস্তে আস্তে সব শিখে যাবি, জেনে নিবি। তখন আর আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগবে না। ঠিক আছে? আর হ্যাঁ মা শোন, বুবুন শাক খাবেনা। ওকে দুটো বেগুন ভেজে দিস। বা এক কাজ কর, তোদের ভাজতে হবেনা। চিনি মাখিয়ে রাখিস, আমি ভেজে দেবো। আমার হাতের রান্না বড় ভালোবাসে ছেলেটা।"

" ঠিক আছে মা।" এইটুকু বলে তিতির ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় মানসীর ঘর থেকে।


৩।


মাস চারেক কেটে গিয়েছে আরো এরপরে। মানসীর সংসার যেমন চলছিল, তেমনই চলছে। একদিন দুপুরবেলা খেয়ে উঠে তিতির ফেসবুক খুলে বসেছে, তাও অনেকদিন পর। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর নোটিফিকেশন বন্ধুদের থেকে। "কী, বিয়ে করে আমাদের ভুলেই গেলি?" "সারাক্ষণ ওই বর বর করলেই হবে?" "খালি বরের সাথেই ঘুরবি? আমাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ কি আর হবে না রে?" ইত্যাদি ইত্যাদি। একে একে সকলের প্রশ্নের উত্তর দিলো তিতির। "না না, আসলে কাজের ফাঁকে সময় হয়না তেমন। সকাল থেকে একটার পর একটা লেগেই থাকে। দুপুরে একটু লেখালিখি। আর গান শোনা, একটু গুনগুন করা। বিকেল হতেই আবার সবাই বাড়ি আসলে একটু রান্নাঘরে টুকটাক কাজ। আর কী, এইভাবেই দিন কেটে যায়। সময় হয়না রে তেমন ভাবে আর।"

"তুই ওইই করে যা। হেঁসেল ঠ্যাল। সবে পঁচিশ। এর মধ্যেই কেউ বিয়ে করে? এম ফিল করে বাড়ি বসে আছিস। মেয়েদের চাকরির যুগ এটা তিতির। এত প্রস্পেক্টিভ একটা কেরিয়ার, জলাঞ্জলি দিলি শুধুমাত্র নিজের জেদে।" প্রাণের বান্ধবী শ্রেয়া লিখল। শ্রেয়া এখন পি এইচ ডি করছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্প্যারেটিভ লিটারেচারে। ওর প্রোফাইল ভর্তি শুধুই আনন্দের টুকরো টুকরো ছবি। লেকচার, সেমিনার, পেপার পাবলিশ, ঘুরে বেড়ানো। বেশ আছে কিন্তু।

নাহ, একটু আরামের জীবন তো তিতির নিজেই চেয়েছিল। আর তাই জন্যই তো কল্যাণীতে অমন ভালো অফার পেয়েও নিলো না। এখন অন্যদের জীবন দেখে আক্ষেপ করবে না ও।


৪।


দিন কেটে যায় আপন লয়ে। তিতিরের জীবনে তেমন কোন স্রোত আসেনা। সপ্তাহান্তে সিনেমা, মাঝে মাঝে একটু আধটু শপিং, মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি। এই নিয়েই কেটে যায় দিন। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে ধুমধাম করে সেলিব্রেশন, ন্যু জিল্যান্ড বেড়াতে যাওয়ার সারপ্রাইজ এসব অবশ্য ওকে মাঝে ফেসবুকে কয়েক মাসের রসদ দিয়েছিল। এরপর আবার সেই থোড় বড়ি খাড়ার জীবন ফিরে আসে তিতিরের। মানসী এতদিনে স্কুলে হেডমিস্ট্রেস হয়েছেন, দায়িত্ব বেড়েছে। আরো পরে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু সংসারের চাবি এখনো শিপ্রার পরামর্শে ওঁরই হাতে এখনো। এই করতে করতে বিয়ের দু বছর এসে যায় দেখতে দেখতে।

" তিতির মা, এবার কিন্তু তোরা ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করতে পারিস।"

"হ্যাঁ রে তিতির। তোর আর জামাইয়ের কী কোন ইচ্ছেই নেই আমাদের নাতি নাতনির মুখ দেখানোর?"

" কী রে, বিয়ের খাওয়া অনেকদিন আগে তো খেলাম, এবার অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থাটা কর, না কি?"

"বৌদিভাই, তোমরা কি সেই ভাই বোনই রয়ে গেলে নাকি? তখন কাকিমণিকে বলেছিলাম। মেয়ে আনতে যাচ্ছি বলিয়ো না দাদাকে দিয়ে। এখন বোঝো! আরে বাবা, ভাইয়ের বিয়েতে একটা নিতবর তো চাই, নাকি?"

সাতজনের সতেরো কথা শুনতে হয় মুখ বুজে তিতিরকে। বুবুনকে বললে, পাত্তাও দেয়না। "শোনো, এখন কেরিয়ারের এমন একটা জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে, আমার পক্ষে এইসব ক্রাইসিস হ্যান্ডল করা সম্ভব না। তাছাড়া আমরা এখনো তিরিশ পেরিয়ে যাইনি। অনেক সময় আছে হাতে। এত তাড়া কী?" এই হল ওর নিয়মমাফিক উত্তর। এরপর তিতির সেই রোজ এক কথা বলে, " আসলে সবাই বলছিল খুব। আমারও এখন মনে হয়। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি। অখণ্ড অবসর। বাচ্চা মানুষ করার জন্য প্রশস্ত সময় ও পরিস্থিতি এটা।"

"সারাদিন বাড়ি বসে আছোই বা কেন বলতো? চাকরি করো না। এখনো বেশ সরকারী চাকরিগুলোতে ট্রাই করলে পেয়ে যাবে। বয়স আছে। তোমার বিদ্যে বুদ্ধি আছে। বাড়ি বসে বসে বোর হচ্ছোই বা কেন?"

"না মানে চিরকাল দেখে এলাম মা কাকি মাসিদের। চাকরি করতে করতে জমিয়ে সংসার করতে পারলনা। সারাক্ষণ একটা গিল্ট ফিলিং চলত। এই বুঝি সংসারে নজর দিলনা। আমরা ঠিক মত বড় হচ্ছিনা। আমি চাইনি এই জীবন। তাই জন্যই তো বাড়িতে বসে গুছিয়ে সংসার করবো প্ল্যান করেছিলাম।"

"তাহলে সংসার করো। এত আবদার কেন তাহলে? স্বেচ্ছায় বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছো। এখন তাহলে বোর হচ্ছি বলো না। তাছাড়া একটা বোরডম কাটানোর জন্য কেউ বাচ্চা আনে নাকি? পাগল হয়েছ? সিঙ্গল ইনকামে বাচ্চা মানুষ করা মনের মত করে, এই মুহূর্তে হবেনা বস, তুমি অপেক্ষা করো বছর দুই আরো।"

এরপর আর তিতিরের কিছুই বলার থাকেনা। বসার ঘরে সোফায় বসে চুপ করে দু চোখ বন্ধ করে থাকে। নিজের সাথে তখন এই চেয়ার, টেবিল, রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ আভেন, ফুড প্রসেসার আর ডিশ ওয়াশারের সাথে কোন পার্থক্যই বের করতে পারেনা। গাল বেয়ে বড় বড় ফোঁটা চোখের জলের জল পড়তে থাকে।

" তিতির, নটা বেজে গেলো যে। ভাতটা হয়েছে? ডাল তরকারি গরম করবি না?"

" হ্যাঁ, করছি মা।" ব্যস, কান্নারও বুঝি সময় হয়না। তোলা থাকে পরেরদিন একলা দুপুরের জন্য, জানলার গ্রিল আকড়ে।


৫।


আরো কিছু মাস কেটে যায়। সবে ফেব্রুয়ারির শেষের দিক। বাজার থেকে আজ তিতির অনেকটা কুল কিনে এনেছে। গতকাল টিভিতে কুলের আচার রান্না শেখাচ্ছিল। দেখতে দেখতে এক ছুট্টে বছর পনেরো আগের স্কুলের দিনগুলি মনে পড়ে যায় তিতিরের। স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে আচার কাকুর থেকে দুটাকা দিয়ে আমসি, কুলের আচার খাওয়ার নিষিদ্ধ আনন্দগুলি কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, যেন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, অন্য এক জগতে। রেসিপি অনুযায়ী কড়াইয়ে সবে একটু ফোড়ন দিয়েছে, ওমনি কলিং বেলের আওয়াজ পেল। এই ভর দুপুরে আবার কে আসলও, ভাবতে ভাবতে গ্যাস বন্ধ করে তিতির এগিয়ে এলো। আইহোল দিয়ে দেখল, পাশের ফ্ল্যাটে পিজি থাকা মেয়ে, সুভদ্রা।

দরজা খুলতেই, "বৌদি, তোমার কাছে একটু ধনেপাতা হবে গো? রান্না করতে করতে দেখলাম শেষ।"

" হ্যাঁ, দিচ্ছি। তুই ভিতরে এসে বস।"

খানিকক্ষণের মধ্যেই ফ্রিজ থেকে এক আঁটি ধনেপাতা হাতে নিয়ে তিতির বসার ঘরে আসতে দেখল সুভদ্রা ওর খুলে রাখা ডায়েরিটা পড়ছে।

" এই নে। আর কিছু লাগবে? কী রাঁধছিস রে?"

" থ্যাঙ্ক ইয়ু বৌদি। ওই একটু আলুর দম করছিলাম। সরি, ডায়েরিটা তোমার পারমিশান না নিয়ে উলটে পালটে দেখলাম বলে। আচ্ছা, এগুলো তোমারই লেখা তো সব?"

" হ্যাঁ রে। ওই একটু খুচখাচ যখন যা মনে আসে, কয়েক লাইন লিখে রাখি হিজিবিজি।"

" হিজিবিজি কী বলছ গো? কী গভীর চিন্তাভাবনাগুলো। আই আম সো স্পেলবাউন্ড।"

" ধ্যাত পাগল মেয়ে। তোর মনে হয় আজকাল বই পড়া কম হচ্ছে। লাইব্রেরী যা বরং। তখন এইসব হেঁজিপেঁজি লেখা পড়ার ইচ্ছেও করবেনা।"

" না বৌদি। সত্যি বলছি। পাবলিশিং হাউজে ইন্টার্নশিপ করেছি। একটু আধটু ধারণা আমারও আছে। প্লীজ চর্চা চালিয়ে যাও।"

" তুই না। পারিসও। যা রান্না কর। আমিও রান্নাঘরে যাই। আচার বানাচ্ছিলাম"

" কীসের আচার গো?"

" কুল। তুই ভালবাসিস?"

" প্রচণ্ড।"

" ঠিক আছে। আমি পাঠাবো তোকে।"

সুভদ্রা যেতে দরজা বন্ধ করে তিতির আবার রান্নাঘরে ফিরল। দশ পনেরো মিনিটও হয়নি, আবার বেল বাজল। আইহোল দিয়ে দেখল, সেই সুভদ্রা। দরজা খুলে, "আয় বস। আমি গ্যাসটা কমিয়ে আসছি।"

" না না, সময় লাগবে। আমি আসছি তোমার সাথে রান্নাঘরে। চলো।"

" আচ্ছা, আয়। বল।"

" শোনো বৌদি আমি এক্ষুনি আমার এক্স বসের সাথে কথা বলছিলাম। খুবই কাকতালীয় ব্যাপারটা। আমায় কল করেছিলেন উনিই। তা ওরা এখন কিছু নবীন লেখকদের লেখা নিয়ে একটা সঙ্কলন বানাতে চায়। আমায় জিজ্ঞেস করছিল কেউ আছে কি না চেনা জানা। তোমার কথা বলেছি।"

" এই তুই কি পাগল হলি না কি?"

" পাগলের কিচ্ছু না বৌদি। শোনো মন দিয়ে কী করতে হবে।"

" উফ। ভর দুপুরে এসছে মেয়ে যত বাজে বকতে। যা কাজ কর। ওসব শুনে আমার কোন কাজ নেই।"

" প্লীজ!"

" না, কোন প্লীজ টিজ না।"

" ভাল্লাগেনা। তোমার আচার বানাতে আর কতক্ষণ? টেস্ট করবো। খুব ভালো গন্ধ বেরোচ্ছে।"

" আরো মিনিট কুড়ি।"

" আচ্ছা, আমি বসবার ঘরে বসছি গিয়ে। এখানে খুব গরম। কী করে যে সারাক্ষণ এই গরমে দাঁড়িয়ে কাজ করো।"

" অভ্যেস রে বাবু, সব অভ্যেস। আচ্ছা তুই বস গিয়ে। আমি রেডি করে আনছি আচার।"

সেদিন সুভদ্রাকে আচার খাইয়ে তারপর বিদায় করে দরজা দিল তিতির। টেবিল থেকে কবিতার খাতাটা তুলে নিজের আলমারিতে রাখল। এরকম ফেলে ছড়িয়ে রাখা ঠিক না। যত উটকো খামখেয়ালিপনা মেয়েটার। ভাবলেও হাসি পায় তিতিরের।



৬।


দিন দশেক পর এরকমই এক দুপুরে তিতিরের মোবাইলে একটা ফোন এলো, অচেনা নম্বর। ট্রুকলারে নাম উঠল সাহানা চক্রবর্তী। কার ফোন, নির্ঘাত রঙ নাম্বার। এই ভেবে প্রথমবার ফোনটা ধরল না ও। কিন্তু ওপর দিক থেকে যিনি কল করছেন, তিনি যে নাছোড়বান্দা। পরপর তিনবার ফোন বাজতে বাজতে কেটে যাওয়ার পর তিতির একটু কৌতূহলবশত নিজেই রিং ব্যাক করল।

" হ্যালো। আমি এই নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসড কল পেলাম। আসলে ব্যস্ত ছিলাম। আপনি কে বলছেন?"

" আমি সাহানা চক্রবর্তী। আঁকিবুঁকি ম্যাগাজিনের এডিটর। আপনি তিতির ঘোষ তো?"

" হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক..."

" হ্যাঁ, না চেনারই কথা। আঁকিবুঁকি এমন কিছু বড় ব্যাপার না। সবে ফেসবুকের গণ্ডী পেরিয়ে প্রিন্টে এসছে এই কিছু মাস হল।"

" আচ্ছা। বলুন।"

" আপনার কিছু লেখা আমি সুভদ্রার থেকে পাই। সেগুলি খুব পছন্দ হয়েছে। সেখান থেকে তিনটে কবিতা বাছাই করেছি। আমাদের ম্যাগাজিনের পরবর্তী সংখ্যায় ছাপতে চাই। আপনার থেকে যেহেতু সুভদ্রা চুরি করে লেখাগুলো আমায় দিয়েছে, তাই ছাপবার আগে আপনার পারমিশান নেওয়াটা উচিত বলেই ফোন করলাম।"

তিতির চুপ। কী বলবে, ভেবে পায়না।

" হ্যালো? তিতির? শুনতে পাচ্ছেন?"

" হ্যাঁ হ্যাঁ। বলুন। আসলে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছি। তাই।"

" হুম, বুঝতে পারছই। সুভদ্রা আমায় সব বলেছে। আপনি খুবই হেজিটেট করছিলেন লেখা দেওয়া নিয়ে। আর তাই ওকে বাধ্য হয়ে আপনার ডায়েরি থেকে লেখাগুলোর ছবি তুলে আমায় পাঠাতে হল। ভাগ্যিস করেছিলও ও, নইলে অনেক রত্ন মিস হয়ে যেত আমাদের।"

" আমি সত্যি বুঝছিনা কীভাবে রিএক্ট করবো। সত্যি আমার কাছে এটা একটা বিরাট পাওনা, কখনো সিরিয়াসলি কিছু ভেবে তো লিখিনা। যখন যেমন মনে হয়, লিখি। রান্না করতে করতে, গাছগুলোতে জল দিতে দিতে কিছু মনে এলে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখি। সেগুলো যে আপনাদের এত পছন্দ হয়ে যাবে, এটা আমার একটা পরম প্রাপ্তি। আপনি নিশ্চয়ই আমার লেখা ছাপবেন। আমি কৃতজ্ঞ। ধন্য।"




৭।


আজ তিতিরের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। সন্ধ্যেবেলা থাকবে বাড়ি ভর্তি লোক। আবার একই সাথে ওর সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানও। কিন্তু সেসব তো দুপুর আর বিকেলের ব্যাপার। তার আগে এখন ওকে ছুটতে হচ্ছে ওর "বুক রিলিজ" অনুষ্ঠানে। এটা তিতিরের প্রথম কবিতার বই। ইতিমধ্যে ফেসবুকীয় সাহিত্য জগতে বড় নাম করেছে ও। তবুও, "ইশশ্রী" নিয়ে ওর খুব টেনশন, নারভাসনেস। মানসী আর সুভদ্রা সমানে ওকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। সব সময়ের মতোই। মানসী আজ তিতিরের গর্বিত মা। তিতির পারবেই। ইশশ্রী ওকে সেই প্রতিষ্ঠা এনে দেবেই যা ওর প্রাপ্য।







Thursday, February 22, 2018

দুহিতা

"জি এম!"
প্রতিদিন তিতিরের ঘুম ভাঙ্গে বাবার থেকে আসা এই মেসেজে। সকাল সাড়ে ছটার এলারম বাজার সাথে সাথেই ঘুম চোখে ফোন হাতে নিয়ে বাবার সুপ্রভাতের উত্তর লিখে তবেই দিন শুরু হয় ওর। বাবা কাছে থাকলে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। বড় আদুরে ও বাবার।  দীর্ঘ আট বছর তিতির কলকাতার বাইরে থেকেছে। প্রথমে লেখাপড়ার সূত্রে পুণায়, তারপর চাকরি সূত্রে বম্বে, মাদ্রাজ হয়ে অবশেষে এখন ব্যাঙ্গালোরে থিতু। বছরে দু তিনবার বাড়ি আসে তিতির, আর বাবা মা ওর কাছে যান দুবার। প্রতিবারই বিচ্ছেদের সময়ে চলে প্রবল কান্নাকাটি। "ধুর পাগল, এত বছর হয়ে গেলো, তাও এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কাঁদার শেষ নেই তোর। তুই কাঁদলে আমার খুব খারাপ লাগে। মন কেমন করে। কতবার বলেছি, কলকাতায় চাকরি দেখ। সেইবেলা শুনবি না।" বাবার কাছে মৃদু বকুনি খেয়েও অভ্যেস পালটায় না।
এইবারের আসাটা একটু আলাদা। আজ যে শেষবারের মত আইবুড়ো তিতির বাবার কাছ থেকে সুপ্রভাত শুনল।

আজ ওর বিয়ে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। ভোরবেলা মা মাসিরা বিয়ের নিয়ম কানুন মানা শুরু করবে বলে ওকে উঠিয়ে দিয়েছে। একটু যে বাবার কাছে শুয়ে, কাছে ঘেঁষে আদর খাবে, তার উপায় নেই। সুপ্রতীকের সাথে তিতিরের বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। এই এক বছরে ভালমতোই আলাপ পরিচয় হয়েছে দুজনের, তাও কেন জানিনা তিতিরের খুব মন খারাপ। হয়তো বাবা মা কে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে, কে জানে।
বৃদ্ধির পুজোয় বসে বাবারও বেশ মন খারাপ। চোখের সামনে নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে আজ কনের সাজে বুকের কাছে কিছু একটা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। যে মেয়েটা রান্নাবাটি খেলত এই তো সেদিন, আজ নাকি সে নিজের একটা সংসার স্থাপন করতে চলেছে। চোখ বন্ধ করলে পরিষ্কার দেখতে পান বাবা, আজকের মতোই মাথায় টোপর লাগিয়ে লাল শাড়ী পরে কনের সাজে পুতুলের মত ছোট্ট তিতির, মামার কোলে বসে প্রথম ভাত খাচ্ছে। কী খেতে না ভালোবাসে তিতির, সেই ওইটুকু বয়স থেকেই। পায়েসের চামচটা কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। আজ দেখো, বেচারি উপোস করে বসে আছে।

আরেকটু বড় হল তিতির। নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হল। নীল ফ্রক পরে প্রথম স্কুল যাচ্ছে, টলমল করতে করতে। কলকল করে সে কত কথা মেয়েটার বাড়ি এসে। স্কুলে পেরেন্টস কল। কেন? লাস্ট পিরিয়ডে বসে নাকি তিতিরের খুব কান্নাকাটি, রোজ। সে কিছুতেই ক্রেশে যাবেনা, বাড়িই আস্তে হবে। এদিকে দেখো, কীরকম আট বছর বাড়ির বাইরে রইলো। মা বাবাকে ছাড়া যে মেয়ে ঘুমোতে পারত না, দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। আজ আবার রাঙ্গা চেলীতে লাল টুক্টুক কনে বৌ সেজে চুপচাপ বসে আছে।

বাবা জানেন যে এই নতুন জীবনেও তিতির ভালো থাকবে। তবু, বাবার মন। মেয়েকে সম্প্রদান করতে বসে চোখের কোণে জল ভরে আসছিল। তিতিরও থম মেরে বসে রইল। পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা যখন তিতির আর সুপ্রতীক সবার আশীর্বাদ নিচ্ছে যাওয়ার আগে, তিতিরের চোখের জলও যেন বাধ মানছে না। সাথে বাবারও। কেন যে এমন নিয়মগুলো হয়। তিতির যাওয়ার আগে বাবার কানে বলে গেল, " কাঁদছ কেন বাবা? আমি তো বিয়ে করতে চাইনি। তুমিই তাড়া দিলে।"
" তুই এগুলো এখন বুঝবি না রে। নিজে মা হ, তখন সব বুঝবি।"
 "ভালো থেকো বাবা। সময় মেনে ওষুধগুলো খেয়ো। মা কে দেখো। জল না ঘাঁটে যেন। এমনিতেই খালি যা সর্দিকাশিতে ভোগে।" আরো কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিল ও, কান্নায় আর শেষ করতে পারল না। সুপ্রতীকের হাত ধরে "কনকাঞ্জলি"র মাধ্যমে মায়ের ঋণ শোধ করে তখন ওর যাওয়ার পালা, "নিজের বাড়ি"তে।

Wednesday, February 21, 2018

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

রান্নার তেলের বিজ্ঞাপনে পিতজাকে পিজ্জা বলা ছেলেটার আজ বিজয় দিবস।
মফঃস্বলের স্যাঁতস্যাঁতে বাংলা মিডিয়াম ক্লাসরুমে পঞ্চম শ্রেণী থেকে এ বি সি ডি শেখা ছেলেটিরও আজ বিজয় দিবস।
সদ্য শেষ হওয়া বইমেলায় যে ছেলেটির ঝুলিতে ছিল শুধুই বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আর শক্তি সুনীল জয়, আজ তারও বিজয় দিবস।
বান্ধবীকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে নিজের লেখা দু লাইন বাংলা কবিতা উপহার দিয়ে 'ছিঃ', 'যা তা', 'ক্লাসলেস' আখ্যা পাওয়া ছেলেটি, তারও আজ বিজয় দিবস।
কালো পাড় সাদা ধনেকালি পরিহিতা লম্বা বেণী ঝুলিয়ে অতুল প্রসাদ গাওয়া মেয়েটির আজ হঠাৎ পিঙ্ক ফ্লয়েডের ভিড়ে ডাক পড়বে।
হ্যারি পটার আজ একদিনের জন্য হলেও বিরাম পাবে, বইয়ের তাক থেকে ধুলো মুছে আজ বেরোবে প্রফেসর শঙ্কু।
সাউথ সিটির তিরিশ তলার বারান্দায় আজ রোদের মায়াবী প্রবেশ স্থান পাবে ফেসবুকে, "বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকনো উঠোনে ঝরে রোদ" ক্যাপশন দিয়ে। 
অভ্র রিদমিকের ডাউনলোড আজ বেড়ে যাবে।
হুজুগে পড়ে সবাই আজ দুই তিন লাইন জ্ঞানের বাণী কপচাবে যত্রতত্র।
একদল আজও বাংলাটা ঠিক আসেনা বলে মিথ্যে আক্ষেপ করবে।
আর পৃথিবীর এক প্রান্তে আজও কিছু আব্দুস, রফিক, আবুল, জব্বরেরা গুলি খাবে, প্রতিদিনের মতোই, মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে। নীরবে। নিঃশব্দে।

Saturday, February 17, 2018

বুরা না মানো, আজ হোলি হ্যায়।

হোলি হ্যায়!

উফ, আবার শুরু হলো। সবে সকাল দশটা। এর মধ্যেই গোটা কমপ্লেক্স জুড়ে লোকে লোকারণ্য। সুতপার কাছে এই দিনটা একটা বিভীষিকা। চেষ্টা করেছিল ঘরের সব দরজা জানলা বন্ধ করে এসিটা চালিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে, যতক্ষণ না এই রঙ খেলার প্রহসন শেষ হয়। মা বাবা অনেকবার করে বলেছিল ওদের সাথে মাসীর বাড়ি ভুবনেশ্বরে যেতে, যাওয়ারও কথা ছিল সুতপার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাজের দোহাই দিয়ে ছুটি ক্যান্সেল করে দিল বস।

হ্যাঁ, প্রহসনই তো বটে। সারা বছর  নোংরা দৃষ্টি দিয়ে ওকে গিলে খায় যে কয় জোড়া চোখ, হোলির দিন "বুরা না মানো, আজ হোলি হ্যায়"এর দোহাইয়ে তারাই বিনা বাধায় হাতের সুখ, মনের সুখ এক করে ফেলে। রঙ এত প্রিয় সুতপার, কিন্তু গত দু বছর ধরে যে মানসিক যন্ত্রণা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, সেই জন্যই এইবারে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে আছে ও। খুব ইচ্ছে করছিল প্রতি বছরের মতোই এবারেও ও ধবধবে সাদা সালোয়ার কামিজ পরবে, দুই হাত ভরে আবির মাখবে আর মাখাবে সমস্ত প্রিয়জনদের। কিন্তু না, ওই যে আজ, হোলি, বুরা মানা বারণ।

কলিং বেলের শব্দে সম্বিৎ ফিরল সুতপার। এই অসময়ে কে এলো আবার? আইহোল দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পেলো সেই দুই জোড়া নোংরা চোখ। ধক করে উঠল বুকটা সুতপার।
"হ্যাঁ রে মা, দরজা খোল। রঙ খেলবি না? বুরা মানলি নাকি? আজ তো হোলি রে পাগলি!"
হঠাৎই সুতপার প্রবলভাবে হোলি খেলার ইচ্ছেটা জেগে উঠল। এক ছুটে রান্নাঘর থেকে সদ্য জার্মানি থেকে ওর দাদার পাঠানো বুচার'স নাইফটা নিয়ে ছিটকিনিটায় হাত রাখল ও।

Tuesday, February 13, 2018

অন্য ভ্যালেন্টাইনস ডে

সকাল থেকেই পিয়ালের whatsapp ভরে যাচ্ছে শুধু ভ্যালেন্টাইন্স ডে মেসেজে। হয় বোন শিমুলের পাঠানো মিষ্টি মিষ্টি টেডি বিয়ার, হাতে তার ইয়া বড় লাল রঙের হার্ট শেপের বেলুন, তাতে লেখা "লাভ", নয়তো মাসীর মেয়ে মনাইয়ের পাঠানো অডিয়ো মেসেজে টকিং টমের গলায় ভ্যালেন্টাইন ডে উইশ। বান্ধবীদের গ্রুপেও জোর কদমে গত দশ দিন ধরে চলছে আজকের তোড়জোড়। কে কার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বরের সাথে কোথায় সেলিব্রেট করবে, তার হাজার হাজার প্ল্যান। নববিবাহিতা পিয়ালের কাছে সকলেরই প্রায় এক প্রশ্ন, " কী রে, আজ কী প্ল্যান? সারাদিন কী করছিস? বর কী গিফট দিলো? কোথায় বেরোচ্ছিস আজ?" ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব প্রশ্নবাণে পিয়াল জর্জরিত। হবে নাই বা কেন?

একেই পিয়াল নিজে একটু মুখচোরা। তার ওপর বিয়ে হয়েছে সবে তিন মাস। খবরের কাগজ দেখে বিয়ে। তেমন মেলামেশাও করেনি বিয়ের আগে। সুমন্ত কলেজে পড়ায়। ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে যেন রসায়নের মাস্টারের জীবনে কোন রসবোধ নেই। বিয়ের এই তিন মাসে একটা দিনও রোমান্টিক কিছুই করেনি সে। নেহাত হানিমুনের টিকিট শ্বশুরমশাই কেটে রেখেছিলেন, তাই নেহাত দুজনে মিলে একটু মুসৌরি ঘুরে এসছিল। তা সেখানে গিয়েও দুজনের একসাথে কোন ছবিই নেই। আশেপাশে যেখানে সব ট্যুরিস্ট কাপলরা মিনিটে মিনিটে রোম্যান্টিক পোজ দিয়ে ছবি তুলছে বা তোলাচ্ছে, এরা দুজনে যেন নিপাট অপরিচিতের মতো দূরত্ব রেখে রেখে দাঁড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লজ্জার মাথা খেয়ে পিয়াল তখন কিছু বলতেও পারেনি, সখ হলেও হাত ধরে হাঁটতে পারেনি, বিকেলের নরম আলোয় বরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মুগ্ধ হতে পারেনি। ওদের এলবাম দেখে ননদ ফুল্কি তো ফুট কেটেই ফেলল, " হ্যাঁ রে বৌদিভাই, তোরা বর বৌ না ভাই বোন রে?" বলেই সে কী হাসি। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে পিয়াল তখন ঘর থেকে পালাতে পারলে বাঁচে!

যদিও সুমন্ত্র থেকে কোনরকমই আশা রাখেনি পিয়াল আজকের দিনটির জন্য, কিন্তু তাও কেন জানি মনের কোণের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা হয়তো থেকেও গিয়েছিল। তাই সকাল সকাল সুমন্ত্র জন্য যখন ওর প্রিয় চিকেন স্যান্ডউইচ বানাচ্ছিল, খুব মনে হচ্ছিল এই বুঝি সুমন্ত হেসে দুটো কথা বলবে। ও মা, বাবু তখন গভীর মনযোগ দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় রাষ্ট্রনীতি পড়তে ব্যস্ত। পাশের পাতায় অঞ্জলির এত বড় বিজ্ঞাপন চোখেও পড়েনা। দুপুরে খেতে বসে রেডিয়োতে শুধুই প্রেমের গান।
 " চাহে তুম কুছ না কহো, ম্যায়নে শুন লিয়া। কে সাথই প্যার কা, মুঝে চুন লিয়া। ম্যাইনে শুন লিয়া।"  কল্পনার আকাশে তখন পিয়াল উড়ছে। মোটা ফ্রেমের চশমা ছেড়ে সুমন্ত কুল সানগ্লাস, লাল টিশার্ট পরে পুরো হিরো, পিয়ালও যশ চোপড়ার সিনেমার হিরোয়িনদের মতো শিফন শাড়িতে অপ্সরা। এসব ভাবতে ভাবতে হাতের ভাত শুকিয়ে যায়। সম্বিৎ ফেরে কলিং বেলের আওয়াজে। নির্ঘাত সুমন্ত ওর জন্য ফুলের বুকে পাঠিয়েছে। কলেজে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে। লাফাতে লাফাতে গিয়ে দরজা খুলতে যাবে, চিতপটাং! এ এক জঘন্য ব্যামো পিয়ালের, শুকনো ডাঙ্গাতেও দুমদাম পড়ে যায়। কোনোমতে উঠে, নিজেকে সামলে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে দরজাটা খুলে দেখে ক্যুরিয়ার। ব্যথার মধ্যেও এইটুকু যাও বা আশা ছিল, সব ভেঙ্গে গেল যখন চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখল এল আই সির প্রিমিয়ামের রিসিপ্ট।

ব্যথায় যন্ত্রণায় সাড়া দুপুর কাতরাতে থাকলো পিয়াল। ভোলিনি লাগিয়েছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ করেই খুব মায়ের জন্য, বাবার জন্য মন খারাপ লাগছিল। বড্ড একা বোধ হচ্ছিল। এই যদি এখন বাড়ির সবাই থাকত, কত যত্নআত্তি খাতির করতও পিয়ালের। এরকম একা একা মোটেই পড়ে থাকতে হতোনা। বাড়ির থেকে এত দূরে বিয়েটা করতেই চায়নি পিয়াল, কিন্তু মা বাবার জোরাজুরিতে শেষমেশ মত দিতে হয়েছিল। অসুস্থ শরীর, দুর্বল মন, বড্ড ভঙ্গুর। কাঁদতে কাঁদতে কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, খেয়াল নেই। দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল কখন, কে জানে। খুট করে দরজার শব্দে ধড়ফড় করে উঠল পিয়াল, উঠতে গিয়েই পায়ের ব্যথাটা জানান দিলো।
" তুমি ঠিক আছো? এই সন্ধ্যেবেলা অন্ধকার ঘরে শুয়ে। বেল বাজালাম, খুললে না। ভাগ্যিস ডুপ্লিকেট ছিল। "
সুমন্ত্র চোখে মুখে একরাশ প্রশ্ন, চিন্তা দেখে নিজেকে আর  সামলাতে পারল না পিয়াল। ভ্যা করে কেঁদেকেটে উল্টে পড়ার কথা জানালো সুমন্তকে। সুমন্ত বেচারা, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একশা। কঠিন কঠিন থারমোডাইনামিক্স ইকুয়েশন সল্ভ করতে ওস্তাদ, জীবনের এইসব ইকুয়েশন ব্যালেন্স করতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যায়। অপটু হাতে গ্যাসে গরম জল করে, হট ব্যাগে জল ভরে সেঁক দিতে থাকে। আরেক হাতে ফোন। ফ্যামিলি ডাক্তার মিত্রবাবুকে তড়িঘড়ি তলব। ডাক্তারবাবু এসে দেখেশুনে বললেন চিন্তার কারন নেই। সেঁক চলতে থাকুক। আর দরকার একটু রেস্ট। ওনাকে বিদায় করে ঘরে ঢুকে সুমন্ত বলে, " শোনো, তুমি চিন্তা করোনা। আমি কদিন ছুটি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি একদম মাটিতে পা ফেলোনা। আমি সবদিক ম্যানেজ করে দেবো। "

রান্নাবান্নায় অপটু সুমন্ত অ্যাপ দিয়ে ডিনার অর্ডার করল দুজনের। অর্ডার করতে গিয়ে টের পেল, দুজনেরই যে বড় প্রিয় চাইনিজ। বেডরুমেই বসে খেলো। খেতে বসে কারেন্ট চলে যেতে আবার "ক্যান্ডেললাইট ডিনার" হল। তারপর পায়ে সেঁক দিয়ে ভোলিনি লাগিয়ে, পেন কিলার খাইয়ে ধীরেসুস্থে ওকে শুইয়ে গায়ে চাদর ঢেকে দিলো। পিয়াল যেন আজ এক অন্য সুমন্তকে চিনছে, অবাক হয়ে তাই তাকিয়েই রইলো। এতটা যত্নশীল। হোক না সে একটু আনরোমান্টিক, কিন্তু এই যত্ন করে আপনজনের মত খেয়াল রাখা, এই বা কম কী? হবো না হবো না করেও, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কিন্তু পালন হয়েই গেল!

Sunday, February 11, 2018

কিছু প্রতিশ্রুতি।

১।

"শোন, বিয়ের পরে কিন্তু তুই চাকরিটা ছাড়বি না। আমি সব সময় তোকে সাপোর্ট করব। যাই হোক না কেনো।" অনির কথাগুলো খুব কানে বাজছে আজ দিয়ার। খানিক আগে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল যে বাড়িতে। চাকরির পোস্টিং হয়েছে দিয়ার মজফফরপুরে। শ্বশুর শাশুড়ির ঘোর আপত্তি। একটু নিজের হয়ে কথা বলার জন্য তাকিয়েছিল দিয়া অনির দিকে। বুঝেছিল, দুই বছর অনেকটাই বেশী সময়, প্রমিসগুলো ভোলার জন্য।


২।

"মা, গড প্রমিস, আমি আর কক্ষনো মিথ্যে কথা বলবো না তোমায়। প্লীজ আমায় বকো না। প্লীজ?" মা কে মিথ্যে বলে মায়ের জন্মদিনের জন্যই সারপ্রাইজ প্ল্যান করতে বেরিয়ে তাতাইয়ের মনে পড়ে গেলো সেই পনেরো বছর আগের দিনটা। মায়ের মুখে হাসি দেখার জন্য বোধহয় কিছু কিছু প্রমিস ভাঙ্গাই যায়, তাই না?


৩।

 "শুনুন পনেরোর নীচে আমি কিছুতেই রাজী হতে পারছিনা। এত রিস্কি একটা প্রসেস। বুঝতেই তো পারছেন। তাহলে দেরি করে তো লাভ নেই, শুভস্য শীঘ্রম। আগামীকালই বিকেলের দিকে নিয়ে আসুন বৌমাকে। সাল্টে দেবো।" কন্যাভ্রূণহত্যার "সুপারি" নিতে গিয়ে একবারের জন্যও ডক্টর মৈত্রর মনে পড়ল না হিপোক্রেটিক ওথের লাইনগুলি। " I will use treatment to help the sick according to my ability and judgment, but never with a view to injury and wrong-doing."


৪।

" শাইনা, বেটি তুই ঘরে ফিরে আয়। শাহাবকেও আসতে বল। আমি আর তোর আব্বু তোকে মাফ করে দিয়েছি রে। বাড়ি আয়। ধুমধাম করে নিকাহ উদযাপন করব। খুদা কসম।"
স্কুলের ধারের মাঠে যখন পরপর আব্বু, ভাইজান আর শোয়েব হকির স্টিক দিয়ে মারতে মারতে শাহাবের কপাল ফাটিয়ে দিচ্ছিল, ধুলোয় লুটিয়ে থাকা, হাত পা বাঁধা আধমরা শাইনার বারবার মনে হচ্ছিল, কেন বিশ্বাস করল আম্মির কথা, কেন শুনল না শাহাবের  সাবধানবাণী।


৫।

" স্যার, আমরা জিতবোই জিতবো আজ এই ম্যাচ, আপনি দেখবেন। আপনার এবং দেশের নাম উজ্জ্বল করবোই। আপনার হাতে বিশ্বকাপের ট্রফিটা তুলে দেবোই।" কথা রেখেছে পৃথ্বী শুভনম, মনজোত, ঈশানরা। রাহুল দ্রাবিড়ের হাতে অবশেষে উঠেছে ক্রিকেট বিশ্বকাপটি।


৬।

ফ্যামিলি গেট টুগেদারের গিয়ে সব ভাই বোনদের আড্ডা দারুন জমেছিল। বিয়ের সবে এক মাস হয়েছে তিতিরের। আনন্দবাজার দেখে বিয়ে। রোহনের সাথে এখনো তেমন বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি, যতটা ওর লাভ ম্যারেজ করা  বান্ধবীদের দেখে। ভালো লাগল যখন গল্পগাছার মধ্যে সবার সামনে রোহন তিতিরকেই ওর "বেস্ট ফ্রেন্ড" আখ্যা দিল। মনে পড়ে গেল বিয়ের সময়ে নেওয়া সাত প্রতিশ্রুতির একটা।
om prajabhyaha santu jaradastayaha", অর্থাৎ "তুমিই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, আমার ভালো মন্দ তোমার চেয়ে বেশী কেউ চায়না। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। "



x

Thursday, February 8, 2018

তুই মায়ের মতোই ভালো

ভোর ছটা বাজতে না বাজতেই তিতিরের চোখ খুলে যায় অভ্যেস মতোই। সবে ফেব্রুয়ারির শুরু, তাতেই যা গরম পড়ে গিয়েছে। তার ওপর তিনতলার ঘরটা বদ্ধ। রাত্রের ঘুমটা মনোমত হয়না। ক্লান্তি মেখেই এরপর নীচে নেমে হাত মুখ ধুয়ে বালতি করে জল ভরে শুরু হয় ওর দিনলিপি। মা মরা মেয়ে, মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছে। বাবাও কোন খোঁজখবর রাখেনা, অন্যত্র সংসার করছে জমিয়ে। দিন রাত্তির তাই মামির খোঁটা খেতে খেতে পেট ভরে তিতিরের।
এরপর চা করে সবার ঘরে ঘরে দিয়ে, জলখাবারের জোগাড় করে তবে ছুটি। অবশ্য ছুটি কি আর একে বলা চলে? কোনোমতে স্নান সেরে মুখে গতরাত্রের বেঁচে যাওয়া শুকনো রুটি বা ভাত খেয়ে ছুট ছুট। অটো চড়ার বিলাসিতার কোনদিনও সুযোগই পায়নি তিতির। কাঁধে কলেজের ব্যাগ নিয়ে কুড়ি মিনিট প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ষ্টেশনে পৌঁছে ভিড় ঠেলে কোনরকমে প্ল্যাটফর্মে আসা। আটটা দশের লোকালটা মিস করলে মুস্কিল। ফার্স্ট ক্লাসটায় লেট হলেও হতে পারে। ভিড় ট্রেনে একটা কোণে চেপ্টে দাঁড়িয়ে, তারপর ট্রেন থেকে নেমে আবার জোরে হাঁটা লাগিয়ে তিতির অবশেষে কলেজ পৌঁছয়, ঘেমে নেয়ে স্নান। চুল উস্কখুস্ক। সালোয়ারের ওড়নাটা ঠিক করে যখন ক্লাসে ঢুকে লাস্ট বেঞ্চে বসে, ততক্ষণে সহপাঠিনীদের এক প্রস্থ রূপচর্চা আর পরনিন্দা পরচর্চা হয়ে গিয়েছে। তিতিরকে দেখে আবার চাপানউতোর শুরু হয়। তিতির আর এসবে গা করেনা। ও বুঝে গিয়েছে, জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে গেলে এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামালে ওর পক্ষেই কঠিন হবে লড়াইটা।
প্রথম ক্লাস শেষ হয়। পরেরটা অফ। বাকি সবাই ছোটে ক্যান্টিনে চা খেতে, আড্ডা মারতে। তিতির গুটি গুটি পায়ে আসে লাইব্রেরীর দিকে। ব্যাগটা জমা রেখে সবে ভিতরে যেতে যাবে, এমন সময় পিছন থেকে " এই তিতির, শোন" বলে ডাক পায়। তাকিয়ে দেখে মহিম। ওরই সহপাঠী। ওর মতোই মুখচোরা। তেমনভাবে কখনো কথাবার্তা হয়ে ওঠেনি এক ক্লাসে পড়লেও।
" কিছু বলবি?"
" এই নে। এইটা খা।" বলে নিজের টিফিন বাক্সটা এগিয়ে দেয় মহিম। তিতির খুলে দেখে তাতে রয়েছে মালপোয়া আর পাটিসাপটা।
" সেদিন সকলে যখন এই নিয়ে আলোচনা করছিল ক্লাসে, তোর মুখ চোখ দেখে খুব মায়া হল। তাই মা যখন বানালো কাল, আমি তোর জন্য আলাদা করে তুলে রেখেছিলাম। "
কেউ যে ওর কথা ভাবতে পারে, এও যেন ভাবতে ভুলে গিয়েছিল তিতির। শেষ কবে কোন ছোটবেলায় মায়ের কাছে এমন যত্ন পেয়েছিল, সেসব আর প্রায় মনেই পড়েনা। মহিমের কথায় আবেগে আপ্লুত হয়ে শুধু একটা কথাই বেরোল ওর মুখ দিয়ে, " তুই মায়ের মতোই ভালো রে। "

Wednesday, February 7, 2018

কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে।

ভোরের দিকে অনেক কষ্ট করে একটু দু চোখের পাতা এক হয়েছিল। ঘুম ভাঙল পাশের বাড়ি থেকে অনিন্দ্যদার তানপুরা সহযোগে রেওয়াজের সুরে।

"ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে হারাই হারাই, সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।"

ক্লান্ত লাগছে। খুব। খবরটা শোনা ইস্তক সারারাত শুধুই এপাশ আর ওপাশ করে কাটালাম। হাজার চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করলেই সিনেমার মতো পরপর ভেসে আসছিল একটার পর একটা মুহূর্ত।

কেমিস্ট্রি ক্লাসের বাইরে আমি দাঁড়িয়ে। তুই এলি রিমার জন্য নোটস দিতে। অ্যারোমাটিক কম্পাউন্ডের সাথে সাথে তখন আমার  কিশোরী মনে যে প্রেমের সৌরভ ভেসে আসছে, তুই তো বুঝিসইনি।  তোর পরনে ছিল লাল চেক শার্ট। সেই থেকে লাল আমার প্রিয় রঙ।

উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পর পুরো গ্রুপ মিলে আমরা গেলাম নিক্কো পার্ক। সারাটাক্ষণ আমি চেষ্টা করে গেলাম তোর সাথে রাইড শেয়ার করবো। একটুর জন্য মুন রেকারে তোর পাশে বসতে পারছিলামও। ঠিক শেষ মুহূর্তে এসে পল্লবী আমায় সরিয়ে তোর পাশটায় বসে পড়ল। মন খারাপ করে সন্ধ্যেবেলা যখন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরলাম, জানলার বাইরে আমার অভিমানী লাল ওড়নাটা হাওয়ায় বেপরোয়া উড়ছে।

কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। তুই গেলি প্রেসিডেন্সি, আমি ব্রেবোরন। ফেস্টে এলো ভূমি। তোর তখনকার অন্যতম প্রিয় ব্যান্ড। সাহস করে তোকে অরকুটে মেসেজ করে জানালাম। বললি আসবি। আমি সেদিন অষ্টাদশীর ন্যায় উচ্ছ্বাসে সারা সকাল বেছে বেছে সেজেগুজে এলাম। সবাই বলেওছিল। লাল সিল্কের শাড়িটাতে আমায় নাকি দারুণ মিষ্টি লাগছিল। যথাসময়ে তুই এলি। সাথে ছিল শ্রেয়া। আমার লাল শাড়ির সাথে কন্ট্রাস্ট করে মুখটা হয়ে গেলো বেজায় কালো।

মাস্টার্স পড়তে তুই চলে গেলি বম্বে। আমি গেলাম রুড়কি। পুজোর ছুটিতে আমাদের পুরো গ্রুপটা দেখা করবে প্ল্যান হল। ম্যাডক্সে। তখন সদ্য আমি ঠাকুমাকে হারিয়েছি। মন ভালো নেই। তাও তুই আসবি বলে আমি যেতে রাজি হলাম। যাবো বলে তিনদিন আগে মায়ের সাথে দক্ষিনাপণ গিয়ে একটা লাল চুড়িদার সেট কিনেছিলাম। ঠিক মোক্ষম মুহূর্তে তুই দেবাকে মেসেজে জানালি, আসছিস না। মৃণালিনীর সাথে নর্থ ঘুরতে গিয়েছিস। আমারও সেদিন কোনোমতে কফিটা শেষ করেই খুব মাথা ধরে গেলো, ফিরে এলাম বাড়ি। সাইনাসের দোহাই দিয়ে আলো নিভিয়ে ঘরবন্দী হয়ে কাটালাম অষ্টমীর সন্ধ্যেটা।

তুই চাকরি নিয়ে গেলি হায়দ্রাবাদ। আমি দিল্লী। অফিসের কাজে এসেছি ভোপাল। হোটেলের লবিতে হঠাৎ তোর মুখোমুখি। তুই একা। সেদিন একসাথে বসে অনেক আড্ডা চলল। কাপের পর কাপ কফি। রাত্রে যে যার ঘরে ফিরলাম যখন, আমার মুখচোখে এক হাল্কা লালচে আভা। বোধহয় একেই  ব্লাশ করা বলে।

ফেসবুকে রইলো যোগাযোগ। সেখানেই একদিন দেখলাম তোর মেসেজ। বিয়ে করছিস। পাত্রী তোরই কলিগ। পাঞ্জাবী মেয়ে। খুব ধুমধাম করেও হল তোদের বিয়ে। দিল্লীতেই। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই সিমলা চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম তোদের বিয়ের এলবাম। লালে লাল। কী খুশী লাগছিল তোকে দেখতে। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন জানিস। খুব।

বলে না, সময়ের সাথে সাথে সবকিছু সহ্য হয়ে যায়, ক্ষতস্থানে প্রলেপ পড়ে যায়। আমিও ভেবেছিলাম বুঝি দেড় বছরে সব ভুলে গিয়েছি। এক তরফা ভালোবাসা। তার আর কীই বা জোর। কিন্তু না। কাল রাত্রে যখন মধুজার মেসেজ পেলাম, শুনলাম তুই খুব কষ্টে আছিস, যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছিস, নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ভীষণ ইচ্ছে করছে রে, আমার কোলে তোর মাথাটা রেখে একটু হাত বুলিয়ে দিই। চুলে বিলি কেটে দিই। আরাম পাবি না বল? আসছি রে আমি। এখুনি আসছি। প্লীজ এবার হারিয়ে যাসনা। চলে যাসনা। আসছি।



Thursday, February 1, 2018

নিজের কথা

আমি কে? ভীষণ কঠিন প্রশ্ন। এ যে ক্লাস সেভেন এইটের টাইম এন্ড ডিস্টেন্স, টাইম এন্ড হাইটের চেয়েও কঠিন। না মানে আমি অঙ্কে কাঁচা, তা কোনভাবেই বলা যায় না। মাধ্যমিকে ৯৮ (অবশ্য জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝে গিয়েছি যে পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর কেবলমাত্র নম্বরই। আর কিচ্ছুটি না।) আর উচ্চ মাধ্যমিকে ১৯৩ পেয়েছিলাম (হ্যাঁ আমি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের যখন উচ্চ মাধ্যমিক হতো একেকটা পেপার ২০০ তে। অবশ্য আমরাই ছিলাম লাস্ট ব্যাচ।)। তবুও প্রতিবার অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে একটাই কথা বলতাম, "যদি একটাও অঙ্ক ঠিক না করি? যদি সব ভুল করি? কী হবে মা? (আমার এমন বলার ভ্যালিড কারণ আছে কিন্তু। আমি হলাম গিয়ে সিলি মিস্টেক করতে ওস্তাদ। মায়ের পইপই করে বলা দেওয়া সত্ত্বেও, তিন চারবার রিভাইজ করেও ভুল খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম বুঝি ফুল মার্কস পাচ্ছি। ড্যাং ড্যাং করতে করতে সব পরীক্ষার পর বেরিয়ে বলতাম, ভালো হয়েছে। আর তারপর রেজাল্ট বেরোলে দেখা যেত এদিকে ভুল, ওদিকে ভুল। বকা খেতাম। ফার্স্ট টার্মে এই রকম হত। বকার রেশটা থাকত সেকেন্ড টার্ম অবধি। তখন এমন পড়া পড়তাম যে এক্কেবারে ক্লাস টপার। ফাইনাল টার্মে গিয়ে আবার যে কে সেই!! হি হি!!! আমি মানুষটা এরকমই। কন্সিস্টেন্সির খুব অভাব।) " কনফিডেন্সের অভাব আমার চিরকাল। এখনো গান গাইতে গেলে স্টেজে সেই চোতা নিয়ে উঠি। যদিও একবারও তাকাই না তার দিকে (তাকাবো কী? আমি তো তখন ভয়ের চোটে চোখ টোখ বন্ধ করে নিজের মনে গেয়ে চলেছি!), তাও সে সাথে না থাকলে হয়না। ভরসা পাইনা। কাজের প্রেজেন্টেশন, অত্যন্ত ইনফরমাল পরিবেশে দিতে গেলেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমাদের রিসার্চ গ্রুপে সপ্তাহে একদিন করে একেকজন স্টুডেন্টকে কাজের আপডেট দিতে হয়। আমার টার্ন আসে হয়তো তিন মাসে একবার। যেদিন আমার প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা, সেইদিন কম করে পঞ্চাশ হাজার বার বাকিদের জ্বালিয়ে মারি এই বলে, "প্লীজ, আমি প্রেজেন্ট করবো না। অন্য কেউ প্রক্সি দাও/দে।" বলা বাহুল্য, শেষমেশ আমাকেই দিতে হয়। ইদানীং মন্দ হচ্ছেনা (টাচ উড, টাচ উড! সময় ভালো যাচ্ছেনা এখন আমার এক্কেবারে। অনেক জায়গায় অনেক কিছু আটকে আছে। আর এইটুকু কাজের দিকে আর নজর লাগাতে চাইনা!)।
ও এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন যে আমি বড্ড টপিক থেকে সরে যাই? ওই যে অঙ্কের কথা বলছিলাম। ইচ্ছে ছিল তারপরে অন্য একটা কথা বলার। মানে লেখা শুরুর আগে সেরকমই ফ্লো প্ল্যান করেছিলাম। লিখতে গিয়ে ঘেঁটে গেল। যাই হোক। হ্যাঁ, অঙ্কে আমি কাঁচা না। বলেছি। কনফিডেন্স নেই। তাও বলেছি। যেটা বলিনি, সেটা হল যে এই জিনিসগুলোর সাথে রীতিমতো ঘরকন্না করতে হবে, সাথে থাকবে মেকানিক্স, সেই ভয়েই আমি জয়েন্টে কিছু একটা র‍্যাঙ্ক পেয়েও ( কলকাতার কোন বেসরকারী কলেজে অবশ্য করেই চান্স পেয়ে যেতাম ইলেক্ট্রিকাল/কেমিক্যাল/আই টি কোথাও একটা) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িনি। আমি না সূচ খুব ভয় পাই। এমনকি টিভি, সিনেমা কোথাও ইঞ্জেকশন দেখানো হচ্ছে হলেও চোখ বন্ধ করে দিই। ছোটবেলায় ম্যান্ডেটরি কিছু টীকা নিতে হয় বলে ওগুলোই শুধু নেওয়া, মরে যাবো, তাও নতুন করে ভ্যাক্সিনেশন করাবো না, এমন মানুষও ইঞ্জিনিয়ারিঙের কাউন্সেলিংএ যাবো বলে ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করিয়েছিলাম! অথচ গেলাম না। এমনই আমি। কোন স্থিরতা নেই। বায়োটেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করব বলে কষ্ট করে কেমিস্ট্রি নিয়ে বি এস সি তে ভর্তি হলাম। লেডি ব্রেবোরন কলেজে। সে তো নামেই কলেজ। আসলে আমার কারমেল স্কুলের চেয়েও বেশী ডিসিপ্লিন আর নিয়মের জাঁতাকল। বন্ধুরা সব আল্ট্রা কুল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে, আমি কিনা যাদবপুরে চান্স পেলাম না, ভীষণভাবে ডিপ্রেসনে চলে গিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ, ফার্স্ট ইয়ারে ২০০তে মোটে ৯৫ পেলাম। কোনমতে অনার্স বাঁচালাম। যে আমি আজ অবধি ৮৫'র নীচে শতাংশে নম্বর পাইনি, কলকাতা ইয়ুনিভারসিটি এসে এক্কেবারে নিজের "অউকাত" বুঝে গেলাম। ওই সময়ে একটা ভারী গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিলাম আমার বাবা আর এক স্যারের থেকে। " কষ্ট হলে কাঁদো, যত ইচ্ছে কাঁদো। কিন্তু একদিন। তারপরে উঠে পড়ে লেগে পড়ো। দেখিয়ে দাও যে তুমিও পারো। কান্নাকাটি করে আর সময় নষ্ট করোনা। " এই কথাগুলি আমি আজও অক্ষরে অক্ষরে মানি। কেমিস্ট্রি পড়তে একদম ভালো লাগত না। তাও যুদ্ধে নেমেছি, তাই শেষ দেখে ছাড়বো। এই একটা মনোভাব এক কালে খুব বেশিরকমের প্রবল ছিল। এখন বুঝেছি, মানসিক শান্তি অনেক দামী। সব লড়াই তাই worth না। অপোনেন্ট বাছি খুব ভেবেচিন্তে।
কিন্তু তা বলে আপোশ করিনা। কোন কিছু বা কাউকে অপছন্দ হলে, কারুর আচরণ আপত্তিকর লাগলে, সটান জানাই। হয় মিষ্টি করে ঠুকে দিই (খুব একটা লাভ হয়না। সেন্স অফ হ্যুমার আজকাল খুব কম লোকজনের। তাই সারকাজম বোঝে কম।), নইলে চাঁছাছোলা ভাষায় বলি। ঝগ্রুটি অপবাদ নেই বটে, কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বুমের‍্যাংএর মতো ফিরে আসি। আর নেহাত যদি দেখি যে বলেও লাভ নেই, উল্টে সময় নষ্ট, তাহলে আর কী? এনারজি বাঁচাতে সেই পদার্থ (ম্যাক্সিমাম সময়ে অবশ্য অপদার্থ) থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই। সময় কাটানোর জিনিসের তো অভাব নেই। মাথার ওপর মস্ত দায়িত্ব রয়েছে। সাড়ে চার বছর যেটার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করলাম (স্যাক্রিফাইস না তো কী? এমন ঘরকুনো মেয়ে, আবাব মায়ের আদুরে, বাবা মা কে ছাড়া থাকতে পারেনা...কিরকম বাড়ি ঘর ছেড়ে পড়ে আছি এই এত্ত দূরে! চাইলেই মায়ের হাতের রান্না খেতে পারিনা। একটু শরীর খারাপ হলে কান্নাকাটি করতে পারি না। আদর আবদার সব মেপে মেপে...স্কাইপে তো তাদের স্পর্শ পাইনা! মাঝরাত্রে প্রবল টেনশনে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাকে জড়িয়ে শুতে পারিনা। নিজে হাতে বিনুনি করতে পারিনা বলে চুলগুলো এমন উড়ণচন্ডীর মতো হয়ে থাকে। আরো অনেক কিছু। বলে শেষ করতে পারবো না। পরের ইভেন্ট এসে যাবে!) , সেই পি এইচ ডি ডিগ্রিটা পেতে হবে তো, না কি? লেখালিখি গান একটু আধটু যা করি, তার জন্যও সময় লাগে। বই পড়ার রয়েছে। আলমারি আর কিন্ডল মিলিয়ে কম করে ১২-১৪টা না পড়া বই রয়েছে। এমাজনের কার্টে আরো গোটা দশেক রাখা আছে উইশলিস্টে (এই প্রসঙ্গে বলি, অনলাইন শপিং করতে ভীষণ ভালোবাসি। এমাজন আমার সবচেয়ে প্রিয় ওয়েবসাইট)। সেই সব নিয়ে থাকবো বাবা।
ভুলভাল বলতে বলতে দেখলেন তো, অনেক কথাই কেমন জানালাম নিজেকে নিয়ে? গুছিয়ে বলিনি ঠিকই। কিন্তু বলেছি তো। আসলে আমি declutteringএ বিশ্বাস করলেও খুব একটা পারদর্শী না। হ্যাঁ, আমার ল্যাপ্টপ, ডেস্কটপের হোমস্ক্রিন এমন ফাঁকা, যে যে কেউ এসে গোল দিয়ে যাবে। কিন্তু যেই না আমার আলমারিটি খুলবেন, জিনিসপত্র (মূলত জামাকাপড়) হুড়মুড়িয়ে গায়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ফর্মাল ভাবে কথা বলতে গেলে হঠাৎ করে, পারিনা। কম করে তিন চারবার মাথার মধ্যে কাল্পনিক একটা কথোপকথন চলতেই থাকে। তবে আমি এটেম্পট নিই। আসলে কোনকিছুই দুমদাম করতে হলে বিরক্তি বোধ করি। বেশ সব কিছু প্ল্যান করে (মানে যতটা নিজের হাতে থাকে, আর কি), ভালো করে আগুপিছু ভেবেচিন্তে করতে হলে আমি খুশি হই। যে জিনিসটা নিজে বিশ্বাস করিনা, সেটা কিছুতেই অন্য একজনকে বিশ্বাস করাতেই পারিনা। লোকজন ঠকানো definitely is not my forte।
ভালবাসতে ভালোবাসি। এই বুড়ি বয়সে এসেও হুটহাট লোকজনের ওপর ক্রাশ হয়ে যায় (কিছু কিছু ক্ষণস্থায়ী। কিছু আবার বিরক্তিকরভাবে লং টার্ম।), একতরফা ভালবাসতে ওস্তাদ। খুব সহজে বিশ্বাস করি মানুষকে। ঠকি। অবশ্য করেই। তাও শিক্ষা হয়না। ভালোবেসেই যাই। বিশ্বাস করেই যাই। তাদের জন্য করেও যাই। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ভালো কাকে বাসি জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই উত্তর হবে বাবা এবং মা (নাকি মা এবং বাবা?)। নিজে কোন কিছু উপভোগ করলে, তাদের সাথে সেই এক্সপিরিয়েন্স শেয়ার না করলে, তাদেরকে সেটা না দিলে শান্তি পাইনা। উদাহরণ দিই। আমি আজকাল ছুটি কম পাওয়া হয় আর ফ্লাইটের দাম মোটামুটি সস্তা বলে, মূলত ফ্লাইটেই যাতায়াত করি। কিন্তু আমার বাবা মাকে কখনো রাজী করাতেই পারিনি প্লেনে চড়তে। আমার খুব মন কেমন করত সব সময়। প্লেনের গল্প বলতাম যখন ওদের, ওরা সব বুঝলেও ১০০ পারসেন্ট তো বুঝতো না। ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্সের আলাদা মূল্য। আর তাই এইবারে রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে যেই না সুযোগ পেলাম ওদের প্লেনে চড়ানোর, আমি নিজে যাকে বলে এক্কেরে "অন ক্লাউড নাইন"। বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, আজ না হয় তারা আমার হাত ধরে প্লেনে চাপা শিখুক। বেড়াতে ভালোবাসি আমরা তিনজনেই। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে আমরা আরো অনেক অনেক জায়গায় ঘুরবো। বড় হয়েছি, নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাদের ঘোরাবো।
আমি খুব মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসি (ওই জন্যই মনে হয় হোম সাথ সাথ হ্যায় সিনেমাটি আমার খুব প্রিয়। এতবার দেখেছি, হাতে গুনে শেষ হবেনা। মন খারাপ লাগলেই কম্প্যুটারে চালিয়ে দেখি। দিন নেই রাত নেই, যখন হোক। শাহ্রুখের কোন সিনেমাও এত বেশী দেখিনি। যদিও কভি খুশি কভি গম ক্লোজ কম্পিটিটর।)। বেশ সব কাছের মানুষগুলো আমায় ঘিরে থাকবে। শুধু মানুষ কেন, অ-মানুষগুলোও। কুকুর, বিড়াল, পাখি। সব। চাই সব প্রিয়জনদের নিয়ে একটা সুস্থ পরিবেশে থাকতে। যেখানে থাকবেনা সিরিয়ালের মতো কুটকাচালি। থাকবেনা রিয়েলিটি শোয়ের অযৌক্তিক ড্রামা। কল্পনা করতে দোষ কী? ট্যাক্স লাগেনা তো? (নাকি লাগে? আজকের বাজেটে কি কিছু এই নিয়ে কথা হলো?)