Thursday, February 8, 2018

তুই মায়ের মতোই ভালো

ভোর ছটা বাজতে না বাজতেই তিতিরের চোখ খুলে যায় অভ্যেস মতোই। সবে ফেব্রুয়ারির শুরু, তাতেই যা গরম পড়ে গিয়েছে। তার ওপর তিনতলার ঘরটা বদ্ধ। রাত্রের ঘুমটা মনোমত হয়না। ক্লান্তি মেখেই এরপর নীচে নেমে হাত মুখ ধুয়ে বালতি করে জল ভরে শুরু হয় ওর দিনলিপি। মা মরা মেয়ে, মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছে। বাবাও কোন খোঁজখবর রাখেনা, অন্যত্র সংসার করছে জমিয়ে। দিন রাত্তির তাই মামির খোঁটা খেতে খেতে পেট ভরে তিতিরের।
এরপর চা করে সবার ঘরে ঘরে দিয়ে, জলখাবারের জোগাড় করে তবে ছুটি। অবশ্য ছুটি কি আর একে বলা চলে? কোনোমতে স্নান সেরে মুখে গতরাত্রের বেঁচে যাওয়া শুকনো রুটি বা ভাত খেয়ে ছুট ছুট। অটো চড়ার বিলাসিতার কোনদিনও সুযোগই পায়নি তিতির। কাঁধে কলেজের ব্যাগ নিয়ে কুড়ি মিনিট প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ষ্টেশনে পৌঁছে ভিড় ঠেলে কোনরকমে প্ল্যাটফর্মে আসা। আটটা দশের লোকালটা মিস করলে মুস্কিল। ফার্স্ট ক্লাসটায় লেট হলেও হতে পারে। ভিড় ট্রেনে একটা কোণে চেপ্টে দাঁড়িয়ে, তারপর ট্রেন থেকে নেমে আবার জোরে হাঁটা লাগিয়ে তিতির অবশেষে কলেজ পৌঁছয়, ঘেমে নেয়ে স্নান। চুল উস্কখুস্ক। সালোয়ারের ওড়নাটা ঠিক করে যখন ক্লাসে ঢুকে লাস্ট বেঞ্চে বসে, ততক্ষণে সহপাঠিনীদের এক প্রস্থ রূপচর্চা আর পরনিন্দা পরচর্চা হয়ে গিয়েছে। তিতিরকে দেখে আবার চাপানউতোর শুরু হয়। তিতির আর এসবে গা করেনা। ও বুঝে গিয়েছে, জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে গেলে এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামালে ওর পক্ষেই কঠিন হবে লড়াইটা।
প্রথম ক্লাস শেষ হয়। পরেরটা অফ। বাকি সবাই ছোটে ক্যান্টিনে চা খেতে, আড্ডা মারতে। তিতির গুটি গুটি পায়ে আসে লাইব্রেরীর দিকে। ব্যাগটা জমা রেখে সবে ভিতরে যেতে যাবে, এমন সময় পিছন থেকে " এই তিতির, শোন" বলে ডাক পায়। তাকিয়ে দেখে মহিম। ওরই সহপাঠী। ওর মতোই মুখচোরা। তেমনভাবে কখনো কথাবার্তা হয়ে ওঠেনি এক ক্লাসে পড়লেও।
" কিছু বলবি?"
" এই নে। এইটা খা।" বলে নিজের টিফিন বাক্সটা এগিয়ে দেয় মহিম। তিতির খুলে দেখে তাতে রয়েছে মালপোয়া আর পাটিসাপটা।
" সেদিন সকলে যখন এই নিয়ে আলোচনা করছিল ক্লাসে, তোর মুখ চোখ দেখে খুব মায়া হল। তাই মা যখন বানালো কাল, আমি তোর জন্য আলাদা করে তুলে রেখেছিলাম। "
কেউ যে ওর কথা ভাবতে পারে, এও যেন ভাবতে ভুলে গিয়েছিল তিতির। শেষ কবে কোন ছোটবেলায় মায়ের কাছে এমন যত্ন পেয়েছিল, সেসব আর প্রায় মনেই পড়েনা। মহিমের কথায় আবেগে আপ্লুত হয়ে শুধু একটা কথাই বেরোল ওর মুখ দিয়ে, " তুই মায়ের মতোই ভালো রে। "

No comments:

Post a Comment