দূর দূর দূর। বেঁচে থেকে আর কী হবে? জীবনটার কোন মূল্যই রইলো না। একে তো ট্যুশানে ওইরকম ভাবে বেইজ্জত হতে
হল স্যারের সামনে, কী না মেকানিক্সে দশের মধ্যে মাইনাস দুই এসছে টিয়ার।
তার ওপর আবার মিলির সাথে ইনটু পিন্টু করতে দেখল ও শুভমকে। মরে যাই মরে যাই।
ছিঃ। তাও আবার দেখাল কে না সন্ধ্যা, যাকে কিনা এমনিতেই দু চক্ষে দেখতে
পারেনা টিয়া। প্রেস্টিজের এক্কেবারে গ্যামাক্সিন হয়ে গেলো। সন্ধ্যার
নিশ্চয়ই এতক্ষণে দোয়েল, শিপ্রা সবাইকে ডেকে ডেকে বলা হয়ে গিয়েছে। কাল
স্কুলে মুখ দেখানোর জো থাকবেনা। সরস্বতী পুজোয়, ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে বড়
মুখ করে যাদের টিয়া শুভমের সাথে ডেটে যাওয়ার গল্প বলেছিল (ওমা, গল্প কেন,
সত্যি সত্যিই তো ওরা সিটি সেন্টার, এক্রোপোলিস গিয়েছিলও), তাদের কাছে
ইতিমধ্যেই ও হাসির খোরাক হয়ে গিয়েছে। খেতে বসেও পাতে সেই বেগুন পোড়া (যাকে
আবার মা পোশাকি নামে ডাকে, বেঙ্গন ভর্তা। দূর ব্যাঙ) আর আটার রুটি। কোথায়
একটু ঝাল ঝাল ডিমের কষা বানাবে, তা না। বললেই বলবে,হুহ, আজ মঙ্গলবার। আজ
নিরামিষ। এই এত মঙ্গল শনি শুক্র সোম করে কী হচ্ছে? কোন আখেরটা গুছিয়েছে মা?
মিছিমিছি যত অত্যাচার সইতে হয় ওকে। এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আর এমন
সহ্য করা যায়না। অনেক হল। ব্যস। বেঁচে থাকা যাবেনা।
কিন্তু টিয়া মরবে কী করে? মরতে চাইলেই মরা যায় নাকি? এ তো আর পিতামহ ভীষ্ম
কেস না যে ইচ্ছামৃত্যু হবে। তবে? ব্লেডে হেবি ভয় টিয়ার। রক্তারক্তি কাণ্ড
ওর দ্বারা হওয়ার না। গলায় ফাঁস টাঁস দিতেও পারবেনা, হাইটেও ভয়। বাড়ির
ধারেকাছে রেল লাইন নেই যে মাথা পাতবে। বড় রাস্তায় মাঝ রাতে বড় বড় লড়ি যায়,
তার সামনে ঝাঁপ মারাই যায়, কিন্তু বেরোবে কী করে? বাবা যে মেইন গেটের তালার
চাবি নিজের কাছে নিয়ে ঘুমোয়। ভাল্লাগেনা, সবেতেই ফেল ফেল ফেল। এই জন্যই
কেউ ওকে পাত্তা দেয়না।
ইউরেকা! ঘুমের ওষুধ খেলে তো শুনেছে মরা টরা
যায়। ওই যে, হেমলক সোসাইটিতে কোয়েল মল্লিককে দেখাচ্ছিল না, মাঝ রাত্রে
ওষুধের দোকান থেকে অতগুলো বড়ি কিনছে। তারপর ওই আনন্দ কর রুপী পরমব্রত এসে
ওকে বাঁচালো (আহা, ওর জীবনের হিরোটাও ঠিকঠাক জুটল না গো। কী পোড়া কপাল।
ইচ্ছে করে বেগুন পোড়ার চেয়ে একদিন ওর কপাল পোড়া খাওয়াবে সবাইকে। হুহ!)।
বাড়িতে অনেক ঘুমের ওষুধ আছে। টিয়া জানে। ঠামের রোজ রাত্রে লাগে। বাবা তো এই
গত পরশু গিয়ে চিত্ত ডাক্তারের কাছ থেকে মাসের ওষুধ নিয়ে এসছে। কপাল ভালো,
ঠাম এবার বড় পিসির বাড়ি যাবে দু সপ্তাহর জন্য, তাই বাবা বোধহয় বেশিদিনেরই
ওষুধ এনেছে, তাই তো আনার কথা ছিল যা শুনেছিল টিয়া। ব্যস, বুড়ি ওষুধ খেয়ে
অঘোরে ঘুমবে। সেই ফাঁকে গিয়ে টেবিল থেকে বড়িগুলো আনলেই হবে। ততক্ষণে গুছিয়ে
একটা সুইসাইড নোট লিখে ফেলতে হবে।
আচ্ছা, সুইসাইড নোটেরও কী
ফরম্যাট আছে? মানে ফর্মাল না ইনফরমাল, কোন ফরম্যাটে লিখবে? রাইটিং প্যাড
নিয়ে বসে এটাই প্রথমে মাথায় এলো। কে জানে, এসব তো আর স্কুলে শেখায়না।
নিকুচি করেছে স্কুল। কোন ব্যাঙ্কে কে লোন নেবে, কার কারখানায় মিস্ত্রি
লাগবে, সেই সব চিঠি শেখাবে। জীবনে কাজে লাগে এসব কারুর? ফালতু এসব না করিয়ে
গুছিয়ে একটা সুইসাইড নোট লেখানো শেখাত, কাজে দিত। গোগোল মামাকে জিজ্ঞেস
করলেই হয়, তিনি কি না ইংরেজির মাস্টার। কিন্তু মামা ঠিক মায়ের কানে তুলবেই
কথাটা। তারপর মায়ের যে রণচণ্ডী মূর্তি হবে, সে আর বলতে? অগত্যা একটু
অক্ষরের হেরফের। গোগোলের জায়গায় গুগুল, মামার জায়গায় ভায়া। গুগুল ভায়া কে
জিজ্ঞেস করা। অনেক লেখাপড়া করে (এত তো টিয়া ট্রিগনোমেট্রির অঙ্কেও খাটেনা)
লেখা শুরু করল ও।
প্রিয় মা
না না, প্রিয় আবার কী? শ্রীচরণেষু মা।
এই রে, ষ না শ? বানান ভুল করলে মা বলেছিল পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙবে। তার চেয়ে ডিয়ার মা লিখবে? হ্যাঁ, সেই ভালো।
ডিয়ার মা
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে, ততক্ষণে আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছি। জীবন মরণের
সীমানা ছাড়িয়ে দূরে কোথায় যে আমি পৌঁছে গেছি, আমিও জানিনা। শুধু এইটুকুই
বলার মা, বড্ড আক্ষেপ নিয়ে গেলাম আমি। আমায় কেউ ভালোবাসেনা। বন্ধুরাও তো
আজকাল হ্যাটা করে আমায়। তুমিই বা কম যাও নাকি? কবে থেকে একটু বলছি চাউমিন
দিতে টিফিনে, দিয়ে যাচ্ছ ওই ব্রেড জ্যাম নয় ব্রেড মারজারিন। বাটার দিলেও নয়
বুঝতাম। যাক গে। পরে কখনো কোথাও কোন জন্মে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। ভালো
থেকো তোমরা।
যাই। ও সরি, আসি। আবার তো নইলে সেটা নিয়েও বকবে, "যাওন নাই, আসো গিয়া।' উফফ।
ইতি
তোমার টিয়া।
ভেবে ভেবে লিখতে লিখতে এগারোটা বেজে গেল। টিভিতে "রাঙিয়ে দিয়ে যাও"ও শেষ।
এবার বন্ধ করে সবাই ঘুমোতে যাবে। টিয়া জলদি জলদি নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে
দিয়ে " মা শুতে গেলাম। গুড নাইট" বলে মশারির মধ্যে ঢুকে গেল। বড় ঘড়িতে
শুনলও বারোটার বারোটা ঢং ঢং। সাড়া বাড়ি নিঃশব্দ, শান্ত। খালি পায়ে চুপি
চুপি টিয়া গেল ঠাকুমার ঘরে। রাস্তার আলোয় টেবিলটা ভালো করেই দেখা যায়। পেলও
ওষুধের কৌটোটা। হ্যাঁ, ক্যালি ফস। দেখে নিলো ঠিক করে নাম। আশে পাশে এত একই
দেখতে শিশি। হ্যাঁ, এটাই খায় ঠাম। আর পায় কে ওকে! ঘরে এসে, কাঁদো কাঁদো
চোখে নাক ফোঁসফোঁস করতে করতে এক গ্লাস জল দিয়ে পুরো বোতলটা শেষ করে দিয়ে
শুয়ে পড়ল। ব্যস, আর খানিকক্ষণ। এরপরেই এক গভীর শান্তি ওকে ঢেকে ফেলবে। আর
কোন ঝুটঝামেলা, কূটকাচালি, ঝগড়াঝাঁটি কিচ্ছু ওকে ভাবাবে না, ঘাঁটাবে না।
শান্তির চিরনিদ্রায় মগ্ন হবে টিয়া। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে। আহ, কী আরাম।
আহা।
"এই টিয়া, উঠেছিস?
সকাল সাতটা বেজে গেলো, এখনো উঠিসনি
কী রে? স্কুল টুল যেতে হবে না নাকি? উঠে আয় এদিকে। ঠামের ঘরে যা। কী ওষুধ
খুঁজে পাচ্ছেনা বলছে। দেখ গে। আমি আর পারিনা। ধুর বাবা। কতদিক সামলাবো। মরণ
দশা যত।"
যাচ্চলে। সেই ঘুম ভাঙল? মানে এই মরার অভিযানেও ফেল?
চিত্ত ডাক্তার কী ভুলভাল ওষুধ দেয় যে ওতে মানুষ মরেওনা (আহা টিয়া কি আর
জানে নাকি কে অতগুলো হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেলে শুধু ঘুমটাই ভালো হবে, আর কিছু
না?)? ধুর ধুর। কিসসু হলো না জীবনে। ধুস। তাড়াতাড়ি উঠে ডায়েরির নীচে চাপা
দেওয়া চিঠিটা তুলে কুচি কুচি করে ছিঁড়ল টিয়া, ডাস্টবিনে ফেলা যাবেনা। বাই
চান্স মা জননীর চোখে পড়লেই শেষ। পাতা নষ্ট করার জন্য আরেক প্রস্থ বকুনি। এর
চেয়ে স্কুলে গিয়ে ফেলবে। এই ভেবে ব্যাগের ভিতরের চেনে পুড়ল কুচিগুলো।
আবার একটা দিন। আবার এক প্রস্থ মন খারাপ। বন্ধুদের টিটকিরি। ম্যাডামের বকা
(অঙ্কগুলো শেষ হয়নি তো। ভেবেছিল আর ঘুম ভাঙবেনা, তাই করেওনি। সেই সময়ে বসে
ফন্দী আঁটছিল, তাও আবার ফেল।), পি এন পি সি, দলাদলি।কবে যে এসব থেকে
মুক্তি পাবে টিয়া। কবে বড় হবে।
যাক, আপাতত আগে ঠামের ওদিকে দেখুক ও। ওষুধের শিশিটা মনে করে ফেলল না রে টিয়া, এ বাবা। মা যেই আসবে, দেখবে। ন্যস।
সুপার ডুপার ফেল হল যে টিয়ার মিশন!!!
No comments:
Post a Comment