১।
"মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।" ঠিক এই কথাটাই বলে বুবুন বেরিয়েছিল বিয়ে করতে। কতটা মজার ছলে, কতটা পুরনো রীতি রেওয়াজ মেনে, তা ভাববার তখন সময় পাননি মানসী। শুধু হেসে বুবুনের মাথার টোপরটা ঠিক করতে গিয়ে বলেছিলেন, "ধুর, ওইসব বলতে নেই। তিতির তো আমার আদরের রাজকন্যে। তুই বল বরং, তোমার জন্য মেয়ে আনছি।" "এই দাদা, বৌদিভাই কে আবার কাকিমণি নিজের মেয়ে বলছে রে। খেয়েছে, তোরা ভাই বোন হবি নাকি?" মাঝখান থেকে ফুট কেটেছিল তুলতুল, বুবুনের জেঠতুতো বোন, যে নিজে ঘোরতর সংসারী। বুবুন কিছু উত্তর দেয়নি, হেসেছিল শুধু। ততক্ষণে যে বিয়ের লগ্ন এসে যাচ্ছে বলে তাড়া পড়ছিল জ্যাঠা কাকাদের দিক থেকে।
২।
বুবুন, তিতির আর স্বামী প্রমথেশকেকে নিয়ে মানসীর ভরা সংসার। সক্কাল থেকে সেখানে ব্যস্ততা শুরু। মানসীর স্কুল, প্রমথেশের চেম্বার, বুবুনের অফিস বেরোনোর তাড়া। আগে মানসীর ওপর সকালটা ভীষণ চাপ পড়ত, তিতির আসায় অনেকটাই যেন সুরাহা হয়েছে। বুবুনের বিয়ের আজ দেখতে দেখতে আট মাস হতে চলল। এই আট মাসে নিয়ম করে প্রতিদিন হাসি মুখে বাড়ির সব কাজ সামলে দিয়েছে তিতির। সকাল হতে না হতেই চা, তারপর টেবিলে জলখাবার পরিবেশন করা, তিনজনের মুখরোচক টিফিন প্যাক করে দেওয়া, ঠিকে লোকের ওপর তদারকি করা, এইসব কাজ নিয়ে আর মানসীকে মাথা ঘামাতেই হয়না। মানসী একটু ধীরেসুস্থে স্কুল যেতে পারে, শাড়ির প্লিটটা ঠিকঠাক ভাবে পড়ে, চুলের খোঁপাটা সাজানো হয়। ম্যাচিং ক্লিপ আর কানের দুলও ড্রেসিং টেবিল থেকে সহজেই বেরিয়ে পড়ে। সেদিন তো ওঁর বহু পুরনো কলিগ, হিস্ট্রির দিদিমণি, শিপ্রাদি মন্তব্যও করেই দিলেন, " বাবা মানসী, তুই তো আজকাল বেশ ঝাড়া হাত পা হয়ে গিয়েছিস মনে হচ্ছে। দিব্যি সেজেগুজে গুছিয়ে আসছিস। ব্যাপার কী? বৌমার সাথে কম্পিটিশন নাকি? কে কত সুন্দরী?"
" ধুর শিপ্রাদি, কী যে বলো না। মেয়ে আমার অনেক ফিটফাট। আমি সাত বুড়ির এক বুড়ি হতে গেলাম গিয়ে। ওর সাথে কীসের কম্পিটিশন। আসলে আজকাল সকালে আমার কাজ থাকেনা। তিতির পুরোটা সামলে দেয় যে। তাই সময় পাই একটু। তিরিশটা বছর ধরে তো সংসারের ঘানি টেনে গেলাম। এবার মেয়ে এসে গিয়েছে, নিশ্চিন্ত আমি। পুরো রেস্ট। নিজের মত করে উপভোগ করবো বাকি দিন কটা।"
"বেশ তো। কিন্তু হ্যাঁ, পুরো লাগাম ছাড়িস না কিন্তু। দিনের শেষে সংসারের আসল মালকিন কিন্তু তুইই। মাথায় রাখিস মানসী।" শিপ্রা তাঁর অভিজ্ঞ মতামত জানান মানসীকে। মানসী মুখে কিছু বলেন না, হাসেন।
বিকেলবেলা তিতির চায়ের কাপ হাতে মানসীর ঘরে ঢুকতে তিনি বলেন, " তিতির, আজ কী রাঁধতে দিচ্ছিস রে কমলাকে?"
" মা, আজ একটু পালং শাক করাবো ভাবছি। অনেকদিন খাওয়া হয়নি, খুব প্রিয় তো। আমাদের বাড়িতে ঠাকুমা একটা ঘণ্ট বানায়, ওটা দারুণ লাগে। আর বাজারে ভালো শাক দেখলাম। তাই। সাথে ওই পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল আর আমুদি মাছের ঝাল। ভাতটা আমি পরে করে নেবো, নইলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। "
" পালং শাক? আমরা কেউ ভালোবাসি না। ঠিক আছে, শাক কেটে রেখেছিস যখন ঠিক আছে। আজকে করা। কিন্তু এরপর থেকে জেনে নিবি সকালে আমার কাছে। সবে তো ক'মাস এসছিস। এখনো সবার পছন্দ অপছন্দ জানিস না। আস্তে আস্তে সব শিখে যাবি, জেনে নিবি। তখন আর আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগবে না। ঠিক আছে? আর হ্যাঁ মা শোন, বুবুন শাক খাবেনা। ওকে দুটো বেগুন ভেজে দিস। বা এক কাজ কর, তোদের ভাজতে হবেনা। চিনি মাখিয়ে রাখিস, আমি ভেজে দেবো। আমার হাতের রান্না বড় ভালোবাসে ছেলেটা।"
" ঠিক আছে মা।" এইটুকু বলে তিতির ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় মানসীর ঘর থেকে।
৩।
মাস চারেক কেটে গিয়েছে আরো এরপরে। মানসীর সংসার যেমন চলছিল, তেমনই চলছে। একদিন দুপুরবেলা খেয়ে উঠে তিতির ফেসবুক খুলে বসেছে, তাও অনেকদিন পর। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর নোটিফিকেশন বন্ধুদের থেকে। "কী, বিয়ে করে আমাদের ভুলেই গেলি?" "সারাক্ষণ ওই বর বর করলেই হবে?" "খালি বরের সাথেই ঘুরবি? আমাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ কি আর হবে না রে?" ইত্যাদি ইত্যাদি। একে একে সকলের প্রশ্নের উত্তর দিলো তিতির। "না না, আসলে কাজের ফাঁকে সময় হয়না তেমন। সকাল থেকে একটার পর একটা লেগেই থাকে। দুপুরে একটু লেখালিখি। আর গান শোনা, একটু গুনগুন করা। বিকেল হতেই আবার সবাই বাড়ি আসলে একটু রান্নাঘরে টুকটাক কাজ। আর কী, এইভাবেই দিন কেটে যায়। সময় হয়না রে তেমন ভাবে আর।"
"তুই ওইই করে যা। হেঁসেল ঠ্যাল। সবে পঁচিশ। এর মধ্যেই কেউ বিয়ে করে? এম ফিল করে বাড়ি বসে আছিস। মেয়েদের চাকরির যুগ এটা তিতির। এত প্রস্পেক্টিভ একটা কেরিয়ার, জলাঞ্জলি দিলি শুধুমাত্র নিজের জেদে।" প্রাণের বান্ধবী শ্রেয়া লিখল। শ্রেয়া এখন পি এইচ ডি করছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্প্যারেটিভ লিটারেচারে। ওর প্রোফাইল ভর্তি শুধুই আনন্দের টুকরো টুকরো ছবি। লেকচার, সেমিনার, পেপার পাবলিশ, ঘুরে বেড়ানো। বেশ আছে কিন্তু।
নাহ, একটু আরামের জীবন তো তিতির নিজেই চেয়েছিল। আর তাই জন্যই তো কল্যাণীতে অমন ভালো অফার পেয়েও নিলো না। এখন অন্যদের জীবন দেখে আক্ষেপ করবে না ও।
৪।
দিন কেটে যায় আপন লয়ে। তিতিরের জীবনে তেমন কোন স্রোত আসেনা। সপ্তাহান্তে সিনেমা, মাঝে মাঝে একটু আধটু শপিং, মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি। এই নিয়েই কেটে যায় দিন। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে ধুমধাম করে সেলিব্রেশন, ন্যু জিল্যান্ড বেড়াতে যাওয়ার সারপ্রাইজ এসব অবশ্য ওকে মাঝে ফেসবুকে কয়েক মাসের রসদ দিয়েছিল। এরপর আবার সেই থোড় বড়ি খাড়ার জীবন ফিরে আসে তিতিরের। মানসী এতদিনে স্কুলে হেডমিস্ট্রেস হয়েছেন, দায়িত্ব বেড়েছে। আরো পরে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু সংসারের চাবি এখনো শিপ্রার পরামর্শে ওঁরই হাতে এখনো। এই করতে করতে বিয়ের দু বছর এসে যায় দেখতে দেখতে।
" তিতির মা, এবার কিন্তু তোরা ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করতে পারিস।"
"হ্যাঁ রে তিতির। তোর আর জামাইয়ের কী কোন ইচ্ছেই নেই আমাদের নাতি নাতনির মুখ দেখানোর?"
" কী রে, বিয়ের খাওয়া অনেকদিন আগে তো খেলাম, এবার অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থাটা কর, না কি?"
"বৌদিভাই, তোমরা কি সেই ভাই বোনই রয়ে গেলে নাকি? তখন কাকিমণিকে বলেছিলাম। মেয়ে আনতে যাচ্ছি বলিয়ো না দাদাকে দিয়ে। এখন বোঝো! আরে বাবা, ভাইয়ের বিয়েতে একটা নিতবর তো চাই, নাকি?"
সাতজনের সতেরো কথা শুনতে হয় মুখ বুজে তিতিরকে। বুবুনকে বললে, পাত্তাও দেয়না। "শোনো, এখন কেরিয়ারের এমন একটা জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে, আমার পক্ষে এইসব ক্রাইসিস হ্যান্ডল করা সম্ভব না। তাছাড়া আমরা এখনো তিরিশ পেরিয়ে যাইনি। অনেক সময় আছে হাতে। এত তাড়া কী?" এই হল ওর নিয়মমাফিক উত্তর। এরপর তিতির সেই রোজ এক কথা বলে, " আসলে সবাই বলছিল খুব। আমারও এখন মনে হয়। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি। অখণ্ড অবসর। বাচ্চা মানুষ করার জন্য প্রশস্ত সময় ও পরিস্থিতি এটা।"
"সারাদিন বাড়ি বসে আছোই বা কেন বলতো? চাকরি করো না। এখনো বেশ সরকারী চাকরিগুলোতে ট্রাই করলে পেয়ে যাবে। বয়স আছে। তোমার বিদ্যে বুদ্ধি আছে। বাড়ি বসে বসে বোর হচ্ছোই বা কেন?"
"না মানে চিরকাল দেখে এলাম মা কাকি মাসিদের। চাকরি করতে করতে জমিয়ে সংসার করতে পারলনা। সারাক্ষণ একটা গিল্ট ফিলিং চলত। এই বুঝি সংসারে নজর দিলনা। আমরা ঠিক মত বড় হচ্ছিনা। আমি চাইনি এই জীবন। তাই জন্যই তো বাড়িতে বসে গুছিয়ে সংসার করবো প্ল্যান করেছিলাম।"
"তাহলে সংসার করো। এত আবদার কেন তাহলে? স্বেচ্ছায় বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছো। এখন তাহলে বোর হচ্ছি বলো না। তাছাড়া একটা বোরডম কাটানোর জন্য কেউ বাচ্চা আনে নাকি? পাগল হয়েছ? সিঙ্গল ইনকামে বাচ্চা মানুষ করা মনের মত করে, এই মুহূর্তে হবেনা বস, তুমি অপেক্ষা করো বছর দুই আরো।"
এরপর আর তিতিরের কিছুই বলার থাকেনা। বসার ঘরে সোফায় বসে চুপ করে দু চোখ বন্ধ করে থাকে। নিজের সাথে তখন এই চেয়ার, টেবিল, রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ আভেন, ফুড প্রসেসার আর ডিশ ওয়াশারের সাথে কোন পার্থক্যই বের করতে পারেনা। গাল বেয়ে বড় বড় ফোঁটা চোখের জলের জল পড়তে থাকে।
" তিতির, নটা বেজে গেলো যে। ভাতটা হয়েছে? ডাল তরকারি গরম করবি না?"
" হ্যাঁ, করছি মা।" ব্যস, কান্নারও বুঝি সময় হয়না। তোলা থাকে পরেরদিন একলা দুপুরের জন্য, জানলার গ্রিল আকড়ে।
৫।
আরো কিছু মাস কেটে যায়। সবে ফেব্রুয়ারির শেষের দিক। বাজার থেকে আজ তিতির অনেকটা কুল কিনে এনেছে। গতকাল টিভিতে কুলের আচার রান্না শেখাচ্ছিল। দেখতে দেখতে এক ছুট্টে বছর পনেরো আগের স্কুলের দিনগুলি মনে পড়ে যায় তিতিরের। স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে আচার কাকুর থেকে দুটাকা দিয়ে আমসি, কুলের আচার খাওয়ার নিষিদ্ধ আনন্দগুলি কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, যেন তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, অন্য এক জগতে। রেসিপি অনুযায়ী কড়াইয়ে সবে একটু ফোড়ন দিয়েছে, ওমনি কলিং বেলের আওয়াজ পেল। এই ভর দুপুরে আবার কে আসলও, ভাবতে ভাবতে গ্যাস বন্ধ করে তিতির এগিয়ে এলো। আইহোল দিয়ে দেখল, পাশের ফ্ল্যাটে পিজি থাকা মেয়ে, সুভদ্রা।
দরজা খুলতেই, "বৌদি, তোমার কাছে একটু ধনেপাতা হবে গো? রান্না করতে করতে দেখলাম শেষ।"
" হ্যাঁ, দিচ্ছি। তুই ভিতরে এসে বস।"
খানিকক্ষণের মধ্যেই ফ্রিজ থেকে এক আঁটি ধনেপাতা হাতে নিয়ে তিতির বসার ঘরে আসতে দেখল সুভদ্রা ওর খুলে রাখা ডায়েরিটা পড়ছে।
" এই নে। আর কিছু লাগবে? কী রাঁধছিস রে?"
" থ্যাঙ্ক ইয়ু বৌদি। ওই একটু আলুর দম করছিলাম। সরি, ডায়েরিটা তোমার পারমিশান না নিয়ে উলটে পালটে দেখলাম বলে। আচ্ছা, এগুলো তোমারই লেখা তো সব?"
" হ্যাঁ রে। ওই একটু খুচখাচ যখন যা মনে আসে, কয়েক লাইন লিখে রাখি হিজিবিজি।"
" হিজিবিজি কী বলছ গো? কী গভীর চিন্তাভাবনাগুলো। আই আম সো স্পেলবাউন্ড।"
" ধ্যাত পাগল মেয়ে। তোর মনে হয় আজকাল বই পড়া কম হচ্ছে। লাইব্রেরী যা বরং। তখন এইসব হেঁজিপেঁজি লেখা পড়ার ইচ্ছেও করবেনা।"
" না বৌদি। সত্যি বলছি। পাবলিশিং হাউজে ইন্টার্নশিপ করেছি। একটু আধটু ধারণা আমারও আছে। প্লীজ চর্চা চালিয়ে যাও।"
" তুই না। পারিসও। যা রান্না কর। আমিও রান্নাঘরে যাই। আচার বানাচ্ছিলাম"
" কীসের আচার গো?"
" কুল। তুই ভালবাসিস?"
" প্রচণ্ড।"
" ঠিক আছে। আমি পাঠাবো তোকে।"
সুভদ্রা যেতে দরজা বন্ধ করে তিতির আবার রান্নাঘরে ফিরল। দশ পনেরো মিনিটও হয়নি, আবার বেল বাজল। আইহোল দিয়ে দেখল, সেই সুভদ্রা। দরজা খুলে, "আয় বস। আমি গ্যাসটা কমিয়ে আসছি।"
" না না, সময় লাগবে। আমি আসছি তোমার সাথে রান্নাঘরে। চলো।"
" আচ্ছা, আয়। বল।"
" শোনো বৌদি আমি এক্ষুনি আমার এক্স বসের সাথে কথা বলছিলাম। খুবই কাকতালীয় ব্যাপারটা। আমায় কল করেছিলেন উনিই। তা ওরা এখন কিছু নবীন লেখকদের লেখা নিয়ে একটা সঙ্কলন বানাতে চায়। আমায় জিজ্ঞেস করছিল কেউ আছে কি না চেনা জানা। তোমার কথা বলেছি।"
" এই তুই কি পাগল হলি না কি?"
" পাগলের কিচ্ছু না বৌদি। শোনো মন দিয়ে কী করতে হবে।"
" উফ। ভর দুপুরে এসছে মেয়ে যত বাজে বকতে। যা কাজ কর। ওসব শুনে আমার কোন কাজ নেই।"
" প্লীজ!"
" না, কোন প্লীজ টিজ না।"
" ভাল্লাগেনা। তোমার আচার বানাতে আর কতক্ষণ? টেস্ট করবো। খুব ভালো গন্ধ বেরোচ্ছে।"
" আরো মিনিট কুড়ি।"
" আচ্ছা, আমি বসবার ঘরে বসছি গিয়ে। এখানে খুব গরম। কী করে যে সারাক্ষণ এই গরমে দাঁড়িয়ে কাজ করো।"
" অভ্যেস রে বাবু, সব অভ্যেস। আচ্ছা তুই বস গিয়ে। আমি রেডি করে আনছি আচার।"
সেদিন সুভদ্রাকে আচার খাইয়ে তারপর বিদায় করে দরজা দিল তিতির। টেবিল থেকে কবিতার খাতাটা তুলে নিজের আলমারিতে রাখল। এরকম ফেলে ছড়িয়ে রাখা ঠিক না। যত উটকো খামখেয়ালিপনা মেয়েটার। ভাবলেও হাসি পায় তিতিরের।
৬।
দিন দশেক পর এরকমই এক দুপুরে তিতিরের মোবাইলে একটা ফোন এলো, অচেনা নম্বর। ট্রুকলারে নাম উঠল সাহানা চক্রবর্তী। কার ফোন, নির্ঘাত রঙ নাম্বার। এই ভেবে প্রথমবার ফোনটা ধরল না ও। কিন্তু ওপর দিক থেকে যিনি কল করছেন, তিনি যে নাছোড়বান্দা। পরপর তিনবার ফোন বাজতে বাজতে কেটে যাওয়ার পর তিতির একটু কৌতূহলবশত নিজেই রিং ব্যাক করল।
" হ্যালো। আমি এই নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসড কল পেলাম। আসলে ব্যস্ত ছিলাম। আপনি কে বলছেন?"
" আমি সাহানা চক্রবর্তী। আঁকিবুঁকি ম্যাগাজিনের এডিটর। আপনি তিতির ঘোষ তো?"
" হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক..."
" হ্যাঁ, না চেনারই কথা। আঁকিবুঁকি এমন কিছু বড় ব্যাপার না। সবে ফেসবুকের গণ্ডী পেরিয়ে প্রিন্টে এসছে এই কিছু মাস হল।"
" আচ্ছা। বলুন।"
" আপনার কিছু লেখা আমি সুভদ্রার থেকে পাই। সেগুলি খুব পছন্দ হয়েছে। সেখান থেকে তিনটে কবিতা বাছাই করেছি। আমাদের ম্যাগাজিনের পরবর্তী সংখ্যায় ছাপতে চাই। আপনার থেকে যেহেতু সুভদ্রা চুরি করে লেখাগুলো আমায় দিয়েছে, তাই ছাপবার আগে আপনার পারমিশান নেওয়াটা উচিত বলেই ফোন করলাম।"
তিতির চুপ। কী বলবে, ভেবে পায়না।
" হ্যালো? তিতির? শুনতে পাচ্ছেন?"
" হ্যাঁ হ্যাঁ। বলুন। আসলে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছি। তাই।"
" হুম, বুঝতে পারছই। সুভদ্রা আমায় সব বলেছে। আপনি খুবই হেজিটেট করছিলেন লেখা দেওয়া নিয়ে। আর তাই ওকে বাধ্য হয়ে আপনার ডায়েরি থেকে লেখাগুলোর ছবি তুলে আমায় পাঠাতে হল। ভাগ্যিস করেছিলও ও, নইলে অনেক রত্ন মিস হয়ে যেত আমাদের।"
" আমি সত্যি বুঝছিনা কীভাবে রিএক্ট করবো। সত্যি আমার কাছে এটা একটা বিরাট পাওনা, কখনো সিরিয়াসলি কিছু ভেবে তো লিখিনা। যখন যেমন মনে হয়, লিখি। রান্না করতে করতে, গাছগুলোতে জল দিতে দিতে কিছু মনে এলে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখি। সেগুলো যে আপনাদের এত পছন্দ হয়ে যাবে, এটা আমার একটা পরম প্রাপ্তি। আপনি নিশ্চয়ই আমার লেখা ছাপবেন। আমি কৃতজ্ঞ। ধন্য।"
৭।
আজ তিতিরের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। সন্ধ্যেবেলা থাকবে বাড়ি ভর্তি লোক। আবার একই সাথে ওর সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানও। কিন্তু সেসব তো দুপুর আর বিকেলের ব্যাপার। তার আগে এখন ওকে ছুটতে হচ্ছে ওর "বুক রিলিজ" অনুষ্ঠানে। এটা তিতিরের প্রথম কবিতার বই। ইতিমধ্যে ফেসবুকীয় সাহিত্য জগতে বড় নাম করেছে ও। তবুও, "ইশশ্রী" নিয়ে ওর খুব টেনশন, নারভাসনেস। মানসী আর সুভদ্রা সমানে ওকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। সব সময়ের মতোই। মানসী আজ তিতিরের গর্বিত মা। তিতির পারবেই। ইশশ্রী ওকে সেই প্রতিষ্ঠা এনে দেবেই যা ওর প্রাপ্য।
No comments:
Post a Comment