Thursday, February 1, 2018

নিজের কথা

আমি কে? ভীষণ কঠিন প্রশ্ন। এ যে ক্লাস সেভেন এইটের টাইম এন্ড ডিস্টেন্স, টাইম এন্ড হাইটের চেয়েও কঠিন। না মানে আমি অঙ্কে কাঁচা, তা কোনভাবেই বলা যায় না। মাধ্যমিকে ৯৮ (অবশ্য জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝে গিয়েছি যে পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর কেবলমাত্র নম্বরই। আর কিচ্ছুটি না।) আর উচ্চ মাধ্যমিকে ১৯৩ পেয়েছিলাম (হ্যাঁ আমি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের যখন উচ্চ মাধ্যমিক হতো একেকটা পেপার ২০০ তে। অবশ্য আমরাই ছিলাম লাস্ট ব্যাচ।)। তবুও প্রতিবার অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে একটাই কথা বলতাম, "যদি একটাও অঙ্ক ঠিক না করি? যদি সব ভুল করি? কী হবে মা? (আমার এমন বলার ভ্যালিড কারণ আছে কিন্তু। আমি হলাম গিয়ে সিলি মিস্টেক করতে ওস্তাদ। মায়ের পইপই করে বলা দেওয়া সত্ত্বেও, তিন চারবার রিভাইজ করেও ভুল খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম বুঝি ফুল মার্কস পাচ্ছি। ড্যাং ড্যাং করতে করতে সব পরীক্ষার পর বেরিয়ে বলতাম, ভালো হয়েছে। আর তারপর রেজাল্ট বেরোলে দেখা যেত এদিকে ভুল, ওদিকে ভুল। বকা খেতাম। ফার্স্ট টার্মে এই রকম হত। বকার রেশটা থাকত সেকেন্ড টার্ম অবধি। তখন এমন পড়া পড়তাম যে এক্কেবারে ক্লাস টপার। ফাইনাল টার্মে গিয়ে আবার যে কে সেই!! হি হি!!! আমি মানুষটা এরকমই। কন্সিস্টেন্সির খুব অভাব।) " কনফিডেন্সের অভাব আমার চিরকাল। এখনো গান গাইতে গেলে স্টেজে সেই চোতা নিয়ে উঠি। যদিও একবারও তাকাই না তার দিকে (তাকাবো কী? আমি তো তখন ভয়ের চোটে চোখ টোখ বন্ধ করে নিজের মনে গেয়ে চলেছি!), তাও সে সাথে না থাকলে হয়না। ভরসা পাইনা। কাজের প্রেজেন্টেশন, অত্যন্ত ইনফরমাল পরিবেশে দিতে গেলেও হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমাদের রিসার্চ গ্রুপে সপ্তাহে একদিন করে একেকজন স্টুডেন্টকে কাজের আপডেট দিতে হয়। আমার টার্ন আসে হয়তো তিন মাসে একবার। যেদিন আমার প্রেজেন্টেশন দেওয়ার কথা, সেইদিন কম করে পঞ্চাশ হাজার বার বাকিদের জ্বালিয়ে মারি এই বলে, "প্লীজ, আমি প্রেজেন্ট করবো না। অন্য কেউ প্রক্সি দাও/দে।" বলা বাহুল্য, শেষমেশ আমাকেই দিতে হয়। ইদানীং মন্দ হচ্ছেনা (টাচ উড, টাচ উড! সময় ভালো যাচ্ছেনা এখন আমার এক্কেবারে। অনেক জায়গায় অনেক কিছু আটকে আছে। আর এইটুকু কাজের দিকে আর নজর লাগাতে চাইনা!)।
ও এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন যে আমি বড্ড টপিক থেকে সরে যাই? ওই যে অঙ্কের কথা বলছিলাম। ইচ্ছে ছিল তারপরে অন্য একটা কথা বলার। মানে লেখা শুরুর আগে সেরকমই ফ্লো প্ল্যান করেছিলাম। লিখতে গিয়ে ঘেঁটে গেল। যাই হোক। হ্যাঁ, অঙ্কে আমি কাঁচা না। বলেছি। কনফিডেন্স নেই। তাও বলেছি। যেটা বলিনি, সেটা হল যে এই জিনিসগুলোর সাথে রীতিমতো ঘরকন্না করতে হবে, সাথে থাকবে মেকানিক্স, সেই ভয়েই আমি জয়েন্টে কিছু একটা র‍্যাঙ্ক পেয়েও ( কলকাতার কোন বেসরকারী কলেজে অবশ্য করেই চান্স পেয়ে যেতাম ইলেক্ট্রিকাল/কেমিক্যাল/আই টি কোথাও একটা) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িনি। আমি না সূচ খুব ভয় পাই। এমনকি টিভি, সিনেমা কোথাও ইঞ্জেকশন দেখানো হচ্ছে হলেও চোখ বন্ধ করে দিই। ছোটবেলায় ম্যান্ডেটরি কিছু টীকা নিতে হয় বলে ওগুলোই শুধু নেওয়া, মরে যাবো, তাও নতুন করে ভ্যাক্সিনেশন করাবো না, এমন মানুষও ইঞ্জিনিয়ারিঙের কাউন্সেলিংএ যাবো বলে ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করিয়েছিলাম! অথচ গেলাম না। এমনই আমি। কোন স্থিরতা নেই। বায়োটেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করব বলে কষ্ট করে কেমিস্ট্রি নিয়ে বি এস সি তে ভর্তি হলাম। লেডি ব্রেবোরন কলেজে। সে তো নামেই কলেজ। আসলে আমার কারমেল স্কুলের চেয়েও বেশী ডিসিপ্লিন আর নিয়মের জাঁতাকল। বন্ধুরা সব আল্ট্রা কুল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, প্রেসিডেন্সিতে পড়ছে, আমি কিনা যাদবপুরে চান্স পেলাম না, ভীষণভাবে ডিপ্রেসনে চলে গিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ, ফার্স্ট ইয়ারে ২০০তে মোটে ৯৫ পেলাম। কোনমতে অনার্স বাঁচালাম। যে আমি আজ অবধি ৮৫'র নীচে শতাংশে নম্বর পাইনি, কলকাতা ইয়ুনিভারসিটি এসে এক্কেবারে নিজের "অউকাত" বুঝে গেলাম। ওই সময়ে একটা ভারী গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিলাম আমার বাবা আর এক স্যারের থেকে। " কষ্ট হলে কাঁদো, যত ইচ্ছে কাঁদো। কিন্তু একদিন। তারপরে উঠে পড়ে লেগে পড়ো। দেখিয়ে দাও যে তুমিও পারো। কান্নাকাটি করে আর সময় নষ্ট করোনা। " এই কথাগুলি আমি আজও অক্ষরে অক্ষরে মানি। কেমিস্ট্রি পড়তে একদম ভালো লাগত না। তাও যুদ্ধে নেমেছি, তাই শেষ দেখে ছাড়বো। এই একটা মনোভাব এক কালে খুব বেশিরকমের প্রবল ছিল। এখন বুঝেছি, মানসিক শান্তি অনেক দামী। সব লড়াই তাই worth না। অপোনেন্ট বাছি খুব ভেবেচিন্তে।
কিন্তু তা বলে আপোশ করিনা। কোন কিছু বা কাউকে অপছন্দ হলে, কারুর আচরণ আপত্তিকর লাগলে, সটান জানাই। হয় মিষ্টি করে ঠুকে দিই (খুব একটা লাভ হয়না। সেন্স অফ হ্যুমার আজকাল খুব কম লোকজনের। তাই সারকাজম বোঝে কম।), নইলে চাঁছাছোলা ভাষায় বলি। ঝগ্রুটি অপবাদ নেই বটে, কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বুমের‍্যাংএর মতো ফিরে আসি। আর নেহাত যদি দেখি যে বলেও লাভ নেই, উল্টে সময় নষ্ট, তাহলে আর কী? এনারজি বাঁচাতে সেই পদার্থ (ম্যাক্সিমাম সময়ে অবশ্য অপদার্থ) থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই। সময় কাটানোর জিনিসের তো অভাব নেই। মাথার ওপর মস্ত দায়িত্ব রয়েছে। সাড়ে চার বছর যেটার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করলাম (স্যাক্রিফাইস না তো কী? এমন ঘরকুনো মেয়ে, আবাব মায়ের আদুরে, বাবা মা কে ছাড়া থাকতে পারেনা...কিরকম বাড়ি ঘর ছেড়ে পড়ে আছি এই এত্ত দূরে! চাইলেই মায়ের হাতের রান্না খেতে পারিনা। একটু শরীর খারাপ হলে কান্নাকাটি করতে পারি না। আদর আবদার সব মেপে মেপে...স্কাইপে তো তাদের স্পর্শ পাইনা! মাঝরাত্রে প্রবল টেনশনে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাকে জড়িয়ে শুতে পারিনা। নিজে হাতে বিনুনি করতে পারিনা বলে চুলগুলো এমন উড়ণচন্ডীর মতো হয়ে থাকে। আরো অনেক কিছু। বলে শেষ করতে পারবো না। পরের ইভেন্ট এসে যাবে!) , সেই পি এইচ ডি ডিগ্রিটা পেতে হবে তো, না কি? লেখালিখি গান একটু আধটু যা করি, তার জন্যও সময় লাগে। বই পড়ার রয়েছে। আলমারি আর কিন্ডল মিলিয়ে কম করে ১২-১৪টা না পড়া বই রয়েছে। এমাজনের কার্টে আরো গোটা দশেক রাখা আছে উইশলিস্টে (এই প্রসঙ্গে বলি, অনলাইন শপিং করতে ভীষণ ভালোবাসি। এমাজন আমার সবচেয়ে প্রিয় ওয়েবসাইট)। সেই সব নিয়ে থাকবো বাবা।
ভুলভাল বলতে বলতে দেখলেন তো, অনেক কথাই কেমন জানালাম নিজেকে নিয়ে? গুছিয়ে বলিনি ঠিকই। কিন্তু বলেছি তো। আসলে আমি declutteringএ বিশ্বাস করলেও খুব একটা পারদর্শী না। হ্যাঁ, আমার ল্যাপ্টপ, ডেস্কটপের হোমস্ক্রিন এমন ফাঁকা, যে যে কেউ এসে গোল দিয়ে যাবে। কিন্তু যেই না আমার আলমারিটি খুলবেন, জিনিসপত্র (মূলত জামাকাপড়) হুড়মুড়িয়ে গায়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ফর্মাল ভাবে কথা বলতে গেলে হঠাৎ করে, পারিনা। কম করে তিন চারবার মাথার মধ্যে কাল্পনিক একটা কথোপকথন চলতেই থাকে। তবে আমি এটেম্পট নিই। আসলে কোনকিছুই দুমদাম করতে হলে বিরক্তি বোধ করি। বেশ সব কিছু প্ল্যান করে (মানে যতটা নিজের হাতে থাকে, আর কি), ভালো করে আগুপিছু ভেবেচিন্তে করতে হলে আমি খুশি হই। যে জিনিসটা নিজে বিশ্বাস করিনা, সেটা কিছুতেই অন্য একজনকে বিশ্বাস করাতেই পারিনা। লোকজন ঠকানো definitely is not my forte।
ভালবাসতে ভালোবাসি। এই বুড়ি বয়সে এসেও হুটহাট লোকজনের ওপর ক্রাশ হয়ে যায় (কিছু কিছু ক্ষণস্থায়ী। কিছু আবার বিরক্তিকরভাবে লং টার্ম।), একতরফা ভালবাসতে ওস্তাদ। খুব সহজে বিশ্বাস করি মানুষকে। ঠকি। অবশ্য করেই। তাও শিক্ষা হয়না। ভালোবেসেই যাই। বিশ্বাস করেই যাই। তাদের জন্য করেও যাই। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ভালো কাকে বাসি জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই উত্তর হবে বাবা এবং মা (নাকি মা এবং বাবা?)। নিজে কোন কিছু উপভোগ করলে, তাদের সাথে সেই এক্সপিরিয়েন্স শেয়ার না করলে, তাদেরকে সেটা না দিলে শান্তি পাইনা। উদাহরণ দিই। আমি আজকাল ছুটি কম পাওয়া হয় আর ফ্লাইটের দাম মোটামুটি সস্তা বলে, মূলত ফ্লাইটেই যাতায়াত করি। কিন্তু আমার বাবা মাকে কখনো রাজী করাতেই পারিনি প্লেনে চড়তে। আমার খুব মন কেমন করত সব সময়। প্লেনের গল্প বলতাম যখন ওদের, ওরা সব বুঝলেও ১০০ পারসেন্ট তো বুঝতো না। ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্সের আলাদা মূল্য। আর তাই এইবারে রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে যেই না সুযোগ পেলাম ওদের প্লেনে চড়ানোর, আমি নিজে যাকে বলে এক্কেরে "অন ক্লাউড নাইন"। বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, আজ না হয় তারা আমার হাত ধরে প্লেনে চাপা শিখুক। বেড়াতে ভালোবাসি আমরা তিনজনেই। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে আমরা আরো অনেক অনেক জায়গায় ঘুরবো। বড় হয়েছি, নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাদের ঘোরাবো।
আমি খুব মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসি (ওই জন্যই মনে হয় হোম সাথ সাথ হ্যায় সিনেমাটি আমার খুব প্রিয়। এতবার দেখেছি, হাতে গুনে শেষ হবেনা। মন খারাপ লাগলেই কম্প্যুটারে চালিয়ে দেখি। দিন নেই রাত নেই, যখন হোক। শাহ্রুখের কোন সিনেমাও এত বেশী দেখিনি। যদিও কভি খুশি কভি গম ক্লোজ কম্পিটিটর।)। বেশ সব কাছের মানুষগুলো আমায় ঘিরে থাকবে। শুধু মানুষ কেন, অ-মানুষগুলোও। কুকুর, বিড়াল, পাখি। সব। চাই সব প্রিয়জনদের নিয়ে একটা সুস্থ পরিবেশে থাকতে। যেখানে থাকবেনা সিরিয়ালের মতো কুটকাচালি। থাকবেনা রিয়েলিটি শোয়ের অযৌক্তিক ড্রামা। কল্পনা করতে দোষ কী? ট্যাক্স লাগেনা তো? (নাকি লাগে? আজকের বাজেটে কি কিছু এই নিয়ে কথা হলো?)

No comments:

Post a Comment