"জি এম!"
প্রতিদিন তিতিরের ঘুম ভাঙ্গে বাবার থেকে আসা এই মেসেজে। সকাল সাড়ে ছটার এলারম বাজার সাথে সাথেই ঘুম চোখে ফোন হাতে নিয়ে বাবার সুপ্রভাতের উত্তর লিখে তবেই দিন শুরু হয় ওর। বাবা কাছে থাকলে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। বড় আদুরে ও বাবার। দীর্ঘ আট বছর তিতির কলকাতার বাইরে থেকেছে। প্রথমে লেখাপড়ার সূত্রে পুণায়, তারপর চাকরি সূত্রে বম্বে, মাদ্রাজ হয়ে অবশেষে এখন ব্যাঙ্গালোরে থিতু। বছরে দু তিনবার বাড়ি আসে তিতির, আর বাবা মা ওর কাছে যান দুবার। প্রতিবারই বিচ্ছেদের সময়ে চলে প্রবল কান্নাকাটি। "ধুর পাগল, এত বছর হয়ে গেলো, তাও এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কাঁদার শেষ নেই তোর। তুই কাঁদলে আমার খুব খারাপ লাগে। মন কেমন করে। কতবার বলেছি, কলকাতায় চাকরি দেখ। সেইবেলা শুনবি না।" বাবার কাছে মৃদু বকুনি খেয়েও অভ্যেস পালটায় না।
এইবারের আসাটা একটু আলাদা। আজ যে শেষবারের মত আইবুড়ো তিতির বাবার কাছ থেকে সুপ্রভাত শুনল।
আজ ওর বিয়ে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। ভোরবেলা মা মাসিরা বিয়ের নিয়ম কানুন মানা শুরু করবে বলে ওকে উঠিয়ে দিয়েছে। একটু যে বাবার কাছে শুয়ে, কাছে ঘেঁষে আদর খাবে, তার উপায় নেই। সুপ্রতীকের সাথে তিতিরের বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। এই এক বছরে ভালমতোই আলাপ পরিচয় হয়েছে দুজনের, তাও কেন জানিনা তিতিরের খুব মন খারাপ। হয়তো বাবা মা কে ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে, কে জানে।
বৃদ্ধির পুজোয় বসে বাবারও বেশ মন খারাপ। চোখের সামনে নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে আজ কনের সাজে বুকের কাছে কিছু একটা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। যে মেয়েটা রান্নাবাটি খেলত এই তো সেদিন, আজ নাকি সে নিজের একটা সংসার স্থাপন করতে চলেছে। চোখ বন্ধ করলে পরিষ্কার দেখতে পান বাবা, আজকের মতোই মাথায় টোপর লাগিয়ে লাল শাড়ী পরে কনের সাজে পুতুলের মত ছোট্ট তিতির, মামার কোলে বসে প্রথম ভাত খাচ্ছে। কী খেতে না ভালোবাসে তিতির, সেই ওইটুকু বয়স থেকেই। পায়েসের চামচটা কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। আজ দেখো, বেচারি উপোস করে বসে আছে।
আরেকটু বড় হল তিতির। নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হল। নীল ফ্রক পরে প্রথম স্কুল যাচ্ছে, টলমল করতে করতে। কলকল করে সে কত কথা মেয়েটার বাড়ি এসে। স্কুলে পেরেন্টস কল। কেন? লাস্ট পিরিয়ডে বসে নাকি তিতিরের খুব কান্নাকাটি, রোজ। সে কিছুতেই ক্রেশে যাবেনা, বাড়িই আস্তে হবে। এদিকে দেখো, কীরকম আট বছর বাড়ির বাইরে রইলো। মা বাবাকে ছাড়া যে মেয়ে ঘুমোতে পারত না, দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। আজ আবার রাঙ্গা চেলীতে লাল টুক্টুক কনে বৌ সেজে চুপচাপ বসে আছে।
বাবা জানেন যে এই নতুন জীবনেও তিতির ভালো থাকবে। তবু, বাবার মন। মেয়েকে সম্প্রদান করতে বসে চোখের কোণে জল ভরে আসছিল। তিতিরও থম মেরে বসে রইল। পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা যখন তিতির আর সুপ্রতীক সবার আশীর্বাদ নিচ্ছে যাওয়ার আগে, তিতিরের চোখের জলও যেন বাধ মানছে না। সাথে বাবারও। কেন যে এমন নিয়মগুলো হয়। তিতির যাওয়ার আগে বাবার কানে বলে গেল, " কাঁদছ কেন বাবা? আমি তো বিয়ে করতে চাইনি। তুমিই তাড়া দিলে।"
" তুই এগুলো এখন বুঝবি না রে। নিজে মা হ, তখন সব বুঝবি।"
"ভালো থেকো বাবা। সময় মেনে ওষুধগুলো খেয়ো। মা কে দেখো। জল না ঘাঁটে যেন। এমনিতেই খালি যা সর্দিকাশিতে ভোগে।" আরো কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিল ও, কান্নায় আর শেষ করতে পারল না। সুপ্রতীকের হাত ধরে "কনকাঞ্জলি"র মাধ্যমে মায়ের ঋণ শোধ করে তখন ওর যাওয়ার পালা, "নিজের বাড়ি"তে।
No comments:
Post a Comment