Tuesday, February 13, 2018

অন্য ভ্যালেন্টাইনস ডে

সকাল থেকেই পিয়ালের whatsapp ভরে যাচ্ছে শুধু ভ্যালেন্টাইন্স ডে মেসেজে। হয় বোন শিমুলের পাঠানো মিষ্টি মিষ্টি টেডি বিয়ার, হাতে তার ইয়া বড় লাল রঙের হার্ট শেপের বেলুন, তাতে লেখা "লাভ", নয়তো মাসীর মেয়ে মনাইয়ের পাঠানো অডিয়ো মেসেজে টকিং টমের গলায় ভ্যালেন্টাইন ডে উইশ। বান্ধবীদের গ্রুপেও জোর কদমে গত দশ দিন ধরে চলছে আজকের তোড়জোড়। কে কার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বরের সাথে কোথায় সেলিব্রেট করবে, তার হাজার হাজার প্ল্যান। নববিবাহিতা পিয়ালের কাছে সকলেরই প্রায় এক প্রশ্ন, " কী রে, আজ কী প্ল্যান? সারাদিন কী করছিস? বর কী গিফট দিলো? কোথায় বেরোচ্ছিস আজ?" ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব প্রশ্নবাণে পিয়াল জর্জরিত। হবে নাই বা কেন?

একেই পিয়াল নিজে একটু মুখচোরা। তার ওপর বিয়ে হয়েছে সবে তিন মাস। খবরের কাগজ দেখে বিয়ে। তেমন মেলামেশাও করেনি বিয়ের আগে। সুমন্ত কলেজে পড়ায়। ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে যেন রসায়নের মাস্টারের জীবনে কোন রসবোধ নেই। বিয়ের এই তিন মাসে একটা দিনও রোমান্টিক কিছুই করেনি সে। নেহাত হানিমুনের টিকিট শ্বশুরমশাই কেটে রেখেছিলেন, তাই নেহাত দুজনে মিলে একটু মুসৌরি ঘুরে এসছিল। তা সেখানে গিয়েও দুজনের একসাথে কোন ছবিই নেই। আশেপাশে যেখানে সব ট্যুরিস্ট কাপলরা মিনিটে মিনিটে রোম্যান্টিক পোজ দিয়ে ছবি তুলছে বা তোলাচ্ছে, এরা দুজনে যেন নিপাট অপরিচিতের মতো দূরত্ব রেখে রেখে দাঁড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লজ্জার মাথা খেয়ে পিয়াল তখন কিছু বলতেও পারেনি, সখ হলেও হাত ধরে হাঁটতে পারেনি, বিকেলের নরম আলোয় বরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মুগ্ধ হতে পারেনি। ওদের এলবাম দেখে ননদ ফুল্কি তো ফুট কেটেই ফেলল, " হ্যাঁ রে বৌদিভাই, তোরা বর বৌ না ভাই বোন রে?" বলেই সে কী হাসি। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে পিয়াল তখন ঘর থেকে পালাতে পারলে বাঁচে!

যদিও সুমন্ত্র থেকে কোনরকমই আশা রাখেনি পিয়াল আজকের দিনটির জন্য, কিন্তু তাও কেন জানি মনের কোণের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা হয়তো থেকেও গিয়েছিল। তাই সকাল সকাল সুমন্ত্র জন্য যখন ওর প্রিয় চিকেন স্যান্ডউইচ বানাচ্ছিল, খুব মনে হচ্ছিল এই বুঝি সুমন্ত হেসে দুটো কথা বলবে। ও মা, বাবু তখন গভীর মনযোগ দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় রাষ্ট্রনীতি পড়তে ব্যস্ত। পাশের পাতায় অঞ্জলির এত বড় বিজ্ঞাপন চোখেও পড়েনা। দুপুরে খেতে বসে রেডিয়োতে শুধুই প্রেমের গান।
 " চাহে তুম কুছ না কহো, ম্যায়নে শুন লিয়া। কে সাথই প্যার কা, মুঝে চুন লিয়া। ম্যাইনে শুন লিয়া।"  কল্পনার আকাশে তখন পিয়াল উড়ছে। মোটা ফ্রেমের চশমা ছেড়ে সুমন্ত কুল সানগ্লাস, লাল টিশার্ট পরে পুরো হিরো, পিয়ালও যশ চোপড়ার সিনেমার হিরোয়িনদের মতো শিফন শাড়িতে অপ্সরা। এসব ভাবতে ভাবতে হাতের ভাত শুকিয়ে যায়। সম্বিৎ ফেরে কলিং বেলের আওয়াজে। নির্ঘাত সুমন্ত ওর জন্য ফুলের বুকে পাঠিয়েছে। কলেজে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে। লাফাতে লাফাতে গিয়ে দরজা খুলতে যাবে, চিতপটাং! এ এক জঘন্য ব্যামো পিয়ালের, শুকনো ডাঙ্গাতেও দুমদাম পড়ে যায়। কোনোমতে উঠে, নিজেকে সামলে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে দরজাটা খুলে দেখে ক্যুরিয়ার। ব্যথার মধ্যেও এইটুকু যাও বা আশা ছিল, সব ভেঙ্গে গেল যখন চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখল এল আই সির প্রিমিয়ামের রিসিপ্ট।

ব্যথায় যন্ত্রণায় সাড়া দুপুর কাতরাতে থাকলো পিয়াল। ভোলিনি লাগিয়েছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ করেই খুব মায়ের জন্য, বাবার জন্য মন খারাপ লাগছিল। বড্ড একা বোধ হচ্ছিল। এই যদি এখন বাড়ির সবাই থাকত, কত যত্নআত্তি খাতির করতও পিয়ালের। এরকম একা একা মোটেই পড়ে থাকতে হতোনা। বাড়ির থেকে এত দূরে বিয়েটা করতেই চায়নি পিয়াল, কিন্তু মা বাবার জোরাজুরিতে শেষমেশ মত দিতে হয়েছিল। অসুস্থ শরীর, দুর্বল মন, বড্ড ভঙ্গুর। কাঁদতে কাঁদতে কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, খেয়াল নেই। দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল কখন, কে জানে। খুট করে দরজার শব্দে ধড়ফড় করে উঠল পিয়াল, উঠতে গিয়েই পায়ের ব্যথাটা জানান দিলো।
" তুমি ঠিক আছো? এই সন্ধ্যেবেলা অন্ধকার ঘরে শুয়ে। বেল বাজালাম, খুললে না। ভাগ্যিস ডুপ্লিকেট ছিল। "
সুমন্ত্র চোখে মুখে একরাশ প্রশ্ন, চিন্তা দেখে নিজেকে আর  সামলাতে পারল না পিয়াল। ভ্যা করে কেঁদেকেটে উল্টে পড়ার কথা জানালো সুমন্তকে। সুমন্ত বেচারা, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একশা। কঠিন কঠিন থারমোডাইনামিক্স ইকুয়েশন সল্ভ করতে ওস্তাদ, জীবনের এইসব ইকুয়েশন ব্যালেন্স করতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যায়। অপটু হাতে গ্যাসে গরম জল করে, হট ব্যাগে জল ভরে সেঁক দিতে থাকে। আরেক হাতে ফোন। ফ্যামিলি ডাক্তার মিত্রবাবুকে তড়িঘড়ি তলব। ডাক্তারবাবু এসে দেখেশুনে বললেন চিন্তার কারন নেই। সেঁক চলতে থাকুক। আর দরকার একটু রেস্ট। ওনাকে বিদায় করে ঘরে ঢুকে সুমন্ত বলে, " শোনো, তুমি চিন্তা করোনা। আমি কদিন ছুটি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি একদম মাটিতে পা ফেলোনা। আমি সবদিক ম্যানেজ করে দেবো। "

রান্নাবান্নায় অপটু সুমন্ত অ্যাপ দিয়ে ডিনার অর্ডার করল দুজনের। অর্ডার করতে গিয়ে টের পেল, দুজনেরই যে বড় প্রিয় চাইনিজ। বেডরুমেই বসে খেলো। খেতে বসে কারেন্ট চলে যেতে আবার "ক্যান্ডেললাইট ডিনার" হল। তারপর পায়ে সেঁক দিয়ে ভোলিনি লাগিয়ে, পেন কিলার খাইয়ে ধীরেসুস্থে ওকে শুইয়ে গায়ে চাদর ঢেকে দিলো। পিয়াল যেন আজ এক অন্য সুমন্তকে চিনছে, অবাক হয়ে তাই তাকিয়েই রইলো। এতটা যত্নশীল। হোক না সে একটু আনরোমান্টিক, কিন্তু এই যত্ন করে আপনজনের মত খেয়াল রাখা, এই বা কম কী? হবো না হবো না করেও, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কিন্তু পালন হয়েই গেল!

No comments:

Post a Comment