ভোরের দিকে অনেক কষ্ট করে একটু দু চোখের পাতা এক হয়েছিল। ঘুম ভাঙল পাশের বাড়ি থেকে অনিন্দ্যদার তানপুরা সহযোগে রেওয়াজের সুরে।
"ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে হারাই হারাই, সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।"
ক্লান্ত লাগছে। খুব। খবরটা শোনা ইস্তক সারারাত শুধুই এপাশ আর ওপাশ করে কাটালাম। হাজার চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করলেই সিনেমার মতো পরপর ভেসে আসছিল একটার পর একটা মুহূর্ত।
কেমিস্ট্রি ক্লাসের বাইরে আমি দাঁড়িয়ে। তুই এলি রিমার জন্য নোটস দিতে। অ্যারোমাটিক কম্পাউন্ডের সাথে সাথে তখন আমার কিশোরী মনে যে প্রেমের সৌরভ ভেসে আসছে, তুই তো বুঝিসইনি। তোর পরনে ছিল লাল চেক শার্ট। সেই থেকে লাল আমার প্রিয় রঙ।
উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পর পুরো গ্রুপ মিলে আমরা গেলাম নিক্কো পার্ক। সারাটাক্ষণ আমি চেষ্টা করে গেলাম তোর সাথে রাইড শেয়ার করবো। একটুর জন্য মুন রেকারে তোর পাশে বসতে পারছিলামও। ঠিক শেষ মুহূর্তে এসে পল্লবী আমায় সরিয়ে তোর পাশটায় বসে পড়ল। মন খারাপ করে সন্ধ্যেবেলা যখন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরলাম, জানলার বাইরে আমার অভিমানী লাল ওড়নাটা হাওয়ায় বেপরোয়া উড়ছে।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। তুই গেলি প্রেসিডেন্সি, আমি ব্রেবোরন। ফেস্টে এলো ভূমি। তোর তখনকার অন্যতম প্রিয় ব্যান্ড। সাহস করে তোকে অরকুটে মেসেজ করে জানালাম। বললি আসবি। আমি সেদিন অষ্টাদশীর ন্যায় উচ্ছ্বাসে সারা সকাল বেছে বেছে সেজেগুজে এলাম। সবাই বলেওছিল। লাল সিল্কের শাড়িটাতে আমায় নাকি দারুণ মিষ্টি লাগছিল। যথাসময়ে তুই এলি। সাথে ছিল শ্রেয়া। আমার লাল শাড়ির সাথে কন্ট্রাস্ট করে মুখটা হয়ে গেলো বেজায় কালো।
মাস্টার্স পড়তে তুই চলে গেলি বম্বে। আমি গেলাম রুড়কি। পুজোর ছুটিতে আমাদের পুরো গ্রুপটা দেখা করবে প্ল্যান হল। ম্যাডক্সে। তখন সদ্য আমি ঠাকুমাকে হারিয়েছি। মন ভালো নেই। তাও তুই আসবি বলে আমি যেতে রাজি হলাম। যাবো বলে তিনদিন আগে মায়ের সাথে দক্ষিনাপণ গিয়ে একটা লাল চুড়িদার সেট কিনেছিলাম। ঠিক মোক্ষম মুহূর্তে তুই দেবাকে মেসেজে জানালি, আসছিস না। মৃণালিনীর সাথে নর্থ ঘুরতে গিয়েছিস। আমারও সেদিন কোনোমতে কফিটা শেষ করেই খুব মাথা ধরে গেলো, ফিরে এলাম বাড়ি। সাইনাসের দোহাই দিয়ে আলো নিভিয়ে ঘরবন্দী হয়ে কাটালাম অষ্টমীর সন্ধ্যেটা।
তুই চাকরি নিয়ে গেলি হায়দ্রাবাদ। আমি দিল্লী। অফিসের কাজে এসেছি ভোপাল। হোটেলের লবিতে হঠাৎ তোর মুখোমুখি। তুই একা। সেদিন একসাথে বসে অনেক আড্ডা চলল। কাপের পর কাপ কফি। রাত্রে যে যার ঘরে ফিরলাম যখন, আমার মুখচোখে এক হাল্কা লালচে আভা। বোধহয় একেই ব্লাশ করা বলে।
ফেসবুকে রইলো যোগাযোগ। সেখানেই একদিন দেখলাম তোর মেসেজ। বিয়ে করছিস। পাত্রী তোরই কলিগ। পাঞ্জাবী মেয়ে। খুব ধুমধাম করেও হল তোদের বিয়ে। দিল্লীতেই। সেদিন আমি ইচ্ছে করেই সিমলা চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম তোদের বিয়ের এলবাম। লালে লাল। কী খুশী লাগছিল তোকে দেখতে। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন জানিস। খুব।
বলে না, সময়ের সাথে সাথে সবকিছু সহ্য হয়ে যায়, ক্ষতস্থানে প্রলেপ পড়ে যায়। আমিও ভেবেছিলাম বুঝি দেড় বছরে সব ভুলে গিয়েছি। এক তরফা ভালোবাসা। তার আর কীই বা জোর। কিন্তু না। কাল রাত্রে যখন মধুজার মেসেজ পেলাম, শুনলাম তুই খুব কষ্টে আছিস, যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছিস, নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ভীষণ ইচ্ছে করছে রে, আমার কোলে তোর মাথাটা রেখে একটু হাত বুলিয়ে দিই। চুলে বিলি কেটে দিই। আরাম পাবি না বল? আসছি রে আমি। এখুনি আসছি। প্লীজ এবার হারিয়ে যাসনা। চলে যাসনা। আসছি।
No comments:
Post a Comment