দুপুর দুটোর কলকাতা। আধা খালি বাসটা ঢিকিস ঢিকিস করতে করতে এসে পৌঁছেছে অফিসপাড়ায়। সেখানে তখন ফুটপাথের দোকানিরা ভীষণ ব্যস্ত পসরা সাজিয়ে। "আমায় এক প্লেট চাউ দেবেন তো", "এদিকে দুটো ঘুগনি আর মামলেট", "দাদা খুচরো দিন না"। এরই মধ্যে রাস্তায় সিগনালে আটকে থাকা খালি বাসটার দরজা থেকে কন্ডাক্টরের "এ পার্ক স্ট্রীট রবীন্দ্র সদন এক্সাইড হাজরা টালিগঞ্জ ফাঁড়ি। খালি আছে। সীট খালি সীট খালি"র প্রবল আকুতিতে যাত্রী তোলার মরিয়া চেষ্টা। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ। বাসের এফ এমে তখন বিজ্ঞাপনের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান।
লেডিজ সিটে জানলার ধারে বসে মা ব্যস্ত ছেলের স্কুলের ডায়রি দেখতে। ম্যাডাম কী হোমওয়ার্ক দিলেন, পরীক্ষার সিলেবাস কী, প্রশ্নে নাজেহাল দশ বছরের ছেলেটি। ওর মন পড়ে আছে স্কুলের লাস্ট পিরিয়ডের খেলায়। অান্টি তখন মগ্ন হয়ে পড়াচ্ছেন গুলমোহর রিডার থেকে ড্যাফোডিলস। I wandered lonely as a cloud... এদিকে ওরা বন্ধুরা ব্যস্ত বুক ক্রিকেটে। সিগনাল ততক্ষণে সবুজ হয়েছে। তবুও ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। "নে একেবারে বাড়ির ভিতর থেকে লোক ডেকে আন। সত্যিই। কী কুক্ষণে যে এই বাসটাতে চেপেছিলাম।" গুটিকয়েক প্যাসেঞ্জারের রোজের এই মনোলগে আর কান দেননা পঁয়তাল্লিশের ড্রাইভার। তার চেয়ে ঢের বেশী শ্রুতিমধুর রেডিয়োতে তখন বেজে চলা আফগান জলেবি।
বাসটা গুঁটিগুঁটি পায়ে উঠল পার্ক স্ট্রীট ফ্লাইওভারে। সনসন করে হাওয়া দিচ্ছে। ড্রাইভারও বোধহয় মুড পেয়ে গিয়েছেন। বাস সেকেন্ড গিয়ার থেকে একেবারে ফোরথে। "পুচু আমার হাতটা ধরে বসো। এক্ষুনি ব্রেক মারলেই পড়ে যাবে"র উত্তরে একটি নরম হাত চেপে ধরল তার কুচুর বলিষ্ঠ হাত। কব্জির ঘড়িতে তখন সোয়া দুটো। ঝিরঝিরে হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। ডান হাত দিয়ে চোখের উপরে বারবার পড়া চুলের গোছা সরাচ্ছে মেয়েটি। সহযাত্রীর মুগ্ধ দৃষ্টি ওর ঠোঁটের ওপর ছোট্ট কালো তিলে।
"মা, আমি জানলার ধারে বসব প্লিজ"এর উত্তরে সন্ত্রস্ত চিন্তিত মা কাঠের জানলা বন্ধ করছেন। সামনেই ইউনিট টেস্ট। এখন ভিজলেই কেলেঙ্কারি হবে ছেলের।
পিছনের সীটের প্রৌঢ় মগ্ন ফোনে। "ছাতা নিয়ে বেরোইনি কিন্তু আমি। এই এক্সাইড ছাড়ালাম। মাম্পাকে বলো ছাতা নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতে। আর শোনো, রাত্রে খিচুরি করে দিয়ো তো। যা দেখছি আকাশের অবস্থা, থামার তো লক্ষণ নেই। ডিম আছে তো? নইলে মন্টুর দোকান থেকে আনিয়ে নিয়ো। ব্যাস। খিচুরি আর ডিম ভাজা।ঘি আছে তো?"
বাসটা হঠাৎ স্পিড তুলেছে। পূর্ণর স্টপেজে থামলইনা। পিছনে বোধহয় একই রুটের আরেকটা বাস। "গোটা রাস্তা ধীরে চালিয়ে এখন এই র্যাশ ড্রাইভিং। রিডিকিউলাস।" কোনমতে এঁটেসেঁটে বসে ভাবল উনিশের মেয়েটি। ফিরছে কলেজ থেকে। একটু ঘুমিয়ে আবার ছুটবে ট্যুশানে। ইশ, এই ওয়েদার, কোথায় চাদর মুরি দিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে ভূতের গল্প পড়বে, তা না। এক হাঁটু জল ঠেঙ্গিয়ে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রির কচকচানি শুনতে হবে।
রেডিয়োতে পরপর চলছে "আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ", "কাগজের নৌকো", "সাওয়ান বরসে" । আর জে খবর দিচ্ছে মাঝে মাঝে, কোথায় জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে, কোথায় জ্যাম। বারবার সাবধান করছে ভিজে রাস্তায় গাড়ী চালানো নিয়ে। বিকেল তিনটেতেই প্রায় ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।
একটা বিশ্রী শব্দ করে ব্রেক কষল বাসটা। প্রৌঢ় ছিটকে পড়ে যেতে যেতে কোনমতে নিজেকে সামলালেন। "কে রে ভাই? কী করে চালাস বাসটা? তখন থেকে এই করছে ব্যাটা।" ড্রাইভারের চোদ্দ গুষ্টি এক করতে বাসের ওই গুটিকয়েক যাত্রী তখন মরিয়া।
মুহূর্তের মধ্যে রেরে করে ছুটে এলো কিছু পথচারী। আশেপাশের বাস থেকে প্যাসেঞ্জার। এই বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টর ছুটছে। তার পিছনে ছুটছে মত্ত জনতা। তারও পিছনে ট্রাফিক পুলিশ কানে ওয়াকি টকিতে কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে।
শুধু স্থির হয়ে পড়ে আছে বছর চব্বিশের এক কলেজ পড়ুয়া। গলায় ঝুলতে থাকা আই ডি কার্ডটা ছাড়া চেনা যাচ্ছেনা আর। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। কালো পিচের ওপর ধুয়ে যাচ্ছে টাটকা রক্তের স্রোত।
"বাবু, ওইদিকে তাকিয়ো না। চলো। দেখি আবার এখন এখান থেকে অটো পাওয়া যায় কি না। কালকের হোমওয়ার্কগুলো শেষ করতে হবে তো। আবার ক্লাস টেস্টও তো কাল।" পিছনের দরজা দিয়ে নেমে মা ছেলে তখন অন্য দিকে।
"শোনো, একটা বিচ্ছিরি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এখানে। দেখি পরের বাসটা কখন পাই। ভিজেই তো গেলাম। আর মাম্পাকে পাঠাতে হবেনা", দায়িত্ববান পিতা ফোনে জানিয়ে দিলেন বাড়িতে।
পুচু আবার একদম রক্ত দেখতেই পারেনা। কুচুর এখন বিরাট দায়িত্ব তাই। ওকে কোনভাবে স্পট থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
ট্রাফিক সার্জেন্ট পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলেন। আই ডি কার্ডে দেওয়া নম্বরটায় ফোন করে জানাতে হবে তো। এইসব উটকো ঝামেলা যত। প্রফেশনাল হ্যাজারড।
Tuesday, July 31, 2018
Monday, July 30, 2018
একটি রবিবাসরীয় সকাল
গতকাল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। প্রায় সপ্তাহখানেকের প্রস্তুতিপর্বের পর ঠিক হয়েছিল সকাল সকাল প্রতিষ্ঠিত বাঙালি মিষ্টির দোকানে (পড়ুন কে সি দাস) যাব। কচুরি খেয়ে রবিবারের জলখাবারটা সারবো। সেই অনুযায়ী প্ল্যানিংও চলছিল। শনিবার গুগলকে জিজ্ঞেস করে দোকানের টাইমিং জেনে নিলাম। তারপর রবিবার সকালের বড় প্রিয় ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে এবং দায়িত্ব নিয়ে বাকি তিনজনের ঘুম ভাঙিয়ে আমরা রওনা দিলাম ক্যাম্পাস থেকে। সে কী উত্তেজনা। ফেসবুকে একখানা ছবি পোস্টিয়ে দিলাম। আবার স্টেটাসও দিলুম। বেলা বোস গানের প্যারোডি হিসেবে।
"অ্যাপ ক্যাব মোরা পেয়ে গেছি ওগো শুনছ
আর মাত্র কয়েকটা মিনিট ব্যাস।
স্টারটিংএই ওরা কচুরি দেবে
তারপর দেবে মিষ্টি
চুপ করে তখন খাবো আমরা সব।"
পৌনে নটার দিকে দোকানের সামনে পৌঁছে মাথায় হাত। শাটার টাটার নামানো। দোকান খোলেইনি। ততক্ষণে ফেসবুকের ছবির প্রাইভেসি "ওনলি মি" করে দিয়েছি। প্যারোডি ডিলিট। এর মধ্যে যে বেশ বুক ফুলিয়ে জাহির করা হয়ে গিয়েছে। তৃণাদিকেও কনফিডেন্টলি বলে ফেলেছি যে কে সি দাস আটটায় খুলে যায়, ইত্যাদি। গাড়ি থেকে না নেমে সঙ্গে সঙ্গে ডেসটিনেশন চেঞ্জড। চলো পানসি বেসন্ত নগর। চন্দনের ইতিমধ্যে খিদেয় পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক মারছে। পায়েলের মন চা চা করছে। অয়নের মুখ চুন, কারণ ওই ছিল কচুরি অভিযানের মূল হোতা। আমি ভাবছি গেল রে, এত শো অফ, কী হবে এবার। প্রেস্টিজ ইস্যু।
যাই হোক, বেসন্ত নগর বিচে নেমে আমাদের প্রথম প্ল্যান হল কিছু একটা খেতে হবে। চন্দনের কথা মতো গেলাম মুরুগন ইডলি শপে। এই দোকানটি একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড তামিল নাডুর। চেন্নাইতে একাধিক ব্রাঞ্চ। এমনকি আমি সদ্য মাদুরাই গিয়েও দেখেছিলাম এদের ব্রাঞ্চ। বেসন্ত নগরে আমি আগে বার দুয়েক খেয়েছি। সুস্বাদু অথেনটিক দক্ষিনী খাবার। ঠিক হল কফি খাবো আর সাথে হাল্কা ব্রেকফাস্ট। কারণ কচুরি আমাদের খেতেই হবে। প্রায় পাখি পড়ার মতো আমি বাকি তিনজনকে বলেই চলেছি। ওরে, বুঝে শুনে মেপে ঝুঁকে খাস কিন্তু।
তা মুরুগনে তো হেঁটে হেঁটে পৌঁছনো গেল। একটু এদিক ওদিক দেখে শুনে টেবিলও পেলাম। ওখানের সিস্টেম বেশ মজার দেখলাম। একেকটা আইটেম নিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করছে নেব কি না। মানে আলাদা করে একটা এই দুটো ওই ওরকম কোন ব্যাপার নেই। আমরা তো নিলাম প্রথমেই চারজনে চারটে পোড়ি ঘি ইডলি। সে যে কী অপূর্ব স্বাদ, বলে বোঝাতে পারব না। খেতেই হবে। মনে করুন তুলতুলে নরম ইডলি, তাতে ঘি মাখানো। আর তার ওপর পোড়ি ছড়ানো। পোড়িটা আসলে ওই নানান মসলাকে রোস্ট করে গ্রাইন্ড করে দেওয়া হয়। ইডলি, দোসা, উত্থাপমের সাথে দারুণ মানায়। এরপর একে একে "ট্রাই" করলাম পোঙ্গল, সুইট পোঙ্গল, বড়া, প্লেন ইডলি এবং পোড়ি অনিয়ন উত্থাপম। ফিলটার কফিটা বেশ বেশ ভালো ছিল। বিল টিল তো মেটানো হলো। খসলও ভালোই। এদিকে ঘড়ির কাঁটা বলছে সোয়া নটা। কে সি দাস যদি খোলে তো দশটায়। অর্থাৎ আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ধাক্কা। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মনে হল যে তাহলে রোদের মধ্যেই না হয় সমুদ্রের ধারে যাই। এত কাছে এলাম আর বঙ্গোপসাগরের দর্শন নেব না, তা কি হয়?
ওই গরমে আমরা সমুদ্রের ধারে গেলাম। চোখ খুলে তাকাতে পারছিনা এত রোদ। গা পুড়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস সানস্ক্রিন মেখে বেরিয়েছিলাম। এদিকে রোদ চশমা নিইনি। ভাবিনি তো কচুরি খেতে গিয়ে চোখ টোখ ঝলসে যাবে এমন! অয়ন চন্দন আর পায়েল জলে নামলো। আমি দূর থেকেই। ততক্ষণে বারবার কে সি দাসে ফোন করছি। কেউই ধরে না। পৌনে দশটা নাগাদ তাদের কী মনে হল কে জানে ফোন রিসিভ করল। বেশ সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "when will the shop open?", "it is open now" উত্তর পেলাম। উল্লাস দেখে কে! আহা, কচুরি খেতে চলেছি! ফাইনালি!
ঝটপট আবার এক খানা অটো নিয়ে পৌঁছলাম। ঢোকার আগে এক প্রস্থ ছবি ছাবা তুলে ফেলেছি। ইতিমধ্যে আরো বন্ধুদের মেসেজ করা হয়ে গেছে কোথায় এসেছি। কনফিডেন্স ফেরত পেয়ে পুরনো পোস্ট আবার ওপেন টু অল করে ফেলেছি। রীতিমতো টগবগিয়ে ফুটছে আত্মবিশ্বাস। দোকানে ঢুকে দেখি তখনও তেমন বেশী মিষ্টি নেই। কিন্তু গাড়ি থেকে তখন মিষ্টির ট্রে নামানো হবো হবো করছে। একটু আশ্বস্ত হলাম। জিজ্ঞেস করা হল, "কচুরি হবে?" জানলাম হবে, কিন্তু আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। যে আমরা কচুরি খাব বলে সকাল আটটা থেকে দশটা বাজিয়ে দিলাম, নিশ্চয়ই আর আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করাই যায়। ডিটারমিনেশন তুঙ্গে তখন। বললাম, বেশ। করবো অপেক্ষা। বানাও আটটা। শুরু তো হোক আট দিয়ে। তেষ্টা মেটাতে তখন জল, ফ্যান্টা চলছে। এদিক ওদিক দেখছি। প্ল্যান হচ্ছে আর কী মিষ্টি খাওয়া যায়, কেনা যায়। প্লাস এত সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে চলছে অগুন্তি সেলফির বন্যা। অয়নের চাকচিক্যও ফেরত এসে গিয়েছে। পায়েল লাফাচ্ছে রসগোল্লা খাবে বলে। চন্দন ফোনে লাইভ কমেন্টারি দিচ্ছে। আর আমি খুঁজছি ভাজা মিষ্টি।
এমন সময় কে জানে কেন, অয়নের মনে কুডাক দিলো। ওর কী মনে হল, বলল, "আচ্ছা কচুরি মানে খাস্তা কচুরি দেবে না তো?" সবাই মুহূর্তের জন্য ব্যোমকে গেলাম বটে, তারপর সেলফ কন্সোলেশনের মতো বললাম, " না না। কচুরি মানে কচুরি। বাঙালি দোকান। কচুরি বুঝবে না?"
ওই যে কথিত আছে, নেগেটিভ ভাবলে জীবনে সব নেগেটিভ হয়। নেগেটিভ ভাইবস ছড়ায়। তার একদম যথাযথ উদাহরণ সহ দোকানের রান্নাঘর থেকে বেরোল এক সার্ভার। হাতে খাস্তা কচুরি। সিনেমা হলে চারটে পাঁচটা কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ হত ব্যাকগ্রাউন্ডে। আর বাংলা সিরিয়াল হলে তো কথাই নেই। এক সপ্তাহর খোরাক পেয়ে যেত। বারবার ক্যামেরা আমাদের চারজনের মুখে ফোকাস করতো। আমাদের একদা হাসি মুখ মুহূর্তে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বার বার একই শট বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখাতো। গ্যারান্টি দিচ্ছি, দারুণ শট হত। শেষ সম্বলের মতো অয়ন আবার জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা, পুরি পাওয়া যাবে? কচুরি আই মিন। এটা তো খাস্তা কচুরি।" অ্যাটম বোম পড়ল। না। পাওয়া যাবে না। ভগ্ন হৃদয় আমরা চারজনে খুঁটে খুঁটে ওই খেলাম। আরেক প্রস্থ কোল্ড ড্রিঙ্ক ও রসগোল্লা কালো জামের সাহায্যে কচুরি নামালাম। হ্যাঁ মানছি, সুস্বাদু ছিল বটেই। অ্যাসিডিটি হয়নি। কিন্তু তবুও, চাইলাম এক, পেলাম আরেক। আমাদের ভিতরকার দার্শনিক সত্ত্বা তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বেরোচ্ছে। "কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকিয়ে হবে কী?" গোছের প্রবাদ বাক্য বেরোচ্ছে কত দিন পর। ভাগ্যিস মুরুগনে কিছুটা ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলাম, এই নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছি একে অপরকে। চন্দন একটু আপার হ্যান্ড নিচ্ছে। কারণ ওর আইডিয়া ছিল মুরুগন। অয়ন তো ততক্ষণে আবার নিভে গিয়েছে। পায়েলের মন খারাপ। আমি ভাবছি গেলো রে, জনসমাজে মুখ দেখাবো কী করে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাই হোক হাজার টাকা খরচা করে অতি স্মরণীয় রবিবার সকাল কাটালাম বটে আমরা। প্রচুর মেমোরিজ হলো। শুধু মিশন কচুরির বদলে ট্রিপটার নাম মডিফাইড হল মেন্টালি। "মিশন ব্রেকফাস্ট"। মিশনই তো বটে!!
Friday, July 27, 2018
ত্বমাসি মম জীবনম
"কী রে তখন থেকে অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? কী বলবি বল। নয়তো ফোট। এরকম তাকিয়ে থাকলে না অস্বস্তি হয়।" Quora অ্যাপ থেকে মুখ না তুলেই অগ্নি বললো রুমুনকে। "আমি তাকিয়ে আছি বুঝলি কী করে?" ঝাঁঝিয়ে উঠলো রুমুন।
"বুঝতেই পাচ্ছি মেজাজ তোর তিরিক্ষি হয়েছে। কিন্তু তা বলে বুদ্ধিশুদ্ধি যে মা গঙ্গার ভোগে চলে যাবে, এমনটা বুঝিনি রে। ডাইরেক্ট না দেখলেও আড়চোখে দেখা যায় রে হাঁদা।" জিভ দিয়ে একটা চুক চুক শব্দ করে অগ্নি বললো। প্রসঙ্গত এখনো মুখ না তুলেই।
"অগ্নি!! তখন থেকে আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখছিস আর তাও ফোন থেকে চোখ সরাচ্ছিসনা। ভালো লাগছেনা কিন্তু আমার।" এবারে বেশ রাগতস্বরেই কথাগুলো বললো রুমুন।
"তোর যা বলার বল না। আমি তো শুনছি।"
"আমি যখন কথা বলবো, আই নিড ফুল অ্যাটেনশন। বুঝেছিস?"
"আরে আমি ফুল অ্যাটেনশনই দিচ্ছি রে। জাস্ট দ্যাট এখানে এলন মাস্ক লাইভ উত্তর দিচ্ছেন লোকজনের। আমি তাই সেগুলি দেখছি। কিন্তু চাপ নিসনা। আমি শুনছিলাম।"
"না। আই ওয়ান্ট আই কন্ট্যাক্ট। আমি অপেক্ষা করছি। তুই শেষ কর যা করছিস। তারপর বলব কথা। আমার এরকম রোবটের সাথে কথা বলতে ভালো লাগেনা।"
"উফ, জ্বালালি। তুই জানিস আমি কীসে গলব। ঠিক সেই ওষুধটাই ব্যবহার করবি। বল।" ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে পাশে রাখতে রাখতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত মুখ করে অগ্নি বললো।
"শোন, আমার আবার ব্রেকাপ হয়েছে আজ। আমার খুব মন খারাপ।"
"এ আর নতুন কথা কী? তা এবারে জানি কে? রণজয়? না সোহেল?"
"সোমক। উফ। সোহেল ছিল লাস্ট ডিসেম্বরে। আর রণজয় আগের পুজোয়। তুই না!!"
"বাবা রে বাবা। তোর যদি একটার পর একটা রিলেশন হয়, আমি অত ট্র্যাক রাখি কী করে বল তো? সারাক্ষণ কি লেজার মেন্টেন করবো নাকি? লেখাপড়া নেই আমার?"
"ঢং করিসনা তো। নিজে তো আজ অবধি ওই অপর্ণাকে প্রোপোজ করে উঠতে পারলিনা। আবার আমায় খোঁটা দিচ্ছে। হুহ।"
"শোন, অপর্ণা আমার মিউজ। শি ইজ ইন এ রিলেশন উইদ অপূর্ব। আমি এমন রব নে বনা দি জোড়িকে ভেঙে পাপ করি নাকি।"
"নাকি রব নে বনা দি জোড়ি। হু।"
"ওসব তুই বুঝবি না। ট্যাঁস ট্যাঁস খামেল স্কুলে পড়লে বাংলা সিনেমা উপন্যাস আর জানবি কী করে।"
"ও আমার সবজান্তা। শোন আমিও কম পড়িনি বাংলা সাহিত্য। চর্যাপদ টু মঙ্গলকাব্য, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, সব জানি। "
"জীবনানন্দ জানিস বুঝি?"
"অবশ্যই। নাটোরের বনলতা সেন। বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।"
"হুম। বুঝলাম। তা বল তো দেখি, ভালোবাসা সবই খায়। শুকনো পাতা। হেমন্তের এঁটো খড়। বাগানের কোণে পড়ে থাকা রুগ্ন শিকড়। সবই খায়। শুধু খায় না আমাকে। এবং প্রতিদিন রোজ হাঁ করে আমারই সম্মুখে বসে থাকে। কার লেখা?"
"জানিনা।"
"শক্তি চট্টোপাধ্যায়।"
"বুঝলাম। তা আমি এসেছি ব্রেকআপের কষ্ট নিয়ে। উনি আমার সুনীল শক্তি জ্ঞান দিচ্ছেন।"
"শোন, আমার মতো জীবনে একটাও প্রেম না করা মানুষ আর কী বলবে তোকে? আমার দৌড় ওই সাহিত্য অবধি। সেখান থেকে টুকটাক যা খুশি বলতে পারি অল্পবিস্তর। প্র্যাকটিক্যাল নলেজ কোথায় পাব?"
"তা বলে আমার মন খারাপের দায়িত্ব নিবি না?"
"তুই সোমকের সাথে যখন ডেটে গিয়ে হুল্লোড় করলি, এন্তার মজা করলি, আর আমি বাড়ি বসে তখন জ্বরে কাঁপছি, তখন তুই কি এসে আমার দায়িত্ব নিয়েছিলি? নিসনি তো? তাহলে তুই কার না করে সাথে গিয়ে ব্রেকাপ করবি। তার দায় আমি নেব কেন?"
"তুই এরকম বলতে পারলি তো অগ্নি?" গলা কেঁপে গেল রুমুনের। এই না কেঁদে ফেলে। দিনটাই খারাপ। একে ব্রেকাপ। তারপর প্রিয়বন্ধুর এমন নিস্পৃহ হাবভাব।
"হ্যাঁ পারলাম।"
"সেই। বলবি তো। আমায় তো আর ভালোবাসিসনা। অপর্ণা থাকলে আমার জায়গায় কী করতিস, আমি সব জানি।"
"বাহ। এই তো। আমার সবজান্তা ম্যাডাম।"
"তুই চুপ কর। আমার বয়ফ্রেন্ডগুলো একটার পর একটা আমার সাথে ব্রেকাপ করে দেয়। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুইও আমার কথা ভাবিসনা। আমায় কেউ ভালোবাসেনা। হুহ। "
"নাটক করা থামলে বলিস। আমি ততক্ষণ এলন মাস্ক কী বলছে পড়ি।"
"হ্যাঁ তাই তো করবি। কোথায় আমায় সান্ত্বনা দিবি, তা না। উনি এলন মাস্ক ফলো করছেন। ফেলে দেব টান মেরে ফোনটা এই বলে দিলাম। তাকা আমার দিকে।"
"উফ আবার কী?"
"বল, আমি খুব আনলাভেবল, না?"
"এই দেখ, কাঁদছিস কেন? এই যে মেয়েদের কথা নেই বার্তা নেই, কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। কী মুস্কিল!"
"বল না তুই। আমার কেন কেউ ভালোবাসে না? এই নিয়ে চার চারটে ব্রেকাপ হয়ে গেল গত তিন বছরে। দোষটা নিশ্চয়ই আমার। কই আর তো কারুর এরকম হয়না।"
"আরে ধুর। ওই সবকটা ছেলে ভুলভাল। তাই টেকেনি। তুই ভালো মেয়ে। তোকে কেন কেউ ভালোবাসবে না? ভালো যোগ্য ছেলেরা নিশ্চয়ই তোকে মাথায় করে রাখবে।"
"নমুনা দেখে তো উল্টে যাচ্ছি।"
"আরে হ্যাপেন্স। ওগুলো সব রং ডিসিশনস। তুই কদিন চুপচাপ শান্ত হয়ে থাক তো। এত ঝপাং ঝপাং করে রিলেশনে যাস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, একটা কথা। নিজেকে নিয়ে ভুলভাল ভাববি না। তুই এতটাই ভালো মেয়ে যে যে কেউ বর্তে যাবে তোকে পেলে। যারা তোকে পেয়েও হারায় নিজেদের দোষে, তারা সব একেকটি ড্যাশ।"
"শিয়র যে কেউ পেলে বর্তে যাবে?"
"অবশ্যই।"
"তুইও?"
"এখানে আমি কোত্থেকে এলাম আবার?"
"যা জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দে।"
"হুম। মানে ইয়ে।"
"কী ইয়ে? হবি কি হবি না বল?"
"মানে হবো। কিন্তু ... "
"গাধা তো এতদিন মুখ ফুটে বলতে কী হয়েছিল? ছাগল একটা।"
"কী বলব?
"বলবি যে ভালোবাসিস।"
"সিঙ্গল ছিলি কতদিন?"
"কম করে হলেও ছয় মাস মিলিয়ে মিশিয়ে।"
"তা ছাড়া আমি চাইনি ওইসব করে বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে।"
"ইডিয়ট। এই নাকি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? এইটুকুও বুঝলিনা বুদ্ধু যে এতে আমাদের বন্ধুত্ব স্ট্রং হতো।"
"আর বাই চান্স ঘেঁটে গেলে?"
"প্রেম যেত। বন্ধুত্ব কখনোই না।"
"ওরম মনে হয়।"
"বড় এসেছে আমার সবজান্তা সর্বজ্ঞানী।"
"তা হলে?"
"প্রোপোজ কর বিফোর আই সে ইয়েস টু এনিবডি এলস। লম্বা লাইন আছে।"
"আমি প্রিভিলেজড? বাবা। এই দেখ এই বললাম হুটহাট প্রেমে পড়িস না। তাও আবার প্রোপোজ করাচ্ছিস। পারিসও বটে তুই।"
"১ থেকে ১০ গুনবো। বলার হলে বল। নইলে যা পালা। ১ ২ ৩ ৪..."
"হয়েছে হয়েছে। চন্দ্রবিন্দুকে কোট করি দেবী। তোমাকে করবো আদর আত্মি যত্নম। চক্ষে এস অন্ধ হোক, কক্ষে এস নিন্দে হোক। বক্ষে এস গীতগোবিন্দ ভুলিয়া।"
"ত্বমাসি মম জীবনম?"
গীতগোবিন্দ ভুলে ততক্ষণে দুই নব্য কপোত কপোতী গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আরে বকবকানিও থামাতে হবে, নাকি?
"বুঝতেই পাচ্ছি মেজাজ তোর তিরিক্ষি হয়েছে। কিন্তু তা বলে বুদ্ধিশুদ্ধি যে মা গঙ্গার ভোগে চলে যাবে, এমনটা বুঝিনি রে। ডাইরেক্ট না দেখলেও আড়চোখে দেখা যায় রে হাঁদা।" জিভ দিয়ে একটা চুক চুক শব্দ করে অগ্নি বললো। প্রসঙ্গত এখনো মুখ না তুলেই।
"অগ্নি!! তখন থেকে আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখছিস আর তাও ফোন থেকে চোখ সরাচ্ছিসনা। ভালো লাগছেনা কিন্তু আমার।" এবারে বেশ রাগতস্বরেই কথাগুলো বললো রুমুন।
"তোর যা বলার বল না। আমি তো শুনছি।"
"আমি যখন কথা বলবো, আই নিড ফুল অ্যাটেনশন। বুঝেছিস?"
"আরে আমি ফুল অ্যাটেনশনই দিচ্ছি রে। জাস্ট দ্যাট এখানে এলন মাস্ক লাইভ উত্তর দিচ্ছেন লোকজনের। আমি তাই সেগুলি দেখছি। কিন্তু চাপ নিসনা। আমি শুনছিলাম।"
"না। আই ওয়ান্ট আই কন্ট্যাক্ট। আমি অপেক্ষা করছি। তুই শেষ কর যা করছিস। তারপর বলব কথা। আমার এরকম রোবটের সাথে কথা বলতে ভালো লাগেনা।"
"উফ, জ্বালালি। তুই জানিস আমি কীসে গলব। ঠিক সেই ওষুধটাই ব্যবহার করবি। বল।" ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে পাশে রাখতে রাখতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত মুখ করে অগ্নি বললো।
"শোন, আমার আবার ব্রেকাপ হয়েছে আজ। আমার খুব মন খারাপ।"
"এ আর নতুন কথা কী? তা এবারে জানি কে? রণজয়? না সোহেল?"
"সোমক। উফ। সোহেল ছিল লাস্ট ডিসেম্বরে। আর রণজয় আগের পুজোয়। তুই না!!"
"বাবা রে বাবা। তোর যদি একটার পর একটা রিলেশন হয়, আমি অত ট্র্যাক রাখি কী করে বল তো? সারাক্ষণ কি লেজার মেন্টেন করবো নাকি? লেখাপড়া নেই আমার?"
"ঢং করিসনা তো। নিজে তো আজ অবধি ওই অপর্ণাকে প্রোপোজ করে উঠতে পারলিনা। আবার আমায় খোঁটা দিচ্ছে। হুহ।"
"শোন, অপর্ণা আমার মিউজ। শি ইজ ইন এ রিলেশন উইদ অপূর্ব। আমি এমন রব নে বনা দি জোড়িকে ভেঙে পাপ করি নাকি।"
"নাকি রব নে বনা দি জোড়ি। হু।"
"ওসব তুই বুঝবি না। ট্যাঁস ট্যাঁস খামেল স্কুলে পড়লে বাংলা সিনেমা উপন্যাস আর জানবি কী করে।"
"ও আমার সবজান্তা। শোন আমিও কম পড়িনি বাংলা সাহিত্য। চর্যাপদ টু মঙ্গলকাব্য, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, সব জানি। "
"জীবনানন্দ জানিস বুঝি?"
"অবশ্যই। নাটোরের বনলতা সেন। বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।"
"হুম। বুঝলাম। তা বল তো দেখি, ভালোবাসা সবই খায়। শুকনো পাতা। হেমন্তের এঁটো খড়। বাগানের কোণে পড়ে থাকা রুগ্ন শিকড়। সবই খায়। শুধু খায় না আমাকে। এবং প্রতিদিন রোজ হাঁ করে আমারই সম্মুখে বসে থাকে। কার লেখা?"
"জানিনা।"
"শক্তি চট্টোপাধ্যায়।"
"বুঝলাম। তা আমি এসেছি ব্রেকআপের কষ্ট নিয়ে। উনি আমার সুনীল শক্তি জ্ঞান দিচ্ছেন।"
"শোন, আমার মতো জীবনে একটাও প্রেম না করা মানুষ আর কী বলবে তোকে? আমার দৌড় ওই সাহিত্য অবধি। সেখান থেকে টুকটাক যা খুশি বলতে পারি অল্পবিস্তর। প্র্যাকটিক্যাল নলেজ কোথায় পাব?"
"তা বলে আমার মন খারাপের দায়িত্ব নিবি না?"
"তুই সোমকের সাথে যখন ডেটে গিয়ে হুল্লোড় করলি, এন্তার মজা করলি, আর আমি বাড়ি বসে তখন জ্বরে কাঁপছি, তখন তুই কি এসে আমার দায়িত্ব নিয়েছিলি? নিসনি তো? তাহলে তুই কার না করে সাথে গিয়ে ব্রেকাপ করবি। তার দায় আমি নেব কেন?"
"তুই এরকম বলতে পারলি তো অগ্নি?" গলা কেঁপে গেল রুমুনের। এই না কেঁদে ফেলে। দিনটাই খারাপ। একে ব্রেকাপ। তারপর প্রিয়বন্ধুর এমন নিস্পৃহ হাবভাব।
"হ্যাঁ পারলাম।"
"সেই। বলবি তো। আমায় তো আর ভালোবাসিসনা। অপর্ণা থাকলে আমার জায়গায় কী করতিস, আমি সব জানি।"
"বাহ। এই তো। আমার সবজান্তা ম্যাডাম।"
"তুই চুপ কর। আমার বয়ফ্রেন্ডগুলো একটার পর একটা আমার সাথে ব্রেকাপ করে দেয়। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুইও আমার কথা ভাবিসনা। আমায় কেউ ভালোবাসেনা। হুহ। "
"নাটক করা থামলে বলিস। আমি ততক্ষণ এলন মাস্ক কী বলছে পড়ি।"
"হ্যাঁ তাই তো করবি। কোথায় আমায় সান্ত্বনা দিবি, তা না। উনি এলন মাস্ক ফলো করছেন। ফেলে দেব টান মেরে ফোনটা এই বলে দিলাম। তাকা আমার দিকে।"
"উফ আবার কী?"
"বল, আমি খুব আনলাভেবল, না?"
"এই দেখ, কাঁদছিস কেন? এই যে মেয়েদের কথা নেই বার্তা নেই, কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়। কী মুস্কিল!"
"বল না তুই। আমার কেন কেউ ভালোবাসে না? এই নিয়ে চার চারটে ব্রেকাপ হয়ে গেল গত তিন বছরে। দোষটা নিশ্চয়ই আমার। কই আর তো কারুর এরকম হয়না।"
"আরে ধুর। ওই সবকটা ছেলে ভুলভাল। তাই টেকেনি। তুই ভালো মেয়ে। তোকে কেন কেউ ভালোবাসবে না? ভালো যোগ্য ছেলেরা নিশ্চয়ই তোকে মাথায় করে রাখবে।"
"নমুনা দেখে তো উল্টে যাচ্ছি।"
"আরে হ্যাপেন্স। ওগুলো সব রং ডিসিশনস। তুই কদিন চুপচাপ শান্ত হয়ে থাক তো। এত ঝপাং ঝপাং করে রিলেশনে যাস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, একটা কথা। নিজেকে নিয়ে ভুলভাল ভাববি না। তুই এতটাই ভালো মেয়ে যে যে কেউ বর্তে যাবে তোকে পেলে। যারা তোকে পেয়েও হারায় নিজেদের দোষে, তারা সব একেকটি ড্যাশ।"
"শিয়র যে কেউ পেলে বর্তে যাবে?"
"অবশ্যই।"
"তুইও?"
"এখানে আমি কোত্থেকে এলাম আবার?"
"যা জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দে।"
"হুম। মানে ইয়ে।"
"কী ইয়ে? হবি কি হবি না বল?"
"মানে হবো। কিন্তু ... "
"গাধা তো এতদিন মুখ ফুটে বলতে কী হয়েছিল? ছাগল একটা।"
"কী বলব?
"বলবি যে ভালোবাসিস।"
"সিঙ্গল ছিলি কতদিন?"
"কম করে হলেও ছয় মাস মিলিয়ে মিশিয়ে।"
"তা ছাড়া আমি চাইনি ওইসব করে বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে।"
"ইডিয়ট। এই নাকি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড? এইটুকুও বুঝলিনা বুদ্ধু যে এতে আমাদের বন্ধুত্ব স্ট্রং হতো।"
"আর বাই চান্স ঘেঁটে গেলে?"
"প্রেম যেত। বন্ধুত্ব কখনোই না।"
"ওরম মনে হয়।"
"বড় এসেছে আমার সবজান্তা সর্বজ্ঞানী।"
"তা হলে?"
"প্রোপোজ কর বিফোর আই সে ইয়েস টু এনিবডি এলস। লম্বা লাইন আছে।"
"আমি প্রিভিলেজড? বাবা। এই দেখ এই বললাম হুটহাট প্রেমে পড়িস না। তাও আবার প্রোপোজ করাচ্ছিস। পারিসও বটে তুই।"
"১ থেকে ১০ গুনবো। বলার হলে বল। নইলে যা পালা। ১ ২ ৩ ৪..."
"হয়েছে হয়েছে। চন্দ্রবিন্দুকে কোট করি দেবী। তোমাকে করবো আদর আত্মি যত্নম। চক্ষে এস অন্ধ হোক, কক্ষে এস নিন্দে হোক। বক্ষে এস গীতগোবিন্দ ভুলিয়া।"
"ত্বমাসি মম জীবনম?"
গীতগোবিন্দ ভুলে ততক্ষণে দুই নব্য কপোত কপোতী গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আরে বকবকানিও থামাতে হবে, নাকি?
Tuesday, July 24, 2018
প্রথম রান্নাবাটি খেলা : খেলাঘর
অগ্নি আর রুমুনের নতুন সংসার। এতই নতুন যে গায়ে এখনও বেশ একটা নতুন বিয়ের গন্ধ লেগে আছে। একদম সাবেকি কায়দায় আনন্দবাজার পত্রিকায় রবিবারের পাত্র পাত্রী দেখে দুজনের বিয়ে হয়। অগ্নি থাকে সুদূর অ্যামেরিকায়, নিউ জার্সিতে। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। রুমুন অঙ্কে মাস্টার্স করে একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াত। টাইম জোনের পার্থক্যে দুজনের মধ্যে তেমন বেশী কথাবার্তাও হয়নি বিয়ের আগে, ওই চার পাঁচবার স্কাইপে হাই হ্যালো আর ফেসবুকে একে অপরের ছবিতে বা স্ট্যাটাসে লাইক করা ছাড়া। এমনকি, লাইক ছেড়ে লাভেও পৌঁছয়নি, তার মধ্যেই বৈশাখের এক প্রচণ্ড ভ্যাপসা সন্ধ্যায় দুইজনে আবদ্ধ হল বিবাহ নামক বন্ধনে।
অগ্নি অফিস বেরিয়ে যায় সকাল সকাল। ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে। সারাদিন রুমুনের একা কাটে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে তেমনভাবে কথাবার্তা খুব যে হয়, তা না। পি এইচ ডি অ্যাপলিকেশন নিয়ে খানিক সময় ব্যয় করে আর ঘরকন্নার কাজেই দিন কেটে যায়। উইকেন্ড হলে তাও একটু বৈচিত্র্য। দুজনে তখন গাড়ি নিয়ে হয় লঙ ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ে, নয় কাছেপিঠে সিনেমা শপিং ইত্যাদি।
রবিবার সাধারণত ওরা একটু বেলা করেই ওঠে। তবে আজ অন্যান্য রবিবারের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। আজ বিশ্বকাপ ফাইনাল। অগ্নির সাপোর্ট ফ্রান্সের জন্য আর রুমুনের ক্রোয়েশিয়া। সক্কাল সক্কাল উঠে যাবতীয় কাজ কর্ম সেরে ওরা জমিয়ে খেলা দেখবে। আগেরদিন থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয়েছে মজার ছলে রেষারেষি। কোন দল কত গোল দেবে আর কত খাবে, সেই নিয়ে মৌখিক লড়াই চলছে।
"শোনো, আজ যদি ফ্রান্স জেতে না, যদি বলছি কেন, জিতবেই, তাহলে কিন্তু আমরা ডিনারে ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টে যাব কোন।" গরম গরম লুচি ছোলার ডাল মুখে পুরতে পুরতে অগ্নি বলে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পাশ থেকে রুমুন ওমনি ফুট কাটে, "হ্যাঁ, ওই আনন্দেই থাকো। ক্রোয়েশীয় রান্নাবান্নার ধরণধারণ কিছু জানিনা বলে সেই রিস্ক নিচ্ছিনা। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া জেতার পর আমি যা চাইব, তোমায় তা দিতেই হবে। বুঝলে?"
"আমি রাজি এই বেটে। তবে একই শর্ত তোমার জন্যও প্রযোজ্য কিন্তু মাদাম!"
"ঠিক আছে!"
যথারীতি খেলা শুরু হলো। ফ্রান্সের ১-০ থেকে ১-১ হয়ে যতক্ষণে ৪-২ এ শেষ হল, ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে বিচিত্র ছবি। অগ্নি লাফালাফি করছে, যেন নিজেই গোল করেছে দু তিনটে। আর রুমুন প্রায় হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে।
"কী, ফেসবুকটা খোলো। দেখো কি স্টেটাস দিলাম!" মুচকি হেসে অগ্নি বলল। রুমুন একবার তাকালো ওর দিকে, তারপর চোখ মুছে বেশ অনিচ্ছাসহ ফোনটা হাতে নিলো। নোটিফিকেশন। "Agni Sen has tagged you in a post. Please review it before it appears on your timeline", স্টেটাস্টি এই প্রকার, "আজ বৌকে ৪-২ গোলে হারালাম। উফ, কী আনন্দ।" সেখানে ইতিমধ্যেই লাইক আর কমেন্টের বন্যা। "এসব বলিস না, হোম মিনিস্টার রাগ করবে", "কপালে গভীর দুঃখ আছে", "বৌদি কি ফেসবুকে নেই নাকি?" ইত্যাদি ইত্যাদি। রাগে মটমট করতে করতে রুমুন দোতলায় বেডরুমে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। বেচারা অগ্নি। রুমমেট ভেবে ঘোরের মধ্যে দিব্যি পাঙ্গা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এ যে এক্কেবারে আনকোরা পরিস্থিতি। বউ অভিমান করেছে। এর সমাধান?
তখনই মনে পড়ল কোন ছোটবেলায় মায়ের সাথে ডেন্টিস্টের কাছে বসে সানন্দা বা সাপ্তাহিক বর্তমান, কোথাও একবার পড়েছিল বটে। "The way to a man's heart is through his stomach", এই ক্ষেত্রে জেন্ডার পরিবর্তন করলেও নিশ্চয়ই একই টোটকা খাটা উচিত। যেমন ভাবা তেমনই কাজ।
তিন বছর বাড়ির বাইরে থাকার সুবাদে রান্নাবান্না মোটামুটি ভালোই রপ্ত ছিল অগ্নির। লেগে পড়ল কাজে। পেঁয়াজ কাটা, লঙ্কা কুঁচি, ডিম ফেটানো, আলু স্লাইস করা। ঘন্টাখানেকের কসরতের পর একটা বড় ট্রেতে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে বেডরুমে গেল।
দুই তিনবার নক করার পর রুমুন দরজা খুলল। কেঁদেকেটে বেচারি মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। কেমন অদ্ভুত মায়া হলো অগ্নির ওকে দেখে। ট্রেটা টেবিলে নামিয়ে এক্কেবারে দুই কানে হাত দিয়ে, "সরি, ভুল হয়ে গিয়েছে। আর কক্ষনো করবো না। এক্ষুনি একটা কারেকশন করে পোস্ট দিয়ে দিচ্ছি ফেসবুকে" বলতেই রুমুন ছলছল চোখে হেসে বলল, "হয়েছে। থাক। আর হ্যাঁ, সবকিছু অত ফেসবুকে দিতে হবেনা। কিছু মুহূর্ত তো নিজেদের থাকুক, নাকি?"
"ইউ আর রাইট মাদাম! শোনো রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলে গিয়েছিলেন, পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য। তেমনই আমি বলছি সেইটাকেই প্যারাফ্রেজ করে, পতির টিমের জয়েই পত্নীর টিমেরও জয় অ্যান্ড ভাইসে ভারসা। তাছাড়া দেখো ইন্ডিয়া কোয়ালিফাইই করেনি। আমরা কেন মিছিমিছি লড়বো বলো?"
"যাক তাহলে ভদ্রলোকের সুমতি হলো! তা কী রান্না করে আনলে দেখি? খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে।"
"ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ!"
"ওয়াও, দুটোই ফেভারিট আমার।"
"বোঝো কাণ্ড। শুধু খেলা দেখার সময় অ্যান্টি ফ্রান্স নাকি?"
খিল খিল করে হেসে ওঠে রুমুন। ততক্ষণে ফ্রেঞ্চ টোস্টে বড় এক কামড় পড়ে গিয়েছে। মুখে খাবার নিয়েই বলে, "উম্মম্ম, দারুণ ক্রিস্পি হয়েছে। একদম মায়ের হাতের রান্নার মতো। ও, কী জানি বলছিলে? অ্যান্টি ফ্রান্স? না না। ওটা অ্যান্টি তুমি। তুমি ক্রোয়েশিয়াকে সাপোর্ট করলে আমি ফ্রান্সকে করতাম!"
"হে ভগবান! নারী চরিত্র সত্যিই..."
"হুম। বুঝবার চেষ্টাও করো না!"
"বেশ বেশ। তা ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ তো হল। এবার একটা ফ্রেঞ্চ কিস হয়ে যাক? সেলিব্রেশনটা কমপ্লিট হোক? কী বলো?"
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ২
হন্তদন্ত হয়ে রুমুন এসে পৌঁছলো কফিশপে। কফিশটি চার্লস নদীর ধারে। অদূরে বোস্টন শহরের আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা। ধূসর। বর্ণহীন। রুমুনের পরনেও সেই ছাইরঙা বিজনেস সুট। কফিশপে দরজা ঠেলে ঢুকতেই বুকের ভিতরের ধুকপুকুনিটা যেন বেড়ে গেলো বেশ অনেকটাই। কিছুটা দৌড়ের জন্য, তবে সিংহভাগই সেই কুড়ি বছর আগের এমনি এক বাদলা সকালের মতোই। এক অজানা অনুভূতির জের।
বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে একটা নীল রঙের গ্রাফিক টিশার্ট পরে অবিন্যস্ত চুলে মাঝে মাঝে দান হাতটি বোলাচ্ছিলো অগ্নি। অন্য হাতে সাদা সেলোফেনে মোড়া এক গুচ্ছ টাটকা ফোটা স্নিগধ হলুদ গোলাপ। এক্সাইডের সিগনালে গাড়িটা যখন আটকে, ঠিক এমনটাই দেখেছিল রুমুন। কখন যে সিগনাল লাল থেকে সবুজ হবে, এ যেন ধৈর্য্যের বিষম পরীক্ষা। অবশেষে মোড়ের মাথায় জল কাদা বাঁচিয়ে রুমুন যখন নামলো, অগ্নি তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে।
ঠিক ওর পাশটাতে গিয়ে দাঁড়ালো রুমুন। পাঁচ ফুট সাতের পাশে কোনোমতে পাঁচ ছুঁই ছুঁই। একটু কষ্ট করেই আর খানিকের ইতস্তত কাটিয়ে অগ্নির কাঁধে হালকা একটা টোকা মারল।
"ও তুই? কোনদিক দিয়ে এলি?" চমকে এ পাশ ফিরে রুমুনকে দেখে অগ্নি বললো।
"এই তো। এস পি মুখার্জি দিয়ে। দাদা নামিয়ে দিয়ে গেল।"
"ও। আমি ভাবছিলাম তুই ঐদিক দিয়ে আসবি। আসলে আমার সেন্স অফ ডিরেকশন বড্ড পুয়োর।"
"অনেক্ষণ অপেক্ষা করে আছিস, না? পুরো ভিজে স্নান হয়ে গিয়েছিস যে। সো সরি।"
"আরে না না। ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর আর কী, ফুলের দোকানে ফেলে এসেছি।"
"ও।"
"আমি খুব ভুলো। এই দেখ, এই এত বকে চলেছি। অথচ তোকে এটাই দিলাম না এখনও। ইয়ে, মানে, কী নেয়া উচিত, কী করা উচিত, কিছু বুঝেছিলাম না। তাই। এই যে।"
যদিও লাল গোলাপ পেলে রুমুনের বেশি ভালো লাগত, তাও প্রথম দিনেই সেটা আবার বাড়াবাড়ি প্রত্যাশা হবে কি না, এইসব ভাবতে ভাবতে রুমুন ত্রস্ত হাতে গোলাপগুলি নিলো।অগ্নির হাত থেকে। আর ওই যে মুহূর্তের স্পর্শ, শরীর মন জুড়ে খেলে গেল বিদ্যুতরেখা। ভালো কোনো সিনেমাটোগ্রাফার হলে হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে নিদেনপক্ষে একটা ভায়োলিন বাজিয়ে দিতেন। কিন্তু এ যে ভারী বাস্তব জীবনে। অর্কেস্ট্রার বদলে শুধুই অফিস টাইমের ব্যস্ত কলকাতার এলোমেলো কর্কশ হর্ন, নেই তাতে কোনো সুর, নেই কোনো ছন্দ।
"থ্যাংক ইউ। হলুদ আমার প্রিয় রঙ। খুব পছন্দ হয়েছে।"
"যাক বাঁচালি। আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম। হলুদ নেব না লাল। তারপর মনে পড়ল ফেসবুকে তোর সব ছবিতেই হলুদের ছোঁয়া লেগে থাকে। তাই।"
"বুঝলাম। তা আমাদের এখন কী প্ল্যান? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো? না কি কোথাও বসা যায়?"
"বসা তো যায়ই। তবে এই যা অবস্থা আমার। কোনো ট্যাক্সিই উঠতে দেবেনা। এR তুইও মনে হয় অফিস টাইমের বাসের ভিড়ে শাড়ি পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবি না।"
"অগত্যা?"
"হলদিরাম?"
"ন্যা। প্লিজ।"
"তাহলে? হাঁটবি?"
"কোথায়?"
"নির্দিষ্ট কিছু নেই। এমনিই। উদ্দেশ্যহীনভাবে। আকাশও ফর্সা হচ্ছে যখন ক্রমশ।"
"নট এ ব্যাড আইডিয়া।"
"ব্যস্ত কলকাতার পথে আমরা দুই জবলেস পাবলিক।"
"জবলেস বলিসনা অগ্নি। কলেজে ক্লাস কেটেছি দুজনেই। দেখা করাটা কাজ না?"
" না না। কাজ বললেই কেমন একটা দায়বদ্ধতা এসে যায়। হাজার কমিটমেন্ট, হাজার নিয়ম।"
"তো আমরা তো কমিটেড, না কি?"
"Yes of course, but we should be like free birds - যতক্ষণ ভালো লাগছে, থাকবো। আর তারপর মন্দবাসা মন্দলাগা এসে গেলে তিক্ততা এড়াতে দূরে সরে যাবো।"
"কপাল। প্রথম ডেটে এসে কী কথার ছিরি।" এক দমকা হেসে রুমুন বললো। হাসি আবার সংক্রামক। অগ্নিও তখন হাসির জোয়ারে গা ভাসিয়েছে।
সেদিন অনেক্ষণ ধরে হেঁটেছিল ওরা দুজন। বাস রাস্তা, গলি ঘিঞ্জি, পার্ক কিচ্ছু বাদ পড়েনি। আর গল্পের বিষয়? সে কখনো বা আবোল তাবোলের ননসেন্স কবিতার চর্চা করে তো কখনো এক ধাপে Gangs of Wasseypur, কখনো Pete Seegerএর Little Boxes তো কখনো চন্দ্রবিন্দুর গীতগোবিন্দ। শক্তি সুনীল যেমন বাদ যায়নি, তেমনই বাদ পড়েনি Love in the times of cholera। রোগ ব্যাধি থেকে একলাফে সিদ্ধারথ মুখারজীর "জিন", তো পরমুহূর্তেই সিদ্ধারথ শঙ্কর রায় হয়ে রাজ্য রাজনীতি। হাতে হাত না ধরেও, মাঝে মাঝে ওই ইচ্ছাকৃত ভুলে একে অপরের স্পর্শে দুজনেই অল্প হলেও awkward অনুভব করছিল শুরুতে বটে, তবে ফিরটি পথে ট্যাক্সির পিছনের সীটে বসে যখন সাহস করেই রুমুন নিজের ছোট আঙুলগুলি অগ্নির লম্বা লম্বা আঙুলের ফাঁকে গলালো, দুজনেই কিছুই যেন হয়নি, এমন একটা ভাব দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারল না। এক ঝটকায় দুজনেই একই সাথে হাত সরিয়ে, সরি বলল খুব নিচু গলায়।
আর তারপর ইস্ট রোডের মুখে ট্যাক্সি থেকে যখন রুমুন নামছে, অগ্নি একেবারে যাকে out of the blue বলে, বলল, "নাহ, কাজল না ধেবড়ালেও মেয়েদের তাহলে ভালোই লাগে দেখতে।"
বোঝো কাণ্ড! এতদিনের অভ্যেসে সবেমাত্র আজ প্রথম না ধেবড়ে কাজল পরল, আর অগ্নির কি না এই মন্তব্য! কী অবস্থা!
রুমুন হাল্কা হেসে বলল, "আমার আবার অপর্ণা ছাড়া কাউকেই ওইরকম সাজে ভালো লাগেনা। অপুর সংসারের আমার প্রিয় সিন। বহুকাল অবধি ফেসবুকের কাভার পিকচার ছিল।"
যাক। অবশেষে অগ্নি নিশ্চিন্ত। সোলমেট কি না বলাটা এখনই too early, কিন্তু এগোতে পারে বটেই।
"আর শোন, আজ থেকে আমার প্রিয় রঙ, কমলা।"
"কী রে, কতক্ষণ ধরে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছিস বল তো? কী ভাবছিস?" বছর চল্লিশের অগ্নির ডাকে সম্বিৎ ফিরল রুমুনের। অগ্নিটা সেই একই আছে। সেই অবিন্যস্ত চুল,কুঁচকানো গ্রাফিক টিশার্ট। কানের পাশে হাল্কা দুই তিনটে রূপোলী আভা।
তুলনায়, রুমুন অনেক বদলে গিয়েছে। বিশাল কর্পোরেট চাকরির ধকল, ব্যক্তিগত জীবনে বেশ বড় কয়েকটা ঝড় ঝাপটা। চোখের কোণের কালীগুলো দামী মেকআপেও তেমনভাবে ঢাকা যায়না।
ক্যাপুচিনো আর ফ্রাইজ অর্ডার দিয়ে কত বছর পর ওরা আবার মুখোমুখি বসল।
"ভালো আছিস রুমুন?"
"হুম। যেমন দেখছিস।"
"বেশ।"
"তুই বল। কেমন আছিস? এত ব্যস্ত মানুষ অগ্নি, হঠাৎ বস্টনে?"
"তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো রে। NABCতে নিউ জার্সি এসেছিলাম ষও করতে। ওখানে একদিন একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভীষণভাবে তোর কথা মনে পড়ল। বুকের এই বা দিকটাতে কেমন চিনচিনে ব্যথা হতে লাগল। ভাবলাম চল্লিশ পেরলাম। অ্যাটাক হচ্ছে নাকি? তারপর নিজেই বুঝলাম। ব্যাপারটা মানসিক। ফেসবুক খুলে তক্ষুনি তাই তোকে পিং করলাম। And here I am madam..."
তুই আর পালটালি না! সেই ইম্পালসিভ রয়েই গেলি!"
"হুম। অভ্যেস পালটানো যায়। স্বভাব না। শোন, আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যায় না রে রুমুন?"
"আবার? আবার যদি সেই নোংরা কুৎসিত হয়ে যাই আমরা নিজেদের কাছে? এই তো বেশ ভালো আছি।"
"পনেরো দেখা হওয়া, এই ভালো?"
"মন্দ কী? Distance আছে বলেই আমরা একে অপরকে মিস করছি। ভালোটুকু মনে রেখেছি। এই থাক না?"
"তুই যা বলবি। বাই দি ওয়ে, কাজলটা ধেবড়ে বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু।"
রুমুনের মুখের অপর তখন পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের মলিন হলুদআভা। এবারেও অগ্নি নিজেরটুকুর জন্য লড়াইটা লড়ল না ওর সাথে। বড্ড সুবোধ বালকের মতোই মেনে নিলো ওর কথা।
বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে একটা নীল রঙের গ্রাফিক টিশার্ট পরে অবিন্যস্ত চুলে মাঝে মাঝে দান হাতটি বোলাচ্ছিলো অগ্নি। অন্য হাতে সাদা সেলোফেনে মোড়া এক গুচ্ছ টাটকা ফোটা স্নিগধ হলুদ গোলাপ। এক্সাইডের সিগনালে গাড়িটা যখন আটকে, ঠিক এমনটাই দেখেছিল রুমুন। কখন যে সিগনাল লাল থেকে সবুজ হবে, এ যেন ধৈর্য্যের বিষম পরীক্ষা। অবশেষে মোড়ের মাথায় জল কাদা বাঁচিয়ে রুমুন যখন নামলো, অগ্নি তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে।
ঠিক ওর পাশটাতে গিয়ে দাঁড়ালো রুমুন। পাঁচ ফুট সাতের পাশে কোনোমতে পাঁচ ছুঁই ছুঁই। একটু কষ্ট করেই আর খানিকের ইতস্তত কাটিয়ে অগ্নির কাঁধে হালকা একটা টোকা মারল।
"ও তুই? কোনদিক দিয়ে এলি?" চমকে এ পাশ ফিরে রুমুনকে দেখে অগ্নি বললো।
"এই তো। এস পি মুখার্জি দিয়ে। দাদা নামিয়ে দিয়ে গেল।"
"ও। আমি ভাবছিলাম তুই ঐদিক দিয়ে আসবি। আসলে আমার সেন্স অফ ডিরেকশন বড্ড পুয়োর।"
"অনেক্ষণ অপেক্ষা করে আছিস, না? পুরো ভিজে স্নান হয়ে গিয়েছিস যে। সো সরি।"
"আরে না না। ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর আর কী, ফুলের দোকানে ফেলে এসেছি।"
"ও।"
"আমি খুব ভুলো। এই দেখ, এই এত বকে চলেছি। অথচ তোকে এটাই দিলাম না এখনও। ইয়ে, মানে, কী নেয়া উচিত, কী করা উচিত, কিছু বুঝেছিলাম না। তাই। এই যে।"
যদিও লাল গোলাপ পেলে রুমুনের বেশি ভালো লাগত, তাও প্রথম দিনেই সেটা আবার বাড়াবাড়ি প্রত্যাশা হবে কি না, এইসব ভাবতে ভাবতে রুমুন ত্রস্ত হাতে গোলাপগুলি নিলো।অগ্নির হাত থেকে। আর ওই যে মুহূর্তের স্পর্শ, শরীর মন জুড়ে খেলে গেল বিদ্যুতরেখা। ভালো কোনো সিনেমাটোগ্রাফার হলে হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে নিদেনপক্ষে একটা ভায়োলিন বাজিয়ে দিতেন। কিন্তু এ যে ভারী বাস্তব জীবনে। অর্কেস্ট্রার বদলে শুধুই অফিস টাইমের ব্যস্ত কলকাতার এলোমেলো কর্কশ হর্ন, নেই তাতে কোনো সুর, নেই কোনো ছন্দ।
"থ্যাংক ইউ। হলুদ আমার প্রিয় রঙ। খুব পছন্দ হয়েছে।"
"যাক বাঁচালি। আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম। হলুদ নেব না লাল। তারপর মনে পড়ল ফেসবুকে তোর সব ছবিতেই হলুদের ছোঁয়া লেগে থাকে। তাই।"
"বুঝলাম। তা আমাদের এখন কী প্ল্যান? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো? না কি কোথাও বসা যায়?"
"বসা তো যায়ই। তবে এই যা অবস্থা আমার। কোনো ট্যাক্সিই উঠতে দেবেনা। এR তুইও মনে হয় অফিস টাইমের বাসের ভিড়ে শাড়ি পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবি না।"
"অগত্যা?"
"হলদিরাম?"
"ন্যা। প্লিজ।"
"তাহলে? হাঁটবি?"
"কোথায়?"
"নির্দিষ্ট কিছু নেই। এমনিই। উদ্দেশ্যহীনভাবে। আকাশও ফর্সা হচ্ছে যখন ক্রমশ।"
"নট এ ব্যাড আইডিয়া।"
"ব্যস্ত কলকাতার পথে আমরা দুই জবলেস পাবলিক।"
"জবলেস বলিসনা অগ্নি। কলেজে ক্লাস কেটেছি দুজনেই। দেখা করাটা কাজ না?"
" না না। কাজ বললেই কেমন একটা দায়বদ্ধতা এসে যায়। হাজার কমিটমেন্ট, হাজার নিয়ম।"
"তো আমরা তো কমিটেড, না কি?"
"Yes of course, but we should be like free birds - যতক্ষণ ভালো লাগছে, থাকবো। আর তারপর মন্দবাসা মন্দলাগা এসে গেলে তিক্ততা এড়াতে দূরে সরে যাবো।"
"কপাল। প্রথম ডেটে এসে কী কথার ছিরি।" এক দমকা হেসে রুমুন বললো। হাসি আবার সংক্রামক। অগ্নিও তখন হাসির জোয়ারে গা ভাসিয়েছে।
সেদিন অনেক্ষণ ধরে হেঁটেছিল ওরা দুজন। বাস রাস্তা, গলি ঘিঞ্জি, পার্ক কিচ্ছু বাদ পড়েনি। আর গল্পের বিষয়? সে কখনো বা আবোল তাবোলের ননসেন্স কবিতার চর্চা করে তো কখনো এক ধাপে Gangs of Wasseypur, কখনো Pete Seegerএর Little Boxes তো কখনো চন্দ্রবিন্দুর গীতগোবিন্দ। শক্তি সুনীল যেমন বাদ যায়নি, তেমনই বাদ পড়েনি Love in the times of cholera। রোগ ব্যাধি থেকে একলাফে সিদ্ধারথ মুখারজীর "জিন", তো পরমুহূর্তেই সিদ্ধারথ শঙ্কর রায় হয়ে রাজ্য রাজনীতি। হাতে হাত না ধরেও, মাঝে মাঝে ওই ইচ্ছাকৃত ভুলে একে অপরের স্পর্শে দুজনেই অল্প হলেও awkward অনুভব করছিল শুরুতে বটে, তবে ফিরটি পথে ট্যাক্সির পিছনের সীটে বসে যখন সাহস করেই রুমুন নিজের ছোট আঙুলগুলি অগ্নির লম্বা লম্বা আঙুলের ফাঁকে গলালো, দুজনেই কিছুই যেন হয়নি, এমন একটা ভাব দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারল না। এক ঝটকায় দুজনেই একই সাথে হাত সরিয়ে, সরি বলল খুব নিচু গলায়।
আর তারপর ইস্ট রোডের মুখে ট্যাক্সি থেকে যখন রুমুন নামছে, অগ্নি একেবারে যাকে out of the blue বলে, বলল, "নাহ, কাজল না ধেবড়ালেও মেয়েদের তাহলে ভালোই লাগে দেখতে।"
বোঝো কাণ্ড! এতদিনের অভ্যেসে সবেমাত্র আজ প্রথম না ধেবড়ে কাজল পরল, আর অগ্নির কি না এই মন্তব্য! কী অবস্থা!
রুমুন হাল্কা হেসে বলল, "আমার আবার অপর্ণা ছাড়া কাউকেই ওইরকম সাজে ভালো লাগেনা। অপুর সংসারের আমার প্রিয় সিন। বহুকাল অবধি ফেসবুকের কাভার পিকচার ছিল।"
যাক। অবশেষে অগ্নি নিশ্চিন্ত। সোলমেট কি না বলাটা এখনই too early, কিন্তু এগোতে পারে বটেই।
"আর শোন, আজ থেকে আমার প্রিয় রঙ, কমলা।"
"কী রে, কতক্ষণ ধরে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছিস বল তো? কী ভাবছিস?" বছর চল্লিশের অগ্নির ডাকে সম্বিৎ ফিরল রুমুনের। অগ্নিটা সেই একই আছে। সেই অবিন্যস্ত চুল,কুঁচকানো গ্রাফিক টিশার্ট। কানের পাশে হাল্কা দুই তিনটে রূপোলী আভা।
তুলনায়, রুমুন অনেক বদলে গিয়েছে। বিশাল কর্পোরেট চাকরির ধকল, ব্যক্তিগত জীবনে বেশ বড় কয়েকটা ঝড় ঝাপটা। চোখের কোণের কালীগুলো দামী মেকআপেও তেমনভাবে ঢাকা যায়না।
ক্যাপুচিনো আর ফ্রাইজ অর্ডার দিয়ে কত বছর পর ওরা আবার মুখোমুখি বসল।
"ভালো আছিস রুমুন?"
"হুম। যেমন দেখছিস।"
"বেশ।"
"তুই বল। কেমন আছিস? এত ব্যস্ত মানুষ অগ্নি, হঠাৎ বস্টনে?"
"তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো রে। NABCতে নিউ জার্সি এসেছিলাম ষও করতে। ওখানে একদিন একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভীষণভাবে তোর কথা মনে পড়ল। বুকের এই বা দিকটাতে কেমন চিনচিনে ব্যথা হতে লাগল। ভাবলাম চল্লিশ পেরলাম। অ্যাটাক হচ্ছে নাকি? তারপর নিজেই বুঝলাম। ব্যাপারটা মানসিক। ফেসবুক খুলে তক্ষুনি তাই তোকে পিং করলাম। And here I am madam..."
তুই আর পালটালি না! সেই ইম্পালসিভ রয়েই গেলি!"
"হুম। অভ্যেস পালটানো যায়। স্বভাব না। শোন, আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যায় না রে রুমুন?"
"আবার? আবার যদি সেই নোংরা কুৎসিত হয়ে যাই আমরা নিজেদের কাছে? এই তো বেশ ভালো আছি।"
"পনেরো দেখা হওয়া, এই ভালো?"
"মন্দ কী? Distance আছে বলেই আমরা একে অপরকে মিস করছি। ভালোটুকু মনে রেখেছি। এই থাক না?"
"তুই যা বলবি। বাই দি ওয়ে, কাজলটা ধেবড়ে বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু।"
রুমুনের মুখের অপর তখন পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের মলিন হলুদআভা। এবারেও অগ্নি নিজেরটুকুর জন্য লড়াইটা লড়ল না ওর সাথে। বড্ড সুবোধ বালকের মতোই মেনে নিলো ওর কথা।
Monday, July 23, 2018
কলেজের প্রথম দিন : ইন্ট্রো
থার্ড পিরিয়ড শেষের বেলটা বাজলেই কেমিস্ট্রি অনার্সের প্রথম বর্ষের এই গোটা কুড়ি ছাত্র ছাত্রীর বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে। সবে এক সপ্তাহ হল হাই স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে এসেছে। সিনিয়রদের সাথে রোজই দেখা হবো হবো করেও হচ্ছেনা। আর সেইখানেই হয়েছে মুস্কিল। বোটানি জুলজি স্ট্যাটস ফিজিক্স সব ডিপার্টমেন্টেই "সাক্ষাৎকার" ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। সেখানে পড়া বন্ধুদের থেকে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনে মনের মধ্যে সকলেরই কী জানি কী হয় গোছের একটা শুরু হয়ে গিয়েছে। এদিকে কেমিস্ট্রির দাদা দিদিদের দেখাই নেই।
"আমার তো মনে হয় আমাদের সিনিয়রগুলো খুব ভীতু। পাছে আমরা র্যাগিং ট্যাগিং নিয়ে কমপ্লেন করে দিই, সেই ভয়ে আসছে না ধারে কাছে।" অনিমেষ মন্তব্য করল। সঙ্গে সঙ্গে এলো সুমিলার উত্তর, "তুই যে কী চিজ, সেই খবরটা ওদের কানে মনে হয় এর মধ্যেই আকাশলীনা তুলে দিয়েছে। তোর ভয়ে হয়তো এ মুখো হচ্ছে না।"
" বাজে কথা বলিসনা তো যত। নিশ্চয়ই ওরা ব্যস্ত প্র্যাক্টিকাল নিয়ে, তাই আসছেনা। সারাক্ষণই তো দেখছি ল্যাবে মুখ গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে ওরা।" দীপের প্রাজ্ঞ মতামত এলো।
"কাটা ওসব। চল খেয়ে আসি। কালকের ভেজ চপটা যা ছিল না। আজ আমি দুটো খাবোই।" অনিমেষ তাড়া লাগাল। "হ্যাঁ সেই। যে যার নিজের তালে। এই শ্রুতি, চল চল। একা একা ওই কোণে বসে আছিস কেন রে?" সুমিলা হাঁক দিল।
একটা কোণে ফার্স্ট বেঞ্চে তখন চুপ করে বসে ওদের কথা শুনছিল শ্রুতি। ক্লাসের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে। এসেছে বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। শহুরে ঠাটবাটে এখনও অভ্যস্ত হয়নি। তাই সবার মতো অত উচ্ছ্বল না। চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে হাসে। ব্যস এইটুকুই। মেস থেকে টিফিন নিয়ে আসে একটা স্টিলের ঝোলা করে। টিফিন ব্রেকে ওই কোণে বসেই খুঁটে খুঁটে খায়। আর সাথে মাকে ফোন করে একটু গল্প করে। আজ সুমিলার ডাকে না বলতে পারল না। টিফিনসহ উঠে পড়ল। ওরা সবাই মিলে সবে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সামনে প্রায় গোটা পনেরোজনের একটা জটলা।
"ফার্স্ট ইয়ার তো। চল সব ঝটপট ক্লাসে ঢোক। ইন্ট্রো হবে আজ।"
ব্যস, যা নিয়ে এতদিনের টেনশন ছিল সবার, অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি এসেই গেলো।
সিনিয়রদের দলের মধ্যে এক দিদি, বেশ স্মার্ট চেহারা। জিন্স টপ পরে, মাথায় লম্বা বিনুনি। কানে বড় দুল। চোখে নীল আইলাইনার, জামার সাথে ম্যাচ করে। সেই যত কথা বলার বলে যাচ্ছিল। প্রথমে ওদের ব্যাচের সকলের পরিচয় দিল জুনিয়রদের কাছে। এক এক করে নাম বলছে আর শ্রুতি তাকিয়ে দেখছে। তমাল, পলাশ, অনন্যা, মৃণাল, রৌশন, জুনেইদ, শাক্য, পল্লবী, কমলিকা...আনন্দ। এই শেষ নামটি যার, তার দিকে তাকিয়ে শ্রুতি যেন আর চোখ ফেরাতে পারেনা। কী সৌম্য চেহারা। কালো ফতুয়া, নীল জিন্স প্যান্ট পরে, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা। ফর্সা গালে দুদিনের না কাটা দাড়ির হাল্কা আভা।
শাক্য বলে ছেলেটি এরপর এক এক করে শ্রুতিদের ব্যাচের সকলকে ডাকল ডায়াসে। শুরু হল "পরিচিতি"। সকলকে যে যা ভালো পারে, সেইরকম কিছু করতেই বলা হচ্ছিল। সুমিলা নাচল অপূর্ব। দীপ দারুণ মিমিক্রি করল। অনিমেষ আবৃত্তি করল। শ্রুতির পালা এলো। বড় লাজুক মেয়ে। কী পারে ভালো, জিজ্ঞেস করতে ও প্রায় মিনমিন করেই বলল, "কিছুই না।" আনন্দ একটু মুচকি হেসে ওর দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে বলল, "বাঙালি মেয়ে। কিছু পারিস না, তা তো স্বয়ং ঈশ্বর এসে বললেও আমি বিশ্বাস করবো না! গান বা নাচ নিশ্চয়ই শিখেছিস। কিছু একটা করতেই হবে।"
"সত্যি বলছি। আমি কিছুই পারিনা।"
নীল আইলাইনার দিদি হই হই করে উঠল, "ধ্যাত, ভাও খাস না তো। টিফিন শেষ হতে চলল। গেয়ে দে। বা নেচে দে। ব্যস তোদের ছুটি। ঝটপট কর। আর যতক্ষণ না করছিস কিছু, ছুটি নেই। এই বলে দিলাম। চল।"
ইতিমধ্যে শ্রুতির দু চোখ জলে টইটুম্বুর। ওর ব্যাচমেট, মেঘনা আলতো করে ওর হাতটা চেপে ধরল। কানে কানে বলল, "তুই কিছু একটা গেয়ে দে প্লীজ। দু লাইন অন্তত। চোখ বন্ধ করে গা। তাহলেই হবে। ভয় পাস না। আমরা আছি তো সাথে। কিন্তু না গাইলে ওরা জ্বালিয়ে মারবে। প্লীজ শ্রুতি। ভয় পাস না লক্ষ্মীটি।"
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে শ্রুতি বড় করে ঢোঁক গিলল একটা। তারপর শুরু করল ওর রেওয়াজি গলায় "মোহে রঙ দো লাল ..."
গাইতে গাইতে ও তো বিভোর হয়েছিল, সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গোটা ক্লাস হাঁ হয়ে শুনল ওর গান। গানের শেষে প্রবল হাততালিতে ভরে গেলো ক্লাসরুম।
বলাই বাহুল্য, সেইদিনের পর থেকে শ্রুতির আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। উপরি পাওনা ফ্রেশারসে আনন্দর সাথে তিনটে ডুয়েট গাইবার সুযোগ। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল বটে দুজনেই।
"আমার তো মনে হয় আমাদের সিনিয়রগুলো খুব ভীতু। পাছে আমরা র্যাগিং ট্যাগিং নিয়ে কমপ্লেন করে দিই, সেই ভয়ে আসছে না ধারে কাছে।" অনিমেষ মন্তব্য করল। সঙ্গে সঙ্গে এলো সুমিলার উত্তর, "তুই যে কী চিজ, সেই খবরটা ওদের কানে মনে হয় এর মধ্যেই আকাশলীনা তুলে দিয়েছে। তোর ভয়ে হয়তো এ মুখো হচ্ছে না।"
" বাজে কথা বলিসনা তো যত। নিশ্চয়ই ওরা ব্যস্ত প্র্যাক্টিকাল নিয়ে, তাই আসছেনা। সারাক্ষণই তো দেখছি ল্যাবে মুখ গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে ওরা।" দীপের প্রাজ্ঞ মতামত এলো।
"কাটা ওসব। চল খেয়ে আসি। কালকের ভেজ চপটা যা ছিল না। আজ আমি দুটো খাবোই।" অনিমেষ তাড়া লাগাল। "হ্যাঁ সেই। যে যার নিজের তালে। এই শ্রুতি, চল চল। একা একা ওই কোণে বসে আছিস কেন রে?" সুমিলা হাঁক দিল।
একটা কোণে ফার্স্ট বেঞ্চে তখন চুপ করে বসে ওদের কথা শুনছিল শ্রুতি। ক্লাসের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে। এসেছে বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। শহুরে ঠাটবাটে এখনও অভ্যস্ত হয়নি। তাই সবার মতো অত উচ্ছ্বল না। চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে হাসে। ব্যস এইটুকুই। মেস থেকে টিফিন নিয়ে আসে একটা স্টিলের ঝোলা করে। টিফিন ব্রেকে ওই কোণে বসেই খুঁটে খুঁটে খায়। আর সাথে মাকে ফোন করে একটু গল্প করে। আজ সুমিলার ডাকে না বলতে পারল না। টিফিনসহ উঠে পড়ল। ওরা সবাই মিলে সবে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সামনে প্রায় গোটা পনেরোজনের একটা জটলা।
"ফার্স্ট ইয়ার তো। চল সব ঝটপট ক্লাসে ঢোক। ইন্ট্রো হবে আজ।"
ব্যস, যা নিয়ে এতদিনের টেনশন ছিল সবার, অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি এসেই গেলো।
সিনিয়রদের দলের মধ্যে এক দিদি, বেশ স্মার্ট চেহারা। জিন্স টপ পরে, মাথায় লম্বা বিনুনি। কানে বড় দুল। চোখে নীল আইলাইনার, জামার সাথে ম্যাচ করে। সেই যত কথা বলার বলে যাচ্ছিল। প্রথমে ওদের ব্যাচের সকলের পরিচয় দিল জুনিয়রদের কাছে। এক এক করে নাম বলছে আর শ্রুতি তাকিয়ে দেখছে। তমাল, পলাশ, অনন্যা, মৃণাল, রৌশন, জুনেইদ, শাক্য, পল্লবী, কমলিকা...আনন্দ। এই শেষ নামটি যার, তার দিকে তাকিয়ে শ্রুতি যেন আর চোখ ফেরাতে পারেনা। কী সৌম্য চেহারা। কালো ফতুয়া, নীল জিন্স প্যান্ট পরে, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা। ফর্সা গালে দুদিনের না কাটা দাড়ির হাল্কা আভা।
শাক্য বলে ছেলেটি এরপর এক এক করে শ্রুতিদের ব্যাচের সকলকে ডাকল ডায়াসে। শুরু হল "পরিচিতি"। সকলকে যে যা ভালো পারে, সেইরকম কিছু করতেই বলা হচ্ছিল। সুমিলা নাচল অপূর্ব। দীপ দারুণ মিমিক্রি করল। অনিমেষ আবৃত্তি করল। শ্রুতির পালা এলো। বড় লাজুক মেয়ে। কী পারে ভালো, জিজ্ঞেস করতে ও প্রায় মিনমিন করেই বলল, "কিছুই না।" আনন্দ একটু মুচকি হেসে ওর দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে বলল, "বাঙালি মেয়ে। কিছু পারিস না, তা তো স্বয়ং ঈশ্বর এসে বললেও আমি বিশ্বাস করবো না! গান বা নাচ নিশ্চয়ই শিখেছিস। কিছু একটা করতেই হবে।"
"সত্যি বলছি। আমি কিছুই পারিনা।"
নীল আইলাইনার দিদি হই হই করে উঠল, "ধ্যাত, ভাও খাস না তো। টিফিন শেষ হতে চলল। গেয়ে দে। বা নেচে দে। ব্যস তোদের ছুটি। ঝটপট কর। আর যতক্ষণ না করছিস কিছু, ছুটি নেই। এই বলে দিলাম। চল।"
ইতিমধ্যে শ্রুতির দু চোখ জলে টইটুম্বুর। ওর ব্যাচমেট, মেঘনা আলতো করে ওর হাতটা চেপে ধরল। কানে কানে বলল, "তুই কিছু একটা গেয়ে দে প্লীজ। দু লাইন অন্তত। চোখ বন্ধ করে গা। তাহলেই হবে। ভয় পাস না। আমরা আছি তো সাথে। কিন্তু না গাইলে ওরা জ্বালিয়ে মারবে। প্লীজ শ্রুতি। ভয় পাস না লক্ষ্মীটি।"
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে শ্রুতি বড় করে ঢোঁক গিলল একটা। তারপর শুরু করল ওর রেওয়াজি গলায় "মোহে রঙ দো লাল ..."
গাইতে গাইতে ও তো বিভোর হয়েছিল, সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গোটা ক্লাস হাঁ হয়ে শুনল ওর গান। গানের শেষে প্রবল হাততালিতে ভরে গেলো ক্লাসরুম।
বলাই বাহুল্য, সেইদিনের পর থেকে শ্রুতির আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। উপরি পাওনা ফ্রেশারসে আনন্দর সাথে তিনটে ডুয়েট গাইবার সুযোগ। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল বটে দুজনেই।
প্রথম বাড়ি ছাড়া অনিকেত
আজ তিন দিন হল চেন্নাই এসেছি। আড়াই মাসের জন্য সামার প্রোজেক্টে। থাকছি একটা পিজি অ্যাকোমোডেশনে। বাবা এসেছিল আমায় পৌঁছোতে, এই কদিন ছিল অপর একটি পিজিতে। আমি থাকতাম সারাদিন ল্যাবে, বিকেল হতে বাবা ক্যাম্পাসে চলে আসত। আমরা ঘোরাঘুরি করে, অল্প খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরে যেতাম নিজের নিজের পিজিতে। মানে, বাবা আমায় পৌঁছে দিয়ে তারপর নিজে ফিরত। আজও তাই হল। তবে একটাই পার্থক্য। আজ রাত্রেই বাবার ট্রেন। ফিরে যাচ্ছে কলকাতা। এরপর দীর্ঘ আড়াই মাস আমি পড়ে থাকব এখানে একা। উফ, ভাবতেই চোখ ফেটে জল এসে যাচ্ছে। একেই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মাকে ফেলে রেখে আসার জন্য কী মন খারাপই না করছিল। ভাগ্যিস দুপুরবেলা ছিল। চোখের জল লুকোতে সানগ্লাস পরে নিয়েছিলাম। কারণ আমায় কাঁদতে দেখলে যে মায়েরও মন খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন, সন্ধ্যেবেলা। কী করে চোখের জল লুকোই? দুই চোখের কোণা চিকচিক করছে আমার জলে। বাবারও মুখ চুন। জানি দুজনের মনের ভিতরেই চলছে জোর সংগ্রাম। এই প্রথম যে বাবা আমায় অচেনা জায়গায় একা ফেলে রেখে যাচ্ছে। উফ, কী মারাত্মক রকমের মন খারাপ করা। অনেক কষ্টে না কেঁদে বাবাকে টাটা করে ঘরে এলাম। আর তারপর আলো নিভিয়ে হাপুস নয়নে কেঁদেই চললাম। বাবা ফোন করেছিল খানিক পরে। কথা বলব কী, তখনও যে কেঁদেই চলেছি। এদিকে বাবার সামনে ব্রেভ গার্লের মুখোশটা ঠিক রাখতেই হবে। তাই কোনোমতে হুম হ্যাঁ করে কাটালাম সেই যাত্রা।
দিন কাটে। ক্রমশ একা থাকাটা অভ্যেসে পরিণত হতে থাকে। শিখতে থাকি মা বাবাকে ছেড়ে, প্রিয় কলকাতাকে ছেড়ে থাকা। রোজ নতুন করে বড় হই যখন প্রতি মুহূর্তে নিজের দায়িত্ব নিজে নিই, বিভিন্ন ভুল ভ্রান্তি ভরা জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে চলি একটা চেনা বা কখনো অচেনা ছকে। এখন একাকীত্ব বলতে গেলে প্রায় নেই, টেকনোলজির উন্নতির সুবাদে বাবা মা প্রিয়জনেরা হাতের মুঠোয়। কিন্তু তবুও, প্রথম বাড়ি ছাড়ার দিনগুলো আজও চোখে জল আনে - স্মৃতিমেদুর সে দিনগুলি বড়ই আপন, বড়ই নিজস্ব।
দিন কাটে। ক্রমশ একা থাকাটা অভ্যেসে পরিণত হতে থাকে। শিখতে থাকি মা বাবাকে ছেড়ে, প্রিয় কলকাতাকে ছেড়ে থাকা। রোজ নতুন করে বড় হই যখন প্রতি মুহূর্তে নিজের দায়িত্ব নিজে নিই, বিভিন্ন ভুল ভ্রান্তি ভরা জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে চলি একটা চেনা বা কখনো অচেনা ছকে। এখন একাকীত্ব বলতে গেলে প্রায় নেই, টেকনোলজির উন্নতির সুবাদে বাবা মা প্রিয়জনেরা হাতের মুঠোয়। কিন্তু তবুও, প্রথম বাড়ি ছাড়ার দিনগুলো আজও চোখে জল আনে - স্মৃতিমেদুর সে দিনগুলি বড়ই আপন, বড়ই নিজস্ব।
Sunday, July 22, 2018
প্রথম স্কুল: কিশলয়
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বেডরুমে এলো অপর্ণা। বিছানায় ততক্ষনে অঘোরে ঘুমোচ্ছে টুকুস। পাশে শুয়ে অভিজিৎ ল্যাপটপ খুলে টুকটাক অফিসের কাজ সারছে। অপর্ণাকে দেখে মুখ তুলে আবার কাজে মন দিলো। আয়নার সামনে বসে সারাদিনের সাজগোজ তুলে তারপর হাতে মুখে ক্রিম মেখে চুল বেঁধে বিছানায় আসতে আসতে অন্তত আরো আধ ঘন্টার ধাক্কা। এই সময়টুকু অভিজিৎ আর অপর্ণার সারাদিনের যাবতীয় সাংসারিক আলোচনার সময়।
বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে অপর্ণা বললো, "কাল কটার অ্যালার্ম দেব বলো তো?"
ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই অভিজিতের উত্তর এলো, "দেখো পৌঁছতে পৌঁছতে ওই ভোরবেলা বড়জোর কুড়ি মিনিট লাগবে গাড়িতে। কিন্তু কাল প্রথম দিন। তৈরি হতে একটু বেশি সময়ই লাগার কথা। ধরো এক দেড় ঘন্টা। মনে ওই তাহলে সোয়া পাঁচটার দিলেই হবে।"
"সেফ সাইড, পাঁচটা দিই। টুকুসের ঘুম ভাঙ্গে কখন দেখা যাক। মনে তো হয়না একবারে উঠবে বলে।"
"অনেকক্ষণ হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। অসুবিধে হওয়ার না। তুমিও শুয়ে পড়ো। কাল থেকে নতুন যুদ্ধ শুরু।"
"যা বলেছ, যুদ্ধই বটে। কুড়ি বছর নিজের যুদ্ধ করে আবার কাল থেকে সেই একই গল্প। ইউনিট টেস্ট, গ্রেড, এসাইনমেন্ট উফ। এই শোনো, তুমি একবার লিস্ট মিলিয়ে দেখে নেবে প্লিজ সব ঠিকঠাক ব্যাগে গুছিয়েছি কি না। আমি চট করে রান্নাঘর থেকে আসছি। কালকের রান্নার কিছু বাকি রয়ে গেল কি দেখি।"
"ধ্যাৎ অপর্ণা, এত নার্ভাস কেন। সব ঠিক করেই তো এলে। আবার কেন?"
"না না। আরেকবার দেখে শিওর হতে ক্ষতি কী?"
ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ ঘটলো সুকুমারী দেবীর। ও নাতবৌ, টুকুসবাবুর জামা প্যান্ট গুছিয়ে রেখেছো তো?"
"হ্যাঁ ঠামি, সব ঠিক রয়েছে। তুমি এত রাতে জেগে কেন? যাও যাও, শোও গিয়ে। বাবা দেখলে না কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। চলো ঘরে চলো।"
"তা তোমার শাশুড়ি থাকলে এইসব সেই করতো। সে নেই। কিন্তু দায়িত্বগুলো যে থেকে যায় মা। টুকুস বাবু স্কুল যাবে প্রথম, একটু সাজ সাজ রব পড়বে না হয়? ও তো খোকাও যখন প্রথম গেল স্কুল, কী হইহই কান্ড। তার ঠাকুরদা তো সেদিন কোর্টেই গেল না। নাতির স্কুলের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, পাছে নাতির কিছু দরকার লাগে। তোমার শাশুড়িরও কী হাপুস নয়নে কান্না সেদিন। বাবা রে। তুমি আবার কান্নাকাটি করো না যেন। ছেলেপুলে ঠিক মানুষ হবে।"
"আরে না না। আমি কাঁদবো না। চলো এবার ঘরে চলে। অনেকটা রাত হয়েছে। কাল ভোর ভোর উঠবে তো।"
ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে অভিজিৎ আর অপর্ণা, বেশ কিছুক্ষণ হলো। তবে অন্যান্য দিনের মতো দুজনের কেউই নাক ডাকছেনা এখনো। চোখ মেলে কখনো সিলিংয়ের দিকে কখনো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। ওদের ছোট্ট সোনার কাল থেকে প্রথম স্কুলে যাওয়া। শুরু হবে জীবনভরের লম্বা সফর। সে পথ না জানি কেমন হবে। কোন বাঁকে তার কী থাকে, কে জানে। আর এ সব কিছুর মধ্যে এক্কেবারে কিচ্ছু তোয়াক্কা না করে, মুখে এক অনাবিল হাসি মেখে টুকুস বাবু আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে। এক হাত মায়ের হাতে আরেক হাত বাবার হাতে রেখে।
বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে অপর্ণা বললো, "কাল কটার অ্যালার্ম দেব বলো তো?"
ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই অভিজিতের উত্তর এলো, "দেখো পৌঁছতে পৌঁছতে ওই ভোরবেলা বড়জোর কুড়ি মিনিট লাগবে গাড়িতে। কিন্তু কাল প্রথম দিন। তৈরি হতে একটু বেশি সময়ই লাগার কথা। ধরো এক দেড় ঘন্টা। মনে ওই তাহলে সোয়া পাঁচটার দিলেই হবে।"
"সেফ সাইড, পাঁচটা দিই। টুকুসের ঘুম ভাঙ্গে কখন দেখা যাক। মনে তো হয়না একবারে উঠবে বলে।"
"অনেকক্ষণ হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। অসুবিধে হওয়ার না। তুমিও শুয়ে পড়ো। কাল থেকে নতুন যুদ্ধ শুরু।"
"যা বলেছ, যুদ্ধই বটে। কুড়ি বছর নিজের যুদ্ধ করে আবার কাল থেকে সেই একই গল্প। ইউনিট টেস্ট, গ্রেড, এসাইনমেন্ট উফ। এই শোনো, তুমি একবার লিস্ট মিলিয়ে দেখে নেবে প্লিজ সব ঠিকঠাক ব্যাগে গুছিয়েছি কি না। আমি চট করে রান্নাঘর থেকে আসছি। কালকের রান্নার কিছু বাকি রয়ে গেল কি দেখি।"
"ধ্যাৎ অপর্ণা, এত নার্ভাস কেন। সব ঠিক করেই তো এলে। আবার কেন?"
"না না। আরেকবার দেখে শিওর হতে ক্ষতি কী?"
ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ ঘটলো সুকুমারী দেবীর। ও নাতবৌ, টুকুসবাবুর জামা প্যান্ট গুছিয়ে রেখেছো তো?"
"হ্যাঁ ঠামি, সব ঠিক রয়েছে। তুমি এত রাতে জেগে কেন? যাও যাও, শোও গিয়ে। বাবা দেখলে না কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। চলো ঘরে চলো।"
"তা তোমার শাশুড়ি থাকলে এইসব সেই করতো। সে নেই। কিন্তু দায়িত্বগুলো যে থেকে যায় মা। টুকুস বাবু স্কুল যাবে প্রথম, একটু সাজ সাজ রব পড়বে না হয়? ও তো খোকাও যখন প্রথম গেল স্কুল, কী হইহই কান্ড। তার ঠাকুরদা তো সেদিন কোর্টেই গেল না। নাতির স্কুলের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, পাছে নাতির কিছু দরকার লাগে। তোমার শাশুড়িরও কী হাপুস নয়নে কান্না সেদিন। বাবা রে। তুমি আবার কান্নাকাটি করো না যেন। ছেলেপুলে ঠিক মানুষ হবে।"
"আরে না না। আমি কাঁদবো না। চলো এবার ঘরে চলে। অনেকটা রাত হয়েছে। কাল ভোর ভোর উঠবে তো।"
ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে অভিজিৎ আর অপর্ণা, বেশ কিছুক্ষণ হলো। তবে অন্যান্য দিনের মতো দুজনের কেউই নাক ডাকছেনা এখনো। চোখ মেলে কখনো সিলিংয়ের দিকে কখনো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। ওদের ছোট্ট সোনার কাল থেকে প্রথম স্কুলে যাওয়া। শুরু হবে জীবনভরের লম্বা সফর। সে পথ না জানি কেমন হবে। কোন বাঁকে তার কী থাকে, কে জানে। আর এ সব কিছুর মধ্যে এক্কেবারে কিচ্ছু তোয়াক্কা না করে, মুখে এক অনাবিল হাসি মেখে টুকুস বাবু আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে। এক হাত মায়ের হাতে আরেক হাত বাবার হাতে রেখে।
Thursday, July 19, 2018
বোলে রে পাপিহারা...
আগামীকাল রুমুনের বিয়ে। সারা বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধবের ভিড়। হই হল্লা, গল্প, আড্ডা, নাচ গান, গুলতানি চলছে। একেক ঘরে একেক রকম। রুমুনের ঘরে ওর সমস্ত পিসতুতো মাসতুতো মামাতো খুড়তুতো জেঠতুতো ভাই বোন দাদা বৌদি দিদি জামাইবাবুদের ভিড়। আড্ডার বিষয় মূলত আসন্ন দাম্পত্য জীবনের টিপস অ্যান্ড ট্রিক্স। সাথে মাঝে মাঝে মা মাসিদের প্রবেশ, এই গয়না, ওই শাড়ি নিয়ে এসে মতামত নেওয়া ও দেওয়া। মধ্যে মধ্যে ঘরে ঘরে হাজির হচ্ছে গরম গরম ফিস ফ্রাই পেস্ট্রি কফি কোল্ড ড্রিঙ্ক। ছাদের এক কোণে কাকা দাদাদের একটা জটলা, সেখানে চলছে বিয়ার উইস্কি সহযোগে "ডি-ডে"র জন্য শেষ মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। সাউন্ড বক্সে একের পর এক বেজে চলেছে অরিজিত সিং, আতিফ আসলাম, বাদশা, মিকা সিং ইত্যাদি। বাচ্চাগুলো তালে তালে নেচে বেড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে একেবারে যাকে বলে বিয়েবাড়ি জমজমাট।
সন্ধ্যে সাতটার দিকে মামাতো বোন মাম্পি নীচ থেকে একটু হাঁফাতে হাঁফাতে এলো রুমুনের ঘরে।
"দিদিয়া, তোর জন্য একটা চিঠি এসেছে।" মাম্পির হাত থেকে গোলাপি খামটা নিলো রুমুন। ওর নাম জ্বল জ্বল করছে ওপরে। কিন্তু প্রেরকের কোন নাম নেই।
"কে দিল রে?" অবাক হয়েই রুমুন জিজ্ঞেস করল।
"ক্যুরিয়ারের একটা ছেলে এসে দিয়ে গেল তো।"
একটু অবাক আর বেশ অনেকটাই কৌতূহলী হয়ে রুমুন খামটা সযত্নে ছিঁড়ল। ভিতর থেকে বেরোল The Zen Ladakh হোটেলের তিন দিন দুই রাত্রির ভাউচার। সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট। বহু বছরের পরিচিত হাতের লেখায় লেখা, "তোর হানিমুনে লাদাখ যাওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হোক। ভালোবাসা সহ..."।
গোটা সন্ধ্যেটা ছটফট করতে করতে রাত্রের দিকে ঘর ফাঁকা পেয়ে রুমুন মোবাইলে ডায়াল করল প্রিয় বন্ধু অগ্নিকে। অপর প্রান্তে , "পেয়েছিস তাহলে?"
"তোর মনে আছে?"
"ক্লাস টেন ফেয়ারওয়েল। সায়নদের ছাদে। স্ল্যাম বুক। নীল জেল পেন দিয়ে লিখেছিলি। সযত্নে রয়েছে।"
হঠাৎ কেন কে জানে, বুকের ভিতরটায় একটা হাল্কা মোচড় দিয়ে উঠল রুমুনের।
রাত জাগা পাখিটি তখনও একটানা গেয়ে চলেছে।
"बोले रे पपीहरा
नित मन तरसे, नित मन प्यासा
नित मन तरसे, नित मन प्यासा
बोले रे पपीहरा..."
সন্ধ্যে সাতটার দিকে মামাতো বোন মাম্পি নীচ থেকে একটু হাঁফাতে হাঁফাতে এলো রুমুনের ঘরে।
"দিদিয়া, তোর জন্য একটা চিঠি এসেছে।" মাম্পির হাত থেকে গোলাপি খামটা নিলো রুমুন। ওর নাম জ্বল জ্বল করছে ওপরে। কিন্তু প্রেরকের কোন নাম নেই।
"কে দিল রে?" অবাক হয়েই রুমুন জিজ্ঞেস করল।
"ক্যুরিয়ারের একটা ছেলে এসে দিয়ে গেল তো।"
একটু অবাক আর বেশ অনেকটাই কৌতূহলী হয়ে রুমুন খামটা সযত্নে ছিঁড়ল। ভিতর থেকে বেরোল The Zen Ladakh হোটেলের তিন দিন দুই রাত্রির ভাউচার। সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট। বহু বছরের পরিচিত হাতের লেখায় লেখা, "তোর হানিমুনে লাদাখ যাওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হোক। ভালোবাসা সহ..."।
গোটা সন্ধ্যেটা ছটফট করতে করতে রাত্রের দিকে ঘর ফাঁকা পেয়ে রুমুন মোবাইলে ডায়াল করল প্রিয় বন্ধু অগ্নিকে। অপর প্রান্তে , "পেয়েছিস তাহলে?"
"তোর মনে আছে?"
"ক্লাস টেন ফেয়ারওয়েল। সায়নদের ছাদে। স্ল্যাম বুক। নীল জেল পেন দিয়ে লিখেছিলি। সযত্নে রয়েছে।"
হঠাৎ কেন কে জানে, বুকের ভিতরটায় একটা হাল্কা মোচড় দিয়ে উঠল রুমুনের।
রাত জাগা পাখিটি তখনও একটানা গেয়ে চলেছে।
"बोले रे पपीहरा
नित मन तरसे, नित मन प्यासा
नित मन तरसे, नित मन प्यासा
बोले रे पपीहरा..."
Wednesday, July 4, 2018
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
মেঘলা আকাশ। মৃদুমন্দ বাতাস। আর পাঁচটা আষাঢ়ের সকালের সাথে তেমনভাবে কোন পার্থক্যই নেই। দাদা স্নান করতে যাচ্ছে, বৌদি পিছন পিছন গামছা নিয়ে ছুটছে। মা হড়বড় করতে করতে গ্যাসে তরকারি গরম করছে। বাবা মাঝে মধ্যেই চায়ের জন্য হাঁক দিচ্ছে। টুকুন টলোমলো পায়ে এ ঘর ও ঘর করছে, ওর পিছনে ছায়াদি ঘুরছে, হাতে দুধ রুটির বাটি। বাইরে মিনিবাসের স্ট্যান্ড থেকে মাতব্বর গোছের লোকটার হম্বিতম্বি শোনা যাচ্ছে।
এইসব ব্যস্ততার মাঝে আজ রুমুনেরও ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড উৎসাহ। অগ্নি গতকাল রাত্রে ফিরছে হায়দ্রাবাদ থেকে। গিয়েছিল কলেজ থেকে ইন্টার্নশিপে। আজ দুপুরে দুজনের দেখা করার কথা। কমিটেড হওয়ার পর এই প্রথম। এর আগেও অনেকবার মিউচুয়াল বন্ধদের সাথে একসাথে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু এইবারের ব্যাপারটা অন্যরকম। কিছুদিন whatsappএ রাত জেগে গল্প করতে করতে আর তারপর ফোনে আড্ডা। খেলা রাজনীতি সিনেমা লেখাপড়া থেকে শুরু হয়ে কখন যে একে অপরের মনের খুব কাছে এসে গিয়েছিল, নিজেরাই বুঝতে পারেনি। তারপর একদিন কী করে কী হয়ে গেল। অগ্নি হুঠ করে প্রোপোজ করল রুমুনকে। রুমুনও বেশী সময় না নিয়ে হ্যাঁ বলে দিল। এইবারের দেখাটা তাই খুব স্পেশাল।
বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। কলেজে ফ্রেশারসদের নিয়ে অনুষ্ঠান আছে, এই গল্প দিয়ে বৌদির থেকে ডোকরার একটা দারুণ সেট নিয়েছে। মায়ের কমলা ঢাকাইয়ের সাথে মানাবে ভালো। আলতো করে কালো কাজল নয়না সাজছে ও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন টিপ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও চলল খানিক। বেশ লাগছে কিন্তু দেখতে। আলমারি খুলে পছন্দসই সুগন্ধী বের করে লাগাতে যাবে, এমন সময় আকাশ ভেঙ্গে নামলো বৃষ্টি। যাহ, গেল তো! এবার এই জল কাদা ঠেঙ্গিয়ে যাওয়া। সাজগোজের একশা হয়ে যাবে। ব্যাজার মুখে রুমুন মায়ের ডাকে সারা দিয়ে খেতে বসল।
"কী রে, মুখ ভেটকে কেন? দারুণ সাজটা হাসির অভাবে ইনকমপ্লিট লাগছে যে।" বৌদি ফুট কাটল।
"এই বৃষ্টিতে এমনিই সাজের বারোটা বেজে গেলো। তাই মন খারাপ।" রুমুন আস্তে করে বলল।
বেশ কয়েকবার এর মধ্যে ফোনে অগ্নির মেসেজ ঢুকেছে। "সাজগোজ করে আসছিস নাকি খুব?" "Can't wait to see you", "কখন আসছিস?আমি কিন্তু রওনা দিয়ে ফেলেছি" গোছের। কানুর বাঁশি বাজায়, রাইয়ের যে মন আর টিকছেনা।
"বোনটি আমার, মন খারাপ করে না। আমি ড্রপ করে দেবো তোকে কলেজে", দাদার কথায় যেন এক রাশ স্বস্তি পায় রুমুন। শেষবারের মতো আয়নায় নিজেকে জরিপ করে সন্তুষ্ট হয়ে রুমুন উঠল দাদার গাড়িতে। রেডিও মিরচি চলছে। পরপর বৃষ্টির গানের টিজার।
"তা, কোথায় নামাবো তোকে? এত সেজে যে কলেজ যাচ্ছিস না, সেটা অন্তত আমায় বলতে হবেনা!" মুচকি হেসে দাদা ওর দিকে তাকালো। রুমুন ব্লাশ করে একশা।
"ওই, এক্সাইডের মোড়ে নামালেই হবে। ওখানেই ও আসছে।"
"বেশ বেশ। বোন আমার বড় হয়ে গেলো। তা, "ও"টির সাথে কবে আলাপ করাবি?"
"করাবো রে। আর কদিন যাক।"
"অল দা বেস্ট!"
রুমুনের মুখে এক রাশ হাসি। ফোনে মেসেজ এলো, "আমি পৌঁছে গিয়েছি। ঝটপট আয়।"
আর রেডিওতে মীরের দরাজ গলায় তখন, "আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে এক্ষুনি খবর পেলাম। মেঘ কাটতে শুরু করে দিয়েছে। আর খানিকক্ষণের মধ্যেই কলকাতার আকাশে ঝলমল করবে সূর্য। ফিরছি একটা ব্রেকের পর। ব্রেকের ওপারে আপনার জন্য রয়েছে পরপর পাঁচটা গান। মিরচি পাঁচফোড়ন। যার প্রথম গান, বং কানেকশনের সাউন্ডট্র্যাক থেকে শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে।"
এইসব ব্যস্ততার মাঝে আজ রুমুনেরও ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড উৎসাহ। অগ্নি গতকাল রাত্রে ফিরছে হায়দ্রাবাদ থেকে। গিয়েছিল কলেজ থেকে ইন্টার্নশিপে। আজ দুপুরে দুজনের দেখা করার কথা। কমিটেড হওয়ার পর এই প্রথম। এর আগেও অনেকবার মিউচুয়াল বন্ধদের সাথে একসাথে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু এইবারের ব্যাপারটা অন্যরকম। কিছুদিন whatsappএ রাত জেগে গল্প করতে করতে আর তারপর ফোনে আড্ডা। খেলা রাজনীতি সিনেমা লেখাপড়া থেকে শুরু হয়ে কখন যে একে অপরের মনের খুব কাছে এসে গিয়েছিল, নিজেরাই বুঝতে পারেনি। তারপর একদিন কী করে কী হয়ে গেল। অগ্নি হুঠ করে প্রোপোজ করল রুমুনকে। রুমুনও বেশী সময় না নিয়ে হ্যাঁ বলে দিল। এইবারের দেখাটা তাই খুব স্পেশাল।
বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। কলেজে ফ্রেশারসদের নিয়ে অনুষ্ঠান আছে, এই গল্প দিয়ে বৌদির থেকে ডোকরার একটা দারুণ সেট নিয়েছে। মায়ের কমলা ঢাকাইয়ের সাথে মানাবে ভালো। আলতো করে কালো কাজল নয়না সাজছে ও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন টিপ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও চলল খানিক। বেশ লাগছে কিন্তু দেখতে। আলমারি খুলে পছন্দসই সুগন্ধী বের করে লাগাতে যাবে, এমন সময় আকাশ ভেঙ্গে নামলো বৃষ্টি। যাহ, গেল তো! এবার এই জল কাদা ঠেঙ্গিয়ে যাওয়া। সাজগোজের একশা হয়ে যাবে। ব্যাজার মুখে রুমুন মায়ের ডাকে সারা দিয়ে খেতে বসল।
"কী রে, মুখ ভেটকে কেন? দারুণ সাজটা হাসির অভাবে ইনকমপ্লিট লাগছে যে।" বৌদি ফুট কাটল।
"এই বৃষ্টিতে এমনিই সাজের বারোটা বেজে গেলো। তাই মন খারাপ।" রুমুন আস্তে করে বলল।
বেশ কয়েকবার এর মধ্যে ফোনে অগ্নির মেসেজ ঢুকেছে। "সাজগোজ করে আসছিস নাকি খুব?" "Can't wait to see you", "কখন আসছিস?আমি কিন্তু রওনা দিয়ে ফেলেছি" গোছের। কানুর বাঁশি বাজায়, রাইয়ের যে মন আর টিকছেনা।
"বোনটি আমার, মন খারাপ করে না। আমি ড্রপ করে দেবো তোকে কলেজে", দাদার কথায় যেন এক রাশ স্বস্তি পায় রুমুন। শেষবারের মতো আয়নায় নিজেকে জরিপ করে সন্তুষ্ট হয়ে রুমুন উঠল দাদার গাড়িতে। রেডিও মিরচি চলছে। পরপর বৃষ্টির গানের টিজার।
"তা, কোথায় নামাবো তোকে? এত সেজে যে কলেজ যাচ্ছিস না, সেটা অন্তত আমায় বলতে হবেনা!" মুচকি হেসে দাদা ওর দিকে তাকালো। রুমুন ব্লাশ করে একশা।
"ওই, এক্সাইডের মোড়ে নামালেই হবে। ওখানেই ও আসছে।"
"বেশ বেশ। বোন আমার বড় হয়ে গেলো। তা, "ও"টির সাথে কবে আলাপ করাবি?"
"করাবো রে। আর কদিন যাক।"
"অল দা বেস্ট!"
রুমুনের মুখে এক রাশ হাসি। ফোনে মেসেজ এলো, "আমি পৌঁছে গিয়েছি। ঝটপট আয়।"
আর রেডিওতে মীরের দরাজ গলায় তখন, "আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে এক্ষুনি খবর পেলাম। মেঘ কাটতে শুরু করে দিয়েছে। আর খানিকক্ষণের মধ্যেই কলকাতার আকাশে ঝলমল করবে সূর্য। ফিরছি একটা ব্রেকের পর। ব্রেকের ওপারে আপনার জন্য রয়েছে পরপর পাঁচটা গান। মিরচি পাঁচফোড়ন। যার প্রথম গান, বং কানেকশনের সাউন্ডট্র্যাক থেকে শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে।"
Subscribe to:
Posts (Atom)