দুপুর দুটোর কলকাতা। আধা খালি বাসটা ঢিকিস ঢিকিস করতে করতে এসে পৌঁছেছে অফিসপাড়ায়। সেখানে তখন ফুটপাথের দোকানিরা ভীষণ ব্যস্ত পসরা সাজিয়ে। "আমায় এক প্লেট চাউ দেবেন তো", "এদিকে দুটো ঘুগনি আর মামলেট", "দাদা খুচরো দিন না"। এরই মধ্যে রাস্তায় সিগনালে আটকে থাকা খালি বাসটার দরজা থেকে কন্ডাক্টরের "এ পার্ক স্ট্রীট রবীন্দ্র সদন এক্সাইড হাজরা টালিগঞ্জ ফাঁড়ি। খালি আছে। সীট খালি সীট খালি"র প্রবল আকুতিতে যাত্রী তোলার মরিয়া চেষ্টা। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ। বাসের এফ এমে তখন বিজ্ঞাপনের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান।
লেডিজ সিটে জানলার ধারে বসে মা ব্যস্ত ছেলের স্কুলের ডায়রি দেখতে। ম্যাডাম কী হোমওয়ার্ক দিলেন, পরীক্ষার সিলেবাস কী, প্রশ্নে নাজেহাল দশ বছরের ছেলেটি। ওর মন পড়ে আছে স্কুলের লাস্ট পিরিয়ডের খেলায়। অান্টি তখন মগ্ন হয়ে পড়াচ্ছেন গুলমোহর রিডার থেকে ড্যাফোডিলস। I wandered lonely as a cloud... এদিকে ওরা বন্ধুরা ব্যস্ত বুক ক্রিকেটে। সিগনাল ততক্ষণে সবুজ হয়েছে। তবুও ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। "নে একেবারে বাড়ির ভিতর থেকে লোক ডেকে আন। সত্যিই। কী কুক্ষণে যে এই বাসটাতে চেপেছিলাম।" গুটিকয়েক প্যাসেঞ্জারের রোজের এই মনোলগে আর কান দেননা পঁয়তাল্লিশের ড্রাইভার। তার চেয়ে ঢের বেশী শ্রুতিমধুর রেডিয়োতে তখন বেজে চলা আফগান জলেবি।
বাসটা গুঁটিগুঁটি পায়ে উঠল পার্ক স্ট্রীট ফ্লাইওভারে। সনসন করে হাওয়া দিচ্ছে। ড্রাইভারও বোধহয় মুড পেয়ে গিয়েছেন। বাস সেকেন্ড গিয়ার থেকে একেবারে ফোরথে। "পুচু আমার হাতটা ধরে বসো। এক্ষুনি ব্রেক মারলেই পড়ে যাবে"র উত্তরে একটি নরম হাত চেপে ধরল তার কুচুর বলিষ্ঠ হাত। কব্জির ঘড়িতে তখন সোয়া দুটো। ঝিরঝিরে হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। ডান হাত দিয়ে চোখের উপরে বারবার পড়া চুলের গোছা সরাচ্ছে মেয়েটি। সহযাত্রীর মুগ্ধ দৃষ্টি ওর ঠোঁটের ওপর ছোট্ট কালো তিলে।
"মা, আমি জানলার ধারে বসব প্লিজ"এর উত্তরে সন্ত্রস্ত চিন্তিত মা কাঠের জানলা বন্ধ করছেন। সামনেই ইউনিট টেস্ট। এখন ভিজলেই কেলেঙ্কারি হবে ছেলের।
পিছনের সীটের প্রৌঢ় মগ্ন ফোনে। "ছাতা নিয়ে বেরোইনি কিন্তু আমি। এই এক্সাইড ছাড়ালাম। মাম্পাকে বলো ছাতা নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতে। আর শোনো, রাত্রে খিচুরি করে দিয়ো তো। যা দেখছি আকাশের অবস্থা, থামার তো লক্ষণ নেই। ডিম আছে তো? নইলে মন্টুর দোকান থেকে আনিয়ে নিয়ো। ব্যাস। খিচুরি আর ডিম ভাজা।ঘি আছে তো?"
বাসটা হঠাৎ স্পিড তুলেছে। পূর্ণর স্টপেজে থামলইনা। পিছনে বোধহয় একই রুটের আরেকটা বাস। "গোটা রাস্তা ধীরে চালিয়ে এখন এই র্যাশ ড্রাইভিং। রিডিকিউলাস।" কোনমতে এঁটেসেঁটে বসে ভাবল উনিশের মেয়েটি। ফিরছে কলেজ থেকে। একটু ঘুমিয়ে আবার ছুটবে ট্যুশানে। ইশ, এই ওয়েদার, কোথায় চাদর মুরি দিয়ে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে ভূতের গল্প পড়বে, তা না। এক হাঁটু জল ঠেঙ্গিয়ে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রির কচকচানি শুনতে হবে।
রেডিয়োতে পরপর চলছে "আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ", "কাগজের নৌকো", "সাওয়ান বরসে" । আর জে খবর দিচ্ছে মাঝে মাঝে, কোথায় জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে, কোথায় জ্যাম। বারবার সাবধান করছে ভিজে রাস্তায় গাড়ী চালানো নিয়ে। বিকেল তিনটেতেই প্রায় ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।
একটা বিশ্রী শব্দ করে ব্রেক কষল বাসটা। প্রৌঢ় ছিটকে পড়ে যেতে যেতে কোনমতে নিজেকে সামলালেন। "কে রে ভাই? কী করে চালাস বাসটা? তখন থেকে এই করছে ব্যাটা।" ড্রাইভারের চোদ্দ গুষ্টি এক করতে বাসের ওই গুটিকয়েক যাত্রী তখন মরিয়া।
মুহূর্তের মধ্যে রেরে করে ছুটে এলো কিছু পথচারী। আশেপাশের বাস থেকে প্যাসেঞ্জার। এই বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টর ছুটছে। তার পিছনে ছুটছে মত্ত জনতা। তারও পিছনে ট্রাফিক পুলিশ কানে ওয়াকি টকিতে কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে।
শুধু স্থির হয়ে পড়ে আছে বছর চব্বিশের এক কলেজ পড়ুয়া। গলায় ঝুলতে থাকা আই ডি কার্ডটা ছাড়া চেনা যাচ্ছেনা আর। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। কালো পিচের ওপর ধুয়ে যাচ্ছে টাটকা রক্তের স্রোত।
"বাবু, ওইদিকে তাকিয়ো না। চলো। দেখি আবার এখন এখান থেকে অটো পাওয়া যায় কি না। কালকের হোমওয়ার্কগুলো শেষ করতে হবে তো। আবার ক্লাস টেস্টও তো কাল।" পিছনের দরজা দিয়ে নেমে মা ছেলে তখন অন্য দিকে।
"শোনো, একটা বিচ্ছিরি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এখানে। দেখি পরের বাসটা কখন পাই। ভিজেই তো গেলাম। আর মাম্পাকে পাঠাতে হবেনা", দায়িত্ববান পিতা ফোনে জানিয়ে দিলেন বাড়িতে।
পুচু আবার একদম রক্ত দেখতেই পারেনা। কুচুর এখন বিরাট দায়িত্ব তাই। ওকে কোনভাবে স্পট থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
ট্রাফিক সার্জেন্ট পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলেন। আই ডি কার্ডে দেওয়া নম্বরটায় ফোন করে জানাতে হবে তো। এইসব উটকো ঝামেলা যত। প্রফেশনাল হ্যাজারড।
No comments:
Post a Comment