গতকাল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। প্রায় সপ্তাহখানেকের প্রস্তুতিপর্বের পর ঠিক হয়েছিল সকাল সকাল প্রতিষ্ঠিত বাঙালি মিষ্টির দোকানে (পড়ুন কে সি দাস) যাব। কচুরি খেয়ে রবিবারের জলখাবারটা সারবো। সেই অনুযায়ী প্ল্যানিংও চলছিল। শনিবার গুগলকে জিজ্ঞেস করে দোকানের টাইমিং জেনে নিলাম। তারপর রবিবার সকালের বড় প্রিয় ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে এবং দায়িত্ব নিয়ে বাকি তিনজনের ঘুম ভাঙিয়ে আমরা রওনা দিলাম ক্যাম্পাস থেকে। সে কী উত্তেজনা। ফেসবুকে একখানা ছবি পোস্টিয়ে দিলাম। আবার স্টেটাসও দিলুম। বেলা বোস গানের প্যারোডি হিসেবে।
"অ্যাপ ক্যাব মোরা পেয়ে গেছি ওগো শুনছ
আর মাত্র কয়েকটা মিনিট ব্যাস।
স্টারটিংএই ওরা কচুরি দেবে
তারপর দেবে মিষ্টি
চুপ করে তখন খাবো আমরা সব।"
পৌনে নটার দিকে দোকানের সামনে পৌঁছে মাথায় হাত। শাটার টাটার নামানো। দোকান খোলেইনি। ততক্ষণে ফেসবুকের ছবির প্রাইভেসি "ওনলি মি" করে দিয়েছি। প্যারোডি ডিলিট। এর মধ্যে যে বেশ বুক ফুলিয়ে জাহির করা হয়ে গিয়েছে। তৃণাদিকেও কনফিডেন্টলি বলে ফেলেছি যে কে সি দাস আটটায় খুলে যায়, ইত্যাদি। গাড়ি থেকে না নেমে সঙ্গে সঙ্গে ডেসটিনেশন চেঞ্জড। চলো পানসি বেসন্ত নগর। চন্দনের ইতিমধ্যে খিদেয় পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক মারছে। পায়েলের মন চা চা করছে। অয়নের মুখ চুন, কারণ ওই ছিল কচুরি অভিযানের মূল হোতা। আমি ভাবছি গেল রে, এত শো অফ, কী হবে এবার। প্রেস্টিজ ইস্যু।
যাই হোক, বেসন্ত নগর বিচে নেমে আমাদের প্রথম প্ল্যান হল কিছু একটা খেতে হবে। চন্দনের কথা মতো গেলাম মুরুগন ইডলি শপে। এই দোকানটি একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড তামিল নাডুর। চেন্নাইতে একাধিক ব্রাঞ্চ। এমনকি আমি সদ্য মাদুরাই গিয়েও দেখেছিলাম এদের ব্রাঞ্চ। বেসন্ত নগরে আমি আগে বার দুয়েক খেয়েছি। সুস্বাদু অথেনটিক দক্ষিনী খাবার। ঠিক হল কফি খাবো আর সাথে হাল্কা ব্রেকফাস্ট। কারণ কচুরি আমাদের খেতেই হবে। প্রায় পাখি পড়ার মতো আমি বাকি তিনজনকে বলেই চলেছি। ওরে, বুঝে শুনে মেপে ঝুঁকে খাস কিন্তু।
তা মুরুগনে তো হেঁটে হেঁটে পৌঁছনো গেল। একটু এদিক ওদিক দেখে শুনে টেবিলও পেলাম। ওখানের সিস্টেম বেশ মজার দেখলাম। একেকটা আইটেম নিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করছে নেব কি না। মানে আলাদা করে একটা এই দুটো ওই ওরকম কোন ব্যাপার নেই। আমরা তো নিলাম প্রথমেই চারজনে চারটে পোড়ি ঘি ইডলি। সে যে কী অপূর্ব স্বাদ, বলে বোঝাতে পারব না। খেতেই হবে। মনে করুন তুলতুলে নরম ইডলি, তাতে ঘি মাখানো। আর তার ওপর পোড়ি ছড়ানো। পোড়িটা আসলে ওই নানান মসলাকে রোস্ট করে গ্রাইন্ড করে দেওয়া হয়। ইডলি, দোসা, উত্থাপমের সাথে দারুণ মানায়। এরপর একে একে "ট্রাই" করলাম পোঙ্গল, সুইট পোঙ্গল, বড়া, প্লেন ইডলি এবং পোড়ি অনিয়ন উত্থাপম। ফিলটার কফিটা বেশ বেশ ভালো ছিল। বিল টিল তো মেটানো হলো। খসলও ভালোই। এদিকে ঘড়ির কাঁটা বলছে সোয়া নটা। কে সি দাস যদি খোলে তো দশটায়। অর্থাৎ আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ধাক্কা। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মনে হল যে তাহলে রোদের মধ্যেই না হয় সমুদ্রের ধারে যাই। এত কাছে এলাম আর বঙ্গোপসাগরের দর্শন নেব না, তা কি হয়?
ওই গরমে আমরা সমুদ্রের ধারে গেলাম। চোখ খুলে তাকাতে পারছিনা এত রোদ। গা পুড়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস সানস্ক্রিন মেখে বেরিয়েছিলাম। এদিকে রোদ চশমা নিইনি। ভাবিনি তো কচুরি খেতে গিয়ে চোখ টোখ ঝলসে যাবে এমন! অয়ন চন্দন আর পায়েল জলে নামলো। আমি দূর থেকেই। ততক্ষণে বারবার কে সি দাসে ফোন করছি। কেউই ধরে না। পৌনে দশটা নাগাদ তাদের কী মনে হল কে জানে ফোন রিসিভ করল। বেশ সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "when will the shop open?", "it is open now" উত্তর পেলাম। উল্লাস দেখে কে! আহা, কচুরি খেতে চলেছি! ফাইনালি!
ঝটপট আবার এক খানা অটো নিয়ে পৌঁছলাম। ঢোকার আগে এক প্রস্থ ছবি ছাবা তুলে ফেলেছি। ইতিমধ্যে আরো বন্ধুদের মেসেজ করা হয়ে গেছে কোথায় এসেছি। কনফিডেন্স ফেরত পেয়ে পুরনো পোস্ট আবার ওপেন টু অল করে ফেলেছি। রীতিমতো টগবগিয়ে ফুটছে আত্মবিশ্বাস। দোকানে ঢুকে দেখি তখনও তেমন বেশী মিষ্টি নেই। কিন্তু গাড়ি থেকে তখন মিষ্টির ট্রে নামানো হবো হবো করছে। একটু আশ্বস্ত হলাম। জিজ্ঞেস করা হল, "কচুরি হবে?" জানলাম হবে, কিন্তু আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। যে আমরা কচুরি খাব বলে সকাল আটটা থেকে দশটা বাজিয়ে দিলাম, নিশ্চয়ই আর আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করাই যায়। ডিটারমিনেশন তুঙ্গে তখন। বললাম, বেশ। করবো অপেক্ষা। বানাও আটটা। শুরু তো হোক আট দিয়ে। তেষ্টা মেটাতে তখন জল, ফ্যান্টা চলছে। এদিক ওদিক দেখছি। প্ল্যান হচ্ছে আর কী মিষ্টি খাওয়া যায়, কেনা যায়। প্লাস এত সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে চলছে অগুন্তি সেলফির বন্যা। অয়নের চাকচিক্যও ফেরত এসে গিয়েছে। পায়েল লাফাচ্ছে রসগোল্লা খাবে বলে। চন্দন ফোনে লাইভ কমেন্টারি দিচ্ছে। আর আমি খুঁজছি ভাজা মিষ্টি।
এমন সময় কে জানে কেন, অয়নের মনে কুডাক দিলো। ওর কী মনে হল, বলল, "আচ্ছা কচুরি মানে খাস্তা কচুরি দেবে না তো?" সবাই মুহূর্তের জন্য ব্যোমকে গেলাম বটে, তারপর সেলফ কন্সোলেশনের মতো বললাম, " না না। কচুরি মানে কচুরি। বাঙালি দোকান। কচুরি বুঝবে না?"
ওই যে কথিত আছে, নেগেটিভ ভাবলে জীবনে সব নেগেটিভ হয়। নেগেটিভ ভাইবস ছড়ায়। তার একদম যথাযথ উদাহরণ সহ দোকানের রান্নাঘর থেকে বেরোল এক সার্ভার। হাতে খাস্তা কচুরি। সিনেমা হলে চারটে পাঁচটা কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ হত ব্যাকগ্রাউন্ডে। আর বাংলা সিরিয়াল হলে তো কথাই নেই। এক সপ্তাহর খোরাক পেয়ে যেত। বারবার ক্যামেরা আমাদের চারজনের মুখে ফোকাস করতো। আমাদের একদা হাসি মুখ মুহূর্তে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বার বার একই শট বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখাতো। গ্যারান্টি দিচ্ছি, দারুণ শট হত। শেষ সম্বলের মতো অয়ন আবার জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা, পুরি পাওয়া যাবে? কচুরি আই মিন। এটা তো খাস্তা কচুরি।" অ্যাটম বোম পড়ল। না। পাওয়া যাবে না। ভগ্ন হৃদয় আমরা চারজনে খুঁটে খুঁটে ওই খেলাম। আরেক প্রস্থ কোল্ড ড্রিঙ্ক ও রসগোল্লা কালো জামের সাহায্যে কচুরি নামালাম। হ্যাঁ মানছি, সুস্বাদু ছিল বটেই। অ্যাসিডিটি হয়নি। কিন্তু তবুও, চাইলাম এক, পেলাম আরেক। আমাদের ভিতরকার দার্শনিক সত্ত্বা তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বেরোচ্ছে। "কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকিয়ে হবে কী?" গোছের প্রবাদ বাক্য বেরোচ্ছে কত দিন পর। ভাগ্যিস মুরুগনে কিছুটা ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলাম, এই নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছি একে অপরকে। চন্দন একটু আপার হ্যান্ড নিচ্ছে। কারণ ওর আইডিয়া ছিল মুরুগন। অয়ন তো ততক্ষণে আবার নিভে গিয়েছে। পায়েলের মন খারাপ। আমি ভাবছি গেলো রে, জনসমাজে মুখ দেখাবো কী করে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাই হোক হাজার টাকা খরচা করে অতি স্মরণীয় রবিবার সকাল কাটালাম বটে আমরা। প্রচুর মেমোরিজ হলো। শুধু মিশন কচুরির বদলে ট্রিপটার নাম মডিফাইড হল মেন্টালি। "মিশন ব্রেকফাস্ট"। মিশনই তো বটে!!
No comments:
Post a Comment