Tuesday, July 24, 2018

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ২

হন্তদন্ত হয়ে রুমুন এসে পৌঁছলো কফিশপে। কফিশটি চার্লস নদীর ধারে। অদূরে বোস্টন শহরের আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা। ধূসর। বর্ণহীন। রুমুনের পরনেও সেই ছাইরঙা বিজনেস সুট। কফিশপে দরজা ঠেলে ঢুকতেই বুকের ভিতরের ধুকপুকুনিটা যেন বেড়ে গেলো বেশ অনেকটাই। কিছুটা দৌড়ের জন্য, তবে সিংহভাগই সেই কুড়ি বছর আগের এমনি এক বাদলা সকালের মতোই। এক অজানা অনুভূতির জের।

বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে একটা নীল রঙের গ্রাফিক টিশার্ট পরে অবিন্যস্ত চুলে মাঝে মাঝে দান হাতটি বোলাচ্ছিলো অগ্নি। অন্য হাতে সাদা সেলোফেনে মোড়া এক গুচ্ছ টাটকা ফোটা স্নিগধ হলুদ গোলাপ। এক্সাইডের সিগনালে গাড়িটা যখন আটকে, ঠিক এমনটাই দেখেছিল রুমুন। কখন যে সিগনাল লাল থেকে সবুজ হবে, এ যেন ধৈর্য্যের বিষম পরীক্ষা। অবশেষে মোড়ের মাথায় জল কাদা বাঁচিয়ে রুমুন যখন নামলো, অগ্নি তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে।

ঠিক ওর পাশটাতে গিয়ে দাঁড়ালো রুমুন। পাঁচ ফুট সাতের পাশে কোনোমতে পাঁচ ছুঁই ছুঁই। একটু কষ্ট করেই আর খানিকের ইতস্তত কাটিয়ে অগ্নির কাঁধে হালকা একটা টোকা মারল।
"ও তুই? কোনদিক দিয়ে এলি?" চমকে এ পাশ ফিরে রুমুনকে দেখে অগ্নি বললো।
"এই তো। এস পি মুখার্জি দিয়ে। দাদা নামিয়ে দিয়ে গেল।"
"ও। আমি ভাবছিলাম তুই ঐদিক দিয়ে আসবি। আসলে আমার সেন্স অফ ডিরেকশন বড্ড পুয়োর।"
"অনেক্ষণ অপেক্ষা করে আছিস, না? পুরো ভিজে স্নান হয়ে গিয়েছিস যে। সো সরি।"
"আরে না না। ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর আর কী, ফুলের দোকানে ফেলে এসেছি।"
"ও।"
"আমি খুব ভুলো। এই দেখ, এই এত বকে চলেছি। অথচ তোকে এটাই দিলাম না এখনও। ইয়ে, মানে, কী নেয়া উচিত, কী করা উচিত, কিছু বুঝেছিলাম না। তাই। এই যে।"

যদিও লাল গোলাপ পেলে রুমুনের বেশি ভালো লাগত, তাও প্রথম দিনেই সেটা আবার বাড়াবাড়ি প্রত্যাশা হবে কি না, এইসব ভাবতে ভাবতে রুমুন ত্রস্ত হাতে গোলাপগুলি নিলো।অগ্নির হাত থেকে। আর ওই যে মুহূর্তের স্পর্শ, শরীর মন জুড়ে খেলে গেল বিদ্যুতরেখা। ভালো কোনো সিনেমাটোগ্রাফার হলে হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে নিদেনপক্ষে একটা ভায়োলিন বাজিয়ে দিতেন। কিন্তু এ যে ভারী বাস্তব জীবনে। অর্কেস্ট্রার বদলে শুধুই অফিস টাইমের ব্যস্ত কলকাতার এলোমেলো কর্কশ হর্ন, নেই তাতে কোনো সুর, নেই কোনো ছন্দ।

"থ্যাংক ইউ। হলুদ আমার প্রিয় রঙ। খুব পছন্দ হয়েছে।"
"যাক বাঁচালি। আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম। হলুদ নেব না লাল। তারপর মনে পড়ল ফেসবুকে তোর সব ছবিতেই হলুদের ছোঁয়া লেগে থাকে। তাই।"
"বুঝলাম। তা আমাদের এখন কী প্ল্যান? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো? না কি কোথাও বসা যায়?"
"বসা তো যায়ই। তবে এই যা অবস্থা আমার। কোনো ট্যাক্সিই উঠতে দেবেনা। এR তুইও মনে হয় অফিস টাইমের বাসের ভিড়ে শাড়ি পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবি না।"
"অগত্যা?"
"হলদিরাম?"
"ন্যা। প্লিজ।"
"তাহলে? হাঁটবি?"
"কোথায়?"
"নির্দিষ্ট কিছু নেই। এমনিই। উদ্দেশ্যহীনভাবে। আকাশও ফর্সা হচ্ছে যখন ক্রমশ।"
"নট এ ব্যাড আইডিয়া।"
"ব্যস্ত কলকাতার পথে আমরা দুই জবলেস পাবলিক।"
"জবলেস বলিসনা অগ্নি। কলেজে ক্লাস কেটেছি দুজনেই। দেখা করাটা কাজ না?"
" না না। কাজ বললেই কেমন একটা দায়বদ্ধতা এসে যায়। হাজার কমিটমেন্ট, হাজার নিয়ম।"
"তো আমরা তো কমিটেড, না কি?"
"Yes of course, but we should be like free birds - যতক্ষণ ভালো লাগছে, থাকবো। আর তারপর মন্দবাসা মন্দলাগা এসে গেলে তিক্ততা এড়াতে দূরে সরে যাবো।"
"কপাল। প্রথম ডেটে এসে কী কথার ছিরি।" এক দমকা হেসে রুমুন বললো। হাসি আবার সংক্রামক। অগ্নিও তখন হাসির জোয়ারে গা ভাসিয়েছে।

সেদিন অনেক্ষণ ধরে হেঁটেছিল ওরা দুজন। বাস রাস্তা, গলি ঘিঞ্জি, পার্ক কিচ্ছু বাদ পড়েনি। আর গল্পের বিষয়? সে কখনো বা আবোল তাবোলের ননসেন্স কবিতার চর্চা করে তো কখনো এক ধাপে Gangs of Wasseypur, কখনো Pete Seegerএর Little Boxes তো কখনো চন্দ্রবিন্দুর গীতগোবিন্দ। শক্তি সুনীল যেমন বাদ যায়নি, তেমনই বাদ পড়েনি Love in the times of cholera। রোগ ব্যাধি থেকে একলাফে সিদ্ধারথ মুখারজীর "জিন", তো পরমুহূর্তেই সিদ্ধারথ শঙ্কর রায় হয়ে রাজ্য রাজনীতি। হাতে হাত না ধরেও, মাঝে মাঝে ওই ইচ্ছাকৃত ভুলে একে অপরের স্পর্শে দুজনেই অল্প হলেও awkward অনুভব করছিল শুরুতে বটে, তবে ফিরটি পথে ট্যাক্সির পিছনের সীটে বসে যখন সাহস করেই রুমুন নিজের ছোট আঙুলগুলি অগ্নির লম্বা লম্বা আঙুলের ফাঁকে গলালো, দুজনেই কিছুই যেন হয়নি, এমন একটা ভাব দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারল না। এক ঝটকায় দুজনেই একই সাথে হাত সরিয়ে, সরি বলল খুব নিচু গলায়।
আর তারপর ইস্ট রোডের মুখে ট্যাক্সি থেকে যখন রুমুন নামছে, অগ্নি একেবারে যাকে out of the blue বলে, বলল, "নাহ, কাজল না ধেবড়ালেও মেয়েদের তাহলে ভালোই লাগে দেখতে।"
বোঝো কাণ্ড! এতদিনের অভ্যেসে সবেমাত্র আজ প্রথম না ধেবড়ে কাজল পরল, আর অগ্নির কি না এই মন্তব্য! কী অবস্থা!
রুমুন হাল্কা হেসে বলল, "আমার আবার অপর্ণা ছাড়া কাউকেই ওইরকম সাজে ভালো লাগেনা। অপুর সংসারের আমার প্রিয় সিন। বহুকাল অবধি ফেসবুকের কাভার পিকচার ছিল।"
যাক। অবশেষে অগ্নি নিশ্চিন্ত। সোলমেট কি না বলাটা এখনই too early, কিন্তু এগোতে পারে বটেই।
"আর শোন, আজ থেকে আমার প্রিয় রঙ, কমলা।"

"কী রে, কতক্ষণ ধরে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছিস বল তো? কী ভাবছিস?" বছর চল্লিশের অগ্নির ডাকে সম্বিৎ ফিরল রুমুনের। অগ্নিটা সেই একই আছে। সেই অবিন্যস্ত চুল,কুঁচকানো গ্রাফিক টিশার্ট। কানের পাশে হাল্কা দুই তিনটে রূপোলী আভা।
তুলনায়, রুমুন অনেক বদলে গিয়েছে। বিশাল কর্পোরেট চাকরির ধকল, ব্যক্তিগত জীবনে বেশ বড় কয়েকটা ঝড় ঝাপটা। চোখের কোণের কালীগুলো দামী মেকআপেও তেমনভাবে ঢাকা যায়না।
ক্যাপুচিনো আর ফ্রাইজ অর্ডার দিয়ে কত বছর পর ওরা আবার মুখোমুখি বসল।
"ভালো আছিস রুমুন?"
"হুম। যেমন দেখছিস।"
"বেশ।"
"তুই বল। কেমন আছিস? এত ব্যস্ত মানুষ অগ্নি, হঠাৎ বস্টনে?"
"তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো রে। NABCতে নিউ জার্সি এসেছিলাম ষও করতে। ওখানে একদিন একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভীষণভাবে তোর কথা মনে পড়ল। বুকের এই বা দিকটাতে কেমন চিনচিনে ব্যথা হতে লাগল। ভাবলাম চল্লিশ পেরলাম। অ্যাটাক হচ্ছে নাকি? তারপর নিজেই বুঝলাম। ব্যাপারটা মানসিক। ফেসবুক খুলে তক্ষুনি তাই তোকে পিং করলাম। And here I am madam..."
তুই আর পালটালি না! সেই ইম্পালসিভ রয়েই গেলি!"
"হুম। অভ্যেস পালটানো যায়। স্বভাব না। শোন, আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যায় না রে রুমুন?"
"আবার? আবার যদি সেই নোংরা কুৎসিত হয়ে যাই আমরা নিজেদের কাছে? এই তো বেশ ভালো আছি।"
"পনেরো   দেখা হওয়া, এই ভালো?"
"মন্দ কী? Distance আছে বলেই আমরা একে অপরকে মিস করছি। ভালোটুকু মনে রেখেছি। এই থাক না?"
"তুই যা বলবি। বাই দি ওয়ে, কাজলটা ধেবড়ে বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু।"

রুমুনের মুখের অপর তখন পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের মলিন হলুদআভা। এবারেও অগ্নি নিজেরটুকুর জন্য লড়াইটা লড়ল না ওর সাথে। বড্ড সুবোধ বালকের মতোই মেনে নিলো ওর কথা।

No comments:

Post a Comment