অগ্নি আর রুমুনের নতুন সংসার। এতই নতুন যে গায়ে এখনও বেশ একটা নতুন বিয়ের গন্ধ লেগে আছে। একদম সাবেকি কায়দায় আনন্দবাজার পত্রিকায় রবিবারের পাত্র পাত্রী দেখে দুজনের বিয়ে হয়। অগ্নি থাকে সুদূর অ্যামেরিকায়, নিউ জার্সিতে। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। রুমুন অঙ্কে মাস্টার্স করে একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াত। টাইম জোনের পার্থক্যে দুজনের মধ্যে তেমন বেশী কথাবার্তাও হয়নি বিয়ের আগে, ওই চার পাঁচবার স্কাইপে হাই হ্যালো আর ফেসবুকে একে অপরের ছবিতে বা স্ট্যাটাসে লাইক করা ছাড়া। এমনকি, লাইক ছেড়ে লাভেও পৌঁছয়নি, তার মধ্যেই বৈশাখের এক প্রচণ্ড ভ্যাপসা সন্ধ্যায় দুইজনে আবদ্ধ হল বিবাহ নামক বন্ধনে।
অগ্নি অফিস বেরিয়ে যায় সকাল সকাল। ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে। সারাদিন রুমুনের একা কাটে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে তেমনভাবে কথাবার্তা খুব যে হয়, তা না। পি এইচ ডি অ্যাপলিকেশন নিয়ে খানিক সময় ব্যয় করে আর ঘরকন্নার কাজেই দিন কেটে যায়। উইকেন্ড হলে তাও একটু বৈচিত্র্য। দুজনে তখন গাড়ি নিয়ে হয় লঙ ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ে, নয় কাছেপিঠে সিনেমা শপিং ইত্যাদি।
রবিবার সাধারণত ওরা একটু বেলা করেই ওঠে। তবে আজ অন্যান্য রবিবারের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। আজ বিশ্বকাপ ফাইনাল। অগ্নির সাপোর্ট ফ্রান্সের জন্য আর রুমুনের ক্রোয়েশিয়া। সক্কাল সক্কাল উঠে যাবতীয় কাজ কর্ম সেরে ওরা জমিয়ে খেলা দেখবে। আগেরদিন থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয়েছে মজার ছলে রেষারেষি। কোন দল কত গোল দেবে আর কত খাবে, সেই নিয়ে মৌখিক লড়াই চলছে।
"শোনো, আজ যদি ফ্রান্স জেতে না, যদি বলছি কেন, জিতবেই, তাহলে কিন্তু আমরা ডিনারে ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টে যাব কোন।" গরম গরম লুচি ছোলার ডাল মুখে পুরতে পুরতে অগ্নি বলে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পাশ থেকে রুমুন ওমনি ফুট কাটে, "হ্যাঁ, ওই আনন্দেই থাকো। ক্রোয়েশীয় রান্নাবান্নার ধরণধারণ কিছু জানিনা বলে সেই রিস্ক নিচ্ছিনা। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া জেতার পর আমি যা চাইব, তোমায় তা দিতেই হবে। বুঝলে?"
"আমি রাজি এই বেটে। তবে একই শর্ত তোমার জন্যও প্রযোজ্য কিন্তু মাদাম!"
"ঠিক আছে!"
যথারীতি খেলা শুরু হলো। ফ্রান্সের ১-০ থেকে ১-১ হয়ে যতক্ষণে ৪-২ এ শেষ হল, ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে বিচিত্র ছবি। অগ্নি লাফালাফি করছে, যেন নিজেই গোল করেছে দু তিনটে। আর রুমুন প্রায় হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে।
"কী, ফেসবুকটা খোলো। দেখো কি স্টেটাস দিলাম!" মুচকি হেসে অগ্নি বলল। রুমুন একবার তাকালো ওর দিকে, তারপর চোখ মুছে বেশ অনিচ্ছাসহ ফোনটা হাতে নিলো। নোটিফিকেশন। "Agni Sen has tagged you in a post. Please review it before it appears on your timeline", স্টেটাস্টি এই প্রকার, "আজ বৌকে ৪-২ গোলে হারালাম। উফ, কী আনন্দ।" সেখানে ইতিমধ্যেই লাইক আর কমেন্টের বন্যা। "এসব বলিস না, হোম মিনিস্টার রাগ করবে", "কপালে গভীর দুঃখ আছে", "বৌদি কি ফেসবুকে নেই নাকি?" ইত্যাদি ইত্যাদি। রাগে মটমট করতে করতে রুমুন দোতলায় বেডরুমে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। বেচারা অগ্নি। রুমমেট ভেবে ঘোরের মধ্যে দিব্যি পাঙ্গা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এ যে এক্কেবারে আনকোরা পরিস্থিতি। বউ অভিমান করেছে। এর সমাধান?
তখনই মনে পড়ল কোন ছোটবেলায় মায়ের সাথে ডেন্টিস্টের কাছে বসে সানন্দা বা সাপ্তাহিক বর্তমান, কোথাও একবার পড়েছিল বটে। "The way to a man's heart is through his stomach", এই ক্ষেত্রে জেন্ডার পরিবর্তন করলেও নিশ্চয়ই একই টোটকা খাটা উচিত। যেমন ভাবা তেমনই কাজ।
তিন বছর বাড়ির বাইরে থাকার সুবাদে রান্নাবান্না মোটামুটি ভালোই রপ্ত ছিল অগ্নির। লেগে পড়ল কাজে। পেঁয়াজ কাটা, লঙ্কা কুঁচি, ডিম ফেটানো, আলু স্লাইস করা। ঘন্টাখানেকের কসরতের পর একটা বড় ট্রেতে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে বেডরুমে গেল।
দুই তিনবার নক করার পর রুমুন দরজা খুলল। কেঁদেকেটে বেচারি মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। কেমন অদ্ভুত মায়া হলো অগ্নির ওকে দেখে। ট্রেটা টেবিলে নামিয়ে এক্কেবারে দুই কানে হাত দিয়ে, "সরি, ভুল হয়ে গিয়েছে। আর কক্ষনো করবো না। এক্ষুনি একটা কারেকশন করে পোস্ট দিয়ে দিচ্ছি ফেসবুকে" বলতেই রুমুন ছলছল চোখে হেসে বলল, "হয়েছে। থাক। আর হ্যাঁ, সবকিছু অত ফেসবুকে দিতে হবেনা। কিছু মুহূর্ত তো নিজেদের থাকুক, নাকি?"
"ইউ আর রাইট মাদাম! শোনো রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলে গিয়েছিলেন, পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য। তেমনই আমি বলছি সেইটাকেই প্যারাফ্রেজ করে, পতির টিমের জয়েই পত্নীর টিমেরও জয় অ্যান্ড ভাইসে ভারসা। তাছাড়া দেখো ইন্ডিয়া কোয়ালিফাইই করেনি। আমরা কেন মিছিমিছি লড়বো বলো?"
"যাক তাহলে ভদ্রলোকের সুমতি হলো! তা কী রান্না করে আনলে দেখি? খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে।"
"ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ!"
"ওয়াও, দুটোই ফেভারিট আমার।"
"বোঝো কাণ্ড। শুধু খেলা দেখার সময় অ্যান্টি ফ্রান্স নাকি?"
খিল খিল করে হেসে ওঠে রুমুন। ততক্ষণে ফ্রেঞ্চ টোস্টে বড় এক কামড় পড়ে গিয়েছে। মুখে খাবার নিয়েই বলে, "উম্মম্ম, দারুণ ক্রিস্পি হয়েছে। একদম মায়ের হাতের রান্নার মতো। ও, কী জানি বলছিলে? অ্যান্টি ফ্রান্স? না না। ওটা অ্যান্টি তুমি। তুমি ক্রোয়েশিয়াকে সাপোর্ট করলে আমি ফ্রান্সকে করতাম!"
"হে ভগবান! নারী চরিত্র সত্যিই..."
"হুম। বুঝবার চেষ্টাও করো না!"
"বেশ বেশ। তা ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ তো হল। এবার একটা ফ্রেঞ্চ কিস হয়ে যাক? সেলিব্রেশনটা কমপ্লিট হোক? কী বলো?"
No comments:
Post a Comment