থার্ড পিরিয়ড শেষের বেলটা বাজলেই কেমিস্ট্রি অনার্সের প্রথম বর্ষের এই গোটা কুড়ি ছাত্র ছাত্রীর বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে। সবে এক সপ্তাহ হল হাই স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে এসেছে। সিনিয়রদের সাথে রোজই দেখা হবো হবো করেও হচ্ছেনা। আর সেইখানেই হয়েছে মুস্কিল। বোটানি জুলজি স্ট্যাটস ফিজিক্স সব ডিপার্টমেন্টেই "সাক্ষাৎকার" ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। সেখানে পড়া বন্ধুদের থেকে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনে মনের মধ্যে সকলেরই কী জানি কী হয় গোছের একটা শুরু হয়ে গিয়েছে। এদিকে কেমিস্ট্রির দাদা দিদিদের দেখাই নেই।
"আমার তো মনে হয় আমাদের সিনিয়রগুলো খুব ভীতু। পাছে আমরা র্যাগিং ট্যাগিং নিয়ে কমপ্লেন করে দিই, সেই ভয়ে আসছে না ধারে কাছে।" অনিমেষ মন্তব্য করল। সঙ্গে সঙ্গে এলো সুমিলার উত্তর, "তুই যে কী চিজ, সেই খবরটা ওদের কানে মনে হয় এর মধ্যেই আকাশলীনা তুলে দিয়েছে। তোর ভয়ে হয়তো এ মুখো হচ্ছে না।"
" বাজে কথা বলিসনা তো যত। নিশ্চয়ই ওরা ব্যস্ত প্র্যাক্টিকাল নিয়ে, তাই আসছেনা। সারাক্ষণই তো দেখছি ল্যাবে মুখ গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে ওরা।" দীপের প্রাজ্ঞ মতামত এলো।
"কাটা ওসব। চল খেয়ে আসি। কালকের ভেজ চপটা যা ছিল না। আজ আমি দুটো খাবোই।" অনিমেষ তাড়া লাগাল। "হ্যাঁ সেই। যে যার নিজের তালে। এই শ্রুতি, চল চল। একা একা ওই কোণে বসে আছিস কেন রে?" সুমিলা হাঁক দিল।
একটা কোণে ফার্স্ট বেঞ্চে তখন চুপ করে বসে ওদের কথা শুনছিল শ্রুতি। ক্লাসের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে। এসেছে বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। শহুরে ঠাটবাটে এখনও অভ্যস্ত হয়নি। তাই সবার মতো অত উচ্ছ্বল না। চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে হাসে। ব্যস এইটুকুই। মেস থেকে টিফিন নিয়ে আসে একটা স্টিলের ঝোলা করে। টিফিন ব্রেকে ওই কোণে বসেই খুঁটে খুঁটে খায়। আর সাথে মাকে ফোন করে একটু গল্প করে। আজ সুমিলার ডাকে না বলতে পারল না। টিফিনসহ উঠে পড়ল। ওরা সবাই মিলে সবে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সামনে প্রায় গোটা পনেরোজনের একটা জটলা।
"ফার্স্ট ইয়ার তো। চল সব ঝটপট ক্লাসে ঢোক। ইন্ট্রো হবে আজ।"
ব্যস, যা নিয়ে এতদিনের টেনশন ছিল সবার, অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি এসেই গেলো।
সিনিয়রদের দলের মধ্যে এক দিদি, বেশ স্মার্ট চেহারা। জিন্স টপ পরে, মাথায় লম্বা বিনুনি। কানে বড় দুল। চোখে নীল আইলাইনার, জামার সাথে ম্যাচ করে। সেই যত কথা বলার বলে যাচ্ছিল। প্রথমে ওদের ব্যাচের সকলের পরিচয় দিল জুনিয়রদের কাছে। এক এক করে নাম বলছে আর শ্রুতি তাকিয়ে দেখছে। তমাল, পলাশ, অনন্যা, মৃণাল, রৌশন, জুনেইদ, শাক্য, পল্লবী, কমলিকা...আনন্দ। এই শেষ নামটি যার, তার দিকে তাকিয়ে শ্রুতি যেন আর চোখ ফেরাতে পারেনা। কী সৌম্য চেহারা। কালো ফতুয়া, নীল জিন্স প্যান্ট পরে, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা। ফর্সা গালে দুদিনের না কাটা দাড়ির হাল্কা আভা।
শাক্য বলে ছেলেটি এরপর এক এক করে শ্রুতিদের ব্যাচের সকলকে ডাকল ডায়াসে। শুরু হল "পরিচিতি"। সকলকে যে যা ভালো পারে, সেইরকম কিছু করতেই বলা হচ্ছিল। সুমিলা নাচল অপূর্ব। দীপ দারুণ মিমিক্রি করল। অনিমেষ আবৃত্তি করল। শ্রুতির পালা এলো। বড় লাজুক মেয়ে। কী পারে ভালো, জিজ্ঞেস করতে ও প্রায় মিনমিন করেই বলল, "কিছুই না।" আনন্দ একটু মুচকি হেসে ওর দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে বলল, "বাঙালি মেয়ে। কিছু পারিস না, তা তো স্বয়ং ঈশ্বর এসে বললেও আমি বিশ্বাস করবো না! গান বা নাচ নিশ্চয়ই শিখেছিস। কিছু একটা করতেই হবে।"
"সত্যি বলছি। আমি কিছুই পারিনা।"
নীল আইলাইনার দিদি হই হই করে উঠল, "ধ্যাত, ভাও খাস না তো। টিফিন শেষ হতে চলল। গেয়ে দে। বা নেচে দে। ব্যস তোদের ছুটি। ঝটপট কর। আর যতক্ষণ না করছিস কিছু, ছুটি নেই। এই বলে দিলাম। চল।"
ইতিমধ্যে শ্রুতির দু চোখ জলে টইটুম্বুর। ওর ব্যাচমেট, মেঘনা আলতো করে ওর হাতটা চেপে ধরল। কানে কানে বলল, "তুই কিছু একটা গেয়ে দে প্লীজ। দু লাইন অন্তত। চোখ বন্ধ করে গা। তাহলেই হবে। ভয় পাস না। আমরা আছি তো সাথে। কিন্তু না গাইলে ওরা জ্বালিয়ে মারবে। প্লীজ শ্রুতি। ভয় পাস না লক্ষ্মীটি।"
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে শ্রুতি বড় করে ঢোঁক গিলল একটা। তারপর শুরু করল ওর রেওয়াজি গলায় "মোহে রঙ দো লাল ..."
গাইতে গাইতে ও তো বিভোর হয়েছিল, সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গোটা ক্লাস হাঁ হয়ে শুনল ওর গান। গানের শেষে প্রবল হাততালিতে ভরে গেলো ক্লাসরুম।
বলাই বাহুল্য, সেইদিনের পর থেকে শ্রুতির আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। উপরি পাওনা ফ্রেশারসে আনন্দর সাথে তিনটে ডুয়েট গাইবার সুযোগ। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল বটে দুজনেই।
No comments:
Post a Comment