Tuesday, October 30, 2018

pujo

এইবারের পুজোটাও চেন্নাইতেই কাটালাম। গত বছর এখানে দুর্গাপুজো কাটানোয় জানতাম যে বাড়ির থেকে দূরে থাকলেও, আনন্দ কম হবে না। আসলে এই গত পাঁচ বছরের ওপর এখানে রয়েছি, এত মানুষজনের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে, চেন্নাই শহরটা এখন দিব্যি লাগে!
পুজো বলতে আমি পূজাবার্ষিকী বুঝি। সাম্পানের পূজাবার্ষিকী নিয়ে বেশ কিছুদিন টানা খাটাখাটুনির পর পুজো পুজো ভাব আনতে কিনে ফেললাম শারদীয়া দেশ আর বিচিত্রপত্র। এক দিদির থেকে আনন্দমেলাও পেয়ে গেলাম। আমার পুজো দিব্যি শুরু হয়ে গেল। ইতিমধ্যে অবশ্য ওয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছে। পুজোর সময় কে কবে কোন প্যান্ডেলে যাবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, সেই সব আলোচনা করতে। সেখান থেকেই একে একে ছবি পাচ্ছি, ঠাকুর আসছে বিভিন্ন প্যান্ডেলে। আলপনা দেওয়া চলছে। পুজো প্রাঙ্গণ সাজছে। তৈরি হচ্ছে আগামী কদিনের কর্মযজ্ঞের জন্য।
ষষ্ঠীর দিন থেকেই  নতুন জামা পরতে লাগলাম। এমনই অভ্যেস, বরাবরের। বেশ সাজুগুজু করে ছবিটবি তুলব, ওয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে দেবো। এতেই আনন্দ। সারাদিন নতুন জামা পরে ল্যাবে কাজকর্ম করে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোলাম। আমাদের চেন্নাইয়ে বেশ কয়েকটা পুজো হয়। প্রায় ১০-১২টা তো বটেই। তবে বড় ও জনপ্রিয় ওই হাতে গোনা কয়েকটিই। তার মধ্যে সবচেয়ে কাছে পড়ে ক্যাম্পাস থেকে, বেসন্ত নগরের সাউথ মাদ্রাস কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। ষষ্ঠীতে তাই ওখানেই গেলাম। ঠাকুর প্রতিমা একদম সাবেকি। রঙিন ঝলমলে শাড়ি গয়নায় মাকে সাজানো।
ঠাকুর নমস্কার করে এসে মূল কাজে মন দিলাম। পেট পুজো। পুজো মানেই চুটিয়ে খাওয়া দাওয়া করা আর আড্ডা মারা। সত্যি বলতে কী, প্যান্ডেলে গিয়ে কতবার ঠাকুর নমস্কার করি, মাঝে মাঝে খেয়ালই পড়ে না! বেসন্ত নগরের পুজো চত্বরে দারুণ দারুণ খাবারের স্টল থাকে। রোল বিরিয়ানি চপ ফ্রাই চাউমিন সিঙ্গারা লুচি পরোটা সব। এ ছাড়া মিষ্টি তো আছেই। ঘুরে ঘুরে সব দেখে শুনে প্রথম দিনের পেট পুজোটা সারলাম বিরিয়ানি আর এগ রোল সাঁটিয়ে। চেনা পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হয়েই যায় এখানে, হলও তাই। ফিরলাম হোস্টেল।
ইচ্ছে ছিল পরেরদিন, অর্থাৎ সপ্তমী থেকে দশমী ল্যাবে যাবো না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কিছু পেন্ডিং কাজ পড়ে যায়, সপ্তমী দুপুরটায় ল্যাবে থাকতেই হল। অবশ্য তার আগে সকাল সকাল মাইলাপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে সপ্তমীর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে নিয়েছি। দুপুরে ভোগ প্রসাদের ছবি আসছে ওয়াটসঅ্যাপে। এদিকে আমি কম্পিটারের সামনে বসে চরম মাথা ব্যাথা নিয়েও গ্রাফের পর গ্রাফ প্লট করে চলেছি। আজ কাজটা শেষ করতেই হবে। নইলে কাল আবার বসতে হবে এই নিয়ে। পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক দিচ্ছে। উহু। এরকম করে তো চলবে না। অনলাইন খাবার অর্ডার করে ফেললাম। সরু চালের ভাত, ডাল আর গারলিক ফিশ। এনার্জি পেয়ে কাজ শেষ করে হোস্টেলে এসে হাল্কা বিউটি ন্যাপ দিয়ে আবার সন্ধ্যেয় বেরোলাম বেসন্ত নগর। এবার সদলবলে। সঙ্গে ক্যামেরা। প্রচুর ছবি তুললাম। খেলামও অনেক। পুজোর ভোগের খিচুরি তরকারি তো ছিলই, এ ছাড়া মাছ ভাজা থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, শেষ পাতে ইয়া বড় বড় কমলাভোগ। আড্ডা টাড্ডাও মারলাম। তারপর আর কী, ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পরেরদিন অষ্টমী। অঞ্জলি দিতে হবে। রেস্ট দরকার।
অষ্টমীর অঞ্জলি দিলাম টি নগর বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পুজোয়। এবারে বোধহয় ওদের ৮০ না ৮৫তম পুজো ছিল। এসোসিয়েশনের নিজস্ব বিল্ডিঙে হয়। পুজোর জায়গাটা একটু ছোট। আর খুব ভিড়। তার মধ্যেও জায়গা করে নিলাম। ঠাকুরের প্রতিমা সাবেকি। আসলে চেন্নাইয়ে এখনও থিম পুজোর উপদ্রব শুরু হয়নি তো, তাই সব জায়গায় ঠাকুরের রূপ অসামান্য লাগে। কেমন একটা মোহময়ী স্নিগ্ধ মাতৃরূপ। অঞ্জলি দিলাম। সন্ধিপুজো দেখলাম। তারপর পেট পুজো। অতি লোভনীয় লুচি ছোলার ডাল আর রসগোল্লা। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কাছাকাছির মধ্যে কালীবাড়ি, সেখানে যাওয়া গেল না তাই। আবারও আড্ডা মেরে ভোগ খেতে বসলাম। সাবেকি ভোগ। খিচুরি লাবড়া বেগুনি চাটনি পায়েস। কী অপূর্ব স্বাদ। আহা। সন্ধ্যেয় আবার বেসন্ত নগর। আবারও প্রচুর চেনা লোক। আড্ডা। গল্প। আমার স্কুলের এক বান্ধবীর সাথে দীর্ঘ ষোল বছর পর দেখা হল। আরাত্রিকা। বেশ ভালোই লাগল। ছবি টবি তুললাম। খেলাম দেলাম। পুজোও মাঝামাঝি পর্যায়ে। ক্লান্তি আসছে অল্প করে। একেই পুজো কাটিয়েছি অসহ্য মাথা ব্যথায়। তবুও আনন্দ করব বলে দাঁতে দাঁত চিপে ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুরেছি এই কটাদিন। বই পড়াও হচ্ছেনা। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত।
তাই নবমীর অঞ্জলি দেওয়া হল না। লাঞ্চের আগে আগে বেসন্ত নগর পৌঁছে গেলাম। আজও সদলবলে। তবে অন্য দল। বলে রাখা ভালো। আমার প্রচুর সার্কেল এখানে। সকলের সাথে মিলে মিশে প্ল্যান করে দেখা সাক্ষাত করতে হয়েছে পুজোয়। আজও ভালো মতনই খ্যাঁটন হল। পোলাও মাংস মাছ ভাজা মিষ্টি তো ছিলই, (ভোগ বাই ডিফল্ট ছিল) সাথে যোগ হল ফুচকা। হ্যাঁ জানি ভাবছেন বাবা, এ মেয়ে কত খায়। হ্যাঁ। ওজন বেড়ে যে কোথায় পৌঁছেছে, লজ্জার মাথা খেয়ে আর মাপিনি!
যাই হোক, নবমীর দুপুরে সব একে তাকে একসাথে নিয়ে আমাদের পরিক্রমায় বেরোনোর কথা ছিল। দেখা গেল লেট হচ্ছে। আমি ধ্রুব দা অপর্ণা দি আর ওদের ছেলে ময়ূখ বেরিয়ে পড়লাম ওলা নিয়ে। রামকৃষ্ণ মিশন পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি সুজয়দারা বিরাট টেম্পো ত্র্যাভেলার নিয়ে চলে এসেছে। আর সৈকতদারাও গাড়ি নিয়ে এসে গিয়েছে। ব্যস। আর কী, পুরো গ্রুপ রেডি। এরপর শুধুই ঘোরা। এ গাড়ি থেকে ওই গাড়িতে ফোন করে ডিরেকশন নেওয়া। ছবি তোলা। সিঙ্গল। কাপল। গ্রুপ। সেলফি। মানে যত রকমের কম্বিনেশন হয়। মাঝে চায়ের ব্রেক নেওয়া হল আন্না নগর দক্ষিনী সোসাইটির পুজোয়। বৃষ্টি হয়ে রাস্তায় কাদা। ভিড়। সব মিলিয়ে কালীবাড়ি হয়ে টি নগরে এলাম যখন, ভেবেছিলাম ডিনার প্যাক করে হোস্টেলে ফিরব। ওরে বাবা, ওখানে এত ভিড়, তিলধারণের জায়গা নেই বলা যায়।  শুনলাম এগারোটার আগে ডিনার পাওয়াই যাবে না। অগত্যা আবার বেসন্ত নগর। ওলা ছেড়ে দিয়েছি। গাড়ি আর পাওয়া যায় না। এত লোকের ঢল রাস্তায়। সত্যি বলছি, মনে হচ্ছিল, এ কলকাতা নাকি? শেষ মেশ অটো করে বেসন্ত নগর এলাম। মোগলাই পরোটা আর ফিস ফ্রাই প্যাক করে ফিরলাম হোস্টেল।
আর এনার্জি নেই। পরেরদিন তাই আর প্যান্ডেলে যাইনি। পি এইচ ডি স্কলার মানুষ। ফিরলাম ল্যাবে। কাগজে কলমে পুজো শেষ হল। তবে আমার পুজো এখনও চলছে। পরপর বন্ধুরা বাড়ি থেকে ফিরছে। মিষ্টির পর মিষ্টি খাচ্ছি। শারদীয়াগুলো পড়ছি। এছাড়াও আরো অনেক বই কেনা রয়েছে (দুটো তো সপ্তমীর দিন পেলাম)। সেগুলি পড়ছি এক এক করে। পুজোর এই রেশ থাকবে কিছুদিন! অন্তত কালীপূজো অবধি।

Monday, October 29, 2018

অগ্নির জন্য

বেলা দেড়টা। নিউ জার্সির লিবার্টি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছি, বোর্ডিঙের অপেক্ষায়। প্লেন ছাড়তে এখনও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। এক্ষুনি আমার প্লেনেরই সহযাত্রী সম্ভবত, বছর উনিশ কুড়ির দুই বঙ্গ তনয়া এসে আমার সাথে সেলফি তুলে গেল। ইন্সটাগ্রামে দেবে। অটোগ্রাফও দিতে হল।

সপ্তাহ খানেকের জন্য এসেছিলাম ইস্ট কোস্টে। এই প্রথম এই দিকে এলাম। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বখ্যাত নিউ ইয়র্ক ফেস্টিভালে রেডিও অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আবারও এই বছর সানডে সাসপেন্সের জন্য পাওয়া গোল্ডেন প্রাইজটি গ্রহণ করা। এই নিয়ে টানা দশ বছর আমরা এই পুরস্কার পাচ্ছি। এই বারে যেহেতু আমার নির্দেশনায় "কৈলাসে কেলেঙ্কারি"র জন্য অ্যাওয়ার্ড, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি এসেছিলাম পুরস্কার নিতে। কাছাকাছি সময়েই নর্থ অ্যামেরিকা বেঙ্গলি কনভেনশনও ছিল। জার্সি সিটিতে হল। গত দুই বছর ধরে আমন্ত্রণ পেয়েও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এইবারে সেই কাজটিও সেরে এলাম। প্রবাসেও যে আমাদের এত ভালোবাসে লোকে, অনুভব করে খুব ভালো লাগল।

নয় নয় করে প্রায় বারো বছর হয়ে গেল মিরচিতে আছি। ক্যাপ্টেন নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আজকাল ওঁর শোটা এখন আমিই করি। প্রথম যখন এই সুযোগটা আসে আমার কাছে, খুব চ্যালেঞ্জিং লেগেছিল। ক্যাপ্টেন শোটাকে যেই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, সেখানে পৌঁছনো যে কী কঠিন কাজ হবে, আমি হাড়ে হাড়ে জানতাম। আর আজ তাই যখন সেই শোয়ের জন্যই জায়গায় জায়গায় পুরস্কার পাই, শ্রোতাদের ভালোবাসা পাই, অসম্ভব আনন্দ হয়। এই যেমন গত মাসে রেডিও কনেক্স অ্যাওয়ার্ডে ইস্টার্ন জোনের বেস্ট আর জে হলাম। বা গত বছর পেলাম জনপ্রিয় চ্যানেলের সেরা বাঙালি পুরস্কার। যখন মিরচির অডিশন দিতে গিয়েছিলাম, কখনও ভেবেছিলাম একদিন এই জায়গায় পৌঁছতে পারবো?

এত খ্যাতি, তার জন্য এত এদিক ওদিক যাওয়া আসা, লেগেই রয়েছে। তবুও, যতই হিল্লি দিল্লী ঘুরে বেড়াই না কেন, দিনের শেষে কলকাতায় ফেরার তৃপ্তিটাই আলাদা। এই যে সাতদিন পর আবার কাল বাড়ি ফিরছি, ভেবেই রোমাঞ্চ জাগছে। আবার ঠিক সকাল সাতটা বাজলেই মাইক্রোফোনের সামনে বসব। মিস করেছি এই কদিন, খুব। এতগুলো মানুষের সাথে আবার কানেক্ট করব নিজেকে। দারুণ।

জীবনে তেমনভাবে প্ল্যান করে কখনোই চলিনি। তবু হলফ করে বলতে পারি, যেমনভাবে যে পথে যে গতিতে এগিয়ে চলেছি, এই তো, দিব্যি আছি। প্রায় কোন আক্ষেপ নেই বলা চলে। হুম, "প্রায়"। কেন বললাম? আসলে নিজের জন্য কখনও কারুর কাছে তেমনভাবে দাবী করে উঠতে পারিনি।  আবার সময়মতো সঠিক লোককে সঠিক কথাটা বলতে পারিনি। আর তাই, এই যে আমি, এখনও মূর্তিমান "সদা সিঙ্গল" হয়েই রয়ে গেলাম! এটাও অভাবনীয় কিন্তু, শোয়ের ট্যাগলাইন যে এইভাবে ফলে যাবে আমার ব্যক্তিগত জীবনে... যাই হোক, লাইন পড়ছে। উঠি। ষোল ঘণ্টার লম্বা জার্নি। হ্যান্ডব্যাগেই "সেরা সন্দেশ" রাখা আছে। আমার সময় ঠিক কেটে যাবে।  জয় গুরু! 

Monday, October 22, 2018

Post Pujo হ্যাঙ্গাম

পুজো শেষ। কদিনের হইহুল্লোড়ের পর বাচ্চাগুলো মামাবাড়ি থেকে ফিরেছে। একটুও ফাঁকি মারার জো নেই। এতগুলো বই নিয়ে এসেছে মামাবাড়ি থেকে, পড়ার এখন স্কোপই নেই। স্কুল খুললেই পরীক্ষা। আর তাই সারাক্ষণ মায়ের চোখ রাঙানি।

মায়ের কড়া অনুশাসনে ছেলেমেয়েগুলো এতদিন পর সবে আবার বই নিয়ে বসেছে। একগাদা পড়া বাকি। হোমওয়ার্ক রয়েছে। সিলেবাসও এগিয়ে রাখতে হবে। মায়ের হাতে শারদীয়া পত্রিকা। মাঝে মাঝে চায়ের কাপ থেকে এক এক চুমুক দিচ্ছেন আর বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে বাচ্চাগুলোকে দেখে নিচ্ছেন। "পড়ছিস তো? পরীক্ষায় যেন একটাও যেন সিলি মিস্টেক না হয়। মন দিয়ে পড় বাবা।"

এদিকে পাশে রাখা ফোনটা সমানে টুং টাং করে বেজেই চলেছে। বিরক্ত লেগে যায়। ওয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকের গুচ্ছের নোটিফিকেশন। লোকগুলো যত বলিহারি। আরে বাবা, এতদিন আনন্দ করলি। বেশ। এবার তো কাজে ফের। তা না। এই গুচ্ছের গুচ্ছের ছবি সব সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে হবে। আর করবি কর। আবার এত ট্যাগ কেন বাবা? একটুও শান্তিতে থাকতে দিবি না? নিজেদের না হয় এখনও ছুটি। কাজ কর্ম নেই। কিন্তু এই বাচ্চাগুলো তো ডিস্টার্ব ফিল করছে, বোঝে না কেন এরা?

ধুস। রাগের চোটে মা এবার ফোন থেকে নেটই অফ করে দিলেন।


বিঃ দ্রঃ বুঝলেন তো, এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল বলছি। স্ট্রেট ফ্রম কৈলাস। মা দুর্গা অ্যান্ড কোংকে এবার একটু নিজেদের মতো থাকতে দিন প্লিজ। নেট অফ আপাতত। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেলে সারা বছর আমার আপনার প্রার্থনাগুলো শুনবেন কী করে বলুন তো?

বিঃ বিঃ দ্রঃ জনৈক অনুপম রায়ের একটি বিখ্যাত গান এখন মায়ের কলার ট্যুন।

Friday, October 19, 2018

আমার দশমী

বিজয়া দশমী একেক সময় একেক রকমের অনুভূতি নিয়ে আসে আমার কাছে। যখন একদম ছোট ছিলাম, তখন মনে হত এ বাবা, আজকেই তো পুজো শেষ। তার মানে গুরুজনদের বিজয়ার প্রণাম করে ফেললেই চারদিনের লেখাপড়া থেকে ছুটির মেয়াদ শেষ। স্কুল খুললেই সেকেন্ড টার্ম, হাজার অনুনয় বিনয় করলেও মা শুনবে না। আমার অস্ত্র থাকত তখন, দাঁড়াও, ঠাকুর আগে বিসর্জন হোক। তারপর তো... খালি মনে হত, ঠাকুর, আগে যেন ফেজ ওয়ান না বেরোয়। ফেজ টু যাক, ফোর যাক, দূরদর্শন যাক। আমাদের ফেজ ওয়ান যেন না বেরোয়। নিজেদের ঠাকুর বেরিয়ে গেলেই ব্যস। আর কোন বাহানাই কাজে লাগবে না। কপাল ভালো থাকলে কিছু কিছু বছর ফেজ ওয়ান বেরোত সাতটার পর। ব্যান্ড পার্টি নাচগান ইত্যাদি দেখতে দেখতে আটটা। ফার্স্ট টার্মে খুব ঝোলান ঝোলাইনি, তাই মা একটু সদয় হল। আরো একদিন ভর সন্ধ্যেবেলা পূজাবার্ষিকী পড়ার অনুমতি পেয়ে যেতাম।

আরেকটু বড় হতে "দর্পণে বিসর্জন"এর কনসেপ্টটি জানতে পারলাম। তখন আর কী নিজের সুবিধার্থে সেটি ব্যবহার করছি। ঠাকুর যায়নি বলে পড়তেও বসছি না। এদিকে সবে সবে বাবার মোবাইল আসায় বন্ধুদের এস এম এস পাঠানোর লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কী দ্বন্দ্ব, ভাবা যায়? কে আগে কাকে এস এম এস পাঠাতে পারে... আমার আবার চিরকালই একটু ফরওয়ার্ডেড মেসেজের প্রতি অনীহা। তাই নিজে নিজে ভেবেচিন্তে কিছু কম্পোজ করতে হবে। কত তাড়াতাড়ি ভালো কিছু লেখা যায়, সেই নিয়ে হুলুস্থুল। দুপুর দুপুর হয়ে গেলে রিপ্লাই পাঠাতে থাকো, না হলে কারুর পাঠানো মেসেজ এলে "এখনও ঠাকুর জলে যায় নি" বলে ঠেকিয়ে রাখো।

বাড়ির বাইরে থাকা শুরু হতে বিজয়া দশমী মানে একটু একটু মন খারাপ। ছুটি প্রায় শেষের দিকেই। পুজো পুজো ভাবটাই ভালো। এলেই তো শেষ। আর বিজয়া মানেই এরপর হুড়মুড় হুড়মুড় করে লক্ষ্মী পুজো। আর তার মানেই পরেরদিন ফ্লাইট। আবার কবে ফিরব, কে জানে?

বিজয়ার স্মৃতি বললে একেক বছরের কিছু টুকরো টুকরো ছবি মনে এসে যায়। অনেকটাই ছোট তখন, বছর কুড়ি আগে প্রায়। সোমা পিসি অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে অনেক বছর পর। ভাসান দেখে ওর মধ্যেকার যুবতী সত্ত্বা জেগে উঠেছে। কী উত্তাল নাচ নেচেছিল। বিজয়া মানে তখন আনন্দ। বিজয়া মানে তখন সব আত্মীয় পরিজনদের সাথে দেখা হওয়া। প্রণাম করা।

এখন এই চেন্নাই শহরে বসে সেরকম ভাবে কিছু মনে হয় না। মণ্ডপে না গেলে না শুনতে পাই ঢাকের আওয়াজ। না শুনি শঙ্খধ্বনি। একটা শিউলিও চোখে পড়ে না। ওই মণ্ডপে মণ্ডপে চারদিন ঘুরলাম। সবার সাথে দেখাও হল। ব্যস। বিজয়া দশমী মানে আবার সেই গতানুগতিকে ফেরা। তাই আজকের দিনে যেন আরো বেশি করে মা দুর্গার মুখটা দেখে বারবার কান্না পায়। হঠাৎ মন কেমন করে ওঠে কলকাতায় বসে আছে আমার যে মা দুর্গা, তার কথা ভেবে। ফোন করলে কেঁদে ফেলব, সেই ভয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিই।

অনেকগুলো বছর আগের বিকেলের কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ছোট্ট ম্যাটাডোরে চেপে কোন না কোন বাড়ির পুজোর প্রতিমা বিসর্জনের আওয়াজের বিষাদ  আর বর্তমানে বিজয়ার সন্ধ্যেয় ক্যাম্পাসে সাইকেল চালিয়ে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ ভেসে আসা ছাতিমের পাগলকরা গন্ধ কোথায় যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা চেপে ধরে।

বারবার যেন তখন মন বলে ওঠে, আরেকটা দিন কি থেকে গেলে হত না?



Friday, October 12, 2018

আনন্দমেলা


ভোগের খিচুরি সাঁটিয়ে পূর্ব দিকের ঘরের খাটটার ওপর মালিকানা নিয়ে খালি ঝগড়া হত বাবার সাথে। ভাদুড়িদের দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে শুয়ে শুয়ে ওই চুরি করে পাওয়া এক কণা রোদের আলোয় শারদীয়া আনন্দমেলা পড়ব। এদিকে বাবার তখন চোখে ঘুম। সারা বছরের খাটুনির পর এই তো কষ্টেসৃষ্টে সপ্তমী অষ্টমী সি এল না আর এইচ কীসব নিয়ে টানা চারদিনের ছুটি। একটু জিরিয়ে নেওয়ার মতলব।

পুজো উপলক্ষে তখন চারটে জানলা আর দরজায় মায়ের পছন্দের ছিটের নতুন পর্দা টাঙানো। সাদার ওপর সবুজ লতাপাতার প্রিন্ট। বা অফ ওয়াইটের ওপর ব্রাউন বড় বড় শুকনো পাতা। কী কন্ট্রাস্ট। একটায় তারুণ্যের প্রাচুর্য, অন্যটায় দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার ভার। ঠিক যেন বাবা আর আমি।

বেলা ছোট হয়ে এসেছে। এই ঘরে বেশিক্ষণ রোদ আসবে না আর। একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আমেজ, তার মধ্যে এই এক ফালি রোদ যেন বড় আরাম।

তর্ক বিতর্কের পর রফা হত বাবার সাথে। যতক্ষণ না মা রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে ঘরে আসছে, ততক্ষণ পর্দা ফাঁক করে একটু বই পড়া যাবে। তারপর মা এলে সব্বাই ঘুম দেবে। বেশ। ভালো উপায়। জানি মায়ের সমস্ত কাজকর্ম মেটাতে মেটাতে অন্তত একটা ছোট গল্প শেষ হবেই। বা ক্যুইজের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিতে পারবোই। নিদেনপক্ষে সমস্ত রঙিন বিজ্ঞাপনগুলো পড়া হয়ে যাবে।

যথারীতি তারপর শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা ঘরে আসত। আমি ততক্ষণে দুঃসাহস দেখিয়ে অর্জুনের সাথে তিস্তাকে পাশে রেখে চলেছি জঙ্গলের দিকে। "একটুও মনে হয় না না, মা কে সাহায্য করি? শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলা পড়া হচ্ছে। আর তোমাকেও বলিহারি, ছাড়া জামাগুলো একটু ভাঁজ করে রাখতে পারো না? সব আমায় করতে হবে। এতটুকু দয়া হয় না আমার ওপর তোমাদের কারুর। সেই সকাল থেকে খেটেই চলেছি।" মায়ের অভিযোগে ফিরে আসি কলকাতার ঘরে।

"তুমি শোও না। চলো একটু ঘুমিয়ে নিই। আমি বিকেলে উঠে পাট করে দেবো।" আমার অনুনয় কাজে লাগে না। মা নিজে সমস্ত কাজ গুছোতে থাকে। আমি চলি ততক্ষণে আবার উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে, আরো গভীরে। এই বুঝি কোন অজানা বিপদ এলো অর্জুনের দিকে। "বইটা রাখ। শুয়ে পড়। একটু রেস্ট নে কটাদিন। স্কুল খুললেই পরীক্ষা। দশমীর দিন সন্ধ্যে থেকে কিন্তু পড়তে বসতে হবে। তখন একটুও কোন বাহানা শুনবো না। এখন কয়েকদিন একটু ঘুমিয়ে নে।" "প্লিজ মা, আর একটুখানি বাকি। দেখো। দশ পাতা।"
"রেডিওটা বন্ধ কর। কী বকরবকর শুনেই চলেছিস..."
"না না চলুক না। আমি শোওয়ার আগে বন্ধ করে দেবো। একটু রাস্তাঘাটের ভিড়ের কথা শুনি..."

যতক্ষণে তারপর বইটা নামিয়ে রাখতাম পাশে, বাবা নাক ডাকছে। মাও ঘুমের রাজ্যে। কালো রেডিওটাকে বন্ধ করে মায়ের দিকে পাশ ফিরে, মাকে জড়িয়ে আমিও শুয়ে পড়তাম চোখ বুজে। বালিশের বদলে মাথার নিচে তখন শারদীয়া আনন্দমেলাটা। মায়ের গায়ের গন্ধে কী সহজেই ঘুম এসে যেত। ঘুম ভাঙত ঢাকের আওয়াজে বা প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসা মাইকে কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে। মা ততক্ষণে আবার রান্নাঘরে। চায়ের ব্যবস্থা করতে।

যেমন কিছু অভ্যেস বদলায় না, তেমনই কিছু আশ্রয় আজও সমানভাবে জরাগ্রস্থ মনকে দেয় আরাম, ব্যাধির ওষুধ। আজও পুজোর আগের হিমেল সন্ধ্যেয় ঠাণ্ডা লাগিয়ে জ্বর বাধালে, দুপুরবেলা হোস্টেলের ঘরের খাটে যেটুকু রোদ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে, তার কোল ঘেঁষে শুয়ে আনন্দমেলা পড়লে জ্বর জ্বালা কোথায় যেন ফুস করে উড়ে চলে যায়। গ্লানিগুলো পরাজিত হয় সাদা কালো অক্ষরের সঞ্জীবনীতে। সাইকেল চালাতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা শিউলি জানান দেয় শারদীয়ার। ল্যাবের সিঁড়িতে জলের ক্যানের আওয়াজে ঢাকে কাঠি পড়ার শব্দ বেজে ওঠে কানে।

আজ চতুর্থী।

Thursday, October 11, 2018

ঘরে ফেরা

১।

"এইবারে সপ্তমী হোল নাইট প্ল্যান অন তো?" বুদ্ধর মেসেজ ঢুকল ওয়াটসঅ্যাপে। অরিজিনে এন এম আরের প্লটগুলো করতে করতে মাথা ধরে গিয়েছে রাহীর। উফ। সোমবার দুপুরে এস আর এফ কনভারশানের প্রেজেন্টেশন রয়েছে। সেই নিয়ে টেনশন, তার সাথে পুজোয় বাড়ি যেতে না পারার মন খারাপ। পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম ও পুজোয় কলকাতা যাচ্ছে না। ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে। আর ওদের পঞ্চ পাণ্ডবের গ্রুপ চ্যাটে একটার পর একটা এই রকম মেসেজ, উহু, নট হেল্পিং অ্যাট অল! ও ছাড়া বাকি চারজনই ফিরছে কলকাতা, ষষ্ঠীর দিনেই। বুদ্ধ আর শুভ ব্যাঙ্গালোর থেকে, রঞ্জা বম্বে আর পুপাই দিল্লী থেকে। সেই লোয়ার কেজি থেকে এক স্কুলে এক সেকশনে পড়েছে ওরা। বাড়িও একে অপরের থেকে হাঁটা পথ। একই পাড়া। সব মিলিয়ে পঞ্চ পাণ্ডবের গ্রুপটা দারুণ পাকাপোক্ত। পুজোর চারদিনের হই হুল্লোড় করতে নিজেরাই যথেষ্ট। প্রতি বছরের মতোই এই বছরেও পঞ্চ পাণ্ডবের প্ল্যানিং চলছে পুরো দমে। সবাই উত্তেজিত, এত মাস পরে দেখা হবে সবার সাথে সবার, এতো বাড়তি পাওনা। শুধু রাহীর মন ভালো নেই। ও পি এইচ ডি করছে আই আই টি ম্যাড্রাসে, কেমিস্ট্রি নিয়ে। কাজের চাপ, সাথে ছুটির কমতি। সব মিলিয়ে এইবারে পুজোর ঠাই তাই চেন্নাইই। ওর বন্ধুরা ওকে বারবার বলছে, কোনভাবে ম্যানেজ করতে। কিন্তু কিছুতেই যে কোন উপায় দেখছে না ও।

২।

"বুদ্ধ, ক্যাব বুক করেছিস?" ফোনের ওপারে শুভর কণ্ঠস্বর। সোমবার দুপুর দেড়টা। নামী আই টি কোম্পানির কিউবিকলে বসে কোড রান হচ্ছে। নীল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সেইসবই দেখছিল বুদ্ধ। মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে বাঁ হাতের কব্জিতে। আর পাঁচ ঘণ্টা, আর চার। আর তিন। এই করেই সকাল থেকে কোনমতে ঠেকিয়ে রেখেছে নিজেকে। রাত্তির আটটার ফ্লাইট। ওর আর শুভর। ইলেক্ট্রনিক সিটিতে কাছাকাছিই অফিস দুজনের। ছোট্টবেলার দুই বন্ধু ফ্ল্যাটমেটও। একই ফ্লাইট ধরে ফিরবে। দুজনেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোবে। একসাথেই এয়ারপোর্ট পৌঁছবে। সেইরকমই প্ল্যান।

"হুম। ওলা প্রি-বুকড। সময়মতো এলে হয়। আর রাস্তায় জ্যামে না ফাঁসি।" বুদ্ধ উত্তর দিল।

"সেই, আধা ব্যাঙ্গালোরই তো মনে হয় এই ফ্লাইটটাই ধরছে। যাকেই জিজ্ঞেস করছি, সব শুনছি ৮ঃ৩৫এর জেট। ই-সিটি থেকে শাটল দিলে পারে।" শুভ একটু হেসেই উত্তর দিল। অন্যান্য দিনে শুভর ফোন মানেই এক গাদা ঘ্যানঘ্যান। এই সম্বর রাইস এতো জঘন্য কেন, বিসি বেলে বাথ না বিষ এটা, টি এল টা হেব্বি বজ্জাত, ইচ্ছে করে কাজ আপ্রুভ করছে না, অটোওলা চোর, এইটুকু আস্তে দেড়শ টাকা নিয়ে নিলো। আর আজ দেখো। নো কমপ্লেন। পুজো পুজো আমেজ। খুব আনন্দ করবে ওরা সবাই মিলে। ইশ, রাহীটা যদি আসতে পারতো।

৩।

"ভাই, আমি সিকিউরিটি লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কী লম্বা লাইন রে বাবা। সব্বাই শুধুই বাংলায় কথা বলছে। গোটা দিল্লী কলকাতায় ফিরছে নাকি?" পুপাইয়ের ভয়েস নোট এলো ওদের গ্রুপে।

"দেখিস, আবার ফ্লাইট মিস করিস না। এত দেরি করে কেউ? ৭ঃ৪০ এর ফ্লাইট, সাড়ে ছটা বেজে গেল। এখনও তুই লাইনে।" রঞ্জা একটু কড়া গলায় মেসেজ পাঠাল।

রঞ্জা বরাবরই একটু দিদিমণি গোছের। আর এখন টিচ ফর ইন্ডিয়া ফেলোশিপ দিয়ে বম্বের স্কুলে চাকরি করতে গিয়ে পুরোপুরি দিদিমণি মোডে চলে গিয়েছে।

"না রে। ডোন্ট ওয়ারি। এয়ার এশিয়ার ঠাকুরদারও সাধ্য নেই আমাদের না নিয়ে প্লেন ওড়ানোর। পুরো পুজো ক্রাউড। একদম মনে হচ্ছে এ যেন ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট না। বরং এ বোধহয় কলেজ স্কোয়ারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, নবমীর সন্ধ্যেয়। উফ। খালি বাংলা আর বাংলা। সবার ওই 'মা, আমি আসছি।' বা 'গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়ো। এই বোর্ডিং দিল বলে' চলছে।"

ব্যাঙ্গালোরের কেম্পে গোউডা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পাশাপাশি বসে আছে বুদ্ধ আর শুভ। গ্রুপ চ্যাট পড়ছে। আর হাসছে।

"সত্যি, কত্তদিন পর সবার দেখা হবে, বল? এই প্ল্যানটা ভালো। এয়ারপোর্টেই সবাই মিট করব।" বুদ্ধ বলল।

ফেসবুকে এয়ারপোর্ট চেক-ইন সেলফি আপলোড করতে শুভ এখন ব্যস্ত। মাথা না তুলে শুধু একটা "হুম" বলে ছেড়ে দিল। মোটামুটি আগে পরে ঢুকবে সকলের ফ্লাইট, কাছাকাছি সময়েই। রঞ্জার বম্বের ফ্লাইট একটু দেরিতে। ঘন্টাখানেক মতো। গেট থ্রি বির সামনে সকলের মিট করার কথা। তারপর একসাথে ক্যাব নিয়ে বাড়ি। ঢোকার আগে একবার নিজেদের মণ্ডপে ঢুকে মায়ের মুখ দেখবে। গ্রুপে এই রকমই প্ল্যান হয়ে আছে। আজ তো ষষ্ঠী। বোধন হয়েই গিয়েছে এতক্ষণে। পুজো শুরু। শুধু রাহীর জন্য মন খারাপ লাগছে। বেচারিটা একা একা পড়ে রইল চেন্নাইতে। দুপুরে প্রেজেন্টেশন ভালো হয়েছে জানিয়ে আর মেসেজ করেইনি। সব মেসেজ "সিন" দেখাচ্ছে। উত্তর নেই। নিশ্চয়ই মন খারাপ। বুদ্ধর খারাপ লাগছে। খুব।

৪।

রাত সোয়া এগারোটা। এয়ারপোর্ট গেট থ্রি বির দিকে এগিয়ে চলছে ওরা চারজন। বুদ্ধ, শুভ, পুপাই আর রঞ্জা। "আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল, বল?" রঞ্জা বলল।

"হুম। ব্যাক টু সিটি অফ জয়। এইবারে জয় মা দুর্গা বলে চারদিন হই হই।" পুপাই জবাব দেয়।

"কাল কিন্তু ম্যাডক্স যাবো, যদি এই বছর অন্তত লাক ফেভার করে," বুদ্ধ ফুট কাটল।

"তুই ওই করেই গেলি। ইডিয়ট কোথাকার," শুভ পিছনে লাগে বুদ্ধর।

"সবই ভালো, শুধু রাহীটাকে বড্ড মিস করব।" রঞ্জা বলে।

"আমি ওকে ফ্লাইট থেকে নেমে ফোন করেছিলাম। বলল চেন্নাই বেঙ্গলি গ্রুপের সাথে ঘুরবে। প্ল্যান ট্যান চলছে। শি সাউন্ডেড সো স্যাড রে। আমারই মন খারাপ হয়ে গেল।" পুপাই বলল।

"এই ক্যাব কই রে, সব পনেরো কুড়ি মিনিট ডিস্টেন্সে দেখাচ্ছে। কোন সেডান নেই। যা আছে, ওই এস ইউ ভি।" অ্যাপ থেকে চোখ তুলে শুভ বলল।

"যা পাচ্ছিস, তাই বুক করে দে। ভাই, ষষ্ঠীর রাত। কলকাতা। আর কী এক্সপেক্ট করিস? চল, বাইরে গিয়ে ওয়েট করি।" রঞ্জা পাশ থেকে বলল।

কাঁচের দরজাঠেলে বেরোতেই ওরা থ। ঠিক দেখছে? সামনে ওটা কে? লাল কুর্তা নীল জিন্স, কানে ইয়ারফোন, সাথে বেগুনি ট্রলি ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে, রাহী না?

"সারপ্রাইইইইজ!!!!"

"একী? এটা কখন হলো?"

"কী করে হলো?"

"ফোন করলাম যখন, তুই বললিনা তো?"

"হেঁহেঁ, বল কেমন চমকে দিলাম!"

"এ মেয়ে আমাদের এক কাঠি ওপর দিয়ে যায় দেখছি!"

"আরে, মিটিং ভালো হল। তারপরেও মুখ চুন করে ঘুরছিলাম দেখে গাইড জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে। বললাম সব। উনি বললেন, যাও, দিন দশেক ঘুরে এসো। ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কাটলাম। দশ হাজার খসল বস। কিন্তু সে ছ মাস পরে ভুলে যাবো। তোদের মেসেজগুলো সবই পড়ছিলাম। পুরো প্ল্যান জানতাম। আটটা পাঁচে ল্যান্ড করলাম। এই তিন ঘণ্টা ধরে বসে আছি তোদের অপেক্ষায়! তোরা আমার জন্য হা হুতাশ করছিস। আর এদিকে আমি এখানে বসে আছি। কত কষ্টে যে নিজেকে সামলেছি রে...এবার বল, কেমন দিলাম?"

রঞ্জা ওর দিদিমণি স্টাইলে বিধান দিল, "বেশ করেছিস। এইবারে আমাদের এরকম জেনে শুনে গিলটি ফিল করিয়েছিস বলে তোকে যে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!"

"প্রায়শ্চিত্ত? কীরকম?"

"ডিনারে আজ মন্টুদার বিরিয়ানিটা তুই স্পন্সর করবি!"

"বেশ তাই হবে।"

"ওরে, চল রে। ক্যাব এসে গিয়েছে। এবার না উঠলে আর বিরিয়ানি জুটবে না।"

"চল, চল।"

Thursday, October 4, 2018

মাতৃরুপেণ

পুজোর বাকি আর মোটে দিন দশেক। এই কটাদিন, বিশেষ করে শনি রবি ওদের হোমে থাকে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা। ওরা মানে ওই নানান বয়সী বাচ্চারা। তিতলি, রুপাই, পাপিয়া, মুন্নি, বিকলু, দিয়া, গাব্বু সহ আরো জনা কুড়ি ছেলে মেয়ে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এইদিন সব দাদা দিদি কাকা পিসি মাসিরা আসে, তুলে দেয় ওদের হাতে নতুন জামা, রঙ পেনসিল, বই, খাতা। তারপর ঘটা করে চলে ছবি তোলা, যা শুরু হয় ওদের সাথে, তারপর শহুরে মানুষগুলো নিজেরাই ওই নিজেদের ছবি তুলতেই ব্যস্ত হয়ে যায়। এরপর বিকেল হলে ওরা সবাই ফিরে যায় নিজেদের বাড়ি। পড়ে থাকে এই বাচ্চাগুলো। আর থাকে ওদের শেফালি দি, ঝর্ণা দি। হোমের ঘরগুলো তখন সারাদিনের "উৎসবের" পর লণ্ডভণ্ড অবস্থা। সেই সব পরিষ্কার করতে করতে তাদের তখন মেজাজ তিরিক্ষি। একটু ট্যাঁ ফো করলেই তাই বাচ্চাগুলোর জোটে জোর বকুনি।

বিকলুর একদম ভালো লাগেনা এইসব দিনগুলো।  কী লাভ? ওই খানিকক্ষণ সং সেজে থাকো। ওই কিছু টুকটাক উপহার। ব্যস। তারপর সারা বছর ওরা বাঁচল কি মরল। কী করলো। কারুর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নেই কোন হেলদোল। ওর এই ছয় বছরের ছোট্ট জীবনেই বুঝে গিয়েছে সার সত্যটা। ওরা তো অনাথ। ওদের জন্য তাই ওই কুড়িয়ে বাড়িয়ে যেটুকু আনন্দ পাওয়া যায়, ওইটুকুই। ওদের না আছে তেমনভাবে পুজো, না আছে ক্রিসমাস। একদিন শুধু লাইন দিয়ে তিন চারটে মণ্ডপে ঘোরা, নতুন জামা পরে। বাকি দিনগুলি হলে টিভিতে বসে ঠাকুর দেখা। আর বড়দিনে স্যান্তা দাদুর ঝুলি থেকে কেক আর খেলনা দুই একটা। এই ওদের উৎসব, এই ওদের উদযাপন।
  
আজ সকাল থেকেই বড়দির নির্দেশে ওরা স্নান সেরে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তৈরি হচ্ছে। এবারে নাকি বিদেশ থেকে আসছে একটা দল। বিকলুর মন খারাপ। এক রাশ বিরক্তি। বিদেশী মানেই সেই থতকে থতকে জ্যাক অ্যান্ড জিল আর টুইঙ্কল টুইঙ্কল বলতে হবে। আবার সোনিয়া দিদি মম চিত্তে গাইবে, তিতলি দিদি আর পাপিয়া দিদিকে নাচতে হবে। ভালোই লাগেনা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল ও। এমন সময়ে ঝর্ণাদি এলো ওর কাছে, "বিকলু বাবু, এসো তো। বড়দি তোমায় ডাকছেন।" কী ব্যাপার, ওকে আলাদা করে ডাকছে কেন, একটু অবাক হয়েই বিকলু ঝর্ণাদির পিছু পিছু হাঁটা লাগাল। বড়দির ঘরে ঢুকে দেখে একজন কাকু আর একটা কাকী বসে আছে।
কী সুন্দর দেখতে ওদের। ঠিক যেন ফিল্ম স্টার। ওরা ওকে ঢুকতে দেখেই উঠে এলো ওর কাছে। বিকলুকে জড়িয়ে ধরে আদরে ভরিয়ে দিল। প্রাথমিক অবাক ভাব কাটতেই কী ভালো লাগছে বিকলুর। এত আদর তো কখনও পায়নি আগে ও। আর কাকীটার গায়ে কী মিষ্টি গন্ধ। সমস্ত বিরক্তি মুহূর্তের মধ্যেই ভ্যানিশ। বড়দির গলা খাঁকড়িতে কাকীটা ওকে ছাড়ল বটে, কিন্তু নরম হাত দিয়ে বিকলুর একটা হাত আলতো করে ধরেই রইল।
"বিকলু বাবু। গত ক্রিসমাসে তুমি একটা পরিবার চেয়েছিলে স্যান্টাদাদুর কাছে। মনে আছে তো? এই দেখো, তুমি সারা বছর ভালো হয়ে ছিলে। তাই দাদু তোমার শখ পূরণ করেছেন। এঁরা তোমায় নিয়ে যেতে এসেছেন। আজ থেকে এঁরাই তোমার মা বাবা। কী? পছন্দ হয়েছে তো?"
বিকলু ফ্যালফ্যাল করে একবার বড়দি আর একবার ওর "মা বাবা"র দিকে তাকাচ্ছে। এমনটা হবে, ভাবতেই পারেনি তো ও।
ওর "মা" ওকে বুকে জড়িয়ে কপালে গালে চুমু খেয়ে হাসি মুখে বললেন, "সোনামণি, আজ থেকে আমরা একসাথে থাকব তো?" ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বিকলু জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা, তোমার গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে গো। কী সেন্ট মেখেছ?"
সদ্য হওয়া "মা" বললেন, "এটার নাম জানো কী? এটাকেই বলে মা মা গন্ধ।"

Tuesday, October 2, 2018

হলুদ বনের কলুদ ফুল

১।

"এই শোনো, একবার আমার কুচিটা ধরে দাও না গো?" ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গত পনেরো মিনিট ধরে পাটভাঙা শাড়িটাকে বাগে অ্যানার চেষ্টা করে অসফল রুমুন। অষ্টমীর সকাল। প্যান্ডেল থেকে বারবার অঞ্জলির জন্য ডেকেই চলেছে। আর মোটে দুই ব্যাচ চলবে। এঁর মধ্যে তৈরি হয়ে পৌঁছতেই হবে। "দাঁড়াও দুই মিনিট, এই শব্দছক্টা শেষ করে আসছি।" জানলার ধারে চেয়ারে বসা অগ্নি একবারের জন্যও কাগজ থেকে মুখ না তুলে উত্তর দিল।"ধুর কখন তোমার শব্দছক শেষ হবে, তারপর নাকি কুচি ধরবে। তাহলে আর এই অষ্টমীতে আমায় অঞ্জলি দিতে হবে না। আমি বরং মীনাদিকে দেখি।"
"মীনাদি? ফিনাইলের গন্ধ হয়ে যাবে শাড়িতে। দেখছ না ঘর মুছছে ও?"
"হাত ধুয়ে আসবে তো। অদ্ভুত!"
"সে যতই ধুক না কেন, গন্ধ থেকেই যাবে। আচ্ছা পতন অভ্যুদয় ড্যাশ পন্থা, লাইনটা জানি কী ছিল?"
"বন্ধুর পন্থা।"
"হ্যাঁ। এই তো। ব্যস। হয়ে গেল। চলো।  দেখি কুচিটা ঠিক করি। এও তো আমাদের বছর বছরের অভ্যেস।"
"শোনো, আমি রেডি হচ্ছি, তুমিও তৈরি হয়ে নাও।"
"হ্যাঁ, তোমার তো সময় লাগবে।"
শাড়িটা ঠিক করতে করতে রুমুন দেখল অগ্নি টাওয়েল নিয়ে স্নান করতে ঢুকল বাথরুমে। আলমারি খুলে তাক হাতড়ে হাতড়ে ও গড়িয়াহাট থেকে কেনা কাঁচা হলুদ রঙের  পাঞ্জাবিটা বের করে রাখল।

২।

প্রতি বছরের মতো এই বছর রুমুনের পুজোর বাজার আর নিজের মতো করে করাই হয়নি। পুজোর ছুটি পড়ার ঠিক আগেরদিন শেষ হয়েছে স্কুলে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। তারই তোরজোড়ের জন্য মায়ের সাথে টো টো করে হাতিবাগান কলেজ স্ট্রিট চত্বর ঘুরে বেরিয়ে পুজোর মার্কেটিং করার বাৎসরিক রেওয়াজের তাল কেটেছে এই বছর। হাতে নাতে ফলও পেয়েছে। মায়ের সাথে আর সমস্ত বিষয়ে মিল ভালো হলেও জামাকাপড়ের পছন্দের বিশেষ অমিল। ওঁর পছন্দ হালফিলেরও রঙের পোশাক। এদিকে মা এবারে "মাধ্যমিক দিবি এবার, এবারে তো শাড়ি পর," এই অজুহাতে পুজোর পাঁচদিনের জন্যই পাঁচটা সিল্ক আর ঢাকাই শাড়ি বাছাই করে কিনে রেখেছে। অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়ার জন্য মায়ের পছন্দ একটা হাল্কা হলুদের ওপর হলুদ সুতোর কাজের চিকন শাড়ি। হলুদ, রুমুনের সবচেয়ে অপছন্দের রঙ।

৩।

আয়নার ওপরের আলোটা জ্বালিয়ে রুমুন আলতো করে চোখের কোণে কাজলটা লাগাচ্ছিল। এই সময়ে ভীষণভাবে মনোযোগ লাগে ওর। এত বছরের অভ্যেস, তবুও একটু অমনোযোগী হলেই কাজলটা ধেবড়ে যায়। সেটা ওর বিশেষ অপছন্দ। এই নিয়ে তিনবার ঘেঁটে গিয়েছে, সামনে পড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটা তুলোর বল আর ক্লেনজিং মিল্কের খোলা বোতল। বাথরুম থেকে শাওয়ারেরজল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে গুনগুন করে অগ্নির গলায় "শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি"। সত্যিই। ওর গলাটা এত সুন্দর, ভরাট, সুরেলা।
"এই আমার পাজামার দড়িটা পরিয়ে দিয়ো না গো রুমুন। আমার স্নান হয়ে এলো।"
"কেন যে নিজের কাজ নিজে করতে পারো না তুমি। দেখলে আমি রেডি হচ্ছি। তার মধ্যে এই। সারা সকাল সুদোকু আর শব্দছক নিয়ে রইলে। এখন এসে লাস্ট মোমেন্টে..."
"প্লিজ রুমুন। এই শেষ। পরেরবার থেকে আমি নিজেই করব। তুমি দেখো।"
"জানা আছে আমার। প্রত্যেক বছর এই এক কথাই বলো।"
পঁচিশ বছরের সংসার। ঝটপট হাত চলে। মুহূর্তের মধ্যেই পাজামা রেডি। দরজায় হাল্কা টোকা মেরে খবরটা জানিয়ে রুমুন আয়নার সামনে ফিরল। খোঁপা করা বাকি।

৪।

"মা আমার চুলে কিছু একটা স্টাইল করে দাও না প্লিজ।" কিশোরী রুমুন তার মায়ের কাছে আবদার করলো। সুচরিতা নিয়মিত ম্যাগাজিন পড়েন, স্টাইল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। মেয়ের কোমর ছাপানো চুলের ওপর নিত্যনৈমিত্তিক চলে সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা। সুচরিতা আর পাঁচটা সাধারণ মায়ের মতোই রুমুনের চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে "তেল মাখিস না, রুক্ষ চুল" ইত্যাদি বলে শেষ পর্যন্ত একটা বেশ কায়দার খোঁপা করে দিলেন। রুমুনের বাবাও স্ত্রীর নির্দেশমতো জুঁই ফুলের মালা নিয়ে এসেছেন। খোঁপায় মালা লাগিয়ে, মুখে পাউডার বুলিয়ে রুমুন বেরোল পূজামণ্ডপের উদ্দেশ্যে। অষ্টমীর অঞ্জলি। কোনদিনও বাদ যায় না।
"রুমুন তুই গিয়ে অঞ্জলি দে। আমি পরের ব্যাচে দেবো। তোকে তো এরপর প্রসাদ বিতরণের কাউন্টার সামলাতে হবে।" সুচরিতার নির্দেশ। 

৫।

বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। সকাল থেকে রান্নাঘরেই অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল রুমুনের। ছেলেমেয়ে দুটো পুজোর ছুটিতে এক সপ্তাহর জন্য বাড়ি আসায় , এখন প্রায় দিনের পুরো সময়টাই কাটছে ওদের পিছনে, ওদের জন্য।  নেহাত অগ্নির সাথে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়াটা সেই এতগুলো বছরের অভ্যেস, তাই আজ প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছল মণ্ডপে। শেষ ব্যাচ শুরু হলে বলে। অগ্নিও হন্তদন্ত হয়ে ওর পিছন পিছনই এসে ঢুকল। এত বছর এই পারায় রয়েছে ওরা, প্রায় সকলের সাথেই পরিচিতি তাই রয়েছে। অনেকের সাথেই সেই জন্য সৌজন্যমূলক হাসি ও শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব চলল বেশ খানিকক্ষণ। ইতিমধ্যে মাইকে ঠাকুর মশাইয়ের "শুরু হতে চলেছে লাস্ট ব্যাচ অঞ্জলির। যারা যারা অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে চান, চলে আসুন প্রতিমার সামনে" শোনা আজচ্ছে। বারবার।অগ্নি, রুমুন চলল ঠাকুরের কাছে। ওখানে তাতান আর টিটির আগে থেকেই উপস্থিত। সপরিবারে ওরা অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে।

৬।

ঠাকুরমশাইয়ের বারবার বারণ সত্ত্বেও ঠিক সকলে পুষ্পাঞ্জলির ফুল ঝুড়িতে দেওয়ার অপেক্ষা না করে সামনের দিকেই ছোঁড়ে। প্রতিটি পাড়ায়, প্রতি পুজোয়, প্রতিদিন, প্রতিবার। আর এই পুষ্প নিক্ষেপণের মাধ্যমেই বছর বছর শুরু হয় কত নতুন নতুন সম্পর্ক। গাঁদা ফুলের সাথে দোপাটির পাপড়ি যেমন মিলে মিশে পুষ্পাঞ্জলির রঙিন নৈবেদ্য সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনই রঙিন হয় সম্পর্কগুলি। রুমুনের অনেক বন্ধুরাই ইতিমধ্যে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ। ওর অবশ্য সেই রকম উৎসাহ বা সাহস কোনটাই হয়ে ওঠেনি। আর সুযোগও তেমন মেলেনি।
 অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল হলুদ রঙের চিকনের পাঞ্জাবি আর চুড়িদার পরা, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, সুদর্শন ছেলে মাঝে মাঝেই রুমুনের দিকে তাকিয়ে দেখছে। অতি সৌম্য চেহারা, দেখে তো মনে হয় ওদের থেকে বয়সে বড়। এ পাড়ায় আগে দেখেছে বলেও মনে পড়ছেনা। বাবলিকে দেখতে পেয়ে রুমুন জিজ্ঞেস করল, "হ্যাঁ রে, ওই ছেলেটা কে? চিনিস?"
"কে? ওই হলদে পাঞ্জাবি?"
"হুম। কী দারুণ দেখতে।"
"তা যা বলেছিস। ফাটাফাটি দেখতে। এই দেখ দেখ, রুমুন, তোর দিকে কিন্তু মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে।"
"হ্যাঁ। দেখলাম। অনেকক্ষণ ধরেও ব্যাপারটা অবজারভ করেছি।"
"এই চল না। গিয়ে কথা বলবি?"
"পাগল নাকি? কোন কাকিমা জেঠিমা কে দেখে নেবে। তারপর স্ট্রেট মায়ের কানে..."
"জানিস তো রুমুন, আমার মনে হচ্ছে আজ এই হলদে পাঞ্জাবি তোর দিকেই ফুল ছুঁড়বে। কীরকম ম্যাচ করে গিয়েছিস তোরা। দেখিস। আমার মন বলছে। এক্কেবারে রাজযোটক।"
না, সেদিন বাবলির কথা মেলেনি। ওর দিক থেকে একটা ফুলও রুমুনের গায়ে পড়েনি। তবে অঞ্জলি দেওয়ার পর যখন ওরা দুজনে প্রসাদ বিতরণের কাজে ব্যস্ত, তখন ওদের বন্ধু তিতলি এসে আলাপ করিয়েছিল, "হলুদ পাঞ্জাবির" সাথে ওদের। নাম অগ্নি। মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, তিতলির মামার ছেলে। বাড়ি কুচবিহারে। পড়াশোনার জন্য আপাতত হোস্টেলে থাকে কলকাতায়। পুজো উপলক্ষে পিসির বাড়ি এসেছে। ফল ও নাড়ুর প্রসাদটা রুমুন শালপাতার পাত্রে যখন অগ্নিকে দিল, দুজনের মধ্যে বাক্য বিনিময় হলো না বটে। তবে মিষ্টি হাসি হাসল দুজনেই। আর বোধহয় বিধাতা পুরুষও প্রসন্ন হলেন।
কাজ মিটিয়ে রুমুন বাড়ি ফিরছে। বাবলি ওর বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে।
"এক্সকিউজ মি প্লিজ" ডাকে চমকে গেল ও। থমকে দাঁড়ালো, পিছন ঘুরে দেখে "হলুদ পাঞ্জাবি" ওরফে অগ্নি।
"বলো?" একটু নার্ভাস হাসি হেসে উত্তর দেয় রুমুন।
"না। সেরকম কিছু না। শুধু দুটো কথা ছিল।"
"বলো।"
"এক। তোমাকে ষষ্ঠী থেকে রোজ দেখলাম। দুইবেলা। সব রঙের মধ্যে হলুদেই মানায় তোমাকে সবচেয়ে বেশি।"
"ও আছা।" লাজুক হেসে উত্তর দিল রুমুন।
"দ্বিতীয় কথা হল, এরপর থেকে একটু চোখের কোলে কাজল দিয়ো। তোমার ওই চোখদুটোয় খুব মানাবে।"
মাথা নাড়ল রুমুন। অগ্নি ফিরল মণ্ডপে। রুমুন পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। আগামী দিনগুলির পাথেয় সংগ্রহ করে।

৭।

"বাবা তোমার পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি। স্নানটা সেরে ফেলো। অঞ্জলি শুরু হয়ে গিয়েছে।" আলমারি থেকে হাল্কা হলুদ পাঞ্জাবিটা খাটের ওপর রেখে বলল ঝিনুক। ঝিনুক তাতানের স্ত্রী। বিয়ে হয়ে এসেছে এই বাড়িতে পাঁচ বছর হল। গত চার বছর শাশুড়ির সাথে পুজোর বাজার একসাথে করতে গিয়ে জেনেছে শ্বশুর শাশুড়ির বছরের পর বছরের মেনে চলা অষ্টমীর অঞ্জলির ম্যাচিং হলুদ পোশাকের কথা। গত এপ্রিলে হঠাৎ করেই স্ট্রোক হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী রুমুন। অগ্নির নির্দেশেই এবারে তাই পুজোর বাজার করেছে ঝিনুক।
স্নান সেরে হলদে পাঞ্জাবি সাদা পাজামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুলে চিরুনি বোলাচ্ছিল অগ্নি। আর তখনই আয়নার ভিতর দিয়ে দেখতে পেল একটা ঝলমলে হলুদ রঙের ম্যাক্সি পরে জানলার ধারে খাটে বসে রুমুন। অগ্নি ওর দিকে এগিয়ে গেল। মুখে হাল্কা হাসি। রুমুন ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে। জানলার বাইরে শিউলি গাছের ডালখানা মৃদু হাওয়ার জেরে কম্পমান। গ্রিলের ওপর কয়েকটা শিউলি পড়ে আছে। ভোরের শিশির শুকোতে যায়। শক্ত করে নিজের দুই হাতের মধ্যে রুমুনের কম্পমান শীর্ণ হাতটা চেপে ধরল অগ্নি। অনেকটা বিশ্বাস ও ভরসার এই স্পর্শ। "বুঝলে হে গিন্নি, চল্লিশটা অষ্টমী তো এই বাসন্তীসাজে কাটিয়ে দিলাম আমরা। এই বছরই বা বাদজায় কেন? চলো তোমার জন্য উইলচেয়ারের ব্যবস্থা করেছি। আমায় ধরো, আমরা দেবীদর্শন করি একসাথে। ঠিক পারবে। ও দাঁড়াও, আগে তোমার চোখে কাজল পরাই। এতদিনের অভ্যেস তোমার। দেখি আমার অপটু হাতে পারি কি না। মনে আছে সেইবার তোমার বাঁ হাত ভাঙল ঠিক পুজোর আগে, সেইবার কেমন শিখে নিয়েছিলাম তোমার কুচি ধরতে? তারপর থেকে আমিই যেন সব সময় তোমার শাড়ির কুচি ধরব, এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। মনে পড়ে রুমুন?"
শরতের নরম আলো বিছানার ওপর এসে পড়েছে। রুমুনের রুগ্ন শরীরে যেন হঠাৎ প্রাণের ছোঁয়া। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি" গানটা গাইবে প্লিজ অগ্নি? খুব ভালো লাগে তোমার গলায়..."
অগ্নি ওর সুরেলা কণ্ঠে ধরল ওদের শরতের অ্যান্থেমটি।

"মানিক গাঁথা ওই যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
কুঞ্জছায়ায় গুঞ্জরনের সঙ্গীতে
ওড়না ওরায় একই নাচের ভঙ্গিতে,
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি..." 

উঠছে জেগে সকালগুলো

"অনিইইই, উঠে পড় বাবা।" সক্কাল সক্কাল মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল অনিরুদ্ধর। চোখ মেলে ফোন হাতে নিয়ে দেখল সবে সাড়ে সাতটা। গত কয়েকটাদিন অনেক রাত জেগে অফিসের বেশ কিছু ডেডলাইন সামলে আজ গান্ধী জয়ন্তীর ছুটিতে একটু আয়েশ করে ঘুমোবে বলে অ্যালার্ম বন্ধ রেখেছিল মোবাইলে। কিন্তু ওই যে, কপালে যা থাকে। আজকের দিনেও এই সকাল সকাল বিছানা ছাড়তে ইচ্ছেই করছিল না, তবুও বাধ্য ছেলের মতোই উঠেই পড়ল অনি। ইতিমধ্যে মা ঘরে চলে এসেছেন, হাতে চায়ের কাপ।
"ওঠ ওঠ বাবু। তাড়াতাড়ি ওঠ। অনেক বেলা হয়ে গেল। মেলা কাজ পড়ে আছে। উঠে পড়। নে চা-টা খেয়ে নে" এই বলে ধূমায়িত চায়ের কাপ অনিরুদ্ধর দিকে বাড়িয়ে মণিমালা এগিয়ে গেলেন জানলার দিকে। পর্দা সরাতেই সূর্যের আলোয় ঘর আলোকিত। বাইরে ছুটির দিনের শহর। শান্ত। ভিড় কম। মাঝে মধ্যে রিকশার টুংটাং।
"ও মা, একটা ছুটির দিন পেলাম কতদিন পরে বলো তো। একটু ঘুমোতেও দেবে না আজকে? তুমি না..." কণ্ঠে হাল্কা অনুযোগ নিয়েই কথাগুলি বলে অনি।
"সোনা বাবা আমার। এই একটাই মোটে ছুটির দিন এলো কতদিন পর। পুজোর বাজার করতে হবে না? আর তো কটা মোটে দিন। এসেই তো গেল পুজো। কিচ্ছু কেনাকাটি হয়নি। তুই না নিয়ে গেলে কার সাথে যাবো বল তো? আর সময় কই?"

মায়ের কথাগুলি শুনে অনিরুদ্ধ আর কিচ্ছু বলতে পারে না। এই পুজোটা যে ও মায়ের সাথে কাটাতে পারবে, ভেবেছিল অনি? গত বছর মনে আছে, মহালয়ার দিন সকালেই বিচ্ছিরি বাইক অ্যাকসিডেন্টে গুরুতর জখম হয় ও। তারপর হাসপাতাল, ডাক্তার, পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই কেটে যায় কতগুলো মাস। পুজোর দিনগুলো প্রায় যমে মানুষে টানাটানি চলেছিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে খালি কাঁদত ও। হতাশা, নিরাশায় দিনগুলি যে কীভাবে কেটেছে, ভাবলে ভয় করে এখনো। এমন কী অনিরুদ্ধ তো ভাবতেই পারেনি  যে আরেকটা পুজো ও দেখতে পাবে বলে।

তখনও পাশে ছিল শুধুই মা। ওঁর অসীম সেবা শুশ্রূষা ও সর্বোপরি মায়ের থেকেই লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করে আজ অনিরুদ্ধ আবার একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে। এই নতুন জীবনের জন্য ও সবকিছু করতে রাজি, ছুটির দিনের ঘুম স্যাক্রিফাইস তো তার কাছে কিছুই না।

"চলো। কখন বেরোবে বলো, ক্যাব ডেকে নেবো।"



Monday, October 1, 2018

বছর পঞ্চাশ পর...

কেমন হবে যদি আবার অর্ধ শতাব্দী পর
তোর আর আমার দেখা হল ব্যস্ত শহরের পার্কে,
স্মৃতির গালিচা পেতে বসব দুজনে...
আমি জিজ্ঞেস করব, "কেমন আছিস?"
তুই বলবি "ভালো"।
আমি বলবো, "আগের চেয়েও বেশি?"
তুই বলবি, "থাক না। ভালোমন্দের নাই বা হল বিচার।
চল না, ওদিকে ছায়া আছে। হেঁটে আসি একবার।"

আমি ভাবব, "থাক না। একটু বসি?
দু চোখ ভরে দেখি তোকে আজ।"
"কী রে, চল?" চুটকিতে আমার ঘোর কাটাবি, সেই আগেরই মতন।
"চল তবে"... লাঠিটা হাতে নিয়ে উঠবো আবার।
আগের মতোই ছায়া বনান্তের পথে শুরু হবে পাশাপাশি পথচলা।
আগের মতোই, আঙ্গুলে আঙ্গুল, হাতে হাত...
স্পর্শ পাবে না। এবারেও।
কিছু জিনিস এক জন্মে মেলে না যে আর...



Image may contain: tree, plant, sky, outdoor and nature