Saturday, December 29, 2018

2019 was late by five minutes

"All my bags are packed
I'm ready to go
I'm standing here outside your door
I hate to wake you up to say goodbye..."

It is a little past eleven on a chilly 31st December night. The whole world is partying like crazy. Cars can be heard whizzing past on the roads. Their speakers boom the latest EDM. The night is still very much young. In fact, there is a party going on in my house too. My friends have all come over. There's dance and music. There is food and wine. This year has been a wonderful one for me. A huge raise at work, recognition in the society, an award for my food blogging... and on the personal front too - the proposal from Sankarshan, Munni Didi's precious little one after a much prolonged IVF treatment - indeed, this year has been a fantastic one.

I sit at one corner of my bedroom balcony - one of the very few secluded corners of my house tonight, with a glass of red wine in hand. Tonight, I am tired. I'm tired of all things fancy. I'm overwhelmed with all things bright and beautiful. I sit back and retrospect at the year gone by. And then, suddenly the door opens. In comes an old man, wearing a grey overcoat and a dark grey bowler hat. He looks weary and tired.

"May I please?" he asks, putting his worn out suitcase down and pointing at the empty cane chair. I look up, startled, who is he? What brings him here? I hesitantly nod my head and he obliges. I continue sipping my wine. The night is cold. I notice the man wrapping his red muffler tightly around his neck. He strangely reminds me of my grandpa. I ask him, "Would you like to have something to eat or drink? May be something warm?" He smiles and I notice a twinkle in his eyes. " It's okay Beta. I'm fine. I am just a little tired. Tired of all the burdens that I carry, the baggage that I bear", he says.His eyes wander off outside. A couple of stray dogs start to bark. I continue gazing outside. The silence is disturbingly calming. Yet the otherwise bubbly Anahita in me takes over.
"Umm...Uncle, I'm sorry to put it in this way, but I really did not recognise you. Are you a friend of one of my guests?" The old man, looking wistfully outside, answers, "Friend? Yeah.. to a few. The ones who've had a great year so far. Indeed I am their friend." I notice a melancholy on his face. The yellow streetlight on his face accentuates the creases on his pale skin, making him look sadder. I cannot but wonder, what is he talking about. "I'm sorry. But I do not understand. Could you please be a little less vague?"
"Beta, tell me, how was 2018 for you?"
"It was wonderful", I wanted to say. Could not. Memories flashed across my eyes. Little boys pelting stones at the ginger kitten on the EM Bypass connector I saw last summer. I was driving to work and had deadlines to meet. I could not spare ten minutes to protest and protect. And then Siyahi's face popped up. The ever smiling cheerful classmate of ours. But that is not how I saw her last. She was in all shambles. Though she tried hard to mask it, her favourite yellow or the most expensive cosmetics were unable to mask her pains. The dark circles around her sunken eyes helped her sing "Ek pyar ka nagma" with ultimate perfection on stage at our batch reunion. And then that night, her social media accounts started flowing with RIPs.
"Yes Beta? How was the year?" The old man asked me again. I gave a weak smile and said, "It went well Uncle. But I hope the coming year does bring in so much more. I have so much to do, yet there's so little time. I need to close a few deals at work, travel to places where I haven't checked in yet. Read a few books too - I have a long list of TBR."
"Wait, wait, wait, wait", he stops me midway, looks at his watch. I notice a worn out belt and a damaged glass. But the hands shine bright and keep ticking. it is five minutes to the new year. people are seen coming out to the streets, crackers and confetti in hand. The music gets louder in my house.
"Slow, my child. You are rattling off like a sprinter." When he laughs, I notice the smile reaching his eyes, the wrinkles make him look so genuine. He looks a bit irritated though when he stares out of the balcony and mumbles, "Less thanfive minutes to go and still no sight of him. These youngsters..." He looks at me kindly and then says, "beta, I've seen a lot more in life than you. " I smile and say, "Yeah, you do look so." He grins. And continues, "True. So while I wait for him to come..."
"Who?" I stop him.
"Beta, you interrupt a lot. I will introduce you to him in due course of time. He should have been here by now. Wonder what is keeping him occupied. So as I was saying, did you realise that you never said that you wanted to be happy in the coming year?" Slow down a bit. Enjoy the moments as they come. Don't just spend them instead, live them. Be kind, be compassionate. Be happy."
The clock struck twelve. I expected people to barge in and wish me a "Happy New Year". Strangely, nothing happened. The old man looked up at the clock, then outside and finally at me.
"Oh Uncle, I know all that you say is so wise. But honestly, it sounds so much like those Moral Science classes in high school."
His bright face darkens, immediately. And then in a voice that strangely resembles my grandpa's, he mutters, "I don't want you to live with regrets my child. I don't want you to be silent when someone asks you next year on 31st December, how the year went. I don't want you to wake up in the middle of the night, feeling guilty for all the things that you should have taken care of and did not. I don't want you to feel "comfortably numb". I want you to embrace life and be happy from within." His voice trails off.

I hear a taxi stop at the gate. I look down the balcony railing to see ahandsome young man coming out of it. The driver unloads his baggage. There is quite a load of it, looks brand new and shining. The old man raises his hand and asks the driver to wait, picks his shabby suitcase and walks to the door. He stops, looks back at me and says, "take care Beta" and walks out of the room. The young gentleman looks up, sees me and winks at me with a warm smile on his face.
The digital clock on my table shows "JAN 01 2019 00:05". The city erupts in celebrations as the taxi moves away into oblivion.

 "Kuch pakar khona hai
  kuch khokar pana hi
  jiwan k matlab to ana aur jana hai
  do pal ke jiwan se
  ek umra churani hai
  zindagi aur kuch bh nahi
  teri meri kahani hai..."

Thursday, December 27, 2018

ক্রিসমাস চিঠি

১।
চিঠিটা আরেকবার পড়ে খামে ভরলেন ভদ্রমহিলা। তারপর সেটাকে একটা লাল বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ক্রিসমাস আসতে আর বেশিদিন নেই। তার আগেই এটাকে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে।



২।
ক্রিসমাসের সকাল। প্যানকেক, ব্লুবেরি সস, স্মোকড পোট্যাটো আর স্মোকড সামন দিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ হয়েছে। ঠাকুমাকে আদর করে "মেরি ক্রিসমাস" জানিয়ে জিনা ছুট্টে গিয়েছে ওদের ক্রিসমাস ট্রিয়ের সামনে। সারি সারি বাক্স, বিভিন্ন সাইজে, বিভিন্ন রঙে। ফায়ারপ্লেসের ওপর ওর স্টকিংটা পেট মোটা হয়ে উপচে পড়ছে। এই বছরও জিনা বাধ্য মেয়ে ছিল। স্যান্টা ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু জিনা কিছুতেই সাহস করে এগোতে পারছে না ওইদিকে। কিছুতেই না। এক দুইবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফায়ারপ্লেস অবধি পৌঁছে আবার ফেরত এলো। অজানা এক আতঙ্ক। কী জানি, কী আছে ওতে?


ডিসেম্বরের ছুটিটার জন্য যখন স্কুলের সব বাচ্চারা মুখিয়ে থাকে, জিনার মনে তখন গ্রাস করে আসে এক রাশ দুঃখ। ভিলেজের আর পাঁচটা বাড়ির মতো যদিও আভেন থেকে সদ্য বের করা প্লাম কেকের সৌরভে গোটা বাড়ি ম-ম করে, মাংসের নানান সুস্বাদু পদ রাঁধা হয়, সাজানো হয় রঙ বেরঙের টাটকা শীতের সব্জি ও ফল দিয়ে স্যালাড, লিভিং রুমে ইয়া বড় ক্রিসমাস ট্রিও আসে, সাজানো হয় কনফেটি আর আলো দিয়ে, ট্রিয়ের নীচে বাক্স বাক্স উপহার রাখা থাকে, তবুও জিনার ইচ্ছেই করেনা হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরতে। ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন রকম অভাব না থাকলেও ওর বন্ধুদের বাড়ির মতো সেখানে থাকেনা বাবা মায়ের আদরমাখা উষ্ণতা, থাকেনা হই হই করে একটা প্রাণভরা উৎসবের আনন্দ।

জিনাদের বাড়িতে থাকেন ওর বয়স্কা ঠাকুমা, জিল আর জিনার গভর্নেস, শেলী। মারগারেট এসে রান্না বানা করে দিয়ে যায়। ক্রিসমাস ইভে এই চারজনে এক সাথে এলাহি ডিনার সারে। তারপর ঠাকুমা জিলের কিনে আনা স্টকিংটাকে সযত্নে লিভিং রুমের ফায়ারপ্লেসটার ওপর শেলীর সাহায্যে টাঙ্গিয়ে জিনা চুপটি করে লেপের তলায় ঢুকে যায় বাধ্য মেয়ের মতো। জিনার যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, এই একই ব্যবস্থাই সে দেখে আসছে। মা বাবা বলতে শুধুই একদম জন্মের কিছু মাস অবধি সময়ের ছবিতেই তাঁরা সীমাবদ্ধ।

ঠাকুমাকে খুব জিজ্ঞেস করত আগে ওঁদের কথা। জিল চোখ ছলছল করে নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন না কিছুই। কোথায় জিনার মা বাবা? কেনই বা তাঁরা আসেন না তাদের এই মিষ্টি মেয়েটিকে দেখতে কখনও, কোনরকম যোগাযোগও করেন না। এই রহস্যের উত্তর জানতে চেয়ে কত রাত ছোট্ট জিনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। জিল কিছুই বলতে পারেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, "জিনা, সোনা মেয়ে। কেঁদো না। দেখো, তোমার জন্য তোমার সমস্ত পছন্দের উপহার রয়েছে। খেলা করব তো আমরা এইগুলি নিয়ে। মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করো না।" ঠাকুমার আর্তিতেও জিনা গলেনি, ও আবারও জিজ্ঞেস করতেই থেকেছে, "আমার মা বাবা কোথায়?" অসহায় জিল তখন ঝোঁকের বসেই বলে ফেলেন, "যেদিন তুমি জীবনের পঞ্চাশতম ক্রিসমাস উপহার পাবে, সেইদিন জানতে পারবে বাবা মায়ের কথা।" জিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঠাকুমার মুখের দিকে। সপ্রশ্ন নেত্রে। খানিক চুপ করে থেকে বলে, "কী করে জানবো?" জিল উত্তর দেন, "তোমার স্টকিং এর ভিতর থাকবে হদিশ। নাও ডার্লিং, এইবারে ঘুমিয়ে পড়ো।"
সেই রাত্তিরটা ঠাকুমা ও নাতনি প্রায় কেউই ঘুমোতে পারেনি। সারা রাত জিল এ পাশ ও পাশ করে গিয়েছেন। কী করে বলবেন এই ফুটফুটে শিশুটিকে ওর গুণধর বাপ মায়ের কথা? সেই বাবা মা যারা এই ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটির জন্মের পর থেকে কোন রকম দায় দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি ওর। শুধু বছরের এই একটা সময়ে মেয়ের নামে উপহার পাঠিয়ে দেয় একাধিক। জিলের স্বামী, মরগানের টাকার অভাব ছিল না, তাই কখনও অর্থকষ্টে ভুগতে হবে না ওদের, এইটুকু যা ভরসা। এমনিতেই জিলের অবর্তমানে জিনার কী হবে, সেই ভেবেই ভয় পান, তার ওপর আজ এই পরিস্থিতি। নেহাত বাচ্চা মেয়েটিকে সাময়িক স্তোক বাক্য দিলেন। কিন্তু কতদিন?
জিনার মনে সেইদিন থেকে শুরু হয়ে যায় এক অজানা উৎকণ্ঠা। কী জানবে ও? সেই খবর সুখের হবে তো? জিল বা শেলীর অজান্তেই সেই ক্রিসমাস সকালেই জিনা ওর এ যাবত পাওয়া সমস্ত উপহারের ফিরিস্তি করতে থাকে, ওর ছোট্ট পকেট ডায়েরিতে। একদম ছোটবেলার কথা মনে নেই, কিন্তু জিলের ডায়রি লেখার অভ্যেসের সুবাদে সেই সমস্যাও মিটে গেল।

জিনা গুনে দেখেছে। গতকালই। জিলের সামনে বসে। গত ক্রিসমাস অবধি ও আটচল্লিশটা উপহার পেয়েছে। আজ ওর স্টকিংটা উপচে পড়ছে। তার মানে আজ সেই উপহারের সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবেই। তার মানে তো ঠাকুমার কথা অনুযায়ী আজকেই ও জানতে পারবে ওর বাবা মায়ের হদিশ।

"কী হলো সোনা মেয়ে, স্টকিংটা দেখবে না? দেখো কী কী গিফটস আছে ওতে?" ঠাকুমার আদুরে কণ্ঠস্বরে জিনার সম্বিত ফেরে। ফ্যাকাশে মুখ করে জিনা বলে, "ঠাকুমা, আজ যে আমি আমার পঞ্চাশতম ক্রিসমাস গিফটটি পাবো। মনে আছে, তুমি বলেছিলে সেই কত বছর আগে?"
পলকেই জিলের মুখটা পার্চমেন্ট পেপারের মতো শুকিয়ে গেল। সেদিন কথায় কথায় ওরকম বলেছিলেন। মনেও ছিল না। এইবারে কী বলবেন? নাতনি এখন টিনএজার। মিছে স্তোকবাক্যে ভোলানো মুস্কিল। তবে কি...
"ঠাকুমা, আমার ভয় করছে। নার্ভাস লাগছে। তুমি প্লিজ খুলে দেখাও কী আছে।" কাঁপা কাঁপা গলায় জিনা বলল।
নিরুপায় হয়ে জিল স্টকিংটা নামালেন। ভিতর থেকে এক এক করে বের করলেন নিজের হাতে কেনা জিনার পছন্দের উপহার। আর তার সাথে আরেকটা লাল বাক্স। ছোট্ট। এসেছে প্রতি বছরের মতোই, জিনার বাবা মায়ের থেকে।
"ওটা কি বাবা মায়ের পাঠানো বক্স?" জিনা জিজ্ঞেস করে।
"হুম।" জিল উত্তর দেন।
"ওটাই আগে খোলো প্লিজ।" এক অদ্ভুত আকুতি মিশিয়ে বলে জিনা।
আস্তে আস্তে সভয়ে জিল ফিতেটা খোলেন। বাক্সের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিঠি। জিনাকে উদ্দেশ্য করে। লেখা রয়েছে...


Tuesday, December 25, 2018

ক্রিসমাস ২

মায়ের কাছে শুনলাম, মীনা দি, মানে আমাদের বাড়িতে যে দিদি কাজ করে, পরশু দিন পাড়ার দোকান থেকে একটা ফ্রুট কেক কিনে আমাদের ফ্রিজে রেখেছে। বাড়িতে ওর নাতি নাতনিদের খাওয়াবে বলে। গতকাল সোমবার ছিল। দোকান বন্ধ থাকবে। আর রবিবারেই বাড়ি নিয়ে গেলে নাতি নাতনিরা ওইদিনই খেয়ে ফেলবে। অগত্যা, এই ব্যবস্থা।
শুনলাম আজ মীনা দি কেকটা নিয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই ওর বাড়িতেও আজ বড়দিনের কেক উৎসব পালন হল। আয়োজন যতই সামান্য হোক না কেন।
ওদিকে আমার জেঠু জেঠি আজ সক্কাল সক্কাল তাদের (আমাদের সব্বার) আদরের নাতনি আরিয়ার জন্য ওর পছন্দের কেক-কুকিজ ইত্যাদি নিয়ে গিয়েছে নামী কেকশপ থেকে, ঝুড়ি ঝুড়ি। সাথে খেলনা, চকলেট, কমলালেবু। সব ওর প্রিয়।
কোথায় গিয়ে যেন এই অপত্য স্নেহে সামাজিক সমস্ত স্তর ভেদাভেদ ইত্যাদি সব একাকার হয়ে যায়। সামর্থ্য তখন অনেকটা ছোট হয়ে দাঁড়ালে, ইচ্ছেটাই হয়ে যায় বাঁধা অতিক্রমের উপায়।
আসলে, উৎসব উদযাপনের যে কোন সুনির্দিষ্ট স্থান কাল পাত্র হয় না।

ক্রিসমাস

শীতের কলকাতার এক অন্ধকার ফুটপাথে সদ্যোজাত সন্তানটিকে নিজের একমাত্র ছেঁড়া কাঁথায় মুড়ে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচাতে যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে অসহায়া মা, কই তাকে দেখতে তো সাত সমুদ্র পার করে এলো না কোন তিন রাজা, হাতে দামী উপহারের ডালি নিয়ে? শীতের আকাশের তারাটি কিন্তু আজও সমানভাবে উজ্জ্বল।
ও, তাঁরা বোধহয় ইন্সটাতে চেক-ইন করতে ব্যস্ত। "ফিলিং ফেস্টিভ"। 🙂🙂🙂

Christmas 2018

তথাকথিত "ট্যাঁশ" ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্ট স্কুলের ছাত্রী হলেও কোনদিনও ক্রিসমাস নিয়ে আলাদা কিছু করিনি। এমন কি, স্কুলেও যেতাম না এইদিনে। অনেক বন্ধুরা, সিনিয়ররা, জুনিয়ররা যেত, যায়। শুধু ওই দুদিন আগে স্কুল ছুটি পড়ার দিন স্কুলে কোন একজন স্যর স্যান্টা সেজে আমাদের চকলেট দিতেন। খুব মজা লাগত। চকলেট খেতে, পেতে ও কিনতে বড্ড ভালোবাসি, এখনও। আর স্যোশাল সার্ভিস না কী জানি নামে ওই আশে পাশের "less fortunate" (হ্যাঁ, বেশ ডিপ্লোম্যাটিক এবং পোলাইট শুনতে লাগে) পরিবারের জন্য বিস্কিট, জ্যাম, জেলি, ইত্যাদি নিয়ে যেতে হত স্কুলে। ব্যস।
পিকনিক টিকনিক বোধহয় ইউনিভার্সিটিতে ওই দুই বছর ছাড়া আর কখনও যাইওনি। কাজেই আর পাঁচটা পাতি ছুটির দিনের মতোই ক্রিসমাসও কাটিয়েছি চিরকাল। হ্যাঁ, সকালবেলা ব্রেকফাস্ট টেবিলে মামার দিয়ে যাওয়া নাহুমের রিচ ফ্রুট কেক বা বাবার আনা ক্যাথলিন বা মোঞ্জিনিসের ফ্রুট কেকের একটা টুকরো পেতাম। আর সাথে ইউজুয়াল ছুটির দিনের ব্রেকফাস্ট। লুচি, ইত্যাদি। শীত স্পেশাল মোয়া হয়তো...
স্যান্টা বলে যে আদপে কেউ নেই, সেটা অনেক ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম (বরাবরের ইস্মারট বাচ্চা কি না ), তবুও উম্মি, মানে আমার ঠাকুমার কাছে আবদার থাকত। ক্রিসমাসে একটা গল্পের বই চাইই চাই আমার। বাবা কয়েকদিন আগে অফিস ফেরতা এনে দিত সেই বই। আমার থেকে জেনে নিয়েই, কোন বই আনবে সেই বছর। সব জানি। সকাল সকাল কী পাব, ইত্যাদি। তবুও, কোথাও জানি একটা অদ্ভুত আনন্দ মাখা থাকত ওই শীতের সকালে ঘুম ঘুম চোখে লেপের তলা থেকে হাত বার করে (আমি বাপু বরাবরের শীত কাতুরে। অল্পেই লেপ লাগে। কম্বল লাইজাম্পিতে হয় না) বালিশের নীচ থেকে প্রিয় গল্পের বইটিকে স্পর্শ করতে। নতুন পাতার গন্ধ, সাদার ওপর ওই কালো কালো অক্ষরগুলো আগামী দিনের নতুন বন্ধু... তাদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোয়।
তারপর একদিন বড় হলাম। উম্মিও চলে গেল। ক্রিসমাসের উপহার বলে আর কিছু রইল না। এখন যখন খুশি যবে খুশি যা ইচ্ছে বই কিনতে পারি। কিনি। পড়ি। তবু, গিফট পাওয়ার চার্ম রইল না আর।
থুড়ি, ছিল না। তারপর দুই বছর আগে আমার জীবনে এলো এক নতুন স্যান্টা। আমাদের সকলের আদরের সায়ন্তী। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র অনুভব অনুভূতিগুলো যখন whatsapp আর facebookএর emojisএর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, এই মেয়েটি নিয়ম করে প্রতি বছর hand written note আর আমার প্রিয় চকলেট রেখে যায় আমার জন্য। এবং ঠিক রাত্তিরবেলা, চুপি চুপি, আমার হোস্টেলের দরজার বাইরে। যাতে সেই ছোটবেলার মতোই সকাল সকাল ওই একই রকম আনন্দ পাই।
এই বছরও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। স্যান্টা, নাকি সায়ন্তী (দেখ, নামে কী মিল!) অনেক অনেক ভালোবাসা এই উপহারের জন্য।
বিঃ দ্রঃ এবারের নোটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিস কিন্তু!
ভালো থাক, ভালো রাখ।

Monday, December 24, 2018

শিকড়



এয়ারপোর্টে বসে আছি। সর্বক্ষণের অভ্যেসমতোই হাতে রয়েছে একটি বই। খুব বেশি মনোযোগ সহকারে পড়ছিনা যদিও। মাঝে মধ্যেই এদিক ওদিক চোখ চলে যাচ্ছে। পাশে বসে এক মা তার পুত্রটিকে মাফিন খাইয়ে ব্রেকফাস্ট করানোর চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ইতিউতি ধূমায়িত কফির কাপ নিয়ে ঘুরছেন। সেলফিও উঠে চলেছে খচাখচ। ছুটির মরসুমে ভোরের এয়ারপোর্ট। হাজার ব্যস্ততা। পরপর অনেকগুলো কলকাতার ফ্লাইট। তাই স্বাভাবিকভাবেই চারিদিকে বাংলার ছড়াছড়ি। আমি খুব একটা কোনদিকে পাত্তা দিচ্ছি না বিশেষভাবে। হঠাৎ কানে এলো এক বাংলাদেশী (accent শুনে বুঝলাম) ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর। ফোনে কাউকে বলছেন, " হ্যাঁ, এই আট বিশের ফ্লাইট। কলকাতা পৌঁছব সাড়ে দশটায়। দমদম স্টেশন থেকে শিয়ালদা গিয়ে ওখান থেকে ট্রেনে বনগাঁ। অটো ধরে তারপর পেট্রপোল। বর্ডার পেরোলেই গাড়ি থাকবে। ঠিকঠাক মতো লঞ্চ পেয়ে গেলে সাড়ে পাঁচটা ছটার মধ্যে বরিশাল পৌঁছে যাব।" আরো অনেক কথাই বলছিলেন উনি। আর কানে ঢোকেনি কিছু। ঠিক ওই একটা শব্দ। "বরিশাল"। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কোন মানে নেই কিন্তু। কোনদিনও সেখানে যাইনি। এমনকি বাবা জ্যাঠাও যাননি। শুধু জানি পূর্বপুরুষের বাস বরিশালে। গল্পও সেরকম শুনিনি। শোনার মধ্যে ওই পুকুর নদী আর তা থেকে মাছ ধরে রান্নার গল্প (কী করব, বরাবরের খাদ্যরসিক আমি)। ঠাকুরদার বাবা পুলিশে ছিলেন, আগেভাগেই খবর পেতেন। তাই দেশভাগের ওই দুঃখজনক ঘটনা ঘটার আগেই তাঁরা সপরিবারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে আসেন এই দেশে। ভিটে মাটি বিক্রি করে দিয়ে। (সেই বাড়ির ছবিটুকু দেখেছি মোটে।) কোনরকম ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও নেই। ওপর ওপর দেখলে কোন শোকের অবকাশও নেই। স্বেচ্ছায় চলে এসেছেন তাঁরা।

তবুও, নিজের পূর্বপুরুষের দেশ, বাড়ি সব ছেড়ে এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করা... একটুও কি কষ্ট হয়নি তাঁদের? হয়তো ওঁদের সেই শিকড়ের প্রতি টান, সেইটাই আমি বংশানুক্রমে পেয়েছি। আর তাই কলকাতা, বরিশাল এইসব জায়গা থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও ওই একটি শব্দে একটা অদ্ভুত আত্মিক টান অনুভব
করেছি। সেই শিকড়ের টানটুকু প্রতিফলিত হয়েছে এমন অভূতপূর্ব অনুভূতিতে।

আর তাই গতকাল যখন ফ্লাইটে সহযাত্রী দেখলাম দুজনই বাংলাদেশের, যে আমি কিনা সচরাচর অচেনা অজানা লোকের সাথে কথা বলিনা, নিজে যেচে ওঁদের সাথে কথা বলেছি। এবং শেষে ফিরবার সময়ে ওই ভাইটির থেকে "বাংলাদেশে অবশ্যই আসবেন আপু, নিমন্ত্রণ রইল। ও যে আপনারও দেশ..." শুনে মনটা ভরে গেল।

ছবিটি আমাদের বরিশালের বাড়িটির। ফ্যামিলি গ্রুপ থেকে পাওয়া whatsappএ।

Friday, December 14, 2018

টুপুরের মন খারাপ

টুপুরের আজ খুব মন খারাপ। স্কুল থেকে ফিরে টুপুর কলকল করে সারাদিনে স্কুলে কী কী হল, কোন মিস কী বলল, কে কে হোমওয়ার্ক করেনি বলে বকা খেলও, টিফিনটাইমে কী কী খেলেছে, কে কতবার উল্টে পড়েছে, এই সমস্ত কথা ঠাম্মাকে না বলতে পারলে টুপুরের বিকেলের ভাত গলা দিয়ে নামেনা। আজ তো ঠাম্মা অবাক। টুপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ফ্ল্যাট অবধি এক্কেবারে চুপ, একটা শব্দও নেই মুখে। খেতে বসে ফোনে গেম খেলারও আবদার নেই। কিছু তো একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। ঠাম্মা জানে নাতিবাবুর মন মেজাজ ভালো রাখতে গেলে ভালো মন্দ খাবার খাওয়ানো একটা মোক্ষম উপায়।
ঠাম্মা কড়াইয়ে গরম তেলে লুচি ছাড়তে ছাড়তে "টুপুর সোনা, খেতে দিচ্ছি কিন্তু, ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে নাও" বলে হাঁক পাড়ল। টুপুরের দিক থেকে কোন উত্তর পেল না। লুচি ভাজা শেষ করে থালায় চারটে, আলুর তরকারি আর এক বাটি চালের পায়েসে সাজিয়ে ঠাম্মা যখন খাওয়ার ঘরে এলো, দেখল টুপুর শান্ত চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।
"কী হয়েছে বাবাই? মন খারাপ আমার টুপুর সোনার?" নাতির চুলে বিলি কাটতে কাটতে  ঠাম্মা জিজ্ঞেস করল। টুপুর ওর বড় বড় চোখ মেলে ঠাম্মার দিকে তাকালো, তারপর মাথা নেড়ে "কিছু না" বলেমুখ নামিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো।
কী করে বলবে ও ঠাম্মিকে? আজকে স্কুলে যা ঘটে গেল, ঠাম্মিকে বলা যায়? এমনিতে টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড ওর ঠাম্মি। সব কথা বলে, ভালো হোক কি মন্দ। ক্লাস টিচারের প্রশংসা থেকে বকুনি, সব। কিন্তু এই কথাটা কী করে বলবে? যদি ঠাম্মা বকে? যদি মাকে বলে দেয়? কী লজ্জা।
"টুপুর লুচি খেতে ভালো লাগছে তো?" ঠাম্মার কথায় সম্বিত ফিরল টুপুরের। মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বলল।
"ঝটপট খেয়ে নাও সোনা। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে।" ঠাম্মির কথায় মনে পড়ে যায় টুপুরের। আচ্ছা, ও যখন থাকবে না, সেই সময়ে মা যদি জেনে যায়? কি হবে? মা তো জানতে পারবে ওহাটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে। ওই যে, টু এর সব  ছাত্রদের মায়েদের যে গ্রুপটা আছে, তাতে তো সারাদিন স্কুলে ক্লাসে কী কী হল, সব খবর এসে যায়। এতক্ষণে হয়তো এসেও গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মায়ের ফোনে নেটপ্যাক ভরা নেই। এই বাঁচোয়া। বাড়ি এসে wifi কানেক্ট না করা অবধি জানতে পারবে না। বাড়ি ফিরলেই তো পরীক্ষা, হোমওয়ার্ক, পি টি এম এইসবের খবর পেয়েই যায়। চন্দনা মিসও এই গ্রুপে আঁচে, যদি মায়ের কাছে ওর নামে নালিশ করে? কিন্তু টুপুর যে এত করে সরি বলল, পানিশমেন্টও পেয়েছে। তাও মিস বলে দেবে? ভাবতে ভাবতে কখন যে টুপুরের দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, ও বুঝতেই পারেনি।
ঠাম্মি রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে টুপুরের ঘরে এসে দেখে ওই কাণ্ড মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল," সোনা বাবা আমার, ঠাম্মির কাছে লুকোস না কিছু প্লিজ। বল কী হয়েছে?" ঠাম্মা টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুলের সব কথাই ঠাম্মার সাথে শেয়ার করে ও। তাহলে আজ কেন বলবে না ও? হতেও তো পারে ঠাম্মা কোন সলিউশন দিতে পারে? এমনিও মা ঠিক জানতে পারবেই। বকুনিও দেবে। তার চেয়ে বরং ঠাম্মাকে আগেভাগে বলে রাখলে অন্তত ওর দলে থাকবে। মা অত বকতে পারবে না। এইসব ভেবে টুপুর বলতে শুরু করলো।
"ঠাম্মি আজ স্কুলে ইংলিশ ওয়ানের সারপ্রাইজ টেস্ট হল। তা আমি করেছি কী, একেকটা কোয়েসচেনের আন্সার লিখে সাথে সাথে রাফ খাতায় সেটা লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মি মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন বাবু? এতে তোমার টাইম ওয়েস্ট হচ্ছিল না?"
টুপুর উত্তর দিল, "হুম, হচ্ছিল তো বটেই। কিন্তু কী করব? মা কোয়েসচেন আর তার আন্সারে কী লিখেছই জানতে চাইলে বলতে পারি না বলে বকে। কোয়েসচেন পেপারও তো ফেরত দেয়না। কী করব? তাই লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মা বলল, "তারপর?"
টুপুর বলতে লাগল, "মিস দেখতে পেয়ে আমায় খুব বকল। ভাবল আমি চিটিং করছি। দেখে দেখে লিখছি। আমার আন্সার শিট নিয়ে ফ্রেশ পেপার দিল।"
"এ বাবা। কী টিচার রে। মিলিয়ে মিলিয়ে তুই ঠিক ওই প্রশ্নের উত্তরগুলিই কী করে লিখে নিয়ে যাবি ভাবল, অদ্ভুত তো? তা যাক গে, তুই শেষ করতে পেরেছিলি ফুল পেপার?"
"না, প্লাস ক্লাসের সবাই আমার দিকে কেমন একটা করে তাকাচ্ছিল। যেন আমি চুরি করেছি। আমার খুব খারাপ লেগেছে ঠাম্মি।"
"হ্যাঁ, খারাপ তো লাগারই কথা বাবু। দাঁড়া, আমি মাকে বলব। সব গুছিয়ে বুঝিয়ে বলব। মা আর তোকে বকবে না। আর ভবিষ্যতেও এরকম দাবী করবে না। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো।"
"আর বন্ধুদের কাছে আমার রেপুটেশন?"
"আমি সব সামলে দেবো। ভরসা রাখ ঠাম্মির ওপর।"
টুপুর এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। যাক। ঠাম্মি বলেছে যখন, নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে ঠিক। আর ওর ভয় নেই। বাইরে মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। চাদর চাপা দিয়ে টুপুর শুয়ে পড়ল। ঠাম্মি রোজের মতো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প বলতে লাগল। সেই গল্প শুনতে শুনতে প্রতিদিনের মতোই টুপুর কখন জানি ঘুমিয়েও পড়েছে। ঘুম ভাঙল যখন, দেখল বাইরে অন্ধকার। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠল ও। রান্নাঘর থেকে টুংটাং কড়াইয়ের শব্দ আসছে। ছ্যাঁক ছোক তেলের আওয়াজও। ঠাম্মি আর মায়ের গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে। মনে হছে হাসির শব্দ। ঘরের আলো জ্বালিয়ে টুপুর দেখল সাড়ে ছটা বাজে। এ বাবা। ওর যে ছটা থেকে গানের ক্লাস ছিল? যাহ, আজ আবসেন্ট। মা বকবে না তো?
ঘরে আলো জ্বলছে দেখে ঠাম্মি হাঁক দিল, "টুপুর বাবু, উঠেছ?"
"হ্যাঁ ঠাম্মি।" টুপুর জোরে উত্তর দিল।
"হাত মুখ ধুয়ে একবার এদিকে আসো তো সোনা। আমি রান্নাঘরে আছি।"
কে জানে, মা কী বলবে। একটু দুরুদুরু বুকেই টুপুর মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গেল। আহ, ঠাম্মি নিমকি ভাজছে। কী দারুণ গন্ধ। স্তূপ করে রাখা নিমকিগুলি। গরম গরম। মুচমুচে। দেখেই খেতে ইচ্ছে হয়। আর ঠাম্মির নিমকির স্বাদ যে কোন কেনা নিমকিকে বলে বলে দশ গোলে হারিয়ে দেবে, টুপুর জানে। আর তাই টুক করে একটা নিমকি মুখে দিল ও। আহ, অমৃত।
ঠাম্মি বলল, "টুপুর বাবু, এগুলো তোমার বন্ধুদের জন্য বানাচ্ছি। কাল স্কুলে নিয়ে যেয়ো। টিফিনে সবাইকে খাইয়ো। দেখবে, সবাই আজকের কথা ভুলে যাবে।" টুপুর হাঁ করে শুনছিল ঠাম্মির কথা। একবার মায়ের দিকে তাকালো। দেখল মা মুচকি মুচকি হাসছে। যাক, তার মানে হাওয়া গরম না।
"আর শোন, আমি মাকে সব বলেছি। বুঝিয়েছি।  মা তোকে বকবে তো নাই। বরং ইন ফিউচারও এমন কিছু যাতে তোকে করতে না হয়, তেমন অন্যায্য দাবীও করবে না। ঠিক আছে তো?" থামির কথাগুলো শুনে তুপুর এইবারে এক্কেবারে নিশ্চিন্ত হল।
মা হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, " সরি সোনা। আমার জন্য তোকে এইসব ফেস করতে হল। আমি ক্লাস টিচারকে নোট লিখে দেবো। সব এক্সপ্লেইন করবো। তুই চিন্তা করিস না। কেউ তোকে আর ট্রাবল করবে না।"
"আর বন্ধুরা?" টুপুর জিজ্ঞেস করলো।
"সে তো ঠাম্মিস ম্যাজিক নিমকি খেয়েই সব সল্ভড হয়ে যাবে। চল, আজ গানের ক্লাস যখন মিস হয়েই গেল, আমরা তিনজনে মিলে বরং অন্তাক্ষরী খেলই। বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি। তোর ফেভারিট চাইনিজ ডিনার নিয়ে আসতে বলি। লেটস সেলিব্রেট দ্য পারফেক্ট ওয়েদার।" মায়ের কথা শুনে টুপুর "ইয়াহু" বলে লাফিয়ে উঠল। কী আনন্দ।

Wednesday, December 12, 2018

শীত ইত্যাদি (সাম্পান)

কবে থেকে খুঁজছি জানেন, কিন্তু পাচ্ছিইনা। মনে হয় শব্দগুলো সব চড়ুইভাতি করতে গিয়েছে। আর নইলে পরিযায়ী পাখিদের সাথে ডানা মেলে উড়ছে এদিক ওদিক। আর নয়তো বলতে পারি, যা ঠাণ্ডা পড়েছে, ল্যাদ মোড অন। লেপ কম্বলের তলা থেকে আমাদেরই বের হওয়া, বড়ই মুস্কিল ব্যাপার। স্কুলগুলোরও তো ছুটি পড়ল বলে। আর হয়তো হাতে গুণে দিন দশেক। তাহলে শব্দগুলোরই বা কী দোষ বলুন তো? ওদেরও তো শখ আহ্লাদ আছে। নাকি?
আমরা যখন তখন নতুন গুড়ের মোয়া, পাটালি খাবো। বড়দিনের স্পেশাল নাহুমের রিচ ফ্রুট কেক খাবো। চিড়িয়াখানায় লুচি আর নতুন আলুর দম নিয়ে গিয়ে পিকনিক করব। বাড়ি বসে ফুলকপির তরকারি, পালং শাক, পাবদা পার্শে খেয়ে একটা ছোট্ট ঢেকুর তুলে ছাদে মিঠেকড়া রোদে বসে কমলালেবুর খোসা ছাড়াব। সাথে থাকবে দুপুর দুটোর আকাশবাণীর নাটক। একটু রোদ পড়তে থাকবে যখন, একটা কনকনে বাতাস হঠাৎ ছুঁয়ে যাবে। বেশ জাপ্টে নেবো শালটাকে।
(আমার আবার শাল নিয়ে রোমান্টিসিজম আছে খুব। মায়ের সাথে নিউ মার্কেট থেকে কাশ্মীরি কাজ করা কালো শাল বা হিমাচল প্রদেশ ঘুরতে গিয়ে কেনা কুলু শাল। বা বন্ধু সোহিনীর কথা অনুযায়ী গুরজারি থেকে কেনা সেই "ভুস্কু" শাল। উফ। কী ওম। কী আরাম। বেশ জড়িয়ে জাপটে আরাম। হ্যাঁ, প্র্যাক্টিকালি ভাবতে গেলে সোয়েটার জ্যাকেট অনেক কনভিনিয়েন্ট ঠিকই। কিন্তু শাল হল আভিজাত্য। ভাবুন তো, শীত মানেই বিয়েবাড়ি। ভারী সিল্কের শাড়ির সাথে কি কোন সোয়েটার চলে? উহু। চাই একটা জম্পেশ শাল। আর যদি পরেন পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা কাশ্মীরি শাল ঝোলানো কিন্তু মাস্ট! এই দেখুন গিয়ে কী লিখতে বসে কীসব ফ্যাশনের গল্প করে ফেললাম...)
তা যা বলছিলাম। হয়েছে কী, আমার শব্দগুলোও সব আবদার করেছে। ওদেরও শীতের ছুটি চাই। ওরা বেশ উড়ে বেড়াবে। ঘুরে বেড়াবে। এদিক সেদিক। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে। আমি তো আবার দয়ালু মানুষ। ছুটি মঞ্জুর করেই দিলাম। তবে হ্যাঁ, একটু কড়াও হতে হয়। এক্কেবারে প্রথমেই ছুটি দেওয়া যায় না। তাই বলেছি, এক সপ্তাহ কাজ করতে হবে। তারপর যেখানে খুশি যাও। ওরাও মেনে নিয়েছে।
আগামীকাল থেকে তাই এক সপ্তাহ ব্যাপী "কিশলয়" থিমের ওপর গান গল্প কবিতা থাকছে। আর তারপর?
ছুটি ছুটি ছুটি...
কবে ফেরা? দেখি, ওরা কবে ফেরে?
শীত এঞ্জয় করুন।
(এ তল্লাটেও অল্প বিস্তর ঠাণ্ডা পড়েছে বই কি)

শীত ইত্যাদি

https://youtu.be/pSfci8hdQ1E
দুপুরগুলোয় আর সেই গা চিড়বিড় করা গরমটা বোধ করিনা। ছাতা তো কোন জন্মেই ব্যবহার করিনা (বৃষ্টি ছাড়া), এখন যেন তার প্রয়োজনটুকুও হয় না। ফাটা ঠোঁটে পড়ছে অরিফ্লেমের স্নিগ্ধ পরশ। খুব ঘন ঘনই। সকালে স্নানের সময়ে গরম জলের কলেই প্রায়দিন কাজ চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে পাতলা চাদরে কান মাথা ভালো করে মুড়ি না দিলে হচ্ছে না। অবশ্য নিন্দুকেরা বলবে চেন্নাইয়ে পাঁচ বছরের ওপর থেকে আমি নাকি স্থানীয়দের মতোই হয়ে গিয়েছি। অল্পেই ঠাণ্ডায় কাতর। তবে সত্যি বলছি, ঠাণ্ডা কিন্তু পড়েছে। হতেই পারে, কলকাতার মতো না। তবুও, রাত্রে গায়ে একটা হাল্কা চাপা দিতেই হচ্ছে।
সেইসব ভাবতে ভাবতে আজ এই গানটা বেশ কয়েকবার শুনতে লাগলাম। কেন জানি না, এইটাকে আমার শীতের অ্যান্থেম বলে মনে হয়। মনে আছে, ২০১৩ সালে যখন বেরিয়েছিল দ্বিতীয় পুরুষ অ্যালবামটি, অনুপম রায়ের সই করা সিডি কিনি আমি। কী আনন্দ তাতে। সারাদিন ধরে শুনে যেতাম। মোবাইলে ট্রান্সফারও করে নিয়েছিলাম। তখন আমার সেই সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের নোকিয়া এক্স টু। জিওও আসেনি। ইন্টারনেটে মিউজিক স্ট্রিমিং হয় না তেমন। ওই গোটা অ্যালবামে এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের গান ছিল। ২০১৩র ডিসেম্বর। চেন্নাইয়ে প্রথম শীত। দুপুরে হোস্টেলে খেয়ে ল্যাবে ফিরতাম। বেশ অনেকটা রাস্তা। তখনও সাইকেল কিনিনি। বাসের অপেক্ষা না করে গাছ গাছালির ছায়া দিয়ে মিঠে রোদ পোহাতে পোহাতে কানে ইয়ারফোন গুঁজে এই গানটাই লুপে ফেলে হাঁটতাম।
আজ আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেইসব দিনগুলিতে। ওই রাস্তায়। ওই অনুভুতিগুলোয়... খুব।।

Friday, December 7, 2018

ব্যথা

ওরে বাবা রে, মা রে, ঘাড়ে কী ব্যথা, কী ব্যথা। বলে বোঝাতে পারবো না। সে রাত্রে শুতে পারিনা, সমানে এপাশ ওপাশ করে যাই। তাতেও বড় ব্যথা করে। এ ও বলল, বালিশ তোশক রোদ্দুরে দিতে। তাও দিলাম। কিন্তু ব্যথা যে আর মরেনা। কাজকর্ম করতে পারিনা ব্যথার চোটে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গেলেও বড় কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার বদ্যিতে ওষুধ দিল কিছু। ওই একদিন ব্যথা মরল। তারপর আবার যে কে সেই। শীতকাল পড়েছে। ব্যথা বাড়বে বলছে সকলে। কে জানে বাবা, বুড়ো হার। বারবার এমনি হয়। তবে হ্যাঁ, এই অসুখ আমার নতুন নয়। প্রতি বছর হয়। কটাদিন, কয়েকটা সপ্তাহ একটু মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।
ব্যস, তারপর একদিন সকালে উঠে দেখব, ব্যথা ভ্যানিশ। একটু একটু করে কমতে কমতে পুরোপুরি সে চলে গেল? নাকি অভ্যেস হয়ে গেল সয়ে নেওয়ার, তা অবশ্য আমি জানিনা। তবে হ্যাঁ, আর কষ্টটা হয়না। 



ওই দিদিটাও তো তাইই বলেছিল। ওর নাকি প্রতিবার যখন প্রেম ভেঙ্গে যায়, কষ্ট পেতে থাকে। তারপর অবশ্য ঠিক এইভাবেই একদিন ব্যথার সাথে বন্ধুত্ব করে অভ্যেস করে নেয়। কিংবা, সত্যিই হয়তো, ব্যথাটা কমে যায়। কে জানে...
মেয়েমানুষের জান হে। আমাদের সইবার শক্তি যে অনেক।

Tuesday, December 4, 2018

"সৃজন ছন্দে"

দেয়াসিনীর জন্ম, বড় হয়ে ওঠা সমস্তই পলাশপুর গ্রামের বনেদি বড়লোক বাড়িতে। মিত্র বাড়ি এমনই এক বাড়ি, যেখানে ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন অভাব না থাকলেও, পরিবারের কিছু কিছু সদস্যদের জন্য সব সময়ই অনেক কিছুই থেকেছে না পাওয়ার তালিকায়। সেই বিশেষ সদস্যরা সকলেই নারী। পরিবারের রক্ষণশীল তথাকথিত পুরুষসিংহেরা কেউই চাইতেন না তাঁদের পরিবারের মেয়েরা কোন স্বপ্ন দেখুক। বা নিদেনপক্ষে মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিক। দেয়াসিনী  ও ওর বাকি জেঠতুতো খুড়তুতো দিদি ও বোনেরা এটাকেই স্বাভাবিক, এটাই ভবিতব্য মেনেই নিয়েছিল। দিব্যি চলছিলও জীবন। এক এক করে স্কুলের গণ্ডী পার করেই বসে যেত বিয়ের পিঁড়িতে। তারপর মা কাকীমাদের মতোই অন্যের সংসারের ঘানি টানা।

এমন সময়ে এই বাড়ির বড়কর্তা দিব্যকান্তি মিত্র, অর্থাৎ দেয়াসিনীর সবচেয়ে বড় জ্যাঠার নামে এলো একটি চিঠি। বাড়ির মেয়ে, চন্দ্রিমা, যিনি পঁচিশ বছর আগে পরিবারের "মুখ কালো" করে এক ভিন্ন জাতের ছেলেকে ভালোবেসে তার সাথে পালিয়ে বিয়ে করায় ত্যাজ্য কন্যা হন, সম্প্রতি দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গিয়েছেন। ওঁর একমাত্র ছেলে দেবদূত গ্রামের বাড়িতে এসে সকলের সাথে দেখা করতে চায়। চন্দ্রিমা দেবীর ঘটনাটি ঘটে ওঁর বাবা, রামকৃষ্ণ মিত্রের নির্দেশে। পাঁচ ভাইয়ের পর প্রথম বোন চন্দ্রিমা ছিল দাদাদের বড় আদরের। বাবার কথা অমান্য করার "শিক্ষা" কেউই পাননি বলে তাঁরা তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। তবে আজ যখন সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিব্যকান্তির হাতে, তিনি দুইবার ভাবলেন না। ভাগ্নেকে সত্বর আসতে বললেন। বাকি সদস্য সদস্যারা অবাক হলেন বটে। তবে স্নেহের টানকে যে উপেক্ষা করা যায় না, এটা ভেবে সবটা মেনে দেবদূতের আগমনের আয়োজন শুরু হল।

এক সপ্তাহ পর দেবদূত এলো পলাশপুর। মামার বাড়ি এসে সে যে খুব বেশি খাতির যত্ন পাবে না, এমনটা জানত। তবুও, ওকে আনতে যে স্টেশনে মামারা লোক পাঠাবেন গাড়ি নিয়ে, সেটা ভাবতেই পারেনি। মায়ের কাছে এই বাড়ির কত গল্প শুনেছে। ছোট থেকে যখন বন্ধুরা ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়ার গল্প করত, মুখ চুন করে থাকত ও। আজ এতগুলো বছর পর যে সেই মামাবাড়িতে আসছে, আলাদাই অনুভূতি। শুধু যদি মা এই দিনটা দেখে যেতে পারত।

দেয়াসিনীর খুব ভালো লেগেছে এই দাদাটিকে। কী শান্ত, শোভন, ভদ্র। ওর চেনা পরিচিত এই বয়সী ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক আলাদা। যদিও দেয়ার থেকে দেবদূত প্রায় বছর আটেকে বড়, তবুও দুজনের আলাপটা ভালোই জমেছে। লেখাপড়া, দেশ বিদেশের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে দেয়ার। আর এই দাদাটিও বড় ভালো গল্প করতে পারে। একেবারে মাতিয়ে রাখে।

দেয়াসিনী ওর অন্যান্য ভাই বোনেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। বয়স সুলভ কোন প্রগল্ভতা নেই। শান্ত, স্নিগ্ধ। পরিবারের একেবারে "আদর্শ মেয়ে"। একদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দেয়াসিনী ছাদে বসে চড়াই পাখিদের চাল খাওয়াচ্ছে, এমন সময় পায়ের শব্দে চমকে উঠল। এই সময়ে সচরাচর কেউ এদিকে আসে না। এটা ওর এক্কেবারে নিজস্ব জগত। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দেবদূত। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। ঠিক বাবাই দাদার ওই বন্ধুটার মতো, যে গতবারে পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছিল।
"কী করছ?" হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো দেবদূত।
দেয়া একটু লজ্জা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলল, "তেমন কিছু না। ওই একটু চড়াইগুলোকে খেতে দিচ্ছি। রোজ এই সময়ে ওদের খেতে দিই। না দিলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নেবে।"
দেবদূত বলল, "পাখী ভালোবাসো?"
দেয়া মাথা নাড়ল।
"আর কী কী ভালো লাগে তোমার?" দেবদূত আবার প্রশ্ন করলো।
"আর কী? কিছু না।" দেয়া উত্তর দিল।
দেবদূত নাছোড়বান্দা। আবার প্রশ্ন করলো, "তা তো হয় না দেয়া রাণী। ক্লাস টেনের মেয়ে, শখ আহ্লাদ নেই নাকি? কোন হবি নেই?"
"ওই একটু আধটু মাঝে মাঝে বাড়িতে কেউ না থাকলে বা এমনি দুপুরে ছাদে এসে টুকটাক নাচ করি। দিদিভাই বা বোনুর মতো গানও গাইতে পারি না। আবৃত্তিও পারি না। ওই একটু টিভি দেখে বা স্কুলে যেটুকু বন্ধুদের দেখি, অল্প নাচ পারি।" কথাগুলো বলেই দেয়া জিভ কাটল। বেশ ভয় ভয়েই বলল, "দেবদা, তুমি কিন্তু এই কথাটা বাড়ির কাউকে বলো না প্লিজ। ওরা জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে।"
"কেলেঙ্কারি? কেন? কীসের কেলেঙ্কারি?" দেবদূত অবাক।
"তুমি জানো না দাদা। নাচ নাকি আমাদের মতো ভদ্রও বাড়ির মেয়েরা করে না। এসব নাকি ধিঙ্গিপনা। দুই বছর আগে স্কুলের ফাংশানে আমায় নাচ করতে ডেকেছিল। সেই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। বুড়ি দিদা মানে বাবাদের পিসি, তখন জীবিত ছিলেন। সে কী চিৎকার চেঁচামিচি।" দেয়াসিনী বলল।
"আচ্ছা, তুমি কী নাচ ভালোবাসো? ক্লাসিকাল? নাকি ফিল্ম?" দেবদূত জানতে চাইল।
"আমি সব পারি দাদা। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতির সাথে বেশি ভালো লাগে।" দেবদূত লক্ষ্য করলো, দেয়ার মুখ চোখে কী অপরিসীম আনন্দ যখন ও নাচের গল্প করছিল। কোন কোন গানের সাথে ও কীভাবে স্টেপ শিখেছে, সব গল্প করতে করতে এ যেন এক অন্য দেয়া। শান্ত নির্জীব মেয়েটির মধ্যেও যে এত প্রাণখোলা ব্যাপার আছে, ওকে আজ না দেখলেই জানতেই পারত না দেবদূত।
কলকাতায় বান্ধবী প্রিয়স্মিতাকে ফোন করে সবটা বলল। প্রিয়স্মিতা নিজেও নাচ করে। রীতিমত স্টেজে প্রচুর মানুষের সামনে শো হয় ওর। ভারতনাট্যম। দেবদূত ওকে বলল, "প্রিয়া, আমার এই বোনটার জন্য কিছু কি করা যায় না?"
প্রিয়স্মিতা খানিক ভেবে বলল, "একটা কাজ করবি? আমায় একটা স্যাম্পেল পাঠাতে পারবি ওর নাচের? দেখি?"
দেবদূত খানিক ভেবে বলল, "দেখ ক্যামেরা সাথেই আছে। দেখি দেয়াকে রাজি করাতে পারি কি না।"
"ওই মিনিট দুই তিনেকের করলেই হবে। তুই দেখ। পাঠা আমায়। দেখছি কী করা যায়।" প্রিয়স্মিতা জানালো।

সেদিন বিকেলে চায়ের আসরের গল্প গুজবের এক ফাঁকে দেবদূত দেয়াকে ডেকে বলল, "শোন, আমার এক বান্ধবী খুব ভালো নাচ করে। আমি ওকে বলেছি তোমার কথা। ও খুব আগ্রহী তোমার নাচ দেখতে। তুমি আমায় তোমার নাচের ভিডিও শুট করতে দেবে প্লিজ?"
দেয়ার তো শুনেই মুখ চোখ ফ্যাকাসে হওয়ার জোগাড়। কোনমতে ফিসফিস করে বলল, "সে কী দেবদা? তা আবার হয় নাকি? বাড়ির লোকজন জানতে পারলে কেলেঙ্কারি।"
"জানবে কী করে? তুমি যেমন ছাদে এসে মাঝে মাঝে নিজের মনে নাচ করো, সেরকম করবে। আমি ভিডিও করে নেবো। কেউ জানতেও পারবে না।" দেবদূত আশ্বস্ত করলো দেয়াকে। দেয়া কথা দিল না।

দেবদূতের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে। দেয়াসিনী এখনও দ্বন্দ্বে। কী করবে? নাচতে তো ও ভালোবাসেই। নাচের ভিডিও দাদাকে করতে দেবে? যদি বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়? যদি বকা খায়? গেলবারে যা বকুনি দিয়েছিল জেঠু। বাবাও বাঁচাতে পারেনি। বাবা তাও ওর শখ আহ্লাদ নিয়ে ভাবে। কিন্তু জেঠুর সামনে তেমন বলতেও তো পারে না কিছু।

গল্প করে, এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে কীভাবে যে দিনগুলো কেটে যায়, খেয়ালই থাকেনা। কাল দেবদূত চলে যাবে। আজ শেষবারের মতো সুযোগ। বারবার বলেছে ও দেয়াকে। দেয়া ছাদের এক কোণে চুপ করে বসে আছে। মন খারাপ। একদিকে মনে হচ্ছে নাচটা করেই ফেলে, আবার আরেকদিকে ভয়। লোক জানাজানির।

হঠাৎ টের পেল, কখন জানি পাশে এসে বসেছে বাবা। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেবদূত।
"কী ভাবছিস রে দেয়া?" বাবা সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন।
"কই, কিছু না তো।" দেয়া মাথা না তুলেই উত্তর দিল।
"বললেই হল? আমি পরিষ্কার দেখছি আমার দেয়া রাণীর চোখে মুখে চিন্তা। কী হয়েছে আমায় বল?" বাবা বললেন।
"একটা কনফ্লিক্ট চলছে বাবা মনের মধ্যে।" দেয়া আস্তে আস্তে উত্তর দিল।
"দেবদূত আমায় সব বলেছে। নাচ করতে ভালবাসিস যখন, দাদা নাচ করতে বলছে, কর না। কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। আর শোন, কেউ কিছু বললে, আমি আছি তোর সাথে।" বাবার কথায় যেন দেয়া অনেকটা ভরসা পেল। 
"ঠিক আছে দেবদা, তুমি ক্যামেরা আনো। আমি নাচ করব। এই এইদিকটায় করি? আলোটা ভালো পাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলগুলোও দিব্যি মানাবে। বলো?" দেবদূত বোনের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক। কে বলবে এই মেয়েটাই অন্য সময় এমন গুটিয়ে থাকে। "বেশ। তাই হবে। তুমি এসো।"

ক্যামেরা তাক করে আলো দেখে সেটিং ঠিকঠাক করল।
দেয়াসিনী ওর মোবাইল থেকে "সৃজন ছন্দে আনন্দে" গানটি চালিয়ে শুরু করল ওর নাচ। দেয়ার বাবা মেয়ের এই অপূর্ব নাচ দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলেন। দেবদূতও মুহূর্তগুলি ক্যামেরা বন্দী করতে করতে মুগ্ধ। প্রিয়স্মিতা যদি মেয়েটির এই প্রতিভার জন্য কিছু করতে পারে, তাহলে খুবই ভালো হয়। ভিডিও তুলে দেবদূত খুব সন্তুষ্ট। অনেকদিন পর।
পরেরদিন ওর ফেরার পালা। ভাই বোন মামা মামীদের ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগবেই। শিগগিরই আবার ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ও গেল। সামনে অনেক কাজ। বোনের জন্য কিছু একটা করতে হবে।

দেবদূত চলে যাওয়ার পর প্রায় মাস খানেক কেটে গিয়েছে। এখন বাড়ির লোকেদের আলোচনার মধ্যে ওর প্রসঙ্গ আসাও প্রায় কমেই গিয়েছে। তবে সকলের সাথে ও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, বিশেষ করে ভাই বোনদের সাথে।
ওদেরকে কলকাতায় ওর বাড়িতে আসার জন্য বারবার বলেছে। ওরা শুধু দিনক্ষণ খুঁজছে। এমন সময় বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল। দেয়াসিনীর নাচের ভিডিওটা প্রিয়স্মিতা ওর নাচের গুরুকে দেখিয়েছিল। গুরুমার সেটা বেশ পছন্দ হয়েছিল। উনি এবারে একটা গ্রুমিং ওয়ার্কশপ আয়োজন করবেন ঠিক করেছেন। সপ্তাহব্যাপী। সেখানে যাতে প্রিয়স্মিতা এই মেয়েটিকে আনতে পারে, উনি বারবার করে বলেছেন। দেবদূত জানে, মামাবাড়িতে সবাই ওকে খুব ভালবাসলেও ওর এই প্রস্তাবে রাজি হবে না কিছুতেই। তাই ঠিক করেছে ভাই বোনেদের কলকাতা ঘোরাবার নাম করে পলাশপুর থেকে যে নিয়ে আসবে, সেটা এই ওয়ার্কশপের সময়েই। সেজো মামা, মানে দেয়ার বাবার সাথে আলাদা করে এই নিয়ে কথাও বলে রেখেছে ও। উনিই আসবেন ওদের সাথে অভিভাবক হয়ে।

আজ সক্কাল সক্কাল ভাই বোনেরা দেয়ার বাবার সাথে রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। গতকাল রাত্রে যখন প্রায় শুতে যাবে দেয়া, বাবা ঘরে এসে ওকে একটা নতুন কিনে আনা ঘুঙুর দিতে দিতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "দেয়া রাণী, দুনিয়া জয় করে আয়। আমার সোনা মা।" সারা রাত উত্তেজনায় দেয়ার ঘুম হয়নি। কী আনন্দ। ও নাচ করবে। নাচের প্রশিক্ষণ পাবে। ওর স্বপ্ন সফল হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাবার আশীর্বাদ রয়েছে ওর সাথে।