Tuesday, December 4, 2018

"সৃজন ছন্দে"

দেয়াসিনীর জন্ম, বড় হয়ে ওঠা সমস্তই পলাশপুর গ্রামের বনেদি বড়লোক বাড়িতে। মিত্র বাড়ি এমনই এক বাড়ি, যেখানে ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন অভাব না থাকলেও, পরিবারের কিছু কিছু সদস্যদের জন্য সব সময়ই অনেক কিছুই থেকেছে না পাওয়ার তালিকায়। সেই বিশেষ সদস্যরা সকলেই নারী। পরিবারের রক্ষণশীল তথাকথিত পুরুষসিংহেরা কেউই চাইতেন না তাঁদের পরিবারের মেয়েরা কোন স্বপ্ন দেখুক। বা নিদেনপক্ষে মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিক। দেয়াসিনী  ও ওর বাকি জেঠতুতো খুড়তুতো দিদি ও বোনেরা এটাকেই স্বাভাবিক, এটাই ভবিতব্য মেনেই নিয়েছিল। দিব্যি চলছিলও জীবন। এক এক করে স্কুলের গণ্ডী পার করেই বসে যেত বিয়ের পিঁড়িতে। তারপর মা কাকীমাদের মতোই অন্যের সংসারের ঘানি টানা।

এমন সময়ে এই বাড়ির বড়কর্তা দিব্যকান্তি মিত্র, অর্থাৎ দেয়াসিনীর সবচেয়ে বড় জ্যাঠার নামে এলো একটি চিঠি। বাড়ির মেয়ে, চন্দ্রিমা, যিনি পঁচিশ বছর আগে পরিবারের "মুখ কালো" করে এক ভিন্ন জাতের ছেলেকে ভালোবেসে তার সাথে পালিয়ে বিয়ে করায় ত্যাজ্য কন্যা হন, সম্প্রতি দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গিয়েছেন। ওঁর একমাত্র ছেলে দেবদূত গ্রামের বাড়িতে এসে সকলের সাথে দেখা করতে চায়। চন্দ্রিমা দেবীর ঘটনাটি ঘটে ওঁর বাবা, রামকৃষ্ণ মিত্রের নির্দেশে। পাঁচ ভাইয়ের পর প্রথম বোন চন্দ্রিমা ছিল দাদাদের বড় আদরের। বাবার কথা অমান্য করার "শিক্ষা" কেউই পাননি বলে তাঁরা তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। তবে আজ যখন সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিব্যকান্তির হাতে, তিনি দুইবার ভাবলেন না। ভাগ্নেকে সত্বর আসতে বললেন। বাকি সদস্য সদস্যারা অবাক হলেন বটে। তবে স্নেহের টানকে যে উপেক্ষা করা যায় না, এটা ভেবে সবটা মেনে দেবদূতের আগমনের আয়োজন শুরু হল।

এক সপ্তাহ পর দেবদূত এলো পলাশপুর। মামার বাড়ি এসে সে যে খুব বেশি খাতির যত্ন পাবে না, এমনটা জানত। তবুও, ওকে আনতে যে স্টেশনে মামারা লোক পাঠাবেন গাড়ি নিয়ে, সেটা ভাবতেই পারেনি। মায়ের কাছে এই বাড়ির কত গল্প শুনেছে। ছোট থেকে যখন বন্ধুরা ছুটিতে মামাবাড়ি যাওয়ার গল্প করত, মুখ চুন করে থাকত ও। আজ এতগুলো বছর পর যে সেই মামাবাড়িতে আসছে, আলাদাই অনুভূতি। শুধু যদি মা এই দিনটা দেখে যেতে পারত।

দেয়াসিনীর খুব ভালো লেগেছে এই দাদাটিকে। কী শান্ত, শোভন, ভদ্র। ওর চেনা পরিচিত এই বয়সী ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক আলাদা। যদিও দেয়ার থেকে দেবদূত প্রায় বছর আটেকে বড়, তবুও দুজনের আলাপটা ভালোই জমেছে। লেখাপড়া, দেশ বিদেশের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে দেয়ার। আর এই দাদাটিও বড় ভালো গল্প করতে পারে। একেবারে মাতিয়ে রাখে।

দেয়াসিনী ওর অন্যান্য ভাই বোনেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। বয়স সুলভ কোন প্রগল্ভতা নেই। শান্ত, স্নিগ্ধ। পরিবারের একেবারে "আদর্শ মেয়ে"। একদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর দেয়াসিনী ছাদে বসে চড়াই পাখিদের চাল খাওয়াচ্ছে, এমন সময় পায়ের শব্দে চমকে উঠল। এই সময়ে সচরাচর কেউ এদিকে আসে না। এটা ওর এক্কেবারে নিজস্ব জগত। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দেবদূত। গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। ঠিক বাবাই দাদার ওই বন্ধুটার মতো, যে গতবারে পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছিল।
"কী করছ?" হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো দেবদূত।
দেয়া একটু লজ্জা লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলল, "তেমন কিছু না। ওই একটু চড়াইগুলোকে খেতে দিচ্ছি। রোজ এই সময়ে ওদের খেতে দিই। না দিলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে নেবে।"
দেবদূত বলল, "পাখী ভালোবাসো?"
দেয়া মাথা নাড়ল।
"আর কী কী ভালো লাগে তোমার?" দেবদূত আবার প্রশ্ন করলো।
"আর কী? কিছু না।" দেয়া উত্তর দিল।
দেবদূত নাছোড়বান্দা। আবার প্রশ্ন করলো, "তা তো হয় না দেয়া রাণী। ক্লাস টেনের মেয়ে, শখ আহ্লাদ নেই নাকি? কোন হবি নেই?"
"ওই একটু আধটু মাঝে মাঝে বাড়িতে কেউ না থাকলে বা এমনি দুপুরে ছাদে এসে টুকটাক নাচ করি। দিদিভাই বা বোনুর মতো গানও গাইতে পারি না। আবৃত্তিও পারি না। ওই একটু টিভি দেখে বা স্কুলে যেটুকু বন্ধুদের দেখি, অল্প নাচ পারি।" কথাগুলো বলেই দেয়া জিভ কাটল। বেশ ভয় ভয়েই বলল, "দেবদা, তুমি কিন্তু এই কথাটা বাড়ির কাউকে বলো না প্লিজ। ওরা জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে।"
"কেলেঙ্কারি? কেন? কীসের কেলেঙ্কারি?" দেবদূত অবাক।
"তুমি জানো না দাদা। নাচ নাকি আমাদের মতো ভদ্রও বাড়ির মেয়েরা করে না। এসব নাকি ধিঙ্গিপনা। দুই বছর আগে স্কুলের ফাংশানে আমায় নাচ করতে ডেকেছিল। সেই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড। বুড়ি দিদা মানে বাবাদের পিসি, তখন জীবিত ছিলেন। সে কী চিৎকার চেঁচামিচি।" দেয়াসিনী বলল।
"আচ্ছা, তুমি কী নাচ ভালোবাসো? ক্লাসিকাল? নাকি ফিল্ম?" দেবদূত জানতে চাইল।
"আমি সব পারি দাদা। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতির সাথে বেশি ভালো লাগে।" দেবদূত লক্ষ্য করলো, দেয়ার মুখ চোখে কী অপরিসীম আনন্দ যখন ও নাচের গল্প করছিল। কোন কোন গানের সাথে ও কীভাবে স্টেপ শিখেছে, সব গল্প করতে করতে এ যেন এক অন্য দেয়া। শান্ত নির্জীব মেয়েটির মধ্যেও যে এত প্রাণখোলা ব্যাপার আছে, ওকে আজ না দেখলেই জানতেই পারত না দেবদূত।
কলকাতায় বান্ধবী প্রিয়স্মিতাকে ফোন করে সবটা বলল। প্রিয়স্মিতা নিজেও নাচ করে। রীতিমত স্টেজে প্রচুর মানুষের সামনে শো হয় ওর। ভারতনাট্যম। দেবদূত ওকে বলল, "প্রিয়া, আমার এই বোনটার জন্য কিছু কি করা যায় না?"
প্রিয়স্মিতা খানিক ভেবে বলল, "একটা কাজ করবি? আমায় একটা স্যাম্পেল পাঠাতে পারবি ওর নাচের? দেখি?"
দেবদূত খানিক ভেবে বলল, "দেখ ক্যামেরা সাথেই আছে। দেখি দেয়াকে রাজি করাতে পারি কি না।"
"ওই মিনিট দুই তিনেকের করলেই হবে। তুই দেখ। পাঠা আমায়। দেখছি কী করা যায়।" প্রিয়স্মিতা জানালো।

সেদিন বিকেলে চায়ের আসরের গল্প গুজবের এক ফাঁকে দেবদূত দেয়াকে ডেকে বলল, "শোন, আমার এক বান্ধবী খুব ভালো নাচ করে। আমি ওকে বলেছি তোমার কথা। ও খুব আগ্রহী তোমার নাচ দেখতে। তুমি আমায় তোমার নাচের ভিডিও শুট করতে দেবে প্লিজ?"
দেয়ার তো শুনেই মুখ চোখ ফ্যাকাসে হওয়ার জোগাড়। কোনমতে ফিসফিস করে বলল, "সে কী দেবদা? তা আবার হয় নাকি? বাড়ির লোকজন জানতে পারলে কেলেঙ্কারি।"
"জানবে কী করে? তুমি যেমন ছাদে এসে মাঝে মাঝে নিজের মনে নাচ করো, সেরকম করবে। আমি ভিডিও করে নেবো। কেউ জানতেও পারবে না।" দেবদূত আশ্বস্ত করলো দেয়াকে। দেয়া কথা দিল না।

দেবদূতের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে আসছে। দেয়াসিনী এখনও দ্বন্দ্বে। কী করবে? নাচতে তো ও ভালোবাসেই। নাচের ভিডিও দাদাকে করতে দেবে? যদি বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়? যদি বকা খায়? গেলবারে যা বকুনি দিয়েছিল জেঠু। বাবাও বাঁচাতে পারেনি। বাবা তাও ওর শখ আহ্লাদ নিয়ে ভাবে। কিন্তু জেঠুর সামনে তেমন বলতেও তো পারে না কিছু।

গল্প করে, এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে, খাওয়া দাওয়া করে কীভাবে যে দিনগুলো কেটে যায়, খেয়ালই থাকেনা। কাল দেবদূত চলে যাবে। আজ শেষবারের মতো সুযোগ। বারবার বলেছে ও দেয়াকে। দেয়া ছাদের এক কোণে চুপ করে বসে আছে। মন খারাপ। একদিকে মনে হচ্ছে নাচটা করেই ফেলে, আবার আরেকদিকে ভয়। লোক জানাজানির।

হঠাৎ টের পেল, কখন জানি পাশে এসে বসেছে বাবা। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেবদূত।
"কী ভাবছিস রে দেয়া?" বাবা সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন।
"কই, কিছু না তো।" দেয়া মাথা না তুলেই উত্তর দিল।
"বললেই হল? আমি পরিষ্কার দেখছি আমার দেয়া রাণীর চোখে মুখে চিন্তা। কী হয়েছে আমায় বল?" বাবা বললেন।
"একটা কনফ্লিক্ট চলছে বাবা মনের মধ্যে।" দেয়া আস্তে আস্তে উত্তর দিল।
"দেবদূত আমায় সব বলেছে। নাচ করতে ভালবাসিস যখন, দাদা নাচ করতে বলছে, কর না। কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। আর শোন, কেউ কিছু বললে, আমি আছি তোর সাথে।" বাবার কথায় যেন দেয়া অনেকটা ভরসা পেল। 
"ঠিক আছে দেবদা, তুমি ক্যামেরা আনো। আমি নাচ করব। এই এইদিকটায় করি? আলোটা ভালো পাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ফুলগুলোও দিব্যি মানাবে। বলো?" দেবদূত বোনের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক। কে বলবে এই মেয়েটাই অন্য সময় এমন গুটিয়ে থাকে। "বেশ। তাই হবে। তুমি এসো।"

ক্যামেরা তাক করে আলো দেখে সেটিং ঠিকঠাক করল।
দেয়াসিনী ওর মোবাইল থেকে "সৃজন ছন্দে আনন্দে" গানটি চালিয়ে শুরু করল ওর নাচ। দেয়ার বাবা মেয়ের এই অপূর্ব নাচ দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলেন। দেবদূতও মুহূর্তগুলি ক্যামেরা বন্দী করতে করতে মুগ্ধ। প্রিয়স্মিতা যদি মেয়েটির এই প্রতিভার জন্য কিছু করতে পারে, তাহলে খুবই ভালো হয়। ভিডিও তুলে দেবদূত খুব সন্তুষ্ট। অনেকদিন পর।
পরেরদিন ওর ফেরার পালা। ভাই বোন মামা মামীদের ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগবেই। শিগগিরই আবার ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে ও গেল। সামনে অনেক কাজ। বোনের জন্য কিছু একটা করতে হবে।

দেবদূত চলে যাওয়ার পর প্রায় মাস খানেক কেটে গিয়েছে। এখন বাড়ির লোকেদের আলোচনার মধ্যে ওর প্রসঙ্গ আসাও প্রায় কমেই গিয়েছে। তবে সকলের সাথে ও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, বিশেষ করে ভাই বোনদের সাথে।
ওদেরকে কলকাতায় ওর বাড়িতে আসার জন্য বারবার বলেছে। ওরা শুধু দিনক্ষণ খুঁজছে। এমন সময় বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল। দেয়াসিনীর নাচের ভিডিওটা প্রিয়স্মিতা ওর নাচের গুরুকে দেখিয়েছিল। গুরুমার সেটা বেশ পছন্দ হয়েছিল। উনি এবারে একটা গ্রুমিং ওয়ার্কশপ আয়োজন করবেন ঠিক করেছেন। সপ্তাহব্যাপী। সেখানে যাতে প্রিয়স্মিতা এই মেয়েটিকে আনতে পারে, উনি বারবার করে বলেছেন। দেবদূত জানে, মামাবাড়িতে সবাই ওকে খুব ভালবাসলেও ওর এই প্রস্তাবে রাজি হবে না কিছুতেই। তাই ঠিক করেছে ভাই বোনেদের কলকাতা ঘোরাবার নাম করে পলাশপুর থেকে যে নিয়ে আসবে, সেটা এই ওয়ার্কশপের সময়েই। সেজো মামা, মানে দেয়ার বাবার সাথে আলাদা করে এই নিয়ে কথাও বলে রেখেছে ও। উনিই আসবেন ওদের সাথে অভিভাবক হয়ে।

আজ সক্কাল সক্কাল ভাই বোনেরা দেয়ার বাবার সাথে রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। গতকাল রাত্রে যখন প্রায় শুতে যাবে দেয়া, বাবা ঘরে এসে ওকে একটা নতুন কিনে আনা ঘুঙুর দিতে দিতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "দেয়া রাণী, দুনিয়া জয় করে আয়। আমার সোনা মা।" সারা রাত উত্তেজনায় দেয়ার ঘুম হয়নি। কী আনন্দ। ও নাচ করবে। নাচের প্রশিক্ষণ পাবে। ওর স্বপ্ন সফল হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বাবার আশীর্বাদ রয়েছে ওর সাথে।





No comments:

Post a Comment