Friday, December 14, 2018

টুপুরের মন খারাপ

টুপুরের আজ খুব মন খারাপ। স্কুল থেকে ফিরে টুপুর কলকল করে সারাদিনে স্কুলে কী কী হল, কোন মিস কী বলল, কে কে হোমওয়ার্ক করেনি বলে বকা খেলও, টিফিনটাইমে কী কী খেলেছে, কে কতবার উল্টে পড়েছে, এই সমস্ত কথা ঠাম্মাকে না বলতে পারলে টুপুরের বিকেলের ভাত গলা দিয়ে নামেনা। আজ তো ঠাম্মা অবাক। টুপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ফ্ল্যাট অবধি এক্কেবারে চুপ, একটা শব্দও নেই মুখে। খেতে বসে ফোনে গেম খেলারও আবদার নেই। কিছু তো একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। ঠাম্মা জানে নাতিবাবুর মন মেজাজ ভালো রাখতে গেলে ভালো মন্দ খাবার খাওয়ানো একটা মোক্ষম উপায়।
ঠাম্মা কড়াইয়ে গরম তেলে লুচি ছাড়তে ছাড়তে "টুপুর সোনা, খেতে দিচ্ছি কিন্তু, ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে নাও" বলে হাঁক পাড়ল। টুপুরের দিক থেকে কোন উত্তর পেল না। লুচি ভাজা শেষ করে থালায় চারটে, আলুর তরকারি আর এক বাটি চালের পায়েসে সাজিয়ে ঠাম্মা যখন খাওয়ার ঘরে এলো, দেখল টুপুর শান্ত চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।
"কী হয়েছে বাবাই? মন খারাপ আমার টুপুর সোনার?" নাতির চুলে বিলি কাটতে কাটতে  ঠাম্মা জিজ্ঞেস করল। টুপুর ওর বড় বড় চোখ মেলে ঠাম্মার দিকে তাকালো, তারপর মাথা নেড়ে "কিছু না" বলেমুখ নামিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো।
কী করে বলবে ও ঠাম্মিকে? আজকে স্কুলে যা ঘটে গেল, ঠাম্মিকে বলা যায়? এমনিতে টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড ওর ঠাম্মি। সব কথা বলে, ভালো হোক কি মন্দ। ক্লাস টিচারের প্রশংসা থেকে বকুনি, সব। কিন্তু এই কথাটা কী করে বলবে? যদি ঠাম্মা বকে? যদি মাকে বলে দেয়? কী লজ্জা।
"টুপুর লুচি খেতে ভালো লাগছে তো?" ঠাম্মার কথায় সম্বিত ফিরল টুপুরের। মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বলল।
"ঝটপট খেয়ে নাও সোনা। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে।" ঠাম্মির কথায় মনে পড়ে যায় টুপুরের। আচ্ছা, ও যখন থাকবে না, সেই সময়ে মা যদি জেনে যায়? কি হবে? মা তো জানতে পারবে ওহাটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে। ওই যে, টু এর সব  ছাত্রদের মায়েদের যে গ্রুপটা আছে, তাতে তো সারাদিন স্কুলে ক্লাসে কী কী হল, সব খবর এসে যায়। এতক্ষণে হয়তো এসেও গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মায়ের ফোনে নেটপ্যাক ভরা নেই। এই বাঁচোয়া। বাড়ি এসে wifi কানেক্ট না করা অবধি জানতে পারবে না। বাড়ি ফিরলেই তো পরীক্ষা, হোমওয়ার্ক, পি টি এম এইসবের খবর পেয়েই যায়। চন্দনা মিসও এই গ্রুপে আঁচে, যদি মায়ের কাছে ওর নামে নালিশ করে? কিন্তু টুপুর যে এত করে সরি বলল, পানিশমেন্টও পেয়েছে। তাও মিস বলে দেবে? ভাবতে ভাবতে কখন যে টুপুরের দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, ও বুঝতেই পারেনি।
ঠাম্মি রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে টুপুরের ঘরে এসে দেখে ওই কাণ্ড মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল," সোনা বাবা আমার, ঠাম্মির কাছে লুকোস না কিছু প্লিজ। বল কী হয়েছে?" ঠাম্মা টুপুরের বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুলের সব কথাই ঠাম্মার সাথে শেয়ার করে ও। তাহলে আজ কেন বলবে না ও? হতেও তো পারে ঠাম্মা কোন সলিউশন দিতে পারে? এমনিও মা ঠিক জানতে পারবেই। বকুনিও দেবে। তার চেয়ে বরং ঠাম্মাকে আগেভাগে বলে রাখলে অন্তত ওর দলে থাকবে। মা অত বকতে পারবে না। এইসব ভেবে টুপুর বলতে শুরু করলো।
"ঠাম্মি আজ স্কুলে ইংলিশ ওয়ানের সারপ্রাইজ টেস্ট হল। তা আমি করেছি কী, একেকটা কোয়েসচেনের আন্সার লিখে সাথে সাথে রাফ খাতায় সেটা লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মি মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন বাবু? এতে তোমার টাইম ওয়েস্ট হচ্ছিল না?"
টুপুর উত্তর দিল, "হুম, হচ্ছিল তো বটেই। কিন্তু কী করব? মা কোয়েসচেন আর তার আন্সারে কী লিখেছই জানতে চাইলে বলতে পারি না বলে বকে। কোয়েসচেন পেপারও তো ফেরত দেয়না। কী করব? তাই লিখে নিচ্ছিলাম।"
ঠাম্মা বলল, "তারপর?"
টুপুর বলতে লাগল, "মিস দেখতে পেয়ে আমায় খুব বকল। ভাবল আমি চিটিং করছি। দেখে দেখে লিখছি। আমার আন্সার শিট নিয়ে ফ্রেশ পেপার দিল।"
"এ বাবা। কী টিচার রে। মিলিয়ে মিলিয়ে তুই ঠিক ওই প্রশ্নের উত্তরগুলিই কী করে লিখে নিয়ে যাবি ভাবল, অদ্ভুত তো? তা যাক গে, তুই শেষ করতে পেরেছিলি ফুল পেপার?"
"না, প্লাস ক্লাসের সবাই আমার দিকে কেমন একটা করে তাকাচ্ছিল। যেন আমি চুরি করেছি। আমার খুব খারাপ লেগেছে ঠাম্মি।"
"হ্যাঁ, খারাপ তো লাগারই কথা বাবু। দাঁড়া, আমি মাকে বলব। সব গুছিয়ে বুঝিয়ে বলব। মা আর তোকে বকবে না। আর ভবিষ্যতেও এরকম দাবী করবে না। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমো।"
"আর বন্ধুদের কাছে আমার রেপুটেশন?"
"আমি সব সামলে দেবো। ভরসা রাখ ঠাম্মির ওপর।"
টুপুর এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। যাক। ঠাম্মি বলেছে যখন, নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে ঠিক। আর ওর ভয় নেই। বাইরে মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। চাদর চাপা দিয়ে টুপুর শুয়ে পড়ল। ঠাম্মি রোজের মতো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প বলতে লাগল। সেই গল্প শুনতে শুনতে প্রতিদিনের মতোই টুপুর কখন জানি ঘুমিয়েও পড়েছে। ঘুম ভাঙল যখন, দেখল বাইরে অন্ধকার। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠল ও। রান্নাঘর থেকে টুংটাং কড়াইয়ের শব্দ আসছে। ছ্যাঁক ছোক তেলের আওয়াজও। ঠাম্মি আর মায়ের গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে। মনে হছে হাসির শব্দ। ঘরের আলো জ্বালিয়ে টুপুর দেখল সাড়ে ছটা বাজে। এ বাবা। ওর যে ছটা থেকে গানের ক্লাস ছিল? যাহ, আজ আবসেন্ট। মা বকবে না তো?
ঘরে আলো জ্বলছে দেখে ঠাম্মি হাঁক দিল, "টুপুর বাবু, উঠেছ?"
"হ্যাঁ ঠাম্মি।" টুপুর জোরে উত্তর দিল।
"হাত মুখ ধুয়ে একবার এদিকে আসো তো সোনা। আমি রান্নাঘরে আছি।"
কে জানে, মা কী বলবে। একটু দুরুদুরু বুকেই টুপুর মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গেল। আহ, ঠাম্মি নিমকি ভাজছে। কী দারুণ গন্ধ। স্তূপ করে রাখা নিমকিগুলি। গরম গরম। মুচমুচে। দেখেই খেতে ইচ্ছে হয়। আর ঠাম্মির নিমকির স্বাদ যে কোন কেনা নিমকিকে বলে বলে দশ গোলে হারিয়ে দেবে, টুপুর জানে। আর তাই টুক করে একটা নিমকি মুখে দিল ও। আহ, অমৃত।
ঠাম্মি বলল, "টুপুর বাবু, এগুলো তোমার বন্ধুদের জন্য বানাচ্ছি। কাল স্কুলে নিয়ে যেয়ো। টিফিনে সবাইকে খাইয়ো। দেখবে, সবাই আজকের কথা ভুলে যাবে।" টুপুর হাঁ করে শুনছিল ঠাম্মির কথা। একবার মায়ের দিকে তাকালো। দেখল মা মুচকি মুচকি হাসছে। যাক, তার মানে হাওয়া গরম না।
"আর শোন, আমি মাকে সব বলেছি। বুঝিয়েছি।  মা তোকে বকবে তো নাই। বরং ইন ফিউচারও এমন কিছু যাতে তোকে করতে না হয়, তেমন অন্যায্য দাবীও করবে না। ঠিক আছে তো?" থামির কথাগুলো শুনে তুপুর এইবারে এক্কেবারে নিশ্চিন্ত হল।
মা হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, " সরি সোনা। আমার জন্য তোকে এইসব ফেস করতে হল। আমি ক্লাস টিচারকে নোট লিখে দেবো। সব এক্সপ্লেইন করবো। তুই চিন্তা করিস না। কেউ তোকে আর ট্রাবল করবে না।"
"আর বন্ধুরা?" টুপুর জিজ্ঞেস করলো।
"সে তো ঠাম্মিস ম্যাজিক নিমকি খেয়েই সব সল্ভড হয়ে যাবে। চল, আজ গানের ক্লাস যখন মিস হয়েই গেল, আমরা তিনজনে মিলে বরং অন্তাক্ষরী খেলই। বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি। তোর ফেভারিট চাইনিজ ডিনার নিয়ে আসতে বলি। লেটস সেলিব্রেট দ্য পারফেক্ট ওয়েদার।" মায়ের কথা শুনে টুপুর "ইয়াহু" বলে লাফিয়ে উঠল। কী আনন্দ।

No comments:

Post a Comment